গৌড়রাজমালা/মদনপাল
কুমারপালের মৃত্যুর পর, তদীয় পুত্র [তৃতীয়] গোপাল গৌড়সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। মদনপালের তাম্রশাসন (১৭ শ্লোক) পাঠে অনুমান হয়,—তৃতীয় গোপাল যখন রাজ্যভার প্রাপ্ত হন, তখনও তিনি শৈশবের সীমা অতিক্রম করেন নাই। সন্ধ্যাকর নন্দী লিখিয়াছেন—
“अपि शत्रुघ्नोपायाद्गोपालः स्व र्जगाम तत्सूनुः।”
“তাঁহার [কুমারপালের] পুত্র গোপাল শত্রুঘ্নোপায়-হেতু স্বৰ্গ গমন করিয়াছিলেন।”
“শত্রুঘ্নোপায়ের” [শত্রুহননকারীর উপায়ের] উল্লেখ দেখিয়া মনে হয়, তৃতীয় গোপাল, যুদ্ধে বা ঘাতুকের হস্তে নিহত হইয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর, রামপালের [মদনদেবীর গর্ভজাত] পুত্র মদনপাল সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। মদনপালের রাজ্যের অষ্টম বৎসরে সম্পাদিত [মনহলিতে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে, প্রশস্তিকার (১৮ শ্লোক) তাঁহার শৌর্য্যবীর্য্যের কোন পরিচয় দেন নাই। ইহাতে অনুমান হয়, মদনপাল তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কুমারপালের বা পিতা রামপালের ন্যায় সমর-কুশল ছিলেন না। রাজা দুর্ব্বল হইলে, পতনোন্মুখ রাজ্যের যে অবস্থা হয়, মদনপালের সময় গৌড়রাষ্ট্রেরও তাহাই ঘটিয়াছিল। গৌড়রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ গৌড়পতির হস্তচ্যুত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল। কমৌলীতে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে বৈদ্যদেবকে “মহারাজাধিরাজ-পরমেশ্বর-পরমভট্টারক” উপাধিতে ভূষিত দেখিয়া মনে হয়, বৈদ্যদেব কামরূপে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিয়াছিলেন।
বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনের একটি শ্লোকের সাহায্যে, কুমারপালের এবং মদনপালের কাল নিরূপিত হইতে পারে। এই তাম্রশাসনের ২৮ শ্লোকে উক্ত হইয়াছে,—“মহারাজ বৈদ্যদেব বৈশাখে বিষুবৎ-সংক্রান্তিতে একাদশী তিথিতে” ভূমিদান করিয়াছিলেন। শ্রীযুত আর্থার ভিনিস্ দেখাইয়াছেন, [১০৬০ হইতে ১১৬১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে] ১০৭৭, ১০৯৬, ১১২৩, ১১৪২ এবং ১১৬১ খৃষ্টাব্দে একাদশী তিথিতে, এবং ১১১৫ এবং ১১৩৪ খৃষ্টাব্দে দ্বাদশী তিথিতে মেষ-সংক্রান্তি হইয়াছিল।[১] এই সকল সালের মধ্যে, কোনও সালে বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন উৎকীর্ণ হইয়াছিল। যে যুক্তি-পরম্পরা অবলম্বন করিয়া, ভিনিস্ সাল (১১৪২ খৃঃ-অঃ) নির্ব্বাচন করিয়াছেন, তাহা আর এখন গ্রাহ্য হইতে পারে না। কারণ, কুমরদেবীর সারনাথের শিলালিপি প্রতিপাদন করিতেছে—রামপাল খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দের শেষপাদে গৌড়-সিংহাসনে আসীন ছিলেন। সুতরাং, রামপালের উত্তরাধিকারী কুমারপালের রাজত্ব দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে স্থাপন করিতে হইবে। কুমারপাল যে দীর্ঘজীবী হইয়াছিলেন, বা দীর্ঘকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন, এরূপ বোধ হয় না। কারণ, তাঁহার মৃত্যুকালে, তাঁহার উত্তরাধিকারী তৃতীয় গোপাল শৈশবের সীমা অতিক্রম করিয়াছিলেন না। সুতরাং ১১১৫ খৃষ্টাব্দে বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন সম্পাদিত হইয়াছিল, এরূপ মনে করাই সঙ্গত। এই তাম্রশাসন “সং ৪” বা বৈদ্যদেবের কামরূপে রাজত্বের চতুর্থ বৎসরে সম্পাদিত হইয়াছিল। কুমারপাল বৈদ্যদেবকে হয়ত ১১১২ খৃষ্টাব্দে কামরূপের রাজপদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, এবং কুমারপালের মৃত্যুর এবং তৃতীয় গোপালের হত্যার পরে, [আনুমানিক ১১১৪ খৃষ্টাব্দে] মদনপাল সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। কুমারপালের পরই বৈদ্যদেব স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়া থাকিবেন।
বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন ১১৪২ খৃষ্টাব্দে সম্পাদিত বলিয়া মনে করিবার আরও একটি কারণ ভিনিস্ কর্ত্তৃক সূচিত হইয়াছে। তিনি লিখিয়াছেন,—এই লিপির “অক্ষরের সহিত বিজয়সেনের দেবপাড়া-লিপির অক্ষরের সাদৃশ্য আছে; কিন্তু (বিজয়সেনের লিপির অক্ষরের অপেক্ষা এই লিপির অক্ষরের) বর্ত্তমান বঙ্গাক্ষরের সহিত সাদৃশ্য আরও অধিক।” বিজয়সেনের লিপির অক্ষরের সহিত বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনের অক্ষর মিলাইলে, কথাটা ঠিক বলিয়া মনে হয় না।[২] দেবপাড়ার শিলালিপির ত, ন, ম, র এবং স বর্ত্তমান বঙ্গাক্ষরের অনুরূপ; কিন্তু বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনের ত, ন, ম, র এবং স পুরাতন ঢঙ্গের। সুতরাং অক্ষরের হিসাবে, বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনকে দেবপাড়ার শিলালিপির কিছুকাল পূর্ব্বে স্থাপন না করিয়া উপায় নাই। খৃষ্টীয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দে, বর্ত্তমান বঙ্গাক্ষরের উদ্ভবকালে, যে লিপিতে আধুনিক বঙ্গাক্ষরের সংখ্যা যত বেশী লক্ষিত হয়, সেই লিপিকে তত আধুনিক মনে করাই সঙ্গত।
লক্ষ্মীসরাইয়ের নিকটবর্ত্তী জয়নগর গ্রামে প্রাপ্ত একখানি শিলাখণ্ডে “যে ধর্মা” ইত্যাদি বৌদ্ধমন্ত্র এবং “শ্রীমন্ মদনপালদেব-রাজ্যে সম্বৎ ১৯ আশ্বিন ৩০” উৎকীর্ণ রহিয়াছে।[৩] মদনপালের রাজ্যের ১৯ সম্বতের বা ১১৩১ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বেই, সম্ভবত বর্ম্মণ-বংশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে, বঙ্গ স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিয়াছিল, এবং সামন্তসেনের পৌত্র বিজয়সেন গৌড়রাষ্ট্রের কেন্দ্র বরেন্দ্রমণ্ডলে সেনরাজ্যের ভিত্তিস্থাপনের উদ্যোগ করিতেছিলেন।