গৌড়রাজমালা/কৈবর্ত্ত-বিদ্রোহ

[৪৯ পৃষ্ঠা]
কৈবর্ত্তরাজের প্রতিষ্ঠাস্তম্ভ।

 এই মহাবাহিনী লইয়া, রামপাল নৌকায় গঙ্গাপার হইয়াছিলেন। পাল-রাজের সেনার সহিত কৈবর্ত্ত-রাজের সেনার ভীষণ যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছিল। অবশেষে করিপৃষ্ঠে অবস্থিত তীম বন্দী হইয়াছিলেন (২।১২-২০)। এই উপলক্ষে সন্ধ্যাকর এক পক্ষে সাগর এবং অপর পক্ষে ভীমের চরিত্রের বর্ণনা করিয়াছেন। শ্লেষের অনুরোধেই হউক, আর সত্যের অনুরোধেই হউক, ভীমের চিত্র উজ্জ্বল বর্ণে অঙ্কিত হইয়াছে। সাগরের ন্যায় ভীমও “লক্ষ্মী এবং সরস্বতী উভয়ের আবাস” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। ভীমকে নৃপতি রূপে প্রাপ্ত হইয়া, “বিশ্ব অতিশয় সম্পৎ লাভ করিয়াছিল,” এবং “সজ্জনগণ অযাচিত দান লাভ করিয়াছিল।” ভবানীর সহিত ভবানীপতি অধর্ম্মত্যাগী রাজা ভীমের উপাস্য দেবতা ছিলেন (২।২১-২৭)।

 সন্ধ্যাকর নন্দী-বর্ণিত এই প্রজা-বিদ্রোহের কিছু কিছু আভাস তৎকালের তাম্রশাসনে এবং শিলালিপিতেও পাওয়া যায়। কামরূপের রাজা বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে রামপাল সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে (৪ শ্লোক):—

 “যুদ্ধ-সাগর লঙ্ঘন করিয়া, ভীমরূপ রাবণ বধ করিয়া, জনকভূ উদ্ধার করিয়া, রামপাল ত্রিজগতে দাশরথি রামের ন্যায় যশ বিস্তার করিয়াছিলেন।”

 “রামপালচরিতের” টীকাকারের মতানুসারে, “জনকভূ” বরেন্দ্রী-অর্থে গ্রহণ করিলে, এই শ্লোকেও কৈবর্ত্ত-বিদ্রোহের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯০৮ সালের মার্চ্চ মাসে সারনাথের ভগ্নস্তূপের একাংশ খননকালে আবিষ্কৃত একখানি শিলালিপিতে[] “রামপালচরিতে” উল্লিখিত কয়েক জন পাত্রের এবং কোন কোন ঘটনার উল্লেখ দৃষ্ট হয়। কান্যকুব্জের গহড়বাল-রাজ গোবিন্দচন্দ্রের অন্যতমা মহিষী কুমরদেবী কর্ত্তৃক একটি বৌদ্ধবিহার-প্রতিষ্ঠা-উপলক্ষে এই শিলালিপি উৎকীর্ণ হইয়াছিল। ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে,—“পীঠিকা”র বা “পীঠী”র দেবরক্ষিত নামক এক জন রাজা ছিলেন।

“गौड़ेद्वैतभटः सकाण्ड-पटिकः क्षत्रैक-चूड़ामणिः
प्रख्यातो महणाङ्गपः क्षितिभुजाम्मान्यो भवन्मातुलः।
तं जित्वा युधि देवरक्षित मधात् श्रीरामपालस्य यो
लक्ष्मीं निर्जित-वैरि-रोधनतया देदीप्यमानोदयाम्॥”

 “গৌড়ে অদ্বিতীয় যোদ্ধা, ধনুর্দ্ধর (?), ক্ষত্রকুলের একমাত্র চূড়ামণি, নরপালগণের সম্মানার্হ মাতুল, মহন নামক অঙ্গপতি ছিলেন। তিনি দেবরক্ষিতকে পরাজিত করিয়া, শক্রর বাধা বিদূরিত হওয়ায়, অধিকতর উজ্জ্বল শ্রীরামপালের রাজলক্ষ্মী অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন।”

 “রামপালচরিতে” [২।৮ শ্লোকের টীকায়] রামপালের মাতুল মহন কর্ত্তৃক পীঠীপতি দেবরক্ষিতের পরাজয় উল্লিখিত হইয়াছে। কুমরদেবীর এই শিলালিপির সাহায্যে রামপালের রাজত্বের সময় নিরূপণ করা যাইতে পারে। এই লিপিতে উক্ত হইয়াছে,—মহনদেব শঙ্করদেবী নাম্নী দুহিতাকে পীঠীপতির করে অর্পণ করিয়াছিলেন। কুমরদেবী এই শঙ্করদেবীর কন্যা, এবং গোবিন্দচন্দ্রের মহিষী। কুমরদেবী এবং গোবিন্দচন্দ্রের বংশাবলী পাশাপাশি রাখিলে দেখা যায়,—

 
 
 
পিতা
 
 
 
 
 পিতা
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
অঙ্গাধিপ মহনদেব।
 
ভগিনী=তৃতীয় বিগ্রহপাল-পত্নী।
 
গাহড়বাল চন্দ্রদেব।
(খৃঃ অঃ + ১০৯০-১০৯৭ +)
 
 
 
 
 
 
 
শঙ্করদেবী।রামপাল।মদনচন্দ্র।
 
 
 
 
 
কুমরদেবী।
 
 
 
 
 
 
গোবিন্দচন্দ্র।
(খৃঃ অঃ + ১১১৪-১১৫৪ +)
 
 
 
 
 
 

 অর্থাৎ মহনদেব গাহড়বাল-রাজ চন্দ্রদেবের সমকালবর্ত্তী ছিলেন। মহনদেব এবং রামপাল, সম্পর্কে মামা-ভাগিনেয় হইলেও, উভয়ে সম্ভবত সমবয়সী ছিলেন। “রামপালচরিতে” উক্ত হইয়াছে (৪।৮-১০ শ্লোক), মহনদেব (মথন) পরলোক গমন করিয়াছেন শুনিয়া, “মুদ্গিরিতে” (মুঙ্গেরে) অবস্থিত রামপাল গঙ্গাগর্ভে প্রবেশ করত তনুত্যাগ করিয়াছিলেন। সুতরাং রামপাল কান্যকুব্জ-রাজ চন্দ্রদেবের সমসাময়িক, এবং একাদশ শতাব্দের শেষ পাদ পর্য্যন্ত গৌড়-রাজ্যের রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।

 “রামপালচরিতের” যে অংশে ভীমের বন্ধনের পরবর্ত্তী ঘটনা সকল বর্ণিত হইয়াছে, তাহার টীকা নাই। মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের মতানুসারে, ভীম ধৃত হইলে, তদীয় সুহৃৎ হরি, ছত্রভঙ্গ বিদ্রোহী সেনা পুনঃ সম্মিলিত করিয়া, যুদ্ধার্থ অগ্রসর হইয়াছিলেন। ভীষণ যুদ্ধের পর, হরি ধৃত এবং নিহত হইয়াছিলেন। ভীমও সম্ভবত নিহত হইয়াছিলেন। এই রূপে বিদ্রোহানল নির্ব্বাপিত হইলে, পালবংশের জন্মভূমি [জনকভূ] আবার পাল-নরপালের হস্তগত হইয়াছিল।

 বিদ্রোহ দমন করিয়া, রামপাল “রামাবতী” নামক এক নূতন নগর নির্ম্মাণ করিয়া, বরেন্দ্রভূমির শোভাবর্দ্ধন করিয়াছিলেন। তিনি এক দিকে যেমন অভিনব নগর-নির্ম্মাণে রত ছিলেন, আর এক দিকে তেমনি নষ্টপ্রায় গৌড়-রাজশক্তির পুনরুজ্জীবন-সাধনে যত্নবান হইয়াছিলেন। সন্ধ্যাকর লিখিয়াছেন—পূর্ব্বদিকের এক জন নরপতি, পরিত্রাণ পাইবার জন্য, রামপালকে বর-বারণ, নিজের রথ এবং বর্ম্ম উপহার প্রদান করিয়াছিলেন। যথা—

“स्वपरित्राण-निमित्तं पत्या यः प्राग्दिशीयेन।
वर-वारणेन च निज-स्यन्दन-दानेन वर्म्मणाराधे॥” ३৷४४॥

 বরেন্দ্রবাসী সন্ধ্যাকর যাঁহাকে “প্রাগ্দিশীয়” বলিয়াছেন, তিনি সম্ভবত বাঙ্গালার পূর্ব্ব সীমান্তের কোন পার্ব্বত্য-প্রদেশের নৃপতি। রামপাল কামরূপ জয় করিয়া, গৌড়রাষ্ট্রভুক্ত করিয়াছিলেন [“বিগ্রহনির্জ্জিতকামরূপভৃৎ”]। এই কামরূপ-জয় যে সন্ধ্যাকর নন্দীর কল্পনা-প্রসূত নহে, কুমারপালের প্রসঙ্গে আমরা তাহা দেখিতে পাইব। রামপাল উৎকলে এবং কলিঙ্গেও স্বীয় প্রাধান্য-স্থাপনের চেষ্টা করিয়াছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দী লিখিয়াছেন—

“भवभूषण-सन्ततिभूव मनुजग्राह जित मुत्कलत्रं यः।
जगदवतिस्म समस्तं, कलिङ्गत स्तान् निशाचरान् निघ्रन्॥”३৷४५॥

 “ভবভূষণ (চন্দ্রের) সন্ততির রাজ্য উৎকল জয় করিয়া, তৎপ্রতি যিনি অনুগ্রহ করিয়াছিলেন, এবং চৌরগণকে নিহত করিয়া, কলিঙ্গ হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত জগৎ প্রতিপালন করিয়াছিলেন।”

 রামপাল যখন গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত, তখন গঙ্গ-বংশীয় অনন্তবর্ম্মা-চোড়গঙ্গ [রাজত্ব ১০৭৮-১১৪২ খৃষ্টাব্দ] কলিঙ্গের রাজা ছিলেন, এবং তিনিই উৎকল অধিকার করিয়াছিলেন। গঙ্গ-বংশীয় নৃপতিগণ চন্দ্র বংশোদ্ভব বলিয়া পরিচিত ছিলেন।[] সুতরাং এ স্থলে সন্ধ্যাকর নন্দী চোড়-গঙ্গকে স্মরণ করিয়াই, উৎকলকে “ভবভূষণ-সন্ততিভূ” বলিয়াছেন।[] কিন্তু রামপাল কর্ত্তৃক চোড়-গঙ্গের এই পরাজয়-কাহিনী কতদূর সত্য, তাহা নির্ণয় করা কঠিন। গঙ্গ-বংশীয় নৃপতিগণের মধ্যে চোড়-গঙ্গ সর্ব্বাপেক্ষা পরাক্রান্ত ছিলেন। গঙ্গ-বংশীয় নৃপতিগণের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—চোড়-গঙ্গ গঙ্গার তীর পর্য্যন্ত স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন, এবং গঙ্গাতীরবর্ত্তী যুদ্ধক্ষেত্রে “মন্দারাধিপতিকে” পরাজিত এবং আহত করিয়াছিলেন।[] এই সূত্রেই হয়ত কলিঙ্গ-পতির সহিত গৌড়-পতির সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল, এবং কলিঙ্গ-পতিকে প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুগ্রহ প্রার্থনা করিতে হইয়াছিল। চোড়-গঙ্গের অতি দীর্ঘকালব্যাপী রাজত্বের প্রথম ভাগে, তাঁহাকে রামপালের সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল। সেই সময়, গৌড়াধিপের নিকট মস্তক অবনত করা অসম্ভব নহে; এবং রামপালের মৃত্যুর পর, হয়ত চোড়-গঙ্গ প্রবলতর হইয়াছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দী যে সত্যের অপলাপ করেন নাই, কুমরদেবীর সারনাথের শিলালিপি এবং বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন তাহার সাক্ষ্যদান করিতেছে। সুতরাং তাঁহার বর্ণিত রামপালের কলিঙ্গ-জয়-কাহিনী অমূলক বলিয়া উপেক্ষিত হইতে পারে না। রাঢ়ও অবশ্য রামপাল কর্ণাট-রাজের কবল হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন। দেবপাড়ার শিলালিপি-অনুসারে, সামন্তসেন যে সকল কর্ণাটলক্ষ্মী-লুণ্ঠনকারী দুর্বৃত্তগণকে বিনষ্ট করিয়াছিলেন, তাহারা গৌড়াধিপেরই সেনা। সামন্তসেন এই সকল “দুর্বৃত্তগণকে” বিনাশ করিয়াও, রাঢ়ে কর্ণাট-রাজের আধিপত্য অটুট রাখিতে না পারিয়া হয়ত শেষ বয়সে বানপ্রস্থ অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

 বরেন্দ্রভূমির বিদ্রোহানল নির্ব্বাণ করিয়া, এবং কামরূপ ও কলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করিয়া, রামপাল যে গৌড়রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, সেই অভিনব গৌড়রাষ্ট্রের সহিত রামপালের পূর্ব্বপুরুষগণের শাসিত গৌড়রাষ্ট্রের অনেক প্রভেদ ছিল। প্রজাসাধারণের নির্ব্বাচিত গৌড়াধিপ গোপালের গৌড়রাষ্ট্র, প্রজার প্রীতির এবং প্রজাশক্তির সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হতভাগ্য দ্বিতীয় মহীপালের “অনীতিকারম্ভের” ফলে, এবং দিব্বোক-নিয়ন্ত্রিত বিদ্রোহানলে, সেই ভিত্তি ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছিল। রামপালের পক্ষে, গৌড়রাজ্যের বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুনরায় একত্রিত করিয়া, উহার পুনর্গঠন সম্ভব হইলেও, সেই দেহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা,—সেই ভগ্ন অট্টালিকার বহিরঙ্গের সংস্কার সম্ভব হইলেও,—উহার নষ্টভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, অসম্ভব হইয়াছিল। সুতরাং রামপালের মৃত্যুর পরই, আবার রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে, বিদ্রোহ উপস্থিত হইল। কিন্তু রামপালের জ্যেষ্ঠ পুত্র “গৌড়েশ্বর” কুমারপালের, এবং তাঁহার প্রধান-সচিব এবং সেনাপতি, বৈদ্যদেবের বাহুবলে, গৌড়রাষ্ট্রের পতন আরও কিছু কালের জন্য স্থগিত রহিল। বৈদ্যদেবের [কমৌলিতে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে বৈদ্যদেব কর্ত্তৃক [অনুত্তর বঙ্গে) দক্ষিণবঙ্গে, নৌ-যুদ্ধে জয়লাভ-প্রসঙ্গে, পুনরায় বিদ্রোহ সূচিত হইয়াছে (১১ শ্লোক)। এই সময়ে কামরূপের সামন্ত-নরপতিও বিদ্রোহাচরণ করিয়াছিলেন। বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে—

 “পূর্ব্বদিগ্বিভাগে বহুমান-প্রাপ্ত তিম্‌গ্যদেব-নৃপতির বিদ্রোহ-বিকার শ্রবণ করিয়া, গৌড়েশ্বর তাঁহার রাজ্যে এইরূপ [গুণগ্রাম-সমন্বিত] বিপুল কীর্ত্তিসম্পন্ন বৈদ্যদেবকে নরেশ্বর-পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। সাক্ষাৎ মার্ত্তণ্ড-বিক্রম বিজয়শীল সেই বৈদ্যদেব [আপন] তেজস্বী প্রভুর আজ্ঞাকে মাল্যদামের ন্যায় মস্তকে ধারণ করিয়া, কতিপয় দিবসের দ্রুত-রণযাত্রার [অবসানে] নিজ ভুজবলে সেই অবনিপতিকে যুদ্ধে পরাভূত করিবার পর, [তদীয় রাজ্যে] মহীপতি হইয়াছিলেন (১৩-১৪ শ্লোক)।”

 কুমারপালের মৃত্যুর পর, তদীয় পুত্র [তৃতীয়] গোপাল গৌড়সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। মদনপালের তাম্রশাসন (১৭ শ্লোক) পাঠে অনুমান হয়,—তৃতীয় গোপাল যখন রাজ্যভার প্রাপ্ত হন, তখনও তিনি শৈশবের সীমা অতিক্রম করেন নাই। সন্ধ্যাকর নন্দী লিখিয়াছেন—

“अपि शत्रुघ्नोपायाद्गोपालः स्व र्जगाम तत्‌सूनुः।”

 “তাঁহার [কুমারপালের] পুত্র গোপাল শত্রুঘ্নোপায়-হেতু স্বৰ্গ গমন করিয়াছিলেন।”

 “শত্রুঘ্নোপায়ের” [শত্রুহননকারীর উপায়ের] উল্লেখ দেখিয়া মনে হয়, তৃতীয় গোপাল, যুদ্ধে বা ঘাতুকের হস্তে নিহত হইয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর, রামপালের [মদনদেবীর গর্ভজাত] পুত্র মদনপাল সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। মদনপালের রাজ্যের অষ্টম বৎসরে সম্পাদিত [মনহলিতে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে, প্রশস্তিকার (১৮ শ্লোক) তাঁহার শৌর্য্যবীর্য্যের কোন পরিচয় দেন নাই। ইহাতে অনুমান হয়, মদনপাল তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কুমারপালের বা পিতা রামপালের ন্যায় সমর-কুশল ছিলেন না। রাজা দুর্ব্বল হইলে, পতনোন্মুখ রাজ্যের যে অবস্থা হয়, মদনপালের সময় গৌড়রাষ্ট্রেরও তাহাই ঘটিয়াছিল। গৌড়রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ গৌড়পতির হস্তচ্যুত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল। কমৌলীতে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে বৈদ্যদেবকে “মহারাজাধিরাজ-পরমেশ্বর-পরমভট্টারক” উপাধিতে ভূষিত দেখিয়া মনে হয়, বৈদ্যদেব কামরূপে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিয়াছিলেন।

 বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনের একটি শ্লোকের সাহায্যে, কুমারপালের এবং মদনপালের কাল নিরূপিত হইতে পারে। এই তাম্রশাসনের ২৮ শ্লোকে উক্ত হইয়াছে,—“মহারাজ বৈদ্যদেব বৈশাখে বিষুবৎ-সংক্রান্তিতে একাদশী তিথিতে” ভূমিদান করিয়াছিলেন। শ্রীযুত আর্থার ভিনিস্ দেখাইয়াছেন, [১০৬০ হইতে ১১৬১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে] ১০৭৭, ১০৯৬, ১১২৩, ১১৪২ এবং ১১৬১ খৃষ্টাব্দে একাদশী তিথিতে, এবং ১১১৫ এবং ১১৩৪ খৃষ্টাব্দে দ্বাদশী তিথিতে মেষ-সংক্রান্তি হইয়াছিল।[] এই সকল সালের মধ্যে, কোনও সালে বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন উৎকীর্ণ হইয়াছিল। যে যুক্তি-পরম্পরা অবলম্বন করিয়া, ভিনিস্ সাল (১১৪২ খৃঃ-অঃ) নির্ব্বাচন করিয়াছেন, তাহা আর এখন গ্রাহ্য হইতে পারে না। কারণ, কুমরদেবীর সারনাথের শিলালিপি প্রতিপাদন করিতেছে—রামপাল খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দের শেষপাদে গৌড়-সিংহাসনে আসীন ছিলেন। সুতরাং, রামপালের উত্তরাধিকারী কুমারপালের রাজত্ব দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে স্থাপন করিতে হইবে। কুমারপাল যে দীর্ঘজীবী হইয়াছিলেন, বা দীর্ঘকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন, এরূপ বোধ হয় না। কারণ, তাঁহার মৃত্যুকালে, তাঁহার উত্তরাধিকারী তৃতীয় গোপাল শৈশবের সীমা অতিক্রম করিয়াছিলেন না। সুতরাং ১১১৫ খৃষ্টাব্দে বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন সম্পাদিত হইয়াছিল, এরূপ মনে করাই সঙ্গত। এই তাম্রশাসন “সং ৪” বা বৈদ্যদেবের কামরূপে রাজত্বের চতুর্থ বৎসরে সম্পাদিত হইয়াছিল। কুমারপাল বৈদ্যদেবকে হয়ত ১১১২ খৃষ্টাব্দে কামরূপের রাজপদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, এবং কুমারপালের মৃত্যুর এবং তৃতীয় গোপালের হত্যার পরে, [আনুমানিক ১১১৪ খৃষ্টাব্দে] মদনপাল সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। কুমারপালের পরই বৈদ্যদেব স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়া থাকিবেন।

 বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন ১১৪২ খৃষ্টাব্দে সম্পাদিত বলিয়া মনে করিবার আরও একটি কারণ ভিনিস্ কর্ত্তৃক সূচিত হইয়াছে। তিনি লিখিয়াছেন,—এই লিপির “অক্ষরের সহিত বিজয়সেনের দেবপাড়া-লিপির অক্ষরের সাদৃশ্য আছে; কিন্তু (বিজয়সেনের লিপির অক্ষরের অপেক্ষা এই লিপির অক্ষরের) বর্ত্তমান বঙ্গাক্ষরের সহিত সাদৃশ্য আরও অধিক।” বিজয়সেনের লিপির অক্ষরের সহিত বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনের অক্ষর মিলাইলে, কথাটা ঠিক বলিয়া মনে হয় না।[] দেবপাড়ার শিলালিপির ত, ন, ম, র এবং স বর্ত্তমান বঙ্গাক্ষরের অনুরূপ; কিন্তু বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনের ত, ন, ম, র এবং স পুরাতন ঢঙ্গের। সুতরাং অক্ষরের হিসাবে, বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনকে দেবপাড়ার শিলালিপির কিছুকাল পূর্ব্বে স্থাপন না করিয়া উপায় নাই। খৃষ্টীয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দে, বর্ত্তমান বঙ্গাক্ষরের উদ্ভবকালে, যে লিপিতে আধুনিক বঙ্গাক্ষরের সংখ্যা যত বেশী লক্ষিত হয়, সেই লিপিকে তত আধুনিক মনে করাই সঙ্গত।

 লক্ষ্মীসরাইয়ের নিকটবর্ত্তী জয়নগর গ্রামে প্রাপ্ত একখানি শিলাখণ্ডে “যে ধর্মা” ইত্যাদি বৌদ্ধমন্ত্র এবং “শ্রীমন্‌ মদনপালদেব-রাজ্যে সম্বৎ ১৯ আশ্বিন ৩০” উৎকীর্ণ রহিয়াছে।[] মদনপালের রাজ্যের ১৯ সম্বতের বা ১১৩১ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বেই, সম্ভবত বর্ম্মণ-বংশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে, বঙ্গ স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিয়াছিল, এবং সামন্তসেনের পৌত্র বিজয়সেন গৌড়রাষ্ট্রের কেন্দ্র বরেন্দ্রমণ্ডলে সেনরাজ্যের ভিত্তিস্থাপনের উদ্যোগ করিতেছিলেন।

 মগধে আবিষ্কৃত শিলালিপিতে মহেন্দ্রপাল এবং গোবিন্দপাল নামক আরও দুই জন পাল নরপালের পরিচয় পাওয়া যায়। শিলালিপিতে এবং তাম্রশাসনে প্রত্যেক পাল-নরপালের নামের অন্তে, ‘দেব’-শব্দ দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু যে দুইখানি শিলালিপিতে মহেন্দ্রপালের নাম উল্লিখত হইয়াছে, তাহার কোন খানিতেই মহেন্দ্রপালকে “মহেন্দ্রপালদেব” বলা হয় নাই।[] ইহাতে মনে হয়, মহেন্দ্রপাল পাল-নরপালগণের বংশ-সম্ভূত এবং তাঁহাদের স্থলবর্ত্তী নাও হইতে পারেন। কিন্তু গোবিন্দপালের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহা হইতে অনুমান হয়, তিনি পাল-রাজগণের বংশোদ্ভব এবং পালবংশের শেষ নৃপতি। নেপাল হইতে সংগৃহীত এবং লণ্ডনের রয়াল এসিয়াটিক্ সোসাইটীর পুস্তকালয়ে রক্ষিত একখানি হস্তলিখিত “অষ্টসাহশ্রিকা প্রজ্ঞা-পারমিতা” গ্রন্থের সমাপ্তি-বাক্যের পরে লিখিত আছে,—“পরমেশ্বর-পরমভট্টারক-পরমসৌগত-মহারাজাধিরাজ-শ্রীমদ্গোবিন্দপালবিজয়-রাজ্য-সম্বৎ ৪॥” এই পুস্তকের লেখায় ব্যবহৃত অক্ষরের মধ্যে ত, ন, ম এবং র দেবপাড়ার শিলালিপির ত, ন, ম এবং রএর মত বর্ত্তমান বঙ্গাক্ষরের ঢঙ্গের।[] গয়ার একখানি শিলালিপি হইতে গোবিন্দপালের রাজ্যের অবসান-কাল নিরূপণ করা যায়। এই শিলালিপির সম্পাদন-কাল সম্বন্ধে উল্লিখিত হইয়াছ—“সম্বৎ ১২৩২ বিকারি-সম্বৎসরে শ্রীগোবিন্দপালদেব-গতরাজ্যে চতুর্দ্দশ-সম্বৎসরে গয়ায়াং॥”[১০] ১২৩২ বিক্রম-সম্বৎ বা ১১৭৫ খৃষ্টাব্দের চতুর্দ্দশ বৎসর পূর্ব্বে, অর্থাৎ ১১৬১ খৃষ্টাব্দে, গোবিন্দপালের রাজত্বের অবসান হইয়াছিল। গোবিন্দপাল বা তাঁহার পূর্ববর্ত্তী নৃপতি হয়ত বিজয়সেন কর্ত্তৃক বরেন্দ্র হইতে তাড়িত হইয়া, মগধে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। ১২০২ বিক্রম-সম্বতে [১১৪৬ খৃষ্টাব্দে] কান্যকুব্জেশ্বর গোবিন্দচন্দ্র মগধ আক্রমণ করিয়াছিলেন। কারণ, গোবিন্দচন্দ্রের এই সালের একখানি তাম্রশাসনে[১১] উল্লিখিত হইয়াছে, উহা মুদ্‌গগিরি বা মুঙ্গেরে সম্পাদিত হইয়াছিল। নেপাল হইতে সংগৃহীত এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুস্তকালয়ে রক্ষিত একখানি হস্ত-লিখিত পুস্তকের উপসংহারে লিখিত আছে,[১২]—“পরমেশ্বরেত্যাদি রাজাবলী পূর্ব্ববৎ শ্রীমদ্গোবিন্দপাল-দেবানাং বিনষ্টরাজ্যে অষ্টত্রিংশৎ সম্বৎসরেভিলিখ্যমানো।” এ স্থলে বিনষ্ট-রাজ্যের উল্লেখ দেখিয়া অনুমান হয়, কোনও শত্রুকর্ত্তৃক গোবিন্দপাল রাজ্যচ্যুত হইয়াছিলেন। গোবিন্দপালের রাজ্যনষ্টকারী সম্ভবত বিজয়সেনের পুত্র বল্লালসেন। গোবিন্দপালের রাজ্যনাশের ১৪ এবং ৩৮ বৎসর পরেও, তাঁহার বিনষ্ট বা গতরাজ্যের হিসাবে, সাল-গণনার প্রচলন দেখিয়া মনে হয়, যিনি গোবিন্দপালের রাজ্য নষ্ট করিয়াছিলেন, তিনি সেই স্থলে স্বীয় আধিপত্য সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন না। তিনি ভাঙ্গিতে পারিয়াছিলেন বটে, কিন্তু নূতন করিয়া গড়িবার অবসর পাইয়াছিলেন না। এই জন্যই বিজেতার বিজয়-রাজ্যের সম্বৎসর প্রচলিত হইয়াছিল না; বিজিত গোবিন্দপালের বিনষ্ট রাজ্যের সম্বৎসরই প্রচলিত ছিল।

 যে দুইটি স্বতন্ত্র রাজবংশ অভ্যুদিত হইয়া, পাল-রাজবংশ উন্মূলিত করিয়াছিল, তন্মধ্যে বঙ্গের বর্ম্মা-বংশ পূর্ব্বতন এবং প্রথম উল্লেখযোগ্য। বর্ম্মা-বশের ইতিবৃত্ত-সঙ্কলনকারীর প্রধান অবলম্বন হরিবর্ম্মার তাম্রশাসন, এবং হরিবর্ম্মার ও তাঁহার পুত্রের মন্ত্রী ভট্ট-ভবদেব-বালবলভীভুজঙ্গের ভুবনেশ্বরের প্রশস্তি। হরিবর্ম্মার তাম্রশাসনের পশ্চাদ্ভাগের অস্পষ্ট প্রতিকৃতি এবং তাহার একটি আনুমানিক পাঠ মাত্রই প্রকাশিত হইয়াছে।[১৩] এই অংশ হইতে জানিতে পারা যায়—“বিক্রমপুর-সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবার হইতে মহারাজাধিরাজ-জ্যোতিবর্ম্ম-পাদানুধ্যাত-পরমবৈষ্ণব-পরমেশ্বর-পরমভট্টারক-মহারাজাধিরাজ-শ্রীহরিবর্ম্মদেব” ভূমিদান করিতেছেন। ভট্ট-ভবদেব-বালবলভী-ভুজঙ্গের প্রশস্তিতে উক্ত হইয়াছে,—সাবর্ণমুনির বংশধর শ্রোত্রিয়গণ যে সকল গ্রামে বাস করিতেন, তন্মধ্যে রাঢ় বা রাঢ়দেশের অলঙ্কার সিদ্ধলগ্রাম সর্ব্বাগ্রগণ্য। এই গ্রামের একটি সমুন্নত বংশে (প্রথম) ভবদেব জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি গৌড়নৃপ হইতে হস্তিনীভিট্ট নামক গ্রাম প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই ভবদেবের পুত্র রথাঙ্গ। রথাঙ্গের পুত্র অত্যঙ্গ। অত্যঙ্গের পুত্র স্ফুরিত-বুধ। স্ফুরিত-বুধের পুত্র আদিদেব। আদিদেব বঙ্গরাজের মহামন্ত্রী-মহাপাত্র-সন্ধিবিগ্রহী ছিলেন। আদিদেবের পুত্র গোবর্দ্ধন। গোবর্দ্ধন জনৈক বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণের দুহিতার [সাঙ্গোকার] পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। গোবর্দ্ধন এবং সাঙ্গোকার পুত্র ভবদেব-বালবলভীভুজঙ্গ দীর্ঘকাল হরিবর্ম্মদেবের মন্ত্রী ছিলেন, এবং পরে হরিবর্ম্মদেবের পুত্রেরও মন্ত্রিপদারূঢ় ছিলেন। এই দ্বিতীয় ভবদেব রাঢ়দেশে একটি জলাশয় খনন করাইয়াছিলেন; এবং ভুবনেশ্বরে মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়া, সেই মন্দিরে নারায়ণ, অনন্ত এবং নৃসিংহমূর্ত্তি স্থাপিত করিয়াছিলেন।


 এই প্রশস্তি যে কেবল বর্ম্ম-রাজবংশের এবং দ্বাদশ শতাব্দীর রাঢ়-বঙ্গের একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশের ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে আলোক দান করে এমন নহে, ইহা বাঙ্গালার ইতিহাসের আরও একটি গুরুতর প্রশ্নের মীমাংসার সহায়তা করে। এই গুরুতর প্রশ্ন,—আদিশূর ঐতিহাসিক ব্যক্তি কি না? আদিশূর নামক যে প্রকৃত একজন রাজা ছিলেন, এ বিষয়ে কেহ কখনও সন্দেহ করেন নাই। আদিশূর কখন কোন্ স্থানে রাজত্ব করিয়া গিয়াছেন, এই কথা লইয়াই বহু দিন বাদানুবাদ চলিতেছে। কিন্তু ভট্ট-ভবদেবের ভুবনেশ্বরের প্রশস্তি পাঠ করিলে, আদিশূরের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই সন্দেহ উপস্থিত হয়। “গৌড়রাজমালায়” আদিশূর স্থান পাইতে পারেন কি না, এ স্থলে এ কথার মীমাংসার যত্ন করা কর্ত্তব্য। সুতরাং, প্রক্রমভঙ্গ হইলেও, এখানে সেই প্রশ্নের বিচারের পর, বর্ম্ম-বংশের ইতিহাস আলোচিত হইবে।

 কুলপঞ্জিকা বা ঐ শ্রেণীর গ্রন্থ ভিন্ন, আর কোথায়ও আদিশূরের পরিচয় পাওয়া যায় না। এখন সকল কুলপঞ্জিকা দেখা যায়, তাহা আদিশূরের আনুমানিক আবির্ভাব-কালের অনেক পরে রচিত। পরবর্ত্তী কালের রচনা হইতে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করিতে হইলে, বিশেষ সাবধানতা আবশ্যক। যে পরবর্ত্তী কালের গ্রন্থে তুল্যকালীন গ্রন্থোক্ত প্রমাণ উদ্ধৃত থাকে, তাহাই কেবল ইতিহাসের উপাদানের ভাণ্ডাররূপে গৃহীত হইতে পারে। কুলগ্রন্থনিচয়ে উল্লিখিত আদিশূর রাজার বিবরণ যে সেরূপ প্রমাণ অবলম্বনে সঙ্কলিত, তাহা এযাবৎ কেহই প্রতিপাদন করিতে পারেন নাই। কারণ, আদিশূরের সময়ের কোন চিহ্নই এখনও পাওয়া যায় নাই। অনেকে বলিতে পারেন, কুলপঞ্জিকার আদিশূর রাজার বিবরণ প্রত্যক্ষ প্রমাণমূলক না হইলেও, জনশ্রুতিমূলক; এবং জনশ্রুতির যদি ইতিহাসে স্থানলাভ করিবার অধিকার থাকে, তবে আদিশূর রাজার বিবরণ ইতিহাসে স্থান পাইবে না কেন? জনশ্রুতিমাত্রই যে প্রামাণ্য এবং ঐতিহাসিকের নিকট আদরণীয়, এমন নহে। যে জনশ্রুতি প্রবল এবং প্রত্যক্ষপ্রমাণের অবিরোধী, তাহাই ঐতিহাসিকের বিবেচ্য; এবং যে প্রবল জনশ্রুতি প্রত্যক্ষ প্রমাণের অনুকূল, তাহাই ইতিহাসে স্থান লাভের যোগ্য।

 এখন আদিশূর সম্বন্ধীয় জনশ্রুতির পরীক্ষা করিয়া দেখা যাউক্, উহার ঐতিহাসিকতা কত দূর। রাঢ়ীয় কুলজ্ঞগণের মধ্যে প্রচলিত আদিশূর সম্বন্ধীয় জনশ্রুতি নিম্নোক্ত শ্লোকটিতে বিনিবদ্ধ আছে—

“आसीत् पुरा महाराज आदिशूर प्रतापवान्।
आनीतवान् द्विजान् पञ्च पञ्चगोत्र-समुद्भवान्॥”[১৪]

 এখানে পাওয়া গেল,—আদিশূর ছিলেন (আসীৎ)। বারেন্দ্র কুলজ্ঞগণের গ্রন্থে আরও কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। তাঁহারা আদিশূরের এবং বল্লালসেনের সম্বন্ধ নিরূপণ করিয়াছেন। যথা—

“जातो वल्लालसेनो गुणि-गणित स्तस्य दौहित्र-वंशे।”

 “আদিশূর রাজা পঞ্চগোত্রে পঞ্চব্রাহ্মণ আনয়ণ করিলেন [পঞ্চব্রাহ্মণের পরিচয়] এহি পঞ্চগোত্রে পঞ্চব্রাহ্মণ সংস্থাপন করিয়া আদিশূর রাজার সর্গারোহণ॥ তদন্তে কিছুকালানন্তর তত দহিত্র কুলেত উদ্ভব হইলেন বল্লালসেন [বল্লালসেন কর্ত্তৃক কুলমর্য্যাদা স্থাপন এবং রাঢ়ী ও বারেন্দ্র-বিভাগ] ইত্যবকাশে অন্যান্য দেশীয় রাজাসকল ব্রাহ্মণহীন দেশ বিবেচনা করিয়া বল্লালসেনের নিকট ব্রাহ্মণ যাচিঞা করিয়া কহিলেন সুনহে বল্লালসেন তোমার মাতামহ কুলোদ্ভব আদিসূর পঞ্চগোত্রে পঞ্চব্রাহ্মণ আনয়ন করিয়া গৌড়মণ্ডল পবিত্র করিয়াছেন। আমরা যবনাক্রান্ত দেশে বাস করি আমারদিগের দেশে কিঞ্চিৎ ব্রাহ্মণ প্রেরণ করিয়া আমারদিগের দেশ পবিত্র করি।”[১৫]

 আদিশূর সম্বন্ধে যে সকল জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, তন্মধ্যে এইটিই সর্ব্বাপেক্ষা প্রবল। কুলজ্ঞগণের মুখ্য উদেশ্য ইতিহাস-সঙ্কলন নহে, বংশাবলী-রক্ষা। বংশাবলী অনুসারে হিসাব করিলে, আদিশূরের যে সময় নির্দ্ধারিত হয়, তাহার সহিত এই জনশ্রুতির সামঞ্জস্য করা যাইতে পারে। “গৌড়ে ব্রাহ্মণ”-কার বারেন্দ্র-ব্রাহ্মণগণ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন,[১৬]—“শাণ্ডিল্য-গোত্রীয় বর্ত্তমান ব্যক্তির পুরুষ সংখ্যা ভট্টনারায়ণ হইতে ৩৬।৩৭ এবং ৩৮ পুরুষ, কাশ্যপগোত্রে ৩১।৩২।৩৩।৩৪ পুরুষ, ভরদ্বাজগোত্রে ৩৫ হইতে ৩৯ পুরুষ, কিন্তু বাৎস্যগোত্রে ২৫ হইতে ২৮ পুরুষ দৃষ্ট হয়।” রাঢ়ীয় সমাজে ৩৫ হইতে ঊর্দ্ধতন পর্য্যায়ের লোক বিরল। বাৎস্যগোত্র ছাড়িয়া দিলে, বর্ত্তমান কালকে আদিশূর-আনীত ব্রাহ্মণগণের কাল হইতে গড়পড়তায় ৩৪।৩৫ পুরুষের কাল বলা যাইতে পারে। প্রতি পুরুষে ২৫ বৎসর ধরিয়া লইলে, আদিশূর ৮৫০ বৎসর পূর্ব্বে [১০৬০ খৃষ্টাব্দে] বর্ত্তমান ছিলেন, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। এই অনুমান, “বেদবাণাঙ্ক-শাকেতু গৌড়ে বিপ্রাঃ সমাগতাঃ” [৯৫৪ শাকে বা ১০৩২ খৃষ্টাব্দে গৌড়ে ব্রাহ্মণগণ আগমন করিয়াছিলেন] এই কিম্বদন্তীর বিরোধী নহে, এবং তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে কর্ণাট-রাজকুমার বিক্রমাদিত্যের সহিত বল্লালসেনের পূর্ব্বপুরুষের গৌড়ে আগমনকালের সহিত ঠিকঠাক মিলিয়া যায়। প্রথম রাজেন্দ্রচোলের তিরুমলয়-লিপিতে দক্ষিণরাঢ়ের অধিপতি রণশূরের পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। আদিশূরকে রণশূরের পুত্র বা পৌত্র ধরিয়া লইলে, কোন গোলই থাকে না।

 ভুবনেশ্বরের প্রশস্তিতে উল্লিখিত ভট্টভবদেবের বংশ-বৃত্তান্তের সহিত আদিশূর কর্ত্তৃক ব্রাহ্মণানয়ন-বৃত্তান্তের সামঞ্জস্য অসম্ভব। ভবদেব সাবর্ণ-গোত্রীয়, তাঁহার পূর্ব্বপুরুষগণ সিদ্ধলগ্রামবাসী, এবং তাঁহার জননী বন্দ্যঘটী-বংশীয়া ছিলেন। সুতরাং ভবদেব যে রাঢ়িশ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন, তদ্বিষয়ে আর সংশয় হইতে পারে না। প্রশস্তির রচয়িতা, ভবদেবের সুহৃদ্ বাচস্পতি, যে ইদানীন্তনকালের ঘটকগণের অপেক্ষা ভবদেবের পূর্ব্বপুরুষগণসম্বন্ধে অনেক অধিক খবর রাখিতেন, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। প্রশস্তিতে ভবদেব-বালবলভীভুজঙ্গকে ধরিয়া, সাত পুরুষের বিবরণ আছে। প্রশস্তিতে উল্লিখিত প্রথম ভবদেব খৃষ্টীয় দশম শতাব্দের শেষপাদে বর্ত্তমান ছিলেন, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে; এবং এই প্রথম ভবদেব যে গৌড়-নৃপ হইতে হস্তিনীভিট্টগ্রাম প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তিনি সম্ভবত প্রথম মহীপাল। বাচস্পতি যে ভাবে প্রশস্তির সূচনায় সিদ্ধলগ্রামবাসী সাবর্ণগোত্রীয় ব্রাহ্মণগণের প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়াছেন, তাহাতে মনে হয়, যেন স্মরণাতীত কাল হইতে সাবর্ণগোত্রীয় শ্রোত্রিয়েরা তথায় বাস করিতেছিলেন। এখন যেমন সাবর্ণগোত্রীয় রাঢ়ীয়-বারেন্দ্র ব্রাহ্মণমাত্রই আদিশূর-আনীত বেদগর্ভ বা পরাশর হইতে বংশপরিচয় দিয়া থাকেন, তখন এই প্রবাদ প্রচলিত থাকিলে, বাচস্পতি বোধ হয় প্রিয়-সুহৃদের প্রশস্তিতে তাহার উল্লেখ করিতে বিস্মৃত হইতেন না। ভবদেবের ভুবনেশ্বরের প্রশস্তিতে আদিশূরকর্ত্তৃক সাবর্ণগোত্রীয় ব্রাহ্মণ আনয়নের প্রতিকূল প্রমাণ দেখিয়া, আদিশূর-বৃত্তান্তের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে ঘোর সংশয় উপস্থিত হয়। যত দিন না কোনও তাম্রশাসন বা শিলালিপি দ্বারা এই সংশয় অপসারিত হয়, ততদিন পরস্পর-বিরোধী কুলশাস্ত্রের প্রমাণ অবলম্বনে, আদিশূরের ইতিহাস-উদ্ধারের যত্ন বিড়ম্বনামাত্র।

 ভবদেব-বালবলভীভুজঙ্গের অতিবৃদ্ধ-বৃদ্ধ-প্রপিতামহ প্রথম ভবদেবের সময়ে, রাঢ় গৌড়রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত এবং গৌড়-নৃপের পদানত ছিল, এবং প্রথম ভবদেব গৌড়-নৃপের প্রসাদে হস্তিনীভিট্টগ্রাম লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু ভবদেবের পিতামহ আদিদেবের সময়ে, রাঢ়ে-বঙ্গে “বঙ্গরাজের” প্রাধান্য স্থাপিত হইয়াছিল, এবং আদিদেব তাঁহার সন্ধিবিগ্রহী ছিলেন। ভট্ট গুরবের এবং বৈদ্যদেবের বংশবৃত্তান্ত হইতে জানা যায়, তৎকালে মন্ত্রিপদ বংশানুগত ছিল। আদিদেব যে বঙ্গ-রাজের সন্ধিবিগ্রহী ছিলেন, তিনি সম্ভবত হরিবর্ম্মদেবের পিতা (?) জ্যোতিবর্ম্মা। জ্যোতিবর্ম্মা হয়ত গৌড়েশ্বর কুমারপালের সময়ে, দক্ষিণ বঙ্গে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বনে যত্নবান্ হইয়াছিলেন, এবং তাঁহার দমনার্থ প্রেরিত বৈদ্যদেবকর্ত্তৃক নৌ-যুদ্ধে পরাভূত হইয়াছিলেন। কুমারপালের মৃত্যুর পর, জ্যোতিবর্ম্মার অভিলাষপূরণের আর কোন বাধা ছিল না। আদিদেবের পুত্র গোবর্দ্ধন যুদ্ধক্ষেত্রে [বীরস্থলীষু] বাহুবলে রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন [বর্দ্ধয়ন্ বসুমতী;] বলিয়া কথিত হইয়াছেন; কিন্তু তিনি কখন মন্ত্রিপদ লাভ করিয়াছিলেন, এরূপ কোনও প্রমাণ নাই। গোবর্দ্ধন হয়ত জ্যোতিবর্ম্মা বা হরিবর্ম্মার একজন সেনানায়ক ছিলেন, এবং পিতার জীবদ্দশায় পরলোক গমন করায়, মন্ত্রিপদে উন্নীত হইবার অবসর পাইয়াছিলেন না। সুতরাং আদিদেবের মৃত্যুর পর, ভট্টভবদেব বালবলভীভুজঙ্গ হরিবর্ম্মার মন্ত্রিপদ লাভ করিয়াছিলেন; এবং হরিবর্ম্মার মৃত্যুর পর, তাঁহার অনুল্লিখিতনামা পুত্রের এবং উত্তরাধিকারীর সময়েও, সেই পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রশস্তিকার বাচস্পতি ১৮টি শ্লোকে ভবদেব বালবলভীভুজঙ্গের গুণগ্রামের এবং কীর্ত্তিকলাপের বর্ণন করিয়াছেন; তিনি কি কি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, তাহারও পরিচয় দিয়াছেন। কিন্তু ভবদেবের বাহুবলে এবং নীতিকৌশলে তাঁহার প্রভুর রাজ্য কতটা উন্নতি এবং বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল, এই সুদীর্ঘ প্রশস্তিমধ্যে তাহার কোনও উল্লেখ নাই। ইহাতে অনুমান হয়, সেনবংশের অভ্যুদয়ের পর, ভবদেব স্বীয় প্রভুকে সেনবংশীয় গৌড়াধিপের অধীনতা স্বীকারে উপদেশ দিয়া, স্বয়ং অগস্ত্যবৎ বৌদ্ধাম্ভোনিধি-গণ্ডুষকরণে, পাষণ্ড-তার্কিক-দলনে, এবং স্মৃতি, জ্যোতিষ, এবং মীমাংসা-শাস্ত্রের চর্চ্চায়, মনোনিবেশ করিয়ছিলেন।

 বর্ম্মবংশের অভ্যুদয় এবং মদনপালের দুর্ব্বলতা নিবন্ধন গৌড়রাষ্ট্র যখন বিশৃঙ্খল হইয়া পড়িয়াছিল, তখন সামন্তসেনের পৌত্র [হেমন্তসেন ও রাজ্ঞী যশোদেবীর পুত্র] বিজয়সেন বরেন্দ্রভূমিতে একটি স্বতন্ত্র রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। হেমন্তসেন একজন বড় যোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তিনি বাহুবলে গৌড়রাজ্যের কোন অংশ করতলগত করিতে পারিয়াছিলেন কি না, তাহা বলা যায় না। হেমন্তসেনের পুত্র বিজয়সেন, রাঢ়ে এবং বঙ্গে, বর্ম্ম-রাজের সহিত প্রতিযোগিতা করিতে অসমর্থ হইয়াই, সম্ভবত স্বীয় অভিলাষ চরিতার্থ করিবার জন্য, বরেন্দ্র-অভিমুখে ধাবিত হইয়াছিলেন। অথবা হেমন্তসেনই হয়ত বরেন্দ্রে আশ্রয় লইয়াছিলেন, এবং পরে সুযোগ পাইয়া, বিজয়সেন তথায় স্বতন্ত্র রাজ্য-স্থাপনে ব্রতী হইয়াছিলেন। বল্লালসেন “দানসাগরের” ভূমিকায় লিখিয়া গিয়াছেন—

तदनु विजयसेनः प्रादुरासीत् वरेन्द्रे”

 “(হেমন্তসেনের) পর বিজয়সেন বরেন্দ্রে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন।”

 বিজয়সেনের অভ্যুদয়কাল সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে অনেক মতভেদ আছে। কিল্‌হর্ণের অনুসরণ করিয়া, সামন্তসেনকে খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর চতুর্থ পাদে, হেমন্তসেনকে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম পাদে, এবং বিজয়সেনকে দ্বিতীয় পাদে [আনুমানিক ১১২৫–১১৫০ খৃষ্টাব্দে] স্থাপিত করা যাইতে পারে। এ পর্য্যন্ত আর কোন লেখক এই মত গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া জানি না, এবং কিল্‌হর্ণও তাঁহার মতের অনুকূল যুক্তিগুলি বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করিয়া যাইতে পারেন নাই।

 প্রধানতঃ দুইটি প্রমাণ-বলে, খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দের চতুর্থপাদ বিজয়সেনের অভ্যুদয়কাল বলিয়া নিরূপিত হইয়াছে। বিজয়সেনের দেবপাড়া প্রশস্তিতে (২১ শ্লোক) উক্ত হইয়াছে, তিনি “নান্য” নামক নৃপতিকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন। নেপালের রাজা জয়প্রতাপমল্লের কাটামুণ্ডুতে প্রাপ্ত ১৬৪৯ খৃষ্টাব্দের [৭৬৯ নেপালী-সম্বতের] শিলালিপিতে উল্লিখিত মিথিলার এবং নেপালের “কার্ণাটক”-বংশীয় রাজগণের বংশ-তালিকায় এক “নান্যদেব” উক্ত বংশের আদিপুরুষরূপে উল্লিখিত হইয়াছেন।[১৭] জর্ম্মণির প্রাচ্যবিদ্যানুশীলন সমিতির পুস্তকালয়ে রক্ষিত একখানি পুঁথিতে নান্যদেব [১০১৯ শকে ১০৯৭ খৃষ্টাব্দে] বর্ত্তমান ছিলেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায়।[১৮] প্রত্নবিদ্‌গণ দেবপাড়া প্রশস্তির “নান্য” এবং কার্ণাটক-বংশের আদিপুরুষ “নান্যদেব”কে অভিন্ন মনে করিয়া থাকেন।[১৯] এই মত গ্রহণ করিলেও, একাদশ শতাব্দের শেষ পাদে বিজয়সেনের রাজত্বকাল নিরূপণ অনাবশ্যক; পরন্তু নান্যদেব দ্বাদশ শতাব্দের দ্বিতীয় পাদ পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন; এবং সেই সময়ে, বিজয়সেনের সহিত তাঁহার বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল, এরূপ মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। কার্ণাটক-বংশীয় নৃপতিগণের বংশ-তালিকা-অনুসারে নেপাল-বিজয়ী হরিসিংহ নান্যদেব হইতে অধস্তন সপ্তম পুরুষ। হরিসিংহের মন্ত্রী চণ্ডেশ্বর ঠকুরের সংগৃহীত “বিবাদ-রত্নাকরের” মঙ্গলাচরণ হইতে জানা যায়, হরিসিংহ ১২৩৯ শকাব্দে [১৩১৭ খৃষ্টাব্দে] জীবিত ছিলেন। সুতরাং, প্রতি পুরুষ গড়ে ২৫ বৎসর হিসাবে, হরিসিংহের ঊর্দ্ধতন সপ্তম পুরুষ নান্যদেব, মোটামুট ১১৫০ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। গৌড়রাষ্ট্রের সেই অধঃপতনের সময়, কর্ণাটক্ষত্রিয়-বংশোদ্ভব বিজয়সেন বরেন্দ্রে যে কার্য্য-সাধনে উদ্যোগী হইয়াছিলেন, অপর একজন কর্ণাট-ক্ষত্রিয়, নান্যদেব, পূর্ব্বাবধিই মিথিলায় সেই কার্য্যেই ব্রতী হইয়াছিলেন। সুতরাং নূতন ব্রতী বিজয়সেনের সহিত পুরাতন ব্রতী নান্যদেবের সংঘর্ষ স্বাভাবিক।

 দ্বিতীয় প্রমাণ লক্ষ্মণ-সম্বৎ। কিল্‌হর্ণ স্থির করিয়াছেন,—১১১৯ খৃষ্টাব্দের অক্‌টোবর মাস হইতে এই সম্বতের গণনা আরম্ভ হইয়াছিল; এবং তিনি দেবপাড়া প্রশস্তির ভূমিকায় মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের আরম্ভ হইতে এই সম্বৎ-গণনার আরম্ভ হয়। আবুল ফজলের “আকবর-নামা”-রচনার সময়েও, লক্ষ্মণ-সম্বতের উৎপত্তি সম্বন্ধে এইরূপ কিম্বদন্তী প্রচলিত ছিল।[২০] সুতরাং লক্ষ্মণসেনের পিতামহ বিজয়সেন অবশ্য একাদশ শতাব্দের শেষপাদে রাজত্ব করিয়াছিলেন। কিন্তু বল্লালসেন-রচিত দানসাগর-নামক নিবন্ধে উল্লিখিত হইয়াছে—[২১]

“निखिल-चक्रतिलक-श्रीमद्वलालसेनेन पूर्णे
शशि-नव-दशमिते शक-वर्षे दानसागरो रचितः।”

অর্থাৎ ১০৯১ শকাব্দ (১১৬৯ খৃষ্টাব্দ) পূর্ণ হইলে, বল্লালসেন “দানসাগর” রচনা করিয়াছিলেন।

 ডাক্তার ভাণ্ডারকার বোম্বাই-প্রদেশে সংগৃহীত বল্লালসেন-রচিত “অদ্ভুত সাগরের” যে বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাতে উল্লিখিত হইয়াছে,—বল্লালসেন “শাকে খ-নব-খেন্দ্বব্দে” [১০৯০ শকাব্দে = ১১৬৮ খৃষ্টাব্দে] “অদ্ভুত সাগর” আরম্ভ করিয়াছিলেন।[২২] বোধ হয় এই নিমিত্ত কিল্‌হর্ণ পূর্ব্ব মত পরিত্যাগ করিয়া, লক্ষ্মণসেনের রাজত্ব খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দের শেষ পাদে এবং বল্লালসেনের রাজত্ব তৃতীয় পাদে নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন।[২৩] শ্রীযুত মনোমোহন চক্রবর্ত্তী মহাশয় অদ্ভুত সাগর হইতে বল্লালসেনের রাজ্যাভিষেকের কালও আবিষ্কৃত করিয়াছেন।[২৪] অদ্ভুত সাগরের, “সপ্তর্ষীনামদ্ভুতানি”-প্রকরণে লিখিত আছে,—“ভুজ-বসু-দশ মিতে (১০৮১) শকে শ্রীমদ্‌বল্লালসেন-রাজ্যাদৌ” ইত্যাদি। ইহাতে ১০৮১ শক (১১৫৯ খৃষ্টাব্দ) বল্লালসেনের রাজত্বের প্রথম বৎসর রূপে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে।


 শ্রীযুত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় “দানসাগরের” এবং “অদ্ভুত সাগরের” রচনাকাল-বিজ্ঞাপক শ্লোক প্রামাণ্য রূপে গৃহীত হইতে পারে না বলিয়া মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার এরূপ মনে করিবার প্রথম কারণ,—“দানসাগরের” এবং “অদ্ভুতসাগরের” যে সকল পুঁথিতে কাল-বিজ্ঞাপক শ্লোক আছে, তাহা অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে লিপিবদ্ধ হইয়াছে; এবং উহা ছাড়া, এই দুই গ্রন্থের আরও কয়েকখানি প্রতিলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাতে এই সকল শ্লোক নাই। সুতরাং, উভয় গ্রন্থের কাল-বিজ্ঞাপক শ্লোক পরবর্ত্তী কালে প্রক্ষিপ্ত হওয়া সম্ভব।

 আর এক হিসাবে দেখিতে গেলে, ঠিক বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হয়। “দানসাগর” স্মৃতি-নিবন্ধ, এবং “অদ্ভুত সাগর” জ্যোতিষের নিবন্ধ। যাঁহারা স্মৃতি বা জ্যোতিষ শাস্ত্রের অনুশীলন করিতেন, তাঁহারই এই সকল পুস্তকের প্রতিলিপি প্রস্তুত করিতেন বা করাইতেন। স্মৃতি, জ্যোতিষ প্রভৃতি শাস্ত্রের অনুশীলনকারিগণ, গ্রন্থকারের জীবনী সম্বন্ধে বা গ্রন্থের রচনাকাল সম্বন্ধে, চিরকালই উদাসীন। সুতরাং, কোন কোন লিপিকর, অনাবশ্যক বোধে, আদর্শ পুস্তকের কাল-বিজ্ঞাপক বচন পরিত্যাগ করিয়া থাকিতে পারেন। সেই জন্য সকল পুস্তকে এই বচন দৃষ্ট হয় না।

 এসিয়াটিক্ সোসাইটীর পুস্তকালয়ে যে “অমৃত সাগরের” পুঁথি আছে, তাহার মঙ্গলাচরণের সহিত ভাণ্ডারকার-বর্ণিত পুঁথির মঙ্গলাচরণের তুলনা করিলে এইরূপ সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হয়। বোম্বাইএর পুঁথির মঙ্গলাচরণের প্রথম নয়টি শ্লোকে, সেনরাজ-বংশ, গ্রন্থকার বল্লালসেন, এবং তাঁহার সহযোগী শ্রীনিবাস প্রশংসিত হইয়াছেন। এসিয়াটিক্ সোসাইটীর পুঁথিতে, এই নয়টি শ্লোকের পাঁচটি মাত্র দৃষ্ট হয়; ২, ৩, ৪ এবং ৬ নং শ্লোক একেবারে পরিত্যক্ত হইয়াছে। বোম্বাইএর পুস্তকে এই নয়টি শ্লোকের পরে, সাতটি শ্লোকে, যে যে মূল গ্রন্থ হইতে “অদ্ভুত সাগরের” বচন-প্রমাণ উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাদের তালিকা প্রদত্ত হইয়াছে; এবং তৎপরে আর দ্বাদশটি শ্লোকে গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় সংক্ষেপে উক্ত হইয়াছে। এইরূপ তালিকা এবং বিষয়-সূচী অনেক নিবন্ধেই দৃষ্ট হয়। কিন্তু এসিয়াটিক্ সোসাইটীর পুঁথির ভূমিকায় এই ১৯টি শ্লোকের একটিও স্থানলাভ করে নাই। এই সকল শ্লোকও কি তবে প্রক্ষিপ্ত? বিষয়-সূচীর পর, বোম্বাইএর পুঁথিতে নিম্নোক্ত শ্লোক তিনটি আছে—

“शाके ख-नव-खेंद्वब्दे आरेभे द्भुतसागरं।
गौड़ेंद्र-कुंजरालान-स्तंभवाहु र्महीपतिः॥१॥
ग्रंथेस्मिनसमाप्त एव तनयं साम्राज्यरक्षा-महा-
दीक्षापर्वणि दीक्षणाम्निजकृते र्निष्पत्तिमभ्यर्थ्य सः।
नानादान-चितांबु-संचलनतः सूर्य्यात्मजा-संगमं
गंगायां विरचय्य निर्जरपुरं भार्य्यानुयातो गतः॥२॥
श्रीमल्लक्ष्मणसेन-भूपति रतिश्लाघ्यो यदुद्योगतो
निष्पन्नोद्भुतसागरः कृति रसौ वल्लाल-भूमीभुजः।
ख्यातः केवलमग्लुवः (?) सगरज-स्तोमस्य तत् पूरण-
प्रावीण्येन भगीरथ स्तु भुवनेष्वद्यापि विद्योतते॥३॥

 মর্ম্মানুবাদ—রাজা বল্লালসেল ১০৯০ শাকে “অদ্ভুতসাগরের” আরম্ভ করিয়াছিলেন (১)। তিনি এই গ্রন্থ অসমাপ্ত রাখিয়া, এবং তনয়ের উপর সমাপ্ত করিবার ভার অর্পণ করিয়া, স্বৰ্গারোহণ করিয়াছিলেন (২)। লক্ষ্মণসেনের উদ্যোগে “অদ্ভুতসাগর” সমাপ্ত হইয়াছিল (৩)।

 এই তিনটি শ্লোক একত্রে গ্রথিত। ইহার একটি ফেলিয়া, আর একটি রাখিবার উপায় নাই। কিন্তু এসিয়াটিক্ সোসাইটীর পুঁথিতে তাহাই করা হইয়াছে। প্রথম দুটি পরিত্যক্ত এবং তৃতীয়টি মাত্র লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এ অবস্থায়, “শাকে খ-নব-খেংদ্বব্দে” ইত্যাদি শ্লোকটিকে প্রক্ষিপ্ত বলা যায় না।

 রাখালবাবুর দ্বিতীয় যুক্তি,—বোধগয়ার দুইখানি শিলালিপির[২৫] উপসংহারে আছে—

“श्रीमल्लख्वणसेनस्यातीतराज्ये सं ५१ भाद्र दिने २९”
“श्रीमल्लक्ष्मणसेन-देवपादाना-मतीतराज्ये सं ७४ वैशाख्य-वदि १२ गुरौ॥”

 “শ্রীমল্লক্ষ্মণসেনস্যাতীতরাজ্যে সং ৫১”—ইহার অর্থ লক্ষ্মণসেনের রাজ্য লুপ্ত হওয়ার পর হইতে গণিত ৫১ সম্বতে, অথবা লক্ষ্মণসেনের রাজ্যলাভ হইতে গণিত ৫১ সম্বতে, অথচ লক্ষ্মণসেনের রাজ্যলোপের পরে। কিল্‌হর্ণ এক সময় শেষোক্ত অর্থ গ্রহণ করিয়া, সং ৫১ = ১১২০ + ৫১ = ১২৭১ খৃষ্টাব্দ ধরিয়াছিলেন। রাখালবাবু এই অর্থই বজায় রাখিতে যত্ন করিয়াছেন। এখানে শব্দার্থ লইয়া কাট্যাং কুট্যাং না করিয়া, এই মাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই দুইখানি বোধগয়ার লিপির অক্ষরের, [বিশেষতঃ প এবং দএর,] সহিত গয়ার ১২৩২ সম্বতের (১১৭৫ খৃষ্টাব্দের) গোবিন্দপালদেবের গতরাজ্যের চতুর্দ্দশ সম্বৎসরের শিলা-লিপির,[২৬] অথবা বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনের[২৭] প এবং দ অক্ষরের তুলনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায়,—১২৩২ সম্বতের গয়ার লিপির এবং বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনের প এবং দ পুরাতন নাগরীর ঢঙ্গের; পক্ষান্তরে, আলোচ্য বোধগয়ার লিপিদ্বয়ের প এবং দ বর্ত্তমান বাঙ্গালা প এবং দ এর মত। ঠিক এই প্রকারের প এবং দ চট্টগ্রামে প্রাপ্ত ১১৬৫ শকাব্দের [১২৪৩ খৃষ্টাব্দের] তাম্রশাসনে[২৮] দেখিতে পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দের শেষ ভাগে গৌড়-মণ্ডলে পুরাতন নাগরী ঢঙ্গের প, এবং দ’ই যে প্রচলিত ছিল, বল্লভদেবের “শকে নগ-নভো-রুদ্রৈঃ সংখ্যাতে” অর্থাৎ ১১০৭ শকের (১১৮৪-৮৫ খৃষ্টাব্দের) আসামের তাম্রশাসন তাহার সাক্ষ্যদান করিতেছে।[২৯] সুতরাং “শ্রীমল্লক্ষ্মণসেনস্যাতীতরাজ্যে সং ৫১” ১১৭১ খৃষ্টাব্দরূপে গ্রহণ না করিয়া, [আনুমানিক ১২০০ খৃষ্টাব্দে লক্ষ্মণসেনের মৃত্যু ধরিয়া,] ১২৫১ খৃষ্টাব্দ বলিয়া গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত। এই সিদ্ধান্তের এক আপত্তি আছে। লক্ষ্মণসেনের “অতীতরাজ্য” হইতে কোন সম্বৎ প্রচলিত হইবার প্রমাণ নাই। উত্তরে বলা যাইতে পারে—গোবিন্দপালদেবের “গতরাজ্য” বা “বিনষ্টরাজ্য” হইতেও কোন সম্বৎ প্রচলিত নাই। পক্ষান্তরে গোবিন্দপালদেবের রাজ্যলাভ হইতেও কোন সম্বৎ প্রচলিত হওয়ার প্রমাণ নাই। “গতরাজ্যে” “অতীতরাজ্যে” বা “বিনষ্টরাজ্যে” প্রভৃতি বিশেষণ-পদের এই রূপ অর্থ প্রতিভাত হয়—গোবিন্দপালদেবের রাজ্যলোপের পরে, মগধে অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছিল; লক্ষ্মণ-সেনের রাজ্যলোপের পরেও মগধে অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছিল। তখন মগধে কেহ “প্রবর্দ্ধমান-বিজয়রাজ্য” প্রতিষ্ঠিত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন না; অথবা যিনি মগধ করায়ত্ত করিয়াছিলেন, মগধবাসিগণ তাঁহাকে তখনও অধিপতি বলিয়া স্বীকার করিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এই নিমিত্ত “গতরাজ্যের” বা “অতীত রাজ্যের” সম্বৎ-গণনা প্রচলিত হইয়া থাকিবে। এই সম্পর্কে আর একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হইতে পারে,—লক্ষ্মণ-সম্বতের সূচনা এবং প্রচলন হইল কবে হইতে? পুত্র বিশ্বরূপসেনের সময়ে লক্ষ্মণ-সম্বৎ প্রচলিত ছিল না। বিশ্বরূপসেনের (কেশবসেনের?) ইদিলপুরের তাম্রশাসনের সম্পাদন-কাল, “সং ৩ জ্যৈষ্ঠ দিনে—” এবং মদনপাড়ে প্রাপ্ত তাম্রশাসনের সম্পাদন-কাল, “সং ১৪ আশ্বিনদিনে ১॥” পাল এবং সেন-রাজগণের সময় গৌড়-মণ্ডলে শকাব্দ বা বিক্রম-সম্বৎ প্রচার লাভ করিয়াছিল না; নৃপতিগণের বিজয়-রাজ্যের সম্বৎসরই প্রচলিত ছিল। পাল এবং সেনবংশের রাজ্য-নষ্টের পর, কিছুদিন “বিনষ্টরাজ্যের” বা “অতীতরাজ্যের” সম্বৎ ব্যবহৃত হইয়াছিল। তাহার পরে, প্রচলিত অব্দের অভাব পূরণের জন্য, “লক্ষ্মণাব্দ” উদ্ভাবিত হইয়া থাকিবে।

 লক্ষ্মণাব্দের মূল যাহাই হউক, আমরা কুমরদেবীর সারনাথ-লিপিতে, রামপালচরিতে, বৈদ্যদেবের এবং মদনপালের তাম্রশাসনে, বরেন্দ্রদেশের যে ইতিহাস প্রাপ্ত হই, তাহার উপর নির্ভর করিতে গেলে, দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদের পূর্ব্বে বিজয়সেন কর্ত্তৃক বরেন্দ্রে স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা একেবারে অসম্ভব বোধ হয়। বিজয়সেন যখন বরেন্দ্রে স্বাধীনতা অবলম্বনে উদ্যত ইয়াছিলেন, তখন প্রথমেই অবশ্য তাঁহার সহিত গৌড়পতি পাল-নরপালের সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল। দেবপাড়ার প্রশস্তিতে উক্ত হইয়াছে,—বিজয়সেন “গৌড়েন্দ্রকে সবলে আক্রমণ” করিয়াছিলেন (২০ শ্লোক)। সম্ভবত এই আক্রমণের ফলেই “গৌড়েন্দ্র” বরেন্দ্র ত্যাগ করিয়া, মগধে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তৎপর প্রতিবেশী নৃপতিমাত্রই হয় ত তাঁহার প্রতিকূলতাচরণে উদ্যত হইয়াছিলেন। কার্য্যত না হউক, নামতঃ কামরূপ-রাজ এবং কলিঙ্গ-রাজ, গৌড়েশ্বরের অনুগত ছিলেন। গৌড়েন্দ্রকে বরেন্দ্র হইতে বিতাড়িত হইতে দেখিয়া, হয়ত তাঁহারা বিদ্রোহী বিজয়সেনকে আক্রমণ করিয়াছিলেন। প্রশস্তিকার উমাপতি ধর লিথিয়াছেন—বিজয়সেন “কামরূপভূপকে দমন করিয়াছিলেন, এবং কলিঙ্গ[রাজকে] পরাজিত কবিয়াছিলেন (২০)।” মিথিলাপতি নান্যদেব বিজয়সেনকে আক্রমণ করিতে আসিয়া, ধৃত এবং কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন। উমাপতি ধর লিখিয়াছেন,—বিজয়সেন নান্য ব্যতীত রাঘব, বর্দ্ধন, এবং বীর নামক আরও তিনজন নৃপতিকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন (২১ শ্লোক)। গৌড়রাষ্ট্রের পশ্চিমাংশ [“পাশ্চাত্য-চক্র”] জয় করিবার জন্য, তিনি যে “নৌবিতান” প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহা অধিকদূর অগ্রসর হইতে পারিয়াছিল বালয় বোধ হয় না (২২ শ্লোক)। দক্ষিণ দিকে, বঙ্গে এবং রাঢ়ে, বর্ম্মরাজ কর্ত্তৃক বিজয়সেনের গতি রুদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু বরেন্দ্রে বিজয়সেনের আধিপত্য বদ্ধমূল হইয়াছিল, এবং সেখানে তিনি অনেক লোকহিতকর কার্য্যের অনুষ্ঠানের অবসর পাইয়াছিলেন। উমপতি ধর লিখিয়া গিয়াছেন,—বিজয়সেন অনেক “উত্তুঙ্গ দেবমন্দির” এবং “বিস্তীর্ণ (বিতত) তল্ল” প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। বিজয়সেন-প্রতিষ্ঠিত প্রদ্যুম্নেশ্বর-মন্দিরের ভগ্নাবশেষ এবং তাঁহার রাজধানী—[জনশ্রুতির “বিজয়রাজার বাড়ী”—বিজয়নগর বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। উমাপতি ধর-বিরচিত বিজয়সেনের প্রশস্তি-সম্বলিত শিলা-ফলক বরেন্দ্রের অন্তর্গত দেবপাড়ায় আবিষ্কৃত হইয়াছিল।

 বিজয়সেনের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী [বল্লালসেন] পিতৃ-সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, সমগ্র গৌড়রাষ্ট্র করায়ত্ত করিতে যত্নবান হইয়াছিলেন। বিজয়সেন পালবংশজ “গৌড়েন্দ্র”কে আক্রমণ করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছিলেন। বল্লালসেন, স্বীয় অভীষ্ট সাধনের জন্য, পাল-রাজবংশ উন্মূলিত করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন। ১১৬১ খৃষ্টাব্দে গোবিন্দপালদেব সম্ভবত বল্লালসেন কর্ত্তৃকই রাজ্যভ্রষ্ট হইয়াছিলেন। বর্ম্মরাজকে পদচ্যুত বা পদানত করিয়া, বল্লালসেন বঙ্গে এবং রাঢ়ে স্বীয় আধিপত্য বিস্তৃত করিয়াছিলেন। রাজত্বের “সং ১১ বৈশাখদিনে ১৬” সম্পাদিত, [কাটোয়ার নিকটে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে তাঁহার বঙ্গ এবং রাঢ় অধিকারের পরিচয় পাওয়া যায়। এই তাম্রশাসন “শ্রীবিক্রমপুর-সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবারে” সম্পাদিত হইয়াছিল, এবং এতদ্বারা “শ্রীবর্দ্ধমান-ভুক্ত্যন্তঃপাতী উত্তররাঢ়া-মণ্ডলের” ভূমি দান করা হইয়াছিল। বল্লালসেন সস্তবত কলিঙ্গ-রাজ্যও আক্রমণ করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে—লক্ষ্মণসেন “কলিঙ্গরমণীগণের সহিত কৌমার-কেলি করিয়াছিলেন।” ইহার অর্থ এই,–লক্ষ্মণসেন যখন যুবরাজ, তখন পিতার সহিত অথবা পিতার আদেশানুসারে, কলিঙ্গ আক্রমণ করিয়াছিলেন।

 ১১৫৯ খৃষ্টাব্দে বল্লালসেনের রাজ্যলাভ ধরিলে, “সং ১১” [কাটোয়ার তাম্রশাসনের সম্পাদনকাল] ১১৬৯ খৃষ্টাব্দে নির্দ্ধারিত হইতে পারে। এই বৎসর বল্লালসেন “দানসাগর” সঙ্কলিত করিয়াছিলেন, এবং ইহার পূর্ব্ব বৎসর, “অদ্ভুতসাগরের” সঙ্কলন আরম্ভ করিয়া, তাহা সমাপ্ত না হইতেই, স্বৰ্গারোহন করিয়াছিলেন। ইহাতে অনুমান হয়,—“দানসাগর” সঙ্কলিত হওয়ার [১১৬৯ খৃষ্টাব্দের] পরে, বল্লালসেন বড় অধিক দিন জীবিত ছিলেন না। “দানসাগরের” মঙ্গলাচরণে তিনি আপনাকে “গৌড়েশ্বর” বলিয়াছেন। পরবর্ত্তী-কালের গৌড়রাষ্ট্রের ইতিহাস আলোচনা করিলে প্রতীয়মান হয়,—বল্লালসেন গৌড়রাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দিহীন করিতে সমর্থ হইলেও, দ্বাদশ কি ত্রয়োদশ বর্ষস্থায়ী রাজত্বকালে,—বিস্তীর্ণ গৌড়-মণ্ডলের বিভিন্ন অংশ সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করিবার—গৌড়রাষ্ট্র পুনরায় সুগঠিত এবং এককেন্দ্রীভূত করিবার—অবসর পাইয়ছিলেন না।

 বল্লালসেন যে গৌড়রাষ্ট্র-পুনর্গঠনব্রত অসমাপ্ত অবস্থায় রাখিয়া, পরলোক গমন করিয়াছিলেন; তাঁহার পুত্র লক্ষ্মণসেন তাহা সমাপ্ত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন না। লক্ষ্মণসেনের এই অক্ষমতাই গৌড়ের সর্ব্বনাশের কারণ। লক্ষ্মণসেন পিতৃপিতামহের আরব্ধ কার্য্য সুসম্পন্ন করিতে যত্নের ত্রুটি করেন নাই; কিন্তু দেশ-কাল-পাত্র কিছুই সে মহদনুষ্ঠানের উপযোগী ছিল না। লক্ষ্মণসেনের, ধর্ম্মপাল-মহীপাল-রামপালের তুল্য প্রতিভা ছিল না। প্রজাপুঞ্জের নির্ব্বাচিত [বহুকাল গৌড়সিংহাসনের অধিকারী] গোপালের বংশধরগণকে গৌড়জন যেরূপ ভক্তি-নেত্রে দেখিতেন, বিদেশাগত পালরাজকুল-উন্মূলনকারী বিজয়সেনের এবং বল্লালসেনের উত্তরাধিকারী লক্ষ্মণসেন সেরূপ ভক্তি লাভ করিতে পারিয়াছিলেন না। সেকাল আর একালে প্রভেদও অনেক ছিল। বরেন্দ্রের বিদ্রোহে গৌড়ের প্রজাশক্তি এবং রাজশক্তি এই উভয়ের মধ্যে যে ভেদ উপস্থিত হইয়াছিল, কর্ণাটাগত সেনবংশের অভ্যুদয়ে, তাহা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছিল; এবং “মাৎস্য-ন্যায়” নিবারণের, অথবা “অনীতিকারম্ভের” প্রতীকারের অধিকার বিস্মৃত হইয়া, গৌড়জন কালস্রোতে গা ঢালিয়া দিয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের অভ্যুদয় গৌড়ের সর্ব্বনাশের মূল বা সর্ব্বনাশের ফল বলিয়া কথিত হইতে পারে না; বিজয়সেনের অভ্যুদয়ই গৌড়ের সর্ব্বনাশের প্রকৃত মূল বা ফল বলিয়া কথিত হইতে পারে।

 গৌড়াধিপ লক্ষ্মণসেনও অবশ্যই কলিঙ্গ-পতি এবং কামরূপ-পতিকে বশীভূত রাখিতে যত্ন করিয়াছিলেন; এবং ১১৪২ খৃষ্টাব্দে গোবিন্দচন্দ্রর আক্রমণ-মূলে কান্যকুব্জেশ্বরের মগধের উপর যে দাবী জন্মিয়াছিল, তাহার নিকাশ করিবার জন্য, কান্যকুব্জেশ্বরের সহিতও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। মাধাইনগরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে লক্ষ্মণসেন “বিক্রম-বশীকৃত-কামরূপঃ” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেম। লক্ষ্মণসেনের সময়, গৌড়-সেনা যে কামরূপ আক্রমণ করিয়াছিল, তৎসম্পর্কে অপর পক্ষও সাক্ষ্যদান করিতেছে। আসামে প্রাপ্ত কুমার বল্লভদেবের ১১০৭ শক-সম্বতের [১১৮৪-৮৫ খৃষ্টাব্দের] তাম্রশাসন[৩০] হইতে জানা যায়, বল্লভদেবের পিতামহ রায়ারিদেব-ত্রৈলোক্যসিংহের সময়, গৌড়সেনা কামরূপ আক্রমণ করিয়াছিল। এই শাসনে উক্ত হইয়াছে—“ভাস্কর-বংশীয় নৃপ-শিরোমণি রায়ারিদেব বঙ্গের মহাকায় করি-নিচয়ের উপস্থিতি-নিবন্ধন-ভয়াবহ সমরোৎসবে শত্রুগণকে অস্ত্রচালনা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন (৫ শ্লোক)।” রায়ারিদেব গৌড়-সেনা পরাজিত করিয়াছিলেন, এ কথা এখানে স্পষ্ট বলা হয় নাই। সুতরাং মাধাইনগর-তাম্রশাসনে উক্ত-“বিক্রমবশীকৃতকামরূপঃ”—নিরর্থক না হইতেও পারে।

 লক্ষ্মণসেনের এবং বিশ্বরূপসেনের প্রশস্তিকার, লক্ষ্মণসেন কর্ত্তৃক কাশি-রাজের (কান্যকুব্জ-রাজের) এবং কলিঙ্গ-রাজেরও পরাজয়ের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। মাধাইনগরের তাম্রশাসনে ক্ষোদিত রহিয়াছে,—“তিনি সমরক্ষেত্রে কাশি-রাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন।” বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—দক্ষিণসাগরের তীরে, পুরুষোত্তম-ক্ষেত্রে—অসি, বরণা, এবং গঙ্গাসঙ্গমে বিশ্বেশ্বরের কাশীধামে—ত্রিবেণী-সঙ্গমে প্রয়াগধামে—লক্ষ্মণসেন উচ্চ যজ্ঞ-যূপের সহিত সমর-জয়স্তম্ভ-মালা স্থাপিত করিয়াছিলেন (১২ শ্লোক)। লক্ষ্মণসেন যখন গৌড়াধিপ, তখন কান্যকুব্জের সিংহাসনে গাহড়-বাল-রাজ জয়চ্চন্দ্র, এবং কলিঙ্গের সিংহাসনে দ্বিতীয় রাজরাজ, এবং তৎপরে দ্বিতীয় অনঙ্গভীম, সমাসীন ছিলেন। ইঁহারা কেহই গৌড়াধিপের তুলা পরাক্রমশালী ছিলেন না। সুতরাং ইঁহাদিগের সহিত যুদ্ধে গৌড়াধিপের জয়লাভ অসম্ভব নহে। কিন্তু লক্ষ্মণসেন গৌড়-রাষ্ট্রের বহিঃশত্রু দমনে সমর্থ হইয়া থাকিলেও, প্রজাপুঞ্জের সহযোগিতার অভাবে, আভ্যন্তরীণ ঐক্যসাধনে, এবং বিভিন্ন অংশের রক্ষার সুব্যবস্থা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন না। সেই জন্যই মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার অবাধে মগধ এবং বরেন্দ্র অধিকার করিতে পারিয়াছিলেন।

 তুরূষ্কগণের গৌড়বিজয়-রহস্য বুঝিতে হইলে, তুরূষ্ক-চরিত্র এবং তাহাদিগের উত্তরাপথের অপরাপর অংশের বিজয়-বৃত্তান্ত সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন। আরবগণ উত্তরাপথের সিংহদ্বারোদ্‌ঘাটনে সমর্থ হইয়াছিলেন না। যাঁহারা সেই দুরূহ কার্য্য সম্পাদন করিয়াছিলেন, তাঁহারা [সবুক্‌তিগিন, মামুদ, এবং তাঁহাদের অনুচরগণ] তুরূষ্ক-জাতীয়। মধ্য-এসিয়ার মরুময় মালভূমি তুরূষ্কগণের আদি-নিবাস; নিয়ত পালিত পশুপাল লইয়া, গোচারণক্ষেত্রের অনুসন্ধান করাই ইহাদিগের বৃত্তি ছিল। আদিবাস-ভূমির জলবায়ু এবং চির-অভ্যাস মধ্য-এসিয়ার অধিবাসিগণকে কঠোরক্ষম, চঞ্চল এবং অগ্রগমনশীল করিয়া তুলিয়াছিল। চিরচাঞ্চল্য এবং অগ্রগমনশীলতা মধ্য-এসিয়ার অধিবাসিগণের জাতীয় চরিত্রের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ। এই জাতীয় চরিত্রের বলে বলীয়ান ইউচিগণ, আদি-নিবাসস্থান হইতে বহির্গত হইয়া, [খৃষ্ট-পূর্ব্ব প্রথম শতাব্দে] কুষাণসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠত করিয়াছিলেন; হূণগণ খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দে পূর্ব্ব-ইউরোপ এবং দক্ষিণ-এসিয়া ধ্বস্তবিধ্বস্ত করিয়াছিলেন; খৃষ্টীয় নবম হইতে পঞ্চদশ শতাব্দ পর্য্যন্ত তুরূষ্কগণ এবং [তাঁহাদের জ্ঞাতি] মোগলগণ, অবিরলধারে দলে দলে আসিয়া, ক্রমে আরব-সাম্রাজ্য, রোম-সাম্রাজ্য, চীন-সাম্রাজ্য এবং আরও অনেক প্রাচীন রাজ্য এবং প্রাচীন সভ্যতা বিনষ্ট করিয়াছিলেন। কি এসিয়ায়, কি ইউরোপে, সুসভ্য স্থির-নিবাস কৃষিজীবি জনগণ কখনও মরুভূমির কঠোরকর্ম্মী চঞ্চল সন্তানগণের আক্রমণবেগের গতিরোধ করিতে পারে নাই। খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দের সূচনা হইতে, যাহাদিগের আক্রমণ-প্রবাহ উত্তরাপথে প্রধাবিত হইয়া, ক্রমে হিন্দু-স্বাধীনতা বিলুপ্ত এবং হিন্দু-সভ্যতা ধ্বংস করিতে উদ্যত হইয়াছিল, তাহারা তুরূষ্ক-জাতীয়। মুসলমানধর্ম্মাবলম্বী হইলেও, জাতীয় চরিত্রের প্রেরণাই তাহাদিগকে ভারত-আক্রমণে ব্রতী করিয়াছিল; এবং আদি-নিবাসভূমির কঠোর শিক্ষা তাহাদিগকে শস্য-শ্যামলা ভারতমাতার আদরে লালিত পালিত সন্তানগণের পক্ষে দুর্জ্জেয় করিয়া তুলিয়াছিল। উত্তরাপথের একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দের রাজনীতিক অবস্থা—ঐক্যবিধানক্ষম সার্ব্বভৌম-নৃপতির অভাব, এবং অন্তর্দ্রোহ, আক্রমণকারিগণের পথের প্রকৃত বাধা অন্তর্হিত করিয়া রাখিয়াছিল।

 গজনীর সুলতান মামুদের মৃত্যুর অনতিকাল পরেই, সেল্‌জুকিয়া-তুরূষ্কগণ, মধ্য-এসিয়া হইতে বিনির্গত হইয়া, মামুদের সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশ কাড়িয়া লইয়া গজনী-রাজ্যের তুরূষ্কগণকে হীনবল এবং তুরূষ্ক-প্রবাহের প্রস্রবণ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু তথাপি তাহারা পঞ্জাবের পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হইবার চেষ্টা কখনও পরিত্যাগ করেন নাই। সুলতান মসুদের সময়, আহম্মদ নিয়াল্‌তিগীন্ কর্ত্তৃক বারাণসী-আক্রমণ পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। মসুদের উত্তরাধিকারী সুলতান ইব্রাহিম (১০৪৮-১০৯৯ খৃষ্টাব্দ) সেল্‌জুক-সম্রাট্ মালিক শাহের তনয়ার সহিত স্বীয় তনয়ের বিবাহ দিয়া, রাজ্যের পশ্চিম প্রান্ত সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইয়া, পুনঃ পুনঃ হিন্দুস্থান আক্রমণ করিয়া, অনেকগুলি স্থান এবং দুর্গ হস্তগত করিয়াছিলেন।[৩১] আলাউদ্দিন মসুদের সময় (১০৯৯–১১১৬ খৃষ্টাব্দ), “তুঘাতিগিন্ হিন্দুস্থানে [বিধর্ম্মিগণের সহিত] ধর্ম্ম-যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবার জন্য, গঙ্গা পার হইয়াছিলেন; এবং এমন একস্থান পর্য্যন্ত গিয়াছিলেন, যেখানে সুলতান মামুদ ভিন্ন, আর কেহ কখনও সসৈন্য উপনীত হইতে পারেন নাই।”[৩২] সুলতান বহরাম শাহ (১১১৮-১১৫৮ খৃষ্টাব্দ), সেল্‌জুক-সুলতান সঞ্জরের প্রসাদে গজনীর সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার সময়ে ঘোরের অধিপতি আলাউদ্দীন একবার গজনীনগর ভস্মসাৎ করিয়াছিলেন। তিনিও হিন্দুস্থানে ধর্ম্ম-যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন বলিয়া উল্লিখিত আছে।[৩৩]

 সুলতান মামুদের মৃত্যুর পরে, একাদশ শতাব্দে, পঞ্জাব এবং গৌড় রাজ্যের মধ্যবর্ত্তী ভূভাগের শাসন-ভার যাঁহাদিগের হস্তে ন্যস্ত ছিল, তাঁহাদিগের গজনী-রাজ্যবাসী তুরূষ্কগণের আক্রমণ-বেগ সহ্য করিবার শক্তি ছিল কিনা সন্দেহ। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দে এক দিকে গজনীরাজ্য যেমন নিতান্ত শোচনীয় অবস্থায় পতিত হইয়াছিল, অপর দিকে শাকম্ভরীর (আজমীরের) চৌহান-রাজগণ এবং কান্যকুব্জের গাহড়বাল-রাজগণ তেমনি পরাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। এই সময় যদি চৌহান এবং গাহড়বাল মিলিত হইতে পারিতেন, তবে বোধ হয় অনায়াসে উত্তরাপথের সিংহদ্বার শত্রুশূন্য করিতে পারিতেন। কিন্তু, একশত বৎসরের মধ্যে কখনও ইঁহারা সম্মিলিত হইয়া শক্রর সম্মুখীন হইবার অবসর পাইয়াছিলেন না; অবশেষে মুইজুদ্দীন মহম্মদ ঘোরী আসিয়া, একে একে উভয় রাজ্য ধ্বংস করিয়াছিলেন। দুর্ব্বল গজনবী-তুরূষ্কগণও গাহড়বাল এবং চৌহান-রাজগণকে বিশ্রাম দিয়াছিলেন না। বহরাম শাহ সম্ভবত বারাণসী পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন। কুমরদেবীর সারনাথের শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে—গাহড়বাল-রাজ গোবিন্দচন্দ্র (+১১১৪—১১৫৪+ খৃষ্টাব্দ) মহাদেব কর্ত্তৃক “দুষ্ট তুরূষ্ক-সৈন্যের হস্ত হইতে বারাণসী রক্ষা করিবার জন্য” [বারাণসীং……… দুষ্ট-তুরূষ্ক-সুভটাদবিতুং] নিযুক্ত হইয়াছিলেন।[৩৪] তুরূষ্ক-সৈন্যের হস্ত হইতে গোবিন্দচন্দ্র যে বারণসীর উদ্ধার-সাধন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। কিন্তু বারাণসী রক্ষণ করিয়াই, তাঁহার তৃপ্ত হওয়া উচিত ছিল কি?

 চৌহান-রাজ বীসলদেব, এবং গোবিন্দচন্দ্রের পুত্র গাহড়বাল-রাজ বিজয়চন্দ্রকেও, গজনবীতুরূষ্কগণের আক্রমণ-বেগ সহ্য করিতে হইয়াছিল। ১২২০ সম্বতের [১১৬৪ খৃষ্টাব্দের] দিল্লী-শিবালিক স্তম্ভ-লিপিতে উক্ত হইয়াছে—চৌহান-রাজ বীসলদেব

आर्य्यावर्त्तं यथार्थं पुनरपि कृतवान् म्लेच्छ-चिच्छेदनाभिः।”[৩৫]

“ম্লেচ্ছ নাশ করিয়া, আর্য্যাবর্ত্তের নাম পুনরায় যথার্থ করিয়াছিলেন।” প্রশস্তিকার হয়ত এখানে চৌহানরাজ্য-অর্থে “আর্য্যাবর্ত্ত” শব্দের ব্যবহার করিয়াছেন। কারণ, বীসলদেব বা অন্য কোন হিন্দু-নরপতি কখনও পঞ্জাব আক্রমণ করিয়াছিলেন, গজনবী সুলতানগণের ইতিহাসে এরূপ আভাস পাওয়া যায় না। ১২২৪ সম্বতের [১১৬৮ খৃষ্টাব্দের] গাহড়বাল-রাজ বিজয়চন্দ্রের [কমৌলীতে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে তিনি

भुवन-दलन-हेलाहर्म्य हम्मीर-नारी-
नयनजलद-धारा-धौत-भूलोक-तापः”[৩৬]

“হেলায় ভুবনদলক্ষম হম্মীরের নারীগণের নয়ন-জলধারা দ্বারা ভূলোকের তাপ-ধৌতকারী” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। “হম্মীর” এ স্থলে আমীর বা গজনবী-সুলতান অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। চৌহান বীসলদেব এবং গাহড়বাল বিজয়চন্দ্রের সময়ের গজনবী-সুলতান খুসরু শাহ, গজনী হইতে তাড়িত হইয়া আসিয়া, লাহোরে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু এরূপ দুরবস্থায় পতিত হইয়াও, তিনি তুরূষ্কের স্বভাবগত অগ্রগমনশীলতা ত্যাগ করিতে পারিয়াছিলেন না; সম্ভবত চৌহান এবং গাহড়বাল, এই উভয় রাজ্যই, একবার একবার আক্রমণ করিয়াছিলেন। তুরূষ্ক-যোদ্ধৃগণ এযাবৎ গাহড়বাল-রাজ্য জয় করিতে অসমর্থ হইলেও, তুরূষ্ক-ঔপনিবেশিকগণ রাজ্যের নানা স্থানে প্রবেশলাভ করিয়াছিল। গাহড়বাল-রাজ চন্দ্রদেবের, মদনচন্দ্রের, গোবিন্দচন্দ্রের এবং বিজয়চন্দ্রের অনেক তাম্রশাসনে “তুরূষ্ক-দণ্ড” নামক রাজকরের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। “তুরূষ্ক-দণ্ড” নাম হইতে বুঝিতে পারা যায়,—তুরূষ্ক-প্রজাগণকে এই বিশেষ কর প্রদান করিতে হইত।

 ১১৬৮ কি ১১৬৯ খৃষ্টাব্দে, শেষ গজনবী-সুলতান খুসরু-মালিক, লাহোরের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন; ১১৭০ খৃষ্টাব্দে গাহড়বাল জয়চ্চন্দ্র কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন; ১১৭০ হইতে ১১৮২ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে, চৌহান দ্বিতীয় পৃথ্বিরাজ আজমীরের সিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন; এবং ১১৭৩ খৃষ্টাব্দে সুলতান ঘিয়াসুদ্দীন ঘোরী গজনীনগর অধিকার করিয়া, অনুজ মুইজুদ্দীন মহম্মদ ঘোরীকে সুলতান মামুদের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। মহম্মদ-ঘোরী পরাজয়েও পরাঙ্মুখ না হইয়া, কেমন করিয়া একে একে এই সকল প্রতিদ্বন্দীকে বিনাশ করিয়া হিন্দুস্থানে আধিপতা স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহার বর্ণন এখানে নিষ্প্রয়োজন। লাহোরের সুলতান, দিল্লী ও আজমীরের চৌহানরাজ এবং কনোজের গাহড়বালরাজ [সমবেত ভাবে না হউক] স্বতন্ত্র ভাবে আক্রমণকারীর গতিরোধার্থ যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছিলেন। ইঁহাদিগের দমনার্থ মহম্মদ ঘোরীকে পুনঃ পুনঃ গজনী ত্যাগ করিয়া হিন্দুস্থানে আসিতে হইয়াছিল। কিন্তু শশাঙ্ক, ধর্ম্মপাল, দেবপাল এবং মহীপালের গৌড়রাষ্ট্র [একরূপ নির্ব্বিবাদে] মহম্মদঘোরীর একজন দাসানুদাসকে রাজপদে বরণ করিয়াছিল।

 মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার নামক খল্‌জ্ বা খিলজি বংশীয় একজন তুরূষ্ক, মুইজুদীন মহম্মদের সেনাশ্রেণীতে কর্ম্মের অনুসন্ধানে, গজনী গমন করিয়াছিলেন। মহম্মদের চেহারা পছন্দসহি না হওয়ায়, সেনাসংগ্রহ-বিভাগের প্রধান কর্ম্মচারী তাঁহাকে একটি অল্প বেতনের কর্ম্ম দিতে চাহিয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার প্রস্তাবিত কর্ম্ম গ্রহণ না করিয়া হিন্দুস্থানে—দীল্লিতে গমন করিলেন। মহম্মদঘোরীর প্রতিনিধি কুতবুদ্দীন তখন দীল্লীতে অবস্থান করিতেছিলেন। দীল্লীতেও মহম্মদের আকৃতি তাঁহার মনোমত পদপ্রাপ্তির অন্তরায় হইয়া দাঁড়াইল। হতাশ হইয়া, মহম্মদ অযোধ্যায় গিয়া, মালিক হুসামুদ্দীন আগুল্‌বকের শরণাগত হইলেন। হুসামুদ্দীন মহম্মদের ক্ষিপ্রকারিতার এবং সাহসের পরিচয় পাইয়া, তাঁহাকে “ভগবত” এবং “ভিউলি” নামক দুইটি পরগণা জায়গীর দান করিয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের জায়গীর দক্ষিণ বিহার বা মগধের পশ্চিম সীমা কর্ম্মনাশা নদীর পশ্চিমে, চুনারগড়ের নিকটে অবস্থিত ছিল। এখান হইতে মহম্মদ মাঝে মাঝে মগধে (বিহারে) প্রবেশ করিয়া, গ্রাম লুটপাট আরম্ভ করিলেন; এবং লুণ্ঠিত অর্থের দ্বারা ক্রমশঃ যুদ্ধের অশ্ব, অস্ত্রশস্ত্র, এবং সেনা সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। তাঁহার বীরত্বের খ্যাতি চারিদিকে ব্যাপ্ত হইলে, হিন্দুস্থানের যত খল্‌জ্ বা খিলজি-বংশীয় তুরূষ্ক ছিল, তাহারা আসিয়া তাঁহার সহিত মিলিত হইল। সুলতান কুতবুদ্দীন মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের সুখ্যাতি শুনিয়া, তাঁহাকে খিলাত পাঠাইয়া দিলেন। প্রোৎসাহিত হইয়া, মহম্মদ পুনঃ পুনঃ “বিলায়ৎ বিহার” আক্রমণ করিয়া, অনেক স্থান লুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। “এক দো সাল” এইরূপ আক্রমণ ও লুণ্ঠন চলিল।

বিহার-বিজয়

 অবশেষে মহম্মদ বিহার দুর্গ অধিকার করিতে মনস্থ করিলেন। এই “কিল্লা-বিহার” পাটনা জেলার অন্তর্গত বর্ত্তমান বিহার মহকুমার প্রধান নগর বিহার বলিয়া অনুমিত হয়। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক “বিহার-দুর্গ”, এবং তৎপর বৎসর, “নোদিয়া” অধিকারের সময় লইয়া, পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। রেভার্টির মতে, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে বিহার-দুর্গ অধিকার করিয়াছিলেন।[৩৭] ব্লক্‌ম্যান এই ঘটনা ১১৯৭ কি ১১৯৮ খৃষ্টাব্দে স্থাপন করিতে চাহেন। ব্লক্‌ম্যানের অনুমানই সমীচীনতর বোধ হয়। “বিহার” এবং “নোদিয়া” অধিকারের বিবরণ সম্বন্ধে আমাদের প্রধান অবলম্বন—মিন্‌হাজুদ্দীনের “তবকাত্-ই-নাসিরি” নামক পারস্য ভাষায় রচিত ইতিহাস গ্রন্থ।

 ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে, কুতবুদ্দীন কর্ত্তৃক দীল্লি অধিকারের বৎসরে, মিন্‌হাজুদ্দীন জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন; এবং সুলতান ইয়াল্ তিমিসের এবং তাঁহার বংশধরগণের রাজত্বকালে, প্রথমে গোয়ালিয়রের এবং পরে দীল্লির প্রধান কাজির পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১২৪২ খৃষ্টাব্দে প্রধান কাজির পদ ত্যাগ করিয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন বাঙ্গলায় আসিয়াছিলেন; এবং এখানে দুই বৎসরকাল অবস্থান করিয়া, দীল্লি ফিরিয়া গিয়াছিলেন। এই সুযোগেই, মিন্‌হাজ বিহার এবং বাঙ্গালার তৎকালীন ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করিয়াছিলেন। “বিহার” এবং “নোদিয়া” অধিকারের ৪৫ বৎসর পরে, বিবরণ-সঙ্কলনে ব্রতী হইয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন বৃদ্ধ সৈনিক এবং “বিশ্বস্ত লোকের” মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন, তাহাই লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। মিন্‌হাজুদ্দীন যখন “তবকাত্” রচনায় প্রবৃত্ত, তখন অবশ্যই পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণের প্রবর্ত্তিত প্রমাণ-পরীক্ষা-রীতি কাহারও জানা ছিল না, এবং তৎকালের জনসাধারণের ন্যায় মিন্‌হাজেরও অতিপ্রাকৃত এবং আজগুবি কথায় বিশ্বাস স্থাপনের প্রবৃত্তি যথেষ্ট ছিল। উপরন্তু, স্বধর্ম্মে অনুরাগ এবং পৌত্তলিকতায় অশ্রদ্ধা, মিন্‌হাজের ন্যায় লেখকগণকে স্বজাতির একান্ত পক্ষপাতী করিয়া রাখিয়াছিল। সুতরাং মিন্‌হাজ-বর্ণিত “বিহার” এবং “নোদিয়া”-অধিকারের বিবরণ বিশেষ বিচার পূর্ব্বক গ্রহণ করা কর্ত্তব্য।

 “বিশ্বাসী লোকের” এবং ঐ ঘটনায় লিপ্ত একজন বৃদ্ধ সৈনিকের মুখের কথা শুনিয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন বিহার-কিল্লা অধিকারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার যখন “বিহার” আক্রমণ করেন, তখন তাঁহার অনুচরগণের মধ্যে নিজামুদ্দীন এবং সমসামুদ্দীন এই দুই ভ্রাতা ছিল। ১২৪৩ খৃষ্টাব্দে মিন্‌হাজুদ্দীন যখন “লখ্‌নাবতী” নগরে অবস্থান করিতেছিলেন, তখন সমসামুদ্দীনের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল; এবং সমসামুদ্দীনের মুখে যেরূপ শুনিয়াছিলেন, তিনি তাহাই লিথিয়া গিয়াছেন। বিহার-অধিকার-প্রসঙ্গের সূচনায় মিন্‌হাজুদ্দীন লিখিয়াছেন,—“বিশ্বাসী লোকেরা এইরূপ বলিয়াছেন যে, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার, দুই শত বর্ম্মাচ্ছাদিত-গাত্র অশ্বারোহী লইয়া, বিহারদুর্গের দ্বারদেশে উপনীত হইয়াছিলেন; এবং হঠাৎ ঐ স্থান আক্রমণ করিয়াছিলেন।” পরে সমসামুদ্দীনের উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন,—আক্রমণকারিগণ দুর্গের দ্বারে উপস্থিত হইলে, “মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার সাহসে ভর করিয়া, দ্বারের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। তাঁহারা কিল্লা অধিকার করিয়াছিলেন, এবং বিস্তর দ্রব্য লুণ্ঠিত করিয়াছিলেন। ঐ স্থানের অধিকাংশ অধিবাসী ব্রাহ্মণ ছিলেন, এবং ইঁহাদের সকলেরই মস্তক মুণ্ডিত ছিল। তাঁহারা সকলেই নিহত হইয়াছিলেন। ঐ স্থানে অনেকগুলি পুস্তক ছিল। যখন এই সকল পুস্তক মুসলমানগণের নয়নগোচর হইল, তখন উহাদের মর্ম্ম বুঝাইবার জন্য তাঁহারা কতকগুলি হিন্দুকে ডাকিয়া পাঠাইলেন; কিন্তু সমস্ত হিন্দুই নিহত হইয়াছিল। যখন তাঁহারা [প্রকৃত কথা] জানিতে পারিলেন, তখন দেখা গেল—“তামাম হিসার (দুর্গ) ও সহর একটা বিদ্যালয়, এবং হিন্দী ভাষায় বিদ্যালয়কে (মাদ্‌রাসাকে) ‘বিহার’ বলে।”[৩৮]

 এস্থলে দেখিতে পাওয়া যায়,—মিন্‌হাজুদ্দীন “কিল্লা বিহার” অধিকারের প্রকৃত বিবরণ জানিতে যথেষ্ট শ্রম স্বীকার করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার বিবরণ সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য। কিন্তু তিনি যে শ্রেণীর লোকের নিকট হইতে বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাদের পর্য্যবেক্ষণ-শক্তি যে কত দুর্ব্বল, তাহার দুইটি প্রমাণ পাওয়া গেল। তাহারা একটি বৌদ্ধ-বিদ্যালয়কে “কিল্লা” বলিয়া ভ্রম করিতে সমর্থ হইয়াছিল; এবং অনুসন্ধান করিয়াও, তাহারা ঠিক করিয়া উঠিতে পারে নাই যে—মুণ্ডিত-মস্তক বিহারবাসীরা ব্রাহ্মণ নহে, বৌদ্ধ শ্রমণ।

 মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার “কিল্লা-বিহার” লুণ্ঠন করিয়া, বহু ধন লাভ করিয়াছিলেন। যে বৌদ্ধ-বিহার আক্রমণকারিগণের নিকট কিল্লা এবং সহর বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছিল, তাহাতে যে বহু কালের বহু ভক্ত-জনের প্রদত্ত বহু অর্থ সঞ্চিত থাকিবে, ইহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কি? মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার এই লুণ্ঠিত দ্রব্য লইয়া, স্বয়ং দীল্লিতে কুতবদ্দীন আইবকের নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন। কুতবুদ্দীন তাঁহাকে বহু সম্মান করিয়াছিলেন। মিন্‌হাজ লিখিয়াছেন,—মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার দীল্লি হইতে ফিরিয়া আসিয়া, “বিহার জয় করিয়ছিলেন [বিহার ফতে কর্‌দ]”। এই “বিহার ফতের” কথাটা অতি সাবধানে গ্রহণ করিতে হইবে। “বিহার” বলিতে এখন আমরা যাহা বুঝি, মিন্‌হাজুদ্দীন সে অর্থে বিহার-শব্দের ব্যবহার করেন নাই। তিনি সুলতান ইয়াল্‌তিমিসের রাজত্বের বিবরণের শেষে, বিজিত প্রদেশ-সমূহের যে তালিকা দিয়াছেন, তাহাতে “বিহার” এবং “তিরহুত” স্বতন্ত্র উল্লিখিত হইয়াছে। মিন্‌হাজের “বিহার” দক্ষিণ বিহার বা সাহাবাদ, পাটনা, গয়া, মুঙ্গের, এবং ভাগলপুর জেলা। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার তিরহুত জয় করা দূরে থাকুক, কোন দিন উহার কোন অংশ আক্রমণও করিয়াছিলেন না। যাঁহার শৈথিল্যে বা দুর্ব্বলতায়, দক্ষিণ-বিহার মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের ন্যায় সামান্য জায়গীরদার কর্ত্তৃক পুনঃ পুনঃ আক্রান্ত লুণ্ঠিত এবং অবাধে বিজিত হইতে পারিয়ছিল, সেই “গৌড়েশ্বরের” রাজধানীতে “বিহার ফতের” কাহিনী ঘোর আতঙ্ক উপস্থিত করিয়া, নির্বিরোধে বরেন্দ্র এবং রাঢ়দেশ অধিকারের পথ পরিষ্কার করিয়া থাকিবে।

 মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের অভ্যুদয়-কালে, যিনি উত্তরাপথের পূর্ব্বাংশের প্রধান নরপাল বা “গৌড়েশ্বর” [মিন্‌হাজের ভাষায় “হিন্দের রায়গণের পুরুষানুক্রমিক খালিফাস্থানীয়”] ছিলেন, মিন্‌হাজুদ্দীন তাঁহাকে “রায় লখ্‌মনিয়া” এবং তাঁহার “দার-উল্-মুল্‌ক্” বা রাজধানীকে “সহর নোদিয়া” নামে উল্লেখ করিয়াছেন। মিন্‌হাজ “রায় পিথোরার” [চৌহান-রাজ পৃথ্বীরাজের] এবং “রায় জয়চাঁদের” [গাহড়বাল-রাজ জয়চ্চন্দ্রের] নামোল্লেখ মাত্র করিয়াছেন, কিন্তু “রায় লখ্‌মনিয়ার” জীবনচরিত লিপিবদ্ধ করিতেও যত্ন পাইয়াছেন; তাঁহার শাসনরীতির সুখ্যাতি করিয়াছেন; দানশীলতার জন্য তাঁহাকে “সুলতান করিম কুতবদ্দীন হাতেমুজ্জমান” বা সেই যুগের হাতেম কুতবুদ্দীনের সহিত তুলনা করিয়াছেন; এবং উপসংহারে পৌত্তলিক-বিদ্বেষ বিস্মৃত হইয়া, আশীর্ব্বাদ করিয়াছেন;—“আল্লা [নরকে] তাঁহার শাস্তির লাঘব করুন।”[৩৯] এই “রায় লখ্‌মনিয়া” কে, তদ্বিষয়ে পণ্ডিত-সমাজে বিস্তর মতভেদ আছে। মিন্‌হাজুদ্দীনের “রায় লখ্‌মনিয়া” গৌড়াধিপ লক্ষ্মণসেনের নামের অপভ্রংশ বলিয়াই বোধ হয়। মিন্‌হাজুদ্দীন লখ্‌মনিয়ার যে জীবনী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা তিনি “বিশ্বাসী লোকের” উক্তি (সেফাৎ রোয়াৎ) বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। জনশ্রুতির বাহক এই সকল “বিশ্বাসী লোক” যাঁহাকে ভক্তির চক্ষে দেখেন, তাঁহার জীবনীকে অনেক অলৌকিক ঘটনায় সাজাইতে ভাল বাসেন। মিন্‌হাজুদ্দীন-লিখিত লক্ষ্মণসেনের জন্মবৃত্তান্ত, জন্মমাত্র রাজ্যাভিষেক, এবং সুদীর্ঘ-রাজ্যশাসন-কাহিনী “বিশ্বাসী লোকের” কল্পনা বলিয়াই মনে হয়। তবে মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের “নোদিয়া” আক্রমণের সময় লক্ষ্মণসেন ঠিক অশীতিবর্ষীয় না হউন, বার্দ্ধক্যে পদার্পণ করিয়াছিলেন, এ কথা বিশ্বাস করা যাইতে পারে।

লক্ষ্মণাবতী ও নোদিয়া

 তাহার পর জিজ্ঞাস্য—“সহর নোদিয়হ্” কোন্ খানে ছিল? আবুল্ ফজল্ মিন্‌হাজের “নোদিয়হ্‌কে” “নদীয়া” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, এবং বাঙ্গলায় সংস্কৃত-চর্চ্চার গুরুস্থান নবদ্বীপই যে লখ্‌মনিয়ার “নদীয়া” তাহার আভাস দিয়াছেন।[৪০] আবুল্ ফজলের মতই এখন সর্ব্বত্র সমাদর লাভ করিয়াছে। কিন্তু আবুল্ ফজলের সময়েও, সকলে “নোদিয়হ্”কে “নদীয়া” বলিয়া মনে করিত না। “মুন্তখাব্-উৎ-তওয়ারিখ”-গ্রন্থে আবদুল কাদির বেদৌনি মিন্‌হাজের “নোদিয়হ্”কে “নোদীয়া” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।[৪১] সংস্কৃত সাহিতো, লক্ষ্মণসেনের দুইটি স্বতন্ত্র রাজধানী, ‘বিজয়পুর’ এবং ‘লক্ষ্মণাবতীর’ উল্লেখ পাওয়া যায়। “পবনদূতে” ধোয়ী কবি সুহ্ম বা রাঢ়দেশের বর্ণনা করিয়া এবং

“भागीरथ्या स्तपनतनया यत्र निर्य्याति देवी” (३३)

সেই মুক্তবেণী (ত্রিবেণীর) উল্লেখ করিয়া,

“स्कन्धावारं विजयपुर मित्युन्नतां राजधानी” (३६)

বর্ণন করিয়াছেন। “প্রবন্ধচিন্তামণি”-গ্রন্থে মেরুতুঙ্গ আচার্য্য লিখিয়াছেন,—“গৌড়দেশে লক্ষ্মণাবতী নগরে—লক্ষ্মণসেন নামক রাজা দীর্ঘকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন।” মিন্‌হাজ লিখিয়াছেন,[৪২] “মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার ঐ (রায় লখ্‌মনিয়ার) মুলুক সকল (মমল্‌কত) দখল (জব্‌ত) করিয়া সহর নোদিয়হ্‌কে “খরাব” করিলেন, এবং যে মৌজা [এখন] লখ্‌ণাবতী, তাহার উপর রাজধানী (দার-উল্-মুল্‌ক্) স্থাপন করিলেন।” এখানে দেখা যায়—মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার যেন লখ্‌ণাবতী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। “লখ্‌ণাবতী” লক্ষ্মণাবতীর অপভ্রংশ। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার যে ইচ্ছাপূর্ব্বক ঐ স্থানের নাম “লক্ষ্মণাবতী” রাখিয়াছিলেন, এমন সম্ভব নহে। ঐ স্থানের নাম আগেই “লক্ষ্মণাবতী” ছিল, এবং উহাই লক্ষ্মণসেনের অন্যতম রাজধানী ছিল। সেনরাজগণের কীর্ত্তিচিহ্ন সেখান হইতে এখনও লুপ্ত হয় নাই। কিম্বদন্তী অনুসারে, লখ্‌ণাবতী বা গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের সমীপবর্ত্তী বিশাল সাগরদীঘি লক্ষ্মণসেন খোদাইয়াছিলেন; এবং সাগরদীঘির অনতিদূরস্থিত একটি প্রাচীন দুর্গের ভগ্নাবশেষ এখনও “বল্লালগড়” নামে কথিত হইয়া আসিতেছে। লক্ষ্মণসেনের অপর রাজধানী “বিজয়পুর” মিন্‌হাজুদ্দীন কর্ত্তৃক “নোদিয়াহ্” নামে অভিহিত হইয়া থাকিতে পারে। “পবনদূতের” প্রকাশক প্রবীণ প্রত্নতত্ত্ববিদ্ শ্রীযুত মনোমোহান চক্রবর্ত্তী “নোদিয়াহ্” এবং “নদীয়া” অভিন্ন মনে করিয়া, নদীয়াই বিজয়পুর এইরূপ মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু রাজসাহী জেলার রামপুর বোয়ালিয়া সহরের ১০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত [জনশ্রুতি অনুসারে] কুমার রাজার রাজধানী “কুমারপুরের” নিকটবর্ত্তী বিজয় রাজার রাজবাড়ীর ভগ্নাবশেষপূর্ণ “বিজয়নগর”ই পবনদূতের ‘বিজয়পুর’ বলিয়া বোধ হয়। বিজয়সেনের নামানুসারে যে বিজয়পুরের নামকরণ হইয়াছিল, এ বিষয়ে সংশয় নাই; এবং ‘বিজয়নগরে’ও জনশ্রুতি অনুসারে এক বিজয় রাজা ছিল। দানসাগর-মতে বিজয়সেনের প্রাদুর্ভাব-স্থানে [বরেন্দ্রেই] “বিজয়নগর” অবস্থিত, এবং ইহার ৭ মাইল ব্যবধানে বিজয়সেনের শিলালিপির প্রাপ্তি-স্থান “দেবপাড়া” অবস্থিত। দেবপাড়ার ‘পদুমসহর’ নামক তল্ল বিজয়সেনের প্রতিষ্ঠত প্রদ্যুম্নেশ্বরের স্মৃতি এখনও জাগ্রত রাখিয়াছে, এবং “পদুমসহরের” তীরে একটি বৃহৎ দেবমন্দিরের ভগ্নাবশেষ এখনও বিদ্যমান আছে। সুতরাং বিজয়নগরকে বিজয়পুর বলিয়া গ্রহণ করাই সমীচীন বোধ হয়। বিজয়নগর লক্ষ্মণাবতীর ভগ্নাবশেষ হইতে ৪৫ মাইল বাবধানে অবস্থিত; নদীয়া ১১০ মাইল ব্যবধানে অবস্থিত। মিন্‌হাজের বর্ণনানুসারে ‘লখ্‌নাবতী’ হইতে ‘নোদিয়া’ খুব বেশ দূরে অবস্থিত ছিল বলিয়া বোধ হয় না, এবং এই নিমিত্ত বিজয়নগরকেই “নোদিয়াহ্” বলিতে প্রবৃত্তি হয়।

 মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক “কিল্লা-বিহার” অধিকারের বিবরণ সঙ্কলনে ব্রতী হইয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন যেমন সেই ব্যাপারে স্বয়ং লিপ্ত এক জন বৃদ্ধ সৈনিকের সাক্ষ্য গ্রহণে সমর্থ হইয়াছিলেন, “নোদিয়াহ্”-অধিকার সম্বন্ধে তেমন কোন সাক্ষাৎ দ্রষ্টার মুখের কথা শুনিয়াছিলেন বলিয়া উল্লেখ করিয়া যান নাই। “নোদিয়াহ্”-অধিকার-ব্যাপারে তাঁহার একমাত্র অবলম্বন “বিশ্বাসযোগ্য লোকের” উক্তি। এই সকল “বিশ্বাসযোগ্য লোকেরা”, অর্থাৎ ১২৪২-১২৪৩ খৃষ্টাব্দের লখ্‌নাবতীর তুরূষ্ক রাজপুরুষগণ, মিন্‌হাজকে মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের এবং তাঁহার অনুচরগণের কার্য্যকলাপ সম্বন্ধে সম্ভবত খাঁটি খবরই দিতে পারিয়াছিলেন; কিন্তু মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের “নোদিয়াহ্” প্রবেশের পূর্ব্বে এবং তাঁহার পরোক্ষে নোদিয়ায় যে সকল ঘটনা ঘটিয়াছিল, তৎসম্বন্ধে ইঁহাদের প্রদত্ত বিবরণ তত নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হইতে পারে না। সুতরাং মিন্‌হাজুদ্দীনের বর্ণিত মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক অধিকারের পূর্ব্বের নোদিয়া-বিবরণ বিশেষ বিচার পূর্ব্বক গ্রহণ করা কর্ত্তব্য; এবং যুক্তিবিরুদ্ধ অংশ অমূলক গুজব বলিয়া উপেক্ষনীয়। মিন্‌হাজ লিখিয়াছেন, “যখন মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক “বিহার ফতে” হওয়ার সংবাদ রায় লখ্‌মনিয়ার রাজ্যের “আত্রাফে” পঁহুছিল, তখন এক দল জ্যোতিষী ব্রাহ্মণ-রাজমন্ত্রী রাজার নিকট গিয়া নিবেদন করিল যে, পুরাকালের ব্রাহ্মণগণের পুস্তকে লেখা আছে যে, এই দেশ তুরূষ্কগণের হস্তগত হইবে; এবং এই শাস্ত্রীয় ভবিষ্যৎবাণী সফল হইবার সময়ও আসিয়াছে। সুতরাং সকলেরই এ দেশ হইতে পলায়ন করা উচিত। শাস্ত্রে লেখা ছিল, আজানুলম্বিতবাহু একজন তুরূষ্ক দেশ অধিকার করিবে। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার আজানুলম্বিতবাহু কি না, দেখিয়া আসিবার জন্য রাজা বিশ্বাসী চর পাঠাইলেন; চরেরা আসিয়া বলিল, মহম্মদ বখ্‌তিয়ার যথার্থই আজানুলম্বিতবাহু। যখন এই সংবাদ নোদিয়ায় প্রচারিত হইল, তখন “ঐ মৌজার” ব্রাহ্মণগণ এবং সাহাগণ (ব্যবসায়ীগণ) সঙ্কনতে, বঙ্গে, এবং কামরূপে (কামরূদে) চলিয়া গেল। কিন্তু রাজ্য ছাড়িয়া যাওয়া রায় লখ্‌মনিয়ার পছন্দ “মাফিক” হইল না। সুতরাং মিন্‌হাজের মতে, যাঁহার খান্‌দানকে (বংশকে) হিন্দের “রাইয়ান্” বা রাজগণ “বুজুর্গ” মনে করিত, এবং হিন্দের খলিফা বলিয়া স্বীকার করিত, এবং যাঁহার ফরজন্দান্ [বংশধরগণ] “তবকত-ই-নাসিরি” রচনার সময় [১২৬০ খৃষ্টাব্দ] পর্য্যন্ত বঙ্গের শাসনকর্ত্তা ছিল, সেই রায় লখ্‌মনিয়া একটি বৎসর জনশূন্য নদীয়ায় পড়িয়া রহিলেন!

নোদিয়া-বিজয়

 “দোয়ম সাল (পরের বৎসর) মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার লস্কর প্রস্তুত করিয়া, বিহার হইতে ধাবিত হইলেন; এবং সহসা নদীয়া সহরের নিকট এমন ভাবে উপস্থিত হইলেন যে, ১৮ জনের বেশী সওয়ার (অশ্বারোহী) তাঁহার সঙ্গে ছিল না; এবং “দিগর লস্কর” পশ্চাতে আসিতেছিল। যখন মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার সহরের দরজায় পঁহুছিলেন, কাহাকেও আঘাত করিলেন না, ধীর, স্থির ভাবে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। কেহ মনে করিল না, ইনি মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার; লোকে অনুমান করিল হয়ত একদল সওদাগর বিক্রয় করিবার জন্য ঘোড়া আনিয়াছে। যখন রায় লখ্‌মনিয়ার বাড়ীর (সরাই) দরজায় পঁহুছিলেন, তখন তলোয়ার খুলিয়া হিন্দুদিগকে আক্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

 “তখন রায় লখ্‌মনিয়া আহারে উপবিষ্ট হইয়াছিলেন। তাঁহার নিকট সঠিক খবর পঁহুছিবার পূর্ব্বেই, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার বাড়ীর ভিতর ঢুকিয়া পড়িয়াছিলেন। তখন বৃদ্ধ রায় নগ্নপদে বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগ দিয়া বাহির হইয়া, সঙ্কনাতে ও বঙ্গে প্রস্থান করিলেন। তথায় অল্পকাল পরেই তাঁহার রাজত্বের পরিসমাপ্তি হইয়াছিল।”[৪৩]

 লক্ষ্মণসেনের কাপুরুষতায় বাঙ্গালা তুরূষ্কের পদানত হইল, ইদানীং অনেকেই এ কথা বলিয়া থাকেন। কিন্তু মিন্‌হাজুদ্দীন যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহার প্রতি অক্ষরও যদি সত্য হয়, তাহা হইলে লখ্‌মনিয়াকে বা লক্ষ্মণসেনকে “কাপুরুষ” না বলিয়া, বীরাগ্রগণ্য বলিয়া পূজা করাই সঙ্গত। শাস্ত্রের দোহাই দিয়া, সকলে নোদিয়া ছাড়িয়া সুদূর কামরূপে ও বঙ্গে পলায়ন করিলেন, কিন্তু বৃদ্ধ বীর লখ্‌মনিয়া নোদিয়া ছাড়িয়া এক পদও নড়িলেন না, একটি জনশূন্য রক্ষিশূন্য রাজধানীতে একটি বৎসর শত্রুর প্রতীক্ষায় রছিলেন। যখন শত্রু আসিল, তখন যে অপাত্রের হস্তে নগরদ্বার-রক্ষার ভার অর্পিত হইয়াছিল, তাহারা তুরূষ্ক সওয়ারগণকে ঘোড়ার সওদাগর ভ্রমে বাধা দিল না। সতত শত্রুর প্রতীক্ষাকারী নগরদ্বার-রক্ষকগণ সশস্ত্র অশ্বারোহীদিগকে ঘোড়ার সওদাগর ভ্রমে নগর প্রবেশ করিতে দেয়, মিন্‌হাজুদ্দীন ভিন্ন আর কোন ঐতিহাসিক এরূপ অদ্ভুত ঘটনা বর্ণনার অবসর পাইয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। যখন রাজভবনে প্রবেশ করিয়া, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার হত্যাকাণ্ড আরম্ভ করিয়াছিলেন, তখন খবর পাইয়া, যদি রক্ষকহীন অশীতিবর্ষের বৃদ্ধ রাজা সরিয়া যাওয়া সঙ্গত মনে করিয়া থাকেন, তবে তাঁহাকে কাপুরুষ বলা যায় না।

 তথাপি লক্ষ্মণসেনের “নোদিয়া” হইতে পলায়ন-কাহিনী প্রকৃত ঘটনা বলিয়া স্বীকার করা যায় না;—তাহা অজ্ঞ লোকের পরিকল্পিত উপকথা মাত্র। বিশ্বরূপ এবং কেশব নামক লক্ষ্মণসেনের অন্যূন দুইটি পুত্র ছিল; তিনি যাঁহাকে বালে রাজপণ্ডিত-পদ, যৌবনে প্রধান মন্ত্রি-পদ, এবং যৌবনান্তে যৌবনশেষযোগ্য ধর্ম্মাধিকারির পদ প্রদান করিয়াছিলেন, হলায়ুধের ন্যায় এরূপ হাতেগড় অমাত্য ছিল; এবং তিনি যাঁহাদিগকে লইয়া কাশী হইতে কামরূপ পর্য্যন্ত যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন, এরূপ সৈন্যসামন্তও ছিল। মিন্‌হাজ লখ্‌মনিয়াকে যেরূপ প্রজারঞ্জনকারী এবং দানশীল রাজা বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে মনে হয়, তিনি অনেকের ভক্তিও আকর্ষণ করিয়াছিলেন। সুতরাং, এরূপ নৃপতিকে বার্দ্ধক্যে সকলে দল বাঁধিয়া শত্রুর দ্বারা পদদলিত হইবার জন্য “নোদিয়ায়” ফেলিয়া আসিবে, এবং এক বৎসর পর্য্যন্ত তাঁহার কোন খোঁজ খবর লইবে না, ইহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। অনুমান হয়—যখন “ব্রাহ্মণগণ” এবং “ব্যবসায়িগণ” নোদিয়া ত্যাগ করিয়াছিলেন, “নোদিয়ার” অধীশ্বরও তখনই রাজধানী ত্যাগ করিয়া বঙ্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক এরূপ নির্ব্বিবাদে পশ্চিম-বরেন্দ্র অধিকারের প্রকৃত কারণ এই যে,—যখন মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক মগধ আক্রমণের সংবাদ বিজয়পুরে পঁহুছিয়ছিল, তখনই হয়ত ভয়াতুর মন্ত্রিবর্গের উপদেশে লক্ষ্মণসেন (পূর্ব্ব) বঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন; এবং তাহার অনতিকাল পরে [তুরূষ্ক নায়কের “দোয়ম সালে”, নোদিয়া-আক্রমণের পূর্ব্বে] পরলোক গমন করিয়া থাকিবেন। লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণের যে দুইখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার একখানিতে লক্ষ্মণসেন-পাদানুধ্যাত বিশ্বরূপসেনের নাম উৎকীর্ণ রহিয়াছে; এবং আর একখানিতে অপর একটি নাম বিলুপ্ত করিয়া, লক্ষ্মণসেন-পাদানুধ্যাত কেশবসেনের নাম উৎকীর্ণ রহিয়াছে। ইহাতে মনে হয়,—লক্ষ্মণসেনের অভাবে, সিংহাসন লইয়া পুত্রগণের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল। লক্ষ্মণসেনের পরলোকগমনের অব্যবহিত পরে,—এই ভ্রাতৃবিরোধ-বহ্নি প্রধূমিত হইবার সময়ে,—মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার পশ্চিম বরেন্দ্র অধিকার করিবার অবসর পাইয়া থাকিবেন।

 সন্ধ্যাকর নন্দী-বর্ণিত এই প্রজা-বিদ্রোহের কিছু কিছু আভাস তৎকালের তাম্রশাসনে এবং শিলালিপিতেও পাওয়া যায়। কামরূপের রাজা বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে রামপাল সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে (৪ শ্লোক):—

 “যুদ্ধ-সাগর লঙ্ঘন করিয়া, ভীমরূপ রাবণ বধ করিয়া, জনকভূ উদ্ধার করিয়া, রামপাল ত্রিজগতে দাশরথি রামের ন্যায় যশ বিস্তার করিয়াছিলেন।”

 “রামপালচরিতের” টীকাকারের মতানুসারে, “জনকভূ” বরেন্দ্রী-অর্থে গ্রহণ করিলে, এই শ্লোকেও কৈবর্ত্ত-বিদ্রোহের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯০৮ সালের মার্চ্চ মাসে সারনাথের ভগ্নস্তূপের একাংশ খননকালে আবিষ্কৃত একখানি শিলালিপিতে[৪৪] “রামপালচরিতে” উল্লিখিত কয়েক জন পাত্রের এবং কোন কোন ঘটনার উল্লেখ দৃষ্ট হয়। কান্যকুব্জের গহড়বাল-রাজ গোবিন্দচন্দ্রের অন্যতমা মহিষী কুমরদেবী কর্ত্তৃক একটি বৌদ্ধবিহার-প্রতিষ্ঠা-উপলক্ষে এই শিলালিপি উৎকীর্ণ হইয়াছিল। ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে,—“পীঠিকা”র বা “পীঠী”র দেবরক্ষিত নামক এক জন রাজা ছিলেন।

“गौड़ेद्वैतभटः सकाण्ड-पटिकः क्षत्रैक-चूड़ामणिः
प्रख्यातो महणाङ्गपः क्षितिभुजाम्मान्यो भवन्मातुलः।
तं जित्वा युधि देवरक्षित मधात् श्रीरामपालस्य यो
लक्ष्मीं निर्जित-वैरि-रोधनतया देदीप्यमानोदयाम्॥”

 “গৌড়ে অদ্বিতীয় যোদ্ধা, ধনুর্দ্ধর (?), ক্ষত্রকুলের একমাত্র চূড়ামণি, নরপালগণের সম্মানার্হ মাতুল, মহন নামক অঙ্গপতি ছিলেন। তিনি দেবরক্ষিতকে পরাজিত করিয়া, শক্রর বাধা বিদূরিত হওয়ায়, অধিকতর উজ্জ্বল শ্রীরামপালের রাজলক্ষ্মী অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন।”

 “রামপালচরিতে” [২।৮ শ্লোকের টীকায়] রামপালের মাতুল মহন কর্ত্তৃক পীঠীপতি দেবরক্ষিতের পরাজয় উল্লিখিত হইয়াছে। কুমরদেবীর এই শিলালিপির সাহায্যে রামপালের রাজত্বের সময় নিরূপণ করা যাইতে পারে। এই লিপিতে উক্ত হইয়াছে,—মহনদেব শঙ্করদেবী নাম্নী দুহিতাকে পীঠীপতির করে অর্পণ করিয়াছিলেন। কুমরদেবী এই শঙ্করদেবীর কন্যা, এবং গোবিন্দচন্দ্রের মহিষী। কুমরদেবী এবং গোবিন্দচন্দ্রের বংশাবলী পাশাপাশি রাখিলে দেখা যায়,—

 
 
 
পিতা
 
 
 
 
 পিতা
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
অঙ্গাধিপ মহনদেব।
 
ভগিনী=তৃতীয় বিগ্রহপাল-পত্নী।
 
গাহড়বাল চন্দ্রদেব।
(খৃঃ অঃ + ১০৯০-১০৯৭ +)
 
 
 
 
 
 
 
শঙ্করদেবী।রামপাল।মদনচন্দ্র।
 
 
 
 
 
কুমরদেবী।
 
 
 
 
 
 
গোবিন্দচন্দ্র।
(খৃঃ অঃ + ১১১৪-১১৫৪ +)
 
 
 
 
 
 

 অর্থাৎ মহনদেব গাহড়বাল-রাজ চন্দ্রদেবের সমকালবর্ত্তী ছিলেন। মহনদেব এবং রামপাল, সম্পর্কে মামা-ভাগিনেয় হইলেও, উভয়ে সম্ভবত সমবয়সী ছিলেন। “রামপালচরিতে” উক্ত হইয়াছে (৪।৮-১০ শ্লোক), মহনদেব (মথন) পরলোক গমন করিয়াছেন শুনিয়া, “মুদ্গিরিতে” (মুঙ্গেরে) অবস্থিত রামপাল গঙ্গাগর্ভে প্রবেশ করত তনুত্যাগ করিয়াছিলেন। সুতরাং রামপাল কান্যকুব্জ-রাজ চন্দ্রদেবের সমসাময়িক, এবং একাদশ শতাব্দের শেষ পাদ পর্য্যন্ত গৌড়-রাজ্যের রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।

 “রামপালচরিতের” যে অংশে ভীমের বন্ধনের পরবর্ত্তী ঘটনা সকল বর্ণিত হইয়াছে, তাহার টীকা নাই। মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের মতানুসারে, ভীম ধৃত হইলে, তদীয় সুহৃৎ হরি, ছত্রভঙ্গ বিদ্রোহী সেনা পুনঃ সম্মিলিত করিয়া, যুদ্ধার্থ অগ্রসর হইয়াছিলেন। ভীষণ যুদ্ধের পর, হরি ধৃত এবং নিহত হইয়াছিলেন। ভীমও সম্ভবত নিহত হইয়াছিলেন। এই রূপে বিদ্রোহানল নির্ব্বাপিত হইলে, পালবংশের জন্মভূমি [জনকভূ] আবার পাল-নরপালের হস্তগত হইয়াছিল।

 বিদ্রোহ দমন করিয়া, রামপাল “রামাবতী” নামক এক নূতন নগর নির্ম্মাণ করিয়া, বরেন্দ্রভূমির শোভাবর্দ্ধন করিয়াছিলেন। তিনি এক দিকে যেমন অভিনব নগর-নির্ম্মাণে রত ছিলেন, আর এক দিকে তেমনি নষ্টপ্রায় গৌড়-রাজশক্তির পুনরুজ্জীবন-সাধনে যত্নবান হইয়াছিলেন। সন্ধ্যাকর লিখিয়াছেন—পূর্ব্বদিকের এক জন নরপতি, পরিত্রাণ পাইবার জন্য, রামপালকে বর-বারণ, নিজের রথ এবং বর্ম্ম উপহার প্রদান করিয়াছিলেন। যথা—

“स्वपरित्राण-निमित्तं पत्या यः प्राग्दिशीयेन।
वर-वारणेन च निज-स्यन्दन-दानेन वर्म्मणाराधे॥” ३৷४४॥

 বরেন্দ্রবাসী সন্ধ্যাকর যাঁহাকে “প্রাগ্দিশীয়” বলিয়াছেন, তিনি সম্ভবত বাঙ্গালার পূর্ব্ব সীমান্তের কোন পার্ব্বত্য-প্রদেশের নৃপতি। রামপাল কামরূপ জয় করিয়া, গৌড়রাষ্ট্রভুক্ত করিয়াছিলেন [“বিগ্রহনির্জ্জিতকামরূপভৃৎ”]। এই কামরূপ-জয় যে সন্ধ্যাকর নন্দীর কল্পনা-প্রসূত নহে, কুমারপালের প্রসঙ্গে আমরা তাহা দেখিতে পাইব। রামপাল উৎকলে এবং কলিঙ্গেও স্বীয় প্রাধান্য-স্থাপনের চেষ্টা করিয়াছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দী লিখিয়াছেন—

“भवभूषण-सन्ततिभूव मनुजग्राह जित मुत्कलत्रं यः।
जगदवतिस्म समस्तं, कलिङ्गत स्तान् निशाचरान् निघ्रन्॥”३৷४५॥

 “ভবভূষণ (চন্দ্রের) সন্ততির রাজ্য উৎকল জয় করিয়া, তৎপ্রতি যিনি অনুগ্রহ করিয়াছিলেন, এবং চৌরগণকে নিহত করিয়া, কলিঙ্গ হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত জগৎ প্রতিপালন করিয়াছিলেন।”

 রামপাল যখন গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত, তখন গঙ্গ-বংশীয় অনন্তবর্ম্মা-চোড়গঙ্গ [রাজত্ব ১০৭৮-১১৪২ খৃষ্টাব্দ] কলিঙ্গের রাজা ছিলেন, এবং তিনিই উৎকল অধিকার করিয়াছিলেন। গঙ্গ-বংশীয় নৃপতিগণ চন্দ্র বংশোদ্ভব বলিয়া পরিচিত ছিলেন।[৪৫] সুতরাং এ স্থলে সন্ধ্যাকর নন্দী চোড়-গঙ্গকে স্মরণ করিয়াই, উৎকলকে “ভবভূষণ-সন্ততিভূ” বলিয়াছেন।[৪৬] কিন্তু রামপাল কর্ত্তৃক চোড়-গঙ্গের এই পরাজয়-কাহিনী কতদূর সত্য, তাহা নির্ণয় করা কঠিন। গঙ্গ-বংশীয় নৃপতিগণের মধ্যে চোড়-গঙ্গ সর্ব্বাপেক্ষা পরাক্রান্ত ছিলেন। গঙ্গ-বংশীয় নৃপতিগণের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—চোড়-গঙ্গ গঙ্গার তীর পর্য্যন্ত স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন, এবং গঙ্গাতীরবর্ত্তী যুদ্ধক্ষেত্রে “মন্দারাধিপতিকে” পরাজিত এবং আহত করিয়াছিলেন।[৪৭] এই সূত্রেই হয়ত কলিঙ্গ-পতির সহিত গৌড়-পতির সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল, এবং কলিঙ্গ-পতিকে প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুগ্রহ প্রার্থনা করিতে হইয়াছিল। চোড়-গঙ্গের অতি দীর্ঘকালব্যাপী রাজত্বের প্রথম ভাগে, তাঁহাকে রামপালের সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল। সেই সময়, গৌড়াধিপের নিকট মস্তক অবনত করা অসম্ভব নহে; এবং রামপালের মৃত্যুর পর, হয়ত চোড়-গঙ্গ প্রবলতর হইয়াছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দী যে সত্যের অপলাপ করেন নাই, কুমরদেবীর সারনাথের শিলালিপি এবং বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন তাহার সাক্ষ্যদান করিতেছে। সুতরাং তাঁহার বর্ণিত রামপালের কলিঙ্গ-জয়-কাহিনী অমূলক বলিয়া উপেক্ষিত হইতে পারে না। রাঢ়ও অবশ্য রামপাল কর্ণাট-রাজের কবল হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন। দেবপাড়ার শিলালিপি-অনুসারে, সামন্তসেন যে সকল কর্ণাটলক্ষ্মী-লুণ্ঠনকারী দুর্বৃত্তগণকে বিনষ্ট করিয়াছিলেন, তাহারা গৌড়াধিপেরই সেনা। সামন্তসেন এই সকল “দুর্বৃত্তগণকে” বিনাশ করিয়াও, রাঢ়ে কর্ণাট-রাজের আধিপত্য অটুট রাখিতে না পারিয়া হয়ত শেষ বয়সে বানপ্রস্থ অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

 বরেন্দ্রভূমির বিদ্রোহানল নির্ব্বাণ করিয়া, এবং কামরূপ ও কলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করিয়া, রামপাল যে গৌড়রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, সেই অভিনব গৌড়রাষ্ট্রের সহিত রামপালের পূর্ব্বপুরুষগণের শাসিত গৌড়রাষ্ট্রের অনেক প্রভেদ ছিল। প্রজাসাধারণের নির্ব্বাচিত গৌড়াধিপ গোপালের গৌড়রাষ্ট্র, প্রজার প্রীতির এবং প্রজাশক্তির সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হতভাগ্য দ্বিতীয় মহীপালের “অনীতিকারম্ভের” ফলে, এবং দিব্বোক-নিয়ন্ত্রিত বিদ্রোহানলে, সেই ভিত্তি ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছিল। রামপালের পক্ষে, গৌড়রাজ্যের বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুনরায় একত্রিত করিয়া, উহার পুনর্গঠন সম্ভব হইলেও, সেই দেহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা,—সেই ভগ্ন অট্টালিকার বহিরঙ্গের সংস্কার সম্ভব হইলেও,—উহার নষ্টভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, অসম্ভব হইয়াছিল। সুতরাং রামপালের মৃত্যুর পরই, আবার রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে, বিদ্রোহ উপস্থিত হইল। কিন্তু রামপালের জ্যেষ্ঠ পুত্র “গৌড়েশ্বর” কুমারপালের, এবং তাঁহার প্রধান-সচিব এবং সেনাপতি, বৈদ্যদেবের বাহুবলে, গৌড়রাষ্ট্রের পতন আরও কিছু কালের জন্য স্থগিত রহিল। বৈদ্যদেবের [কমৌলিতে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে বৈদ্যদেব কর্ত্তৃক [অনুত্তর বঙ্গে) দক্ষিণবঙ্গে, নৌ-যুদ্ধে জয়লাভ-প্রসঙ্গে, পুনরায় বিদ্রোহ সূচিত হইয়াছে (১১ শ্লোক)। এই সময়ে কামরূপের সামন্ত-নরপতিও বিদ্রোহাচরণ করিয়াছিলেন। বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে—

 “পূর্ব্বদিগ্বিভাগে বহুমান-প্রাপ্ত তিম্‌গ্যদেব-নৃপতির বিদ্রোহ-বিকার শ্রবণ করিয়া, গৌড়েশ্বর তাঁহার রাজ্যে এইরূপ [গুণগ্রাম-সমন্বিত] বিপুল কীর্ত্তিসম্পন্ন বৈদ্যদেবকে নরেশ্বর-পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। সাক্ষাৎ মার্ত্তণ্ড-বিক্রম বিজয়শীল সেই বৈদ্যদেব [আপন] তেজস্বী প্রভুর আজ্ঞাকে মাল্যদামের ন্যায় মস্তকে ধারণ করিয়া, কতিপয় দিবসের দ্রুত-রণযাত্রার [অবসানে] নিজ ভুজবলে সেই অবনিপতিকে যুদ্ধে পরাভূত করিবার পর, [তদীয় রাজ্যে] মহীপতি হইয়াছিলেন (১৩-১৪ শ্লোক)।”

  1. Epigraphia Indica, Vol. IX, pp. 323-326.
  2. अजनि रजनिजानि-वंशचूड़ा-
    मणि रणिमादि-गुणेन चोड़गङ्गः॥

    Inscription of Svapnesvara, Verse 7, Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 200

  3. “রামচরিতের” ভূমিকায় শাস্ত্রী মহাশয় লিখিয়াছেন,—“He (Rāmapāla) conquered Utkala and restored it to the Nāgvamsis” ইহা দ্বারা বুঝা যায়, শাস্ত্রী মহাশয় “ভবভূষণ-সন্ততি”-পদ “নাগবংশী”-অর্থে গ্রহণ করিয়াছেন। নাগ ভবের (শিবের) ভূষণ হইলেও, নাগবংশীয় কোন রাজা উড়িষ্যায় কখনও রাজত্ব করিয়াছেন বলিয়া এ পর্য্যন্ত জানা যায় নাই। পক্ষান্তরে “রামচরিতের” (২।৫) টীকা হইতে জানা যায়, রামপালের রাজ্যলাভের অব্যবহিত পূর্ব্বে, উৎকলে “কেশরী”-উপাধিধারী একজন নৃপতি ছিলেন। ভীমের সহিত যুদ্ধোদ্যত রামপালের সহিত যাঁহারা যোগদান করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে “উৎকলেশ কর্ণকেশীর”র পরাভবকারী দণ্ডভুক্তি-ভূপতি জয়সিংহের নাম দৃষ্ট হয়।
  4. J. A. S. B., Vol. LXV, Part. p. 241.
  5. Epigraphia Indica, Vol. II, p. 349.
  6. Cunningham’s Archæological Survey Report, Vol. III, p. 125.
  7. Cunningham’s Archæological Report, Vol. III, pp. 123-124.
  8. Cf. Epigraphia Indica, Vol. I, plate 19, and the same Vol. II, plates 29–33.
  9. The Journal of the Royal Asiatic Society, New Series, Vol. VIII (1876), p. 3 and plate 2. (Cowell and Eggelling’s Catalogue of Buddhist Sanskrit Manuscripts in the possession of R. A. S.]
  10. Cunningham’s Archæological Survey Report, Vol. III, p. 125. বন্ধুবর শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই শিলালিপির একটি ছাপ তুলিয়া অনুসন্ধান-সমিতিকে প্রদান করিয়াছেন।
  11. Epigraphia Indica, Vol VII, p. 99.
  12. Bendall’s Catalogue of Buddhist Sanskrit Mss. Cambridge, p iii.
  13. শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু প্রণীত “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস”, দ্বিতীয় ভাগ, ২১৫ পৃষ্ঠা ও চিত্র দ্রষ্টব্য। বসু মহাশয় বলেন,—সুলতান মামুদ কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ আক্রমণ সময়ে (১০১৮ খৃষ্টাব্দে) যিনি কান্যকুব্জের রাজা ছিলেন, তাঁহার নাম জয়পাল (কুল-গ্রন্থোক্ত জয়চন্দ্র)। “অধিক সম্ভব, পরম ধার্ম্মিক মহারাজ হরিবর্ম্মদেব কনোজপতি জয়পাল বা জয়চন্দ্রের কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন।” আবার “প্রায় আড়াই শত বর্ষ পূর্ব্বে” আবির্ভূত রাঘবেন্দ্র কবিশেখর “প্রাচীন লোকদিগের মুখে শুনিয়া এবং প্রাচীন কুলগ্রন্থ সকল দেখিয়া” যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা হইতে জানা যায়, হরিবর্ম্মদেব যখন “গৌড়োড্রবঙ্গাধিপ”, তখন কান্যকুব্জে “যবনাগমন” ও “রাজ্যনাশ” দেখিয়া, গঙ্গাগতি প্রভৃতি বহু ব্রাহ্মণ বঙ্গে আসিয়াছিলেন। অতএব হরিবর্ম্মা সুলতান মামুদ ও জয়চন্দ্রের বা জয়পালের সমসাময়িক। সুলতান মামুদের আক্রমণ-সময়ে যিনি কান্যকুব্জের অধীশ্বর এবং মুসলমান লেখকগণ যাঁহাকে “রায় জয়পাল” বলিয়া উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, তিনি প্রতীহার-রাজ রাজ্যপাল, এ কথা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। কুলগ্রন্থ এই রাজ্যপালের কোন খবর দিতে পারে কিনা জানি না। সুতরাং এই হিসাবে হরিবর্ম্মার সময় নিরূপণের জন্য বসুমহাশয় যে সকল যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা অমূলক। হরিবর্ম্মার আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে প্রধান সাক্ষী হরিবর্ম্মার তাম্রশাসনের এবং ভট্টভবদেবের ভুবনেশ্বর-প্রশস্তির অক্ষর। বসু মহাশয় প্রকাশিত উক্ত তাম্রশাসনের অস্পষ্ট প্রতিকৃতির যে কয়টি অক্ষর বুঝা যায়, তাহা বিজয়সেনের দেবপাড়া প্রশস্তির অনুরূপ। দৃষ্টান্তস্থলে আমরা ত, ম, এবং সএর উল্লেখ করিব। ভট্ট-ভবদেবের ভুবনেশ্বর-প্রশস্তি সম্বন্ধে কিল্‌হর্ণ লিখিয়াছেন,–“On palæographical grounds I do not hesitate to assign this record, like the preceding one, to about A. D. 1200 (Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 205).” কিল্‌হর্ণ “preceding one” বলিয়া যে লিপির উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা ত্রিকলিঙ্গপতি প্রথম অনিয়ঙ্কভীমের সময়ের স্বপ্নেশ্বরদেবের প্রশস্তি। প্রথম অনিয়ঙ্কভীম ১১৯২ খৃষ্টাব্দে কলিঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, দশ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। সুতরাং স্বপ্নেশ্বরদেবের শিলালিপির সময় সম্বন্ধে আর কোন সংশয় হইতে পারে না। ভট্টভবদেবের প্রশস্তির অক্ষর স্বপ্নেশ্বরের লিপির ঠিক অনুরূপ বলিয়া, কিল্‌হর্ণ এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া গিয়াছেন। কিল্‌হর্ণ-কথিত ঠিকঠাক ১২০০ খৃষ্টাব্দ ভট্ট-ভবদেবের প্রশস্তির কাল না হইলেও, অক্ষরের হিসাবে, হরিবর্ম্মার তাম্রশাসন এবং ভবদেবের প্রশস্তি দ্বাদশ শতাব্দের পূর্ব্বে ঠেলিয়া লওয়া যায় না।
  14. রাজসাহীর রাণী হেমন্তকুমারী-সংস্কৃতকলেজের স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক বিক্রমপুর-নিবাসী পণ্ডিতবর শ্রীযুত বামনদাস বিদ্যারত্ন মহাশয় লেখককে যে পাতড়া দিয়াছেন, তাহার আরম্ভে এই শ্লোকটি আছে। তৎপরে আর ১৩টি শ্লোকে পঞ্চব্রাহ্মণের আগমনবৃত্তান্ত বর্ণিত হইয়াছে, এবং উপসংহারে আছে—“ইতি আদিশূর-ব্যাখ্যানং সমাপ্তং।” বিদ্যারত্ন মহাশয় বলেন, এই শ্লোক কয়টি “কুলরমার” সূচনায় দৃষ্ট হয়। আমার পরীক্ষিত রাঢ়ীয় কুলগ্রন্থ মধ্যে ধ্রুবানন্দমিশ্রের “মহাবংশাবলী”-গ্রন্থে কান্যকুব্জ হইতে পঞ্চব্রাহ্মণ আগমনের কোন উল্লেখ নাই। ধ্রুবানন্দ “নত্বা তাং কুলদেবতাং” ইত্যাদি শ্লোকে মঙ্গলাচরণ করিয়া আরম্ভ করিয়াছেন—

    “आयितो बहुरूपाख्यः शिरो गोवर्द्धनः सुधीः।
    गां शिशो मकरन्दश्च जाल्वनाख्यः समा इमे॥”

    মহেশের “নির্দ্দোষ কুলপঞ্জিকায়”—

    “क्षितीशो तिथिमेधा[च] वीतरागः सुधानिधिः।
    सौभरिः पञ्चधर्म्मात्मा आगता गौड़-मण्डले॥”

    এই পর্য্যন্ত উল্লিখিত হইয়াছে, আদিশূরের নাম নাই।

  15. বারেন্দ্র-কুলপঞ্জিকার ঐতিহাসিক অংশ “আদিশূর রাজার ব্যাখ্যা” নামে পরিচিত। লালোর-নিবাসী শ্রীযুত মনোমোহন মুকুটমণির, মাঝগ্রামের শ্রীযুত জানকীনাথ সার্ব্বভৌমের, এবং রামপুর-বোয়ালিয়ার শ্রীযুত নৃত্যগোপাল রায় মহাশয়-সংগৃহীত পুঠিয়া নিবাসী ৺ মহেশচন্দ্র শিরোমণির ঘরের পুস্তক মধ্যে পাঁচ প্রকার “আদিশূর রাজার ব্যাখ্যার” পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তন্মধ্যে দুই খানিতে বল্লালসেন আদিশূরের দৌহিত্র-বংশোদ্ভব বলিয়া কথিত। উপরে তাহা উদ্ধৃত হইল। “গৌড়েব্রাহ্মণ”-গ্রন্থে (দ্বিতীয় সংস্করণ, ৯৬ পৃ) উদ্ধৃত একটি শ্লোকে কথিত হইয়াছে—রাজা শ্রীধর্ম্মপাল ভট্টনারায়ণের পুত্র আদিগাঞিকে যজ্ঞান্তে দক্ষিণা-দানার্থ ধামসার গ্রাম দান করিয়াছিলেন। শ্রীযুত নগেন্দ্রনাথ বসুর মতানুসারে, এই ধর্ম্মপালকে যদি পালবংশীয় ধর্ম্মপাল মনে করা যায়, তবে আদিশূরকে ধর্ম্মপালের পিতা গোপালের তুল্যকালীন বিবেচনা করিতে হয়। এইরূপ সিদ্ধান্ত “গৌড়ে ব্রাহ্মণে” ধৃত (৮৩ পৃঃ) “ভাদুড়ি-কুলের বংশাবলীর” নিম্নোক্ত বচনের বিরোধী—

    “तत्रादिशूरः शूरवंशसिंहो विजित्य वौद्धं नृपपालवंशं।
    शशास गौड़ं इत्यादि।

    “গৌড়েব্রাহ্মণ”-ধৃত এই শেষোক্ত বচন আবার শ্রীযুত নগেন্দ্রনাথ বসু কর্ত্তৃক “বারেন্দ্র-কুলপঞ্জিকা”-ধৃত, “শাকে বেদকলম্বষট্‌ক-বিমিতে রাজাদিশূরঃ স চ” (“বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, প্রথম ভাগ, ৮৩ পৃঃ) এই বচনের, অর্থাৎ আদিশূর ৬৫৪ শকাব্দে বর্ত্তমান ছিলেন এই মতের, বিরোধী। যে যে কুলজ্ঞগণের সহিত আলাপ করিয়াছি, তাঁহারা এই সকল বচনের কোনটির বিষয়ই অবগত নহেন। সুতরাং এই সকল বচন প্রবল জনশ্রুতিমূলক বলিয়া স্বীকার করা যায় না। আদিশূর সম্বন্ধে যদি কোনও জনশ্রুতি নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হয়, তবে তাহা উপরে উদ্ধৃত আদিশূর ও বল্লালসেনের সম্বন্ধবিষয়ক জনশ্রুতি। “গৌড়ব্রাহ্মণ”-ধৃত “ভাদুড়ী-কুলের বংশাবলীর” বচন প্রকারান্তরে ইহারই পোষকতা করে; এবং “লঘুভারতকার”ও আদিশূর কর্ত্তৃক গৌড়ের পালবংশ উচ্ছেদের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন (“গৌড়েব্রাহ্মণ”, ৩২ পৃঃ ৪নং টীকা)।

  16. ১০৯ পৃঃ, টীকা।
  17. Keilhorn’s List of Northern Inscriptions, Appendix to Epigraphia Indica, Vol V.
  18. Deutsche Morganlandische Gesselschaft.
  19. Epigraphia Indica, Vol. I, p.
  20. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1888, Part I, p. 2.
  21. J. A. S. B., 1896, Part I, p. 23. India office-এর পুস্তকালয়ে যে এক খণ্ড, “দানসাগর” আছে, তাহার উপসংহারেও, এই শ্লোকার্দ্ধ আছে। (Eggeling’s Catalogue, p. 545)। রাজসাহী কলেজের সংস্কৃতাধ্যাপক শ্রদ্ধাভাজন পণ্ডিত শ্রীযুত শ্রীশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী মহাশয় বলেন,—তিনি সিভিলিয়ান Mr. Rankingএর নিকট একখণ্ড “দানসাগর” দেখিয়াছিলেন; তাহাতেও এই শ্লোক আছে।
  22. Bhandarkar’s Report on the search for Sanskrit Manuscripts during 1887–88 and 1890-91, p. lхххv.
  23. Epigraphia Indica, Vol. viii, Synchronous Table for Northern India, A. D. 400-1400; column 7.
  24. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1906, p. 17 note.
  25. সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৭শ ভাগ (১৩১৮), ২১৪ এবং ২১৬ পৃঃ।
  26. Cunningham’s Archæological Survey Report, Vol. III, plate রাখালবাবু অনুসন্ধান-সমিতিকে এই শিলা-লিপির একখানি প্রতিলিপি প্রদান করিয়া উপকৃত করিয়াছেন।
  27. J. A. S. B., 1896, Part, I, plates I and II.
  28. J. A. S. B., 1874, Part I, plate XVIII.
  29. Epigraphia Indica, Vol. V, plates 19-20.
  30. Epigraphia Indica, Vol. V. pp. 184.

    “येनापास्त-समस्त-शस्त्र-समयः संग्रामभूमौ रिपु
    श्चक्रे वङ्ग-करीन्द्र-सङ्ग-विषमे साटोप-युद्धोत्‌सवे।
    येनात्यर्थमयं स्वयं सफलित स्त्रैलोक्यसिंहो विधिः
    सोभूद्भास्कर-वंश-राजतिलको रायारिदेवो नृपः॥”

  31. Raverty’s “Tabakat-i-Nasiri”, p. 105, note 4.
  32. Ibid., p. 107.
  33. Ibid, p. 110.
  34. Epigraphia Indica, Vol. IX, p. 324.
  35. Indian Antiquary, Vol. XIX, p. 215. মনুসংহিতার (২৷২২ শ্লোকের) ভাষ্যে মেধাতিথি আর্য্যাবর্ত্তের এই রূপ অর্থ লিখিয়াছেন—“आर्य्या वर्त्तन्ते यत्र पुनः पुनरूद्भवम्त्राकस्याकस्यापि न चिरं यत्र म्लेच्छाः स्यातारी भवन्ति।” প্রশস্তিকার এইরূপ অর্থেই এখানে আর্য্যাবর্ত্ত-শব্দের ব্যবহার করিয়াছেন।
  36. Epigraphia Indica, Vol. IV, p. 119.
  37. Raverty's Tabakat-i-Nasiri, App. D.
  38. Raverty’s Tabakat-i-Nasiri, pp. 551-552.
  39. Raverty, pp. 554-536. Text, pp. 148-149.
  40. Jarrett’s Ain-i-Akbari, Vol. II, p. 148.
  41. Text (Bibliotheca Indica), Vol. I, p. 58.
  42. Raverty’s Tabakat-i-Nasiri, p. 569; Text, p. 151.
  43. Raverty, pp. 556-558. Text, 150-151.
  44. Epigraphia Indica, Vol. IX, pp. 323-326.
  45. अजनि रजनिजानि-वंशचूड़ा-
    मणि रणिमादि-गुणेन चोड़गङ्गः॥

    Inscription of Svapnesvara, Verse 7, Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 200

  46. “রামচরিতের” ভূমিকায় শাস্ত্রী মহাশয় লিখিয়াছেন,—“He (Rāmapāla) conquered Utkala and restored it to the Nāgvamsis” ইহা দ্বারা বুঝা যায়, শাস্ত্রী মহাশয় “ভবভূষণ-সন্ততি”-পদ “নাগবংশী”-অর্থে গ্রহণ করিয়াছেন। নাগ ভবের (শিবের) ভূষণ হইলেও, নাগবংশীয় কোন রাজা উড়িষ্যায় কখনও রাজত্ব করিয়াছেন বলিয়া এ পর্য্যন্ত জানা যায় নাই। পক্ষান্তরে “রামচরিতের” (২।৫) টীকা হইতে জানা যায়, রামপালের রাজ্যলাভের অব্যবহিত পূর্ব্বে, উৎকলে “কেশরী”-উপাধিধারী একজন নৃপতি ছিলেন। ভীমের সহিত যুদ্ধোদ্যত রামপালের সহিত যাঁহারা যোগদান করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে “উৎকলেশ কর্ণকেশীর”র পরাভবকারী দণ্ডভুক্তি-ভূপতি জয়সিংহের নাম দৃষ্ট হয়।
  47. J. A. S. B., Vol. LXV, Part. p. 241.