গৌড়রাজমালা/রামপাল
মহীপাল, শূরপাল, এবং রামপাল, এই তিন পুত্র বর্ত্তমান রাখিয়া, তৃতীয় বিগ্রহপাল পরলোক গমন করিয়াছিলেন। “রামচরিত”-কাব্যে তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্রের এবং পৌত্রগণের রাজত্বের ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে।[১] “রামচরিত”-রচয়িতা সন্ধ্যাকর নন্দী বরেন্দ্রী-মণ্ডলে “শ্রীপৌণ্ড্রবৰ্দ্ধনপুর-প্রতিবদ্ধ” ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার পিতা প্রজাপতি নন্দী পাল-নরপালের “সান্ধি[বিগ্রহিক] বা সন্ধি এবং যুদ্ধ বিষয়ের উপদেষ্টা ছিলেন।” সন্ধ্যাকর “রামচরিতের” উপসংহারে (৪।৪৮) প্রার্থনা করিয়াছেন, [রামপালের দ্বিতীয় পুত্র] রাজা মদন[পাল] “চিরায় রাজ্যং কুরুতাং”। সুতরাং “রামচরিত” তুল্যকালীন কবির রচিত ঐতিহাসিক কাব্য। সন্ধ্যাকর নন্দী “কবি-প্রশস্তিতে” এই কাব্য সম্বন্ধে লিখিয়াছেন—
“अवदानम् रघुपरिवृढ़-गौड़ाधिप-रामदेवयो रेतत्।
कलियुग-रामायण मिह कवि रपि कलिकाल-वाल्मीकिः॥११॥”
“রঘুপতি রামের এবং গৌড়াধিপ রাম[পালের] এই চরিত কলিযুগের রামায়ণ, এবং [এই কাব্যের] কবিও কলিকালের বাল্মীকি।”
“রামচরিতের” প্রথম পরিচ্ছেদের সমস্ত শ্লোকের (১-৫০) এবং দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ১-৩৫ শ্লোকের টীকা আছে; কিন্তু অবশিষ্ট অংশের টীকা পাওয়া যায় নাই। কবি মূল শ্লোকে ঐতিহাসিক ঘটনার এরূপ সামান্য আভাস দিয়াছেন যে, টীকা ব্যতীত তাহা বুঝা কঠিন। “রামচরিত” হইতে ইতিহাসের উপাদান আহরণে টীকাই আমাদের প্রধান আশ্রয়। সুতরাং যে অংশের টীকা নাই, সেই অংশের ঐতিহাসিক তাৎপর্য্য-গ্রহণ দুঃসাধ্য।
“রামচরিতে” বর্ণিত হইয়াছে—(তৃতীয়) বিগ্রহপাল পরলোক গমন করিলে, (দ্বিতীয়) মহীপাল সিংহাসন লাভ করিয়া, দুষ্কার্য্যরত [অনীতিকারম্ভরত] হইয়াছিলেন, এবং কনিষ্ঠ শূরপালকে এবং রামপালকে লৌহ-নিগড়ে নিবদ্ধ করিয়া, কারাগারে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। তখন কৈবর্ত্ত-জাতীয় দিব্য বা দিব্বোক, যুদ্ধে মহীপালকে নিহত করিয়া, “জনকভূ” বা পাল-রাজগণের জন্ম-ভূমি বরেন্দ্র অধিকার করিয়াছিলেন (১।২৯, ৩১-৩৯), এবং দিব্বোকের অনুজ রূদোকের পুত্র ভীম বরেন্দ্রীর রাজপদে অধিরূঢ় হইয়াছিলেন (১।৪০)। বরেন্দ্রী ত্যাগ করিয়া, গৌড়-রাজ্যের অন্যান্য প্রদেশের সামন্তগণকে একত্রিত করিবার জন্য, রামপাল রাঢ়-অঙ্গ-মগধাদি প্রদেশ-পর্য্যটনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন; এবং বরেন্দ্রীর অবস্থা পর্য্যবেক্ষণের জন্য, মহাপ্রতীহার শিবরাজকে প্রেরণ করিয়াছিলেন। ক্রমে সামন্ত-চক্র রামপালের সহিত মিলিত হইয়াছিল। মগধের অন্তর্গত পীঠির রাজা দেবরক্ষিতের পরাভবকারী [রামপালের মাতুল] রাষ্ট্রকূট-বংশীয় মথন বা মহন সামন্তগণের অগ্রণী ছিলেন। মহনের পুত্র কাহ্নুরদেব এবং সুবর্ণদেব, এবং তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র শিবরাজ, তাঁহার সমভিব্যাহারে ছিলেন (২।৮)। “রামপালচরিতের” টীকাকার সামন্তগণের মধ্যে এই সকলের নামোল্লেখ করিয়াছেন; (২।৫)—কান্যকুব্জ-রাজের সেনা-পরাভবকারী পীঠিপতি (মগধাধিপ) ভীমযশা, দক্ষিণদেশের রাজা বীরগুণ, উৎকলেশ কর্ণকেশরীর সেনাধ্বংসকারী দণ্ডভুক্তি-ভূপতি জয়সিংহ, দেবগ্রামপতি বিক্রমরাজ, অপর-মন্দারপতি সমস্ত-আরণ্য-সামন্তচক্র-চূড়ামণি লক্ষ্মীশূর, শূরপাল, তৈলকম্প-পতি রুদ্রশেখর, উচ্ছাল-পতি ময়গলসিংহ, ডেক্করীয়-রাজ প্রতাপসিংহ, কযঙ্গলপতি নরসিংহাৰ্জ্জুন, সঙ্কটগ্রামীয় চণ্ডার্জ্জুন, নিদ্রাবলীর বিজয়রাজ, কৌশাম্বীপতি দ্বোরপবর্দ্ধন এবং পদুবন্বা-পতি সোম।
এই মহাবাহিনী লইয়া, রামপাল নৌকায় গঙ্গাপার হইয়াছিলেন। পাল-রাজের সেনার সহিত কৈবর্ত্ত-রাজের সেনার ভীষণ যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছিল। অবশেষে করিপৃষ্ঠে অবস্থিত তীম বন্দী হইয়াছিলেন (২।১২-২০)। এই উপলক্ষে সন্ধ্যাকর এক পক্ষে সাগর এবং অপর পক্ষে ভীমের চরিত্রের বর্ণনা করিয়াছেন। শ্লেষের অনুরোধেই হউক, আর সত্যের অনুরোধেই হউক, ভীমের চিত্র উজ্জ্বল বর্ণে অঙ্কিত হইয়াছে। সাগরের ন্যায় ভীমও “লক্ষ্মী এবং সরস্বতী উভয়ের আবাস” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। ভীমকে নৃপতি রূপে প্রাপ্ত হইয়া, “বিশ্ব অতিশয় সম্পৎ লাভ করিয়াছিল,” এবং “সজ্জনগণ অযাচিত দান লাভ করিয়াছিল।” ভবানীর সহিত ভবানীপতি অধর্ম্মত্যাগী রাজা ভীমের উপাস্য দেবতা ছিলেন (২।২১-২৭)।