গৌড়রাজমালা/তৃতীয় বিগ্রহপাল

 নয়পালের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী তৃতীয় বিগ্রহপাল, তাঁহার রাজত্বের দ্বাদশ কি ত্রয়োদশ বৎসরে উৎকীর্ণ [আমগাছিতে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে, “শক্রকুল-কালরুদ্র” এবং “বিষ্ণু অপেক্ষাও অধিক সংগ্রাম-চতুর” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন।[] সন্ধ্যাকর নন্দীর “রামচরিতে” তৃতীয় বিগ্রহপালের সংগ্রাম-চতুরতার কথঞ্চিৎ পরিচয় পাওয়া যায়। সন্ধ্যাকর নন্দী লিখিয়াছেন (১।৯):—“বিগ্রহপাল দাহলাধিপতি [কলচুরি] কর্ণকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাকে উন্মূলিত করিয়াছিলেন না; তাঁহার দুহিতা যৌবনশ্রীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন।” বিবাদপ্রিয় কর্ণই, সম্ভবত নয়পালের মৃত্যুর পর, আবার গৌড়-রাজ্য আক্রমণ করিতে আসিয়া, পরাভূত হইয়া কন্যাদান করিয়া, গৌড়াধিপের প্রতি অর্জ্জন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

 কিন্তু তৃতীয় বিগ্রহপালের আমলেই, আর এক বহিঃশত্রু আসিয়া, পাল-বংশের অধঃপতনের বীজ বপন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এই অভিনব শক্র, কল্যাণের[] চালুক্যরাজ আহবমল্ল প্রথম সোমেশ্বরের (রাজত্ব ১০৪০-১০৭১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে) দ্বিতীয় পুত্র, বিক্রমাদিত্য। কুমার বিক্রমাদিত্য, পিতার আদেশক্রমে দিগ্বিজয়ে বহির্গত হইয়া, গৌড় এবং কামরূপ আক্রমণ করিয়াছিলেন। বিহ্লন “বিক্রমাঙ্কদেব-চরিতে” (৩।৭৪) এই দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গে লিখিয়া গিয়াছেনঃ—

“गायन्तिस्म गृहीत-गौड़-विजय-स्तम्बेरमस्याहवे
तस्योन्मूलित-कामरूप-नृपति-प्राज्य-प्रतापश्रियः।
भानु-स्यन्दन-चक्रघोष-मुषित-प्रत्यूषनिद्रारसाः
पूर्वाद्रेः कटकेषु सिद्धवनिताः प्रालेयशुद्धं यशः॥”[]

 “সূর্য্যের রথচক্রের শব্দে প্রত্যূষে নিদ্রাভঙ্গ হইলে, সিদ্ধ-বনিতাগণ পূর্ব্বাদ্রির কটিদেশে, যুদ্ধে গৌড়ের বিজয়হস্তী-গ্রহণকারী এবং কামরূপাধিপতির বিপুল-প্রতাপ-উন্মূলনকারী কুমার বিক্রমাদিত্যের তুষারশুভ্র যশ গান করিয়াছিল।”

 কুমার বিক্রমাদিত্য, উত্তরকালে যখন “ত্রিভুবনমল্ল পর্মাড়িদেব” উপাধি গ্রহণ করিয়া, কল্যাণের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, (১০৭৭-১১২৫ খৃষ্টাব্দ) তখন বিহ্লন কাশ্মীর হইতে আসিয়া, তাঁহার সভার “বিদ্যাপতির” বা প্রধান পণ্ডিতের পদলাভ করিয়াছিলেন। বিদ্যাপতি বিহ্লনের এই গৌড়-কামরূপ-বিজয়-কাহিনী অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হইলেও, একেবারে অমূলক নহে। বিহ্লন “বিক্রমাঙ্কদেব-চরিতে” (১৮।১০২) স্বীয় প্রভুকে “কর্ণাটেন্দু” বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন; এবং কহ্লণ “রাজতরঙ্গিনীতে” (৭।৯৩৬) বিহলনের যে বিবরণ প্রদান করিয়াছেন, তাহাতে “পর্মাড়ি-ভূপতি” বা বিক্রমাদিত্যকে “কর্ণাট” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।[] সুতরাং কর্ণাট বলিতে তৎকালে যে কল্যাণের চালুক্যগণের রাজ্য বুঝাইত, এ বিষয়ে আর সংশয় নাই। গৌড়ের সেন-রাজগণের শিলালিপিতে এবং তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায়,—এক সময়ে গৌড়-রাজ্যের একাংশের [রাঢ়ের] সহিত কর্ণাট-রাজ্যের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। সেনবংশের প্রথম নরপতি বিজয়সেনের দেবপাড়া-প্রশস্তিতে উক্ত হইয়াছে, বিজয়সেনের পিতামহ সামন্তসেন “একাঙ্গ (এক প্রকার) সেনা লইয়া, অরিকুলাকীর্ণ-কর্ণাটলক্ষ্মী-লুণ্ঠনকারি দুর্বৃত্তগণকে বিনষ্ট করিয়াছিলেন” (৮ শ্লোক); এবং শেষ বয়সে, গঙ্গাতীরবর্ত্তী পুণ্যাশ্রমনিচয়ে বিচরণ করিয়াছিলেন (৯ শ্লোক)। আবার বিজয়সেনের পুত্র বল্লালসেনের [কাটোয়ায় প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে—“চন্দ্রবংশে অনেক রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন;………তাঁহারা সদাচারপালন-খ্যাতিগর্ব্বে রাঢ়দেশকে অননুভূতপূর্ব্ব প্রভাবে বিভূষিত করিয়াছিলেন (৩ শ্লোক)।” এই রাজপুত্রগণের বংশে “শক্রসেনা-সাগরের প্রলয়-তপন সামন্তসেন জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন (8 শ্লোক)।” এই উভয় বিবরণে আপাতত বিরোধ দেখা যায়। প্রথম লিপি অনুসারে মনে হয়, সামন্তসেন শেষ বয়সে কর্ণাট ত্যাগ করিয়া, তীর্থভ্রমণ উপলক্ষে, বাঙ্গালায় আসিয়াছিলেন। দ্বিতীয় লিপিতে দেখা যায়, তাঁহার পূর্ব্বপুরুষেরা রাঢ়-নিবাসী ছিলেন। অথচ এই দুইটি লিপি প্রায় একই সময়ে রচিত। এইরূপ তুল্যকালীন লিপিতে এত বিরোধ-কল্পনা অসম্ভব। কিন্তু যদি অনুমান করা যায়, রাঢ়দেশ কর্ণাট-রাজের পদানত ছিল, এবং কর্ণাট-রাজ কর্ত্তৃক রাঢ়-শাসনার্থ নিয়োজিত, [লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগর-তাম্রশাসনে কথিত] “কর্ণাটক্ষত্রিয়”-বংশজাত রাজপুত্রগণের বংশে সামন্তসেন জন্মগ্রহণ করিয়া, রাঢ়দেশেই কর্ণাটরাজের শক্রগণের সহিত যুদ্ধে রত ছিলেন, তাহা হইলে এই বিরোধের ভঞ্জন হয়। বিহ্লন-বিবৃত চালুক্য-রাজকুমার বিক্রমাদিত্য কর্ত্তৃক গৌড়াধিপের এবং [হয়ত গৌড়াধিপের সাহায্যার্থ আগত] কামরূপাধিপের পরাজয়-বৃত্তান্ত এই অনুমানের অনুকূল প্রমাণরূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে। চন্দেল্ল-রাজ কীর্ত্তিবর্ম্মার (রাজত্ব ১০৪৯-১১০০ খৃষ্টাব্দ) আশ্রিত “প্রবোধ-চন্দ্রোদয়”-রচয়িতা কৃষ্ণমিশ্র যাহাকে “গৌড়ং রাষ্ট্রমনুত্তমং নিরুপমা তত্রাপি রাঢ়া” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, কুমার বিক্রমাদিত্য গৌড়াধিপকে পরাজিত করিয়া, সেই রাঢ়দেশ গৌড়-রাষ্ট্র হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াছিলেন। নবজিত রাঢ়-শাসনার্থ কর্ণাট-রাজ যে রাজপুত বা ক্ষত্রিয় সেনা-নায়ককে নিয়োগ করিয়াছিলেন, সামন্তসেন তাঁহারই বংশধর। সামন্তসেন একাদশ শতাব্দের চতুর্থপাদে বিদ্যমান ছিলেন, একথা স্বীকার করিলেই, এই অনুমানকে প্রমাণরূপে গ্রহণের আর আপত্তি থাকে না। সামন্তসেন যে একাদশ শতাব্দের শেষপাদেই প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন, তাহা সেন-রাজগণের কালনির্ণয়-প্রসঙ্গে প্রদর্শিত হইবে।

  1. Indian Antiquary, Vol. XVIII, p. 217.
  2. নিজাম-রাজ্যের অন্তর্গত বর্ত্তমান কল্যানি।
  3. “विक्रमाङ्कदेवचरितम्,” Edited by George Buhler, Bombay, 1875.
  4. काश्मीरेभ्यो विनिर्य्यान्तं राज्ये कलशभूपतेः।
    विद्यापतिं यं कर्णाट श्चक्रे पर्माड़िभूपतिः॥