মহীপালের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী নয়পাল, [তৃতীয় বিগ্রহপালের তাম্রশাসনে], “সকলদিকে প্রতাপ-বিস্তারকারী” এবং “লোকানুরাগভাজন” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। নয়পাল যখন গৌড়-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, তখন সকল দিকে না হউক, পশ্চিম দিকে প্রতাপ-বিস্তারের বিশেষ সুযোগ উপস্থিত হইয়াছিল। কোন কোন মুসলমান ইতিহাস-লেখক লিথিয়াছেন,—মামুদ যখন কান্যকুব্জ আক্রমণ করিয়াছিলেন, তখন কান্যকুব্জ-রাজ [রাজ্যপাল] তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন বলিয়া, চন্দেল্ল-রাজ গণ্ড তাহাকে নিহত করিয়াছিলেন।[১] কচ্ছপঘাত-বংশীয় বিক্রমসিংহের [দুবকুণ্ডে প্রাপ্ত] ১১৪৫ বিক্রম-সংবতের [১০৮৮ খৃষ্টাব্দের] শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে, বিক্রমসিংহের প্রপিতামহ অর্জ্জুন, বিদ্যাধরের আদেশে [কার্য্যনিরতঃ], রাজ্যপাল নামক নরপালকে নিহত করিয়াছিলেন।[২] এই বিদ্যাধর চন্দেল্ল-রাজ গণ্ডের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী বিদ্যাধর, এবং এই রাজ্যপাল কান্যকুব্জের প্রতীহার-বংশীয় রাজা রাজ্যপাল বলিয়া অনুমান হয়। মহোবায় প্রাপ্ত চন্দেল্ল-বংশের একখানি শিলালিপিতে সম্ভবত বিদ্যাধর সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে, তিনি কান্যকুব্জ-রাজের বিনাশবিধান করিয়াছিলেন, [বিহিত-কন্যাকুব্জ-ভূপালভঙ্গম্]।[৩] রাজ্যপালের হন্তা গণ্ডই হউন বা বিদ্যাধরই হউন, রাজ্যপালের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কার্য্যতঃ প্রতীহার-বংশের সৌভাগ্য-সূর্য্য অস্তমিত হইয়াছিল। রাজ্যপালের পরে, ত্রিলোচনপাল এবং তৎপর সম্ভবত যশঃপাল কান্যকুব্জের সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহারা প্রতীহার-বংশের লুপ্ত-গৌরব পুনরুজ্জীবিত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। সুতরাং নয়পালের পশ্চিমদিকে রাজ্য-বিস্তারের বিশেষ সুযোগ ছিল। কিন্তু নয়পালও, মহীপাল এবং পালবংশের ইতিহাসের এই স্থিতিশীল যুগের অন্যান্য নরপালগণের ন্যায়, “মহোদয়শ্রী”-উপার্জ্জন-অভিলাষ-বর্জ্জিত ছিলেন।

 পিতার ন্যায় নয়পালও বহিঃশত্রুর আক্রমণ হইতে উদ্ধার করিয়া, গৌড়রাজ্য অখণ্ড রাখিয়া যাইতে সমর্থ হইয়াছিলেন। “তারিখ-ই-বাইহাকী” নামক পারস্য ভাষায় রচিত ইতিহাসে উল্লিখিত হইয়াছে, মামুদের পুত্র মাসুদ যখন গজনীর অধীশ্বর, তখন [১০৩৩ খৃষ্টাব্দে] লাহোরের শাসনকর্ত্তা আহম্মদ নিয়ালতিগীন্ বারাণসী-নগর আক্রমণ করিয়াছিলেন। উক্ত “তারিখ”-প্রণেতা লিখিয়াছেন—[৪]

 “(নিয়ালতিগীন্ সসৈন্য) গঙ্গাপার হইয়া, বাম তীর দিয়া চলিয়া গিয়া, হঠাৎ বণারস নামক সহরে উপনীত হইলেন। (এই সহর) গঙ্গ-প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সহর (পূর্ব্বে) কখনও মুসলমান-সেনাকর্ত্তৃক আক্রান্ত হয় নাই। সহরটি ২ ফর্‌সঙ্গ (৬০০০ গজ) দীর্ঘ এবং ২ ফর্‌সঙ্গ প্রশস্ত। (এখানে) জল যথেষ্ট ছিল। মুসলমান লস্কর প্রাতঃকালে (পহুঁছিয়া) দ্বিতীয় নমাজের (মধ্যহ্নের) পরে, আর অধিক কাল তথায় তিষ্ঠিতে পারিয়াছিল না; কারণ বিপদের (আশঙ্কা) ছিল। (এই সময় মধ্যে) কাপড়ের বাজার, সুগন্ধিদ্রব্যের বাজার, এবং মণিমুক্তার বাজার—এই তিনটি বাজার ব্যতীত, আর কোন স্থান লুণ্ঠন করিতে পারা গিয়াছিল না। কিন্তু সৈন্যগণ খুব লাভবান হইয়াছিল। সকলেই সোণা, রূপা, আতর, এবং মণিমুক্তা প্রাপ্ত হইয়াছিল এবং অভিলাষ পূর্ণ করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছিল।”

 “তারিখ-ই-বাইহাকি”-প্রণেতা আবুল ফজল, সুলতান মাসুদ এবং আহম্মদ নিয়ালতিগীনের সমসাময়িক লোক, এবং নিয়ালতিগীনের অভিযান সম্বন্ধে খাঁটি খবর সংগ্রহের তাঁহার বেশ সুবিধা ছিল। তাঁহার প্রদত্ত বিবরণ হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, ১০৩৩ খৃষ্টাব্দেও বারাণসী পূর্ব্ববৎ সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু সুলতান মামুদের মৃত্যুর পর, বারাণসীর প্রহরিগণ কিছু অসতর্ক হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাই নিয়ালতিগীন্ রজনীযোগে চলিয়া আসিয়া, হঠাৎ প্রাতঃকালে উপস্থিত হইয়া, ছয় ঘণ্টা কাল মধ্যে তিনটি বাজার লুণ্ঠনের অবসর পাইয়াছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে নগররক্ষিগণ খবর পাইয়া প্রস্তুত হইয়াছিলেন। সুতরাং, নিয়ালতিগীন পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ১০৩৩ খৃষ্টাব্দে নিয়ালতিগীনের আক্রমণ হইতে যাঁহারা বারাণসীর উদ্ধারসাধন করিয়াছিলেন, তাঁহারা নয়পালের আদেশানুবর্ত্তী গৌড়-সেনা, নিঃসন্দেহে এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।

 তিব্বতীয় ভাষায় রচিত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের (অতীশের) জীবনচরিতে, নয়পালের আমলে, “কর্ণ্য”-রাজ্যের রাজা কর্ত্তৃক মগধ-আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায়।[৫] নয়পাল দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে বিক্রমশীলা-বিহারের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করিয়াছিলেন। প্রথম যুদ্ধে গৌড়সেনা “কর্ণ্য”-রাজ্যের সেনা কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিল, এবং শক্রগণ রাজধানী পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিল। কিন্তু পরে নয়পালই জয়লাভ করিয়াছিলেন। অবশেষে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের যত্নে, উভয় পক্ষে মৈত্রী স্থাপিত হইয়াছিল। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবন-চরিতকার বুস্তন তাঁহার নিজের শিষ্য ছিলেন। সুতরাং বুস্তনের প্রদত্ত মগধ-আক্রমণ-বিবরণ অবিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু কোন্ রাজ্যকে যে বুস্তন “কর্ণ্য” নামে উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, তাহার নিরূপণ করা কঠিন। “কর্ণ্য”-শব্দ যদি রাজ্যের নাম রূপে গ্রহণ না করিয়া, রাজার নাম বলিয়া মনে করা যায়, তবে এই সমস্যা পূরণ করা যাইতে পারে। চেদির কলচুরি-রাজ গাঙ্গেয়দেবের পুত্র কর্ণ নয়পালের জীবদ্দশায়, [১০৩৭ হইতে ১০৪২ খৃষ্টাব্দ মধ্যে,][৫] পিতৃ-সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। কর্ণের পৌত্রবধু অহ্লনাদেবীর [ভেরঘাটে প্রাপ্ত] শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে, কর্ণের ভয়ে “কলিঙ্গের সহিত বঙ্গ কম্পমান ছিল।”[৬] অহ্লনাদেবীর পুত্র জয়সিংহদেবের [কর্ণবলে প্রাপ্ত] শিলালিপিতে সূচিত হইয়াছে—গৌড়াধিপ গর্ব্ব ত্যাগ করিয়া কর্ণের আজ্ঞাবহন করিতেন।[৭] কর্ণ চিরজীবন প্রতিবেশী রাজন্যবর্গের সহিত বিরোধে রত ছিলেন। সুতরাং নয়পালের সময়ে মগধ-আক্রমণ তাঁহার পক্ষে অসম্ভব নহে; এবং সেই আক্রমণের পরিণাম সম্বন্ধে বুস্তন যাহা লিখিয়াছেন, তাহাই হয়ত ঠিক।

 বহিঃশত্রুর আক্রমণ সত্বেও, গৌড়াধিপ নয়পাল গৌড়-রাষ্ট্রের মান-মর্য্যাদা-রক্ষায় সমর্থ হইয়াছিলেন। রাজত্বের পঞ্চদশ বর্ষে উৎকীর্ণ, গয়ার কৃষ্ণ-দ্বারকা-মন্দিরের শিলালিপিতে, তিনি “সমস্ত-ভূমণ্ডল-রাজ্য-ভার”-বহনকারী বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন।

  1. Elliot’s History of India, Vol. II, p. 463. মুসলমানলেখকগণ কালঞ্জরের রাজাকে নন্দা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। চন্দেল্ল-রাজগণের শিলালিপি এবং তাম্রশাসনে প্রদত্ত বংশাবলী অনুসারে এই সময়ের কালঞ্জর-রাজের নাম “গণ্ড”। Epigraphia Indica, vol. VIII, app. I, p. 16. দ্রষ্টব্য।
  2. Epigraphia Indica, Vol. II, p. 237:—

    “श्रीविद्याधर-देवकार्य्यनिरतः श्रीराज्यपालं हठात्
    कंठास्थि-छिदनेकवाणनिवहै र्हत्वा महत्याहवे।”

  3. Epigraphia Indica, Vol. I, pp. 229-222.
  4. Tarikh-i-Baihaki (Bibliotheca Indica), p. 497; Elliot’s History of India, Vol. II, pp. 123-124.
  5. ৫.০ ৫.১ Journal of the Buddhist Text Society, Vol. I, 1903, pp. 9-10.
  6. Epigraphia Indica, Vol. VIII, App. I.
  7. Ibid, Vol. II, p. 11.