গৌড়রাজমালা/মহীপালের কীর্ত্তিকলাপ
খৃষ্টীয় অষ্টম শতাদের আরম্ভে (৭১১ খৃষ্টাব্দে) খালিফ-আল-ওয়ালিদের সেনানী মহম্মদ কাশিমের নেতৃত্বাধীনে মুসলমানধর্ম্মী আরবগণ সিন্ধু এবং মুলতান অধিকার করিলেও, আরব-প্রাধান্যের যুগে, মুসলমান-প্রভাব সিন্ধু ও মুলতানের বাহিরে বিস্তারলাভ করিতে পারিয়াছিল না। সেই যুগে পরাক্রান্ত সাহিরাজ্যের নৃপতিগণ উত্তরাপথের উত্তরপশ্চিম-সীমান্ত রক্ষা করিতেছিলেন। পঞ্জাব ও আফগানিস্থানের পূর্ব্বভাগ সাহিরাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। সাহিরাজ্য প্রথমে কুষাণ-সম্রাট কনিষ্কের বংশধরগণের পদানত ছিল। সুতরাং সাহিরাজগণ জাতিতে তুরূষ্ক এবং সম্ভবত বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী হইলেও, কার্য্যত হিন্দুসমাজভূক্ত হইয়া গিয়াছিলেন; এবং মুসলমান-আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার জন্য উত্তরাপথের রাজন্যবর্গের সাহায্যই প্রার্থনা করিতেন।[১] নবম শতাব্দীর মধ্যভাগে কুষাণ-বংশীয় শেষ সাহি-রাজ কতোরমানের ব্রাহ্মণ-মন্ত্রী “লল্লিয়” বা “কালার”, প্রভুকে পদচ্যুত করিয়া, সাহি-সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন।[২] কাবুল কুষাণ-বংশীয় সাহি রাজগণের রাজধানী ছিল। লল্লিয়-সাহি সিন্ধুনদের পশ্চিমতীরবর্ত্তী উদ্ভাণ্ডপুরে (উন্দ) স্বীয় রাজধানী স্থাপিত করিয়াছিলেন। ২৫৬ হিজরি [৮৬৮-৯ খৃষ্টাব্দে] সিস্থানের অধিপতি ইয়াকুব লয়স্ আফগানিস্থানের অন্তর্গত গজনী-প্রদেশ অধিকার করিয়াছিলেন, এবং কাবুল পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন।[৩] ইহার কিয়ৎকাল পরে, তুর্কিস্থানের সামানী-বংশীয় অধিপতি ইস্মাইল কর্ত্তৃক গজনী সামানী-রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল। খৃষ্টীয় দশম শতাব্দের তৃতীয়পাদে, সামানী-রাজের একজন প্রভাবশালী সেনা-নায়ক, আলব-তিগীন, প্রভুর ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হইয়া, গজনীতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। আলব-তিগীনের সবুক্-তিগীন নামক একজন তুরূষ্ক ক্রীতদাস ছিল। প্রভুর মৃত্যুর কয়েক বৎসর পরে, ৯৭৭ খৃষ্টাব্দে, সবুক্-তিগীন গজনীর গদিতে আরোহণ করিয়াছিলেন। ইহার দশ বৎসর পরে, [৯৮৭ খৃষ্টাব্দে] সবুক্-তিগীন উত্তরাপথের সিংহদ্বার [সাহি-রাজ্য] অধিকারে বদ্ধপরিকর হইয়া, উহা আক্রমণ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। সাহি-জয়পাল তখন উদ্ভাণ্ডপুরের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। সবুক্-তিগীন আরব্ধ সাহিরাজ্য-ধ্বংসসাধনত্রত অসম্পূর্ণ রাখিয়া, ৯৯৯ খৃষ্টাব্দে কালগ্রাসে পতিত হইলে, তদীয় উত্তরাধিকারী মামুদ, প্রবলতর পরাক্রম সহকারে, সাহি-রাজ্য আক্রমণ করিতে লাগিলেন। কাশ্মীর, কান্যকুব্জ, কালঞ্জর (জেজ্যভুক্তি) এবং উত্তরাপথের অন্যান্য রাজ্যের রাজন্যবর্গ প্রাণপণে বিপন্ন সাহি-রাজের সহায়তা করিয়াছিলেন। মামুদের গতিরোধ করিতে গিয়া, সাহি জয়পাল, তদীয় পুত্র সাহি আনন্দপাল, পৌত্র সাহি ত্রিলোচনপাল, একে একে প্রাণপাত করিয়াছিলেন। সাহি-রাজ্য সম্পূর্ণরূপে অধিকার করিয়াও, কিন্তু মামুদের উচ্চাভিলাষের তৃপ্তি হইয়াছিল না। তিনি তখন উত্তরাপথের পবিত্র তীর্থক্ষেত্রের এবং সমৃদ্ধ নগরনিচয়ের লুণ্ঠনে এবং ধ্বংস-সাধনে ব্রতী হইয়াছিলেন। থানেশ্বর, মথুরা, কান্যকুব্জ, গোয়ালিয়র, কালঞ্জর, সোমনাথ ক্রমে মামুদের ধনলোভ এবং পৌত্তলিকতা-বিদ্বেষ-বহ্নিতে আহুতি রূপে প্রদত্ত হইয়াছিল। এই ঘোর দুর্দ্দিনে, উত্তরাপথের পূর্বার্দ্ধের অধিপতি গৌড়াধিপ মহীপাল কি করিতেছিলেন?
মামুদের আক্রমণ সম্বন্ধে গৌড়াধিপ মহীপালের ঔদাসীন্যের আলোচনা করিলে মনে হয়, কলিঙ্গজয়ের পর, মৌর্য্য-অশোকের ন্যায়, [কাম্বোজান্বয়জ গৌড়পতির কবল হইতে] বরেন্দ্র উদ্ধার করিয়া, মহীপালেরও বৈরাগ্য উপস্থিত হইয়াছিল; এবং অশোকের ন্যায় মহীপালও যুদ্ধ বিগ্রহ পরিত্যাগ করিয়া, পরহিতকর এবং পারত্রিক কল্যাণকর কর্ম্মানুষ্ঠানে জীবন উৎসর্গ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন। রাঢ়দেশে (মুর্শিদাবাদ জেলায়) “সাগরদীঘি”, এবং বরেন্দ্রে (দীনাজপুর জেলায়) “মহীপালদীঘি”, অ্যাপি মহীপালের পরহিত-নিষ্ঠার পরিচয় দিতেছে। তিনটি সুবৃহৎ নগরের ভগ্নাবশেষ—বগুড়াজেলার অন্তর্গত “মহীপুর”, দীনাজপুর জেলার “মহীসন্তোষ”, এবং মুর্শিদাবাদ জেলার “মহীপাল”,—মহীপালের নামের সহিত জড়িত রহিয়াছে। ১০৮৩ সম্বতের (১০২৬ খৃষ্টাব্দের) সারনাথে প্রাপ্ত একখানি শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে,—গৌড়াধিপ মহীপাল বারাণসীধামে, স্থিরপাল এবং বসন্তপালের দ্বারা, ঈশান (শিব) ও চিত্রঘণ্টার (দুর্গার) মন্দিরাদি [কীর্ত্তিরত্নশতানি] প্রতিষ্ঠিত করাইয়াছিলেন; মৃগদাবের (সারনাথের) “ধর্ম্মরাজিকা” বা অশোকস্তূপ এবং অশোকের স্তম্ভোপরস্থিত “সাঙ্গ-ধর্ম্মচক্রের” জীর্ণসংস্কার করাইয়াছিলেন; এবং অভিনব “শৈলগন্ধকূটী” নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন।
সারনাথের লিপিতে বারাণসীধামে মহীপালের কীর্ত্তিকলাপের যে তালিকা প্রদত্ত হইয়াছে, তাহা পাঠে স্বতঃই মনে হয়,—বারাণসী তখন গৌড়রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দে, গাহড়বাল-রাজগণের আমলে, বারাণসী কান্যকুব্জ রাজ্যের অন্তর্নিবিষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু একাদশ শতাব্দে, বারাণসী কান্যকুব্জের প্রতীহার-রাজগণের অধিকারভুক্ত থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। একাদশ শতাব্দের প্রথম পাদে, কান্যকুব্জ-রাজ রাজ্যপাল, সুলতান মামুদের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া, যখন ঘোর বিপন্ন এবং স্বীয় রাজধানী-রক্ষণে অসমর্থ তখন বারাণসী তাঁহার রক্ষণাধীনে থাকিলে, গৌড়াধিপ যে তথায় শত শত কীর্ত্তিরত্ন-প্রতিষ্ঠায় সাহসী হইতেন, এরূপ মনে হয় না। বারাণসী তখন গৌড়রাষ্ট্রভুক্ত এবং গৌড়সেনা-রক্ষিত ছিল; এবং মহীপাল বারাণসী-রক্ষার সুব্যবস্থা করিয়া রাখিয়ছিলেন বলিয়াই, হয়ত এই মহাতীর্থ সুলতান মামুদের আক্রমণ হইতে অব্যাহতি পাইয়াছিল।[৪]
বারাণসীধামকে কীর্ত্তিরত্নে সজ্জিত করিতে গিয়া, মহীপাল এমনই তন্ময় হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, আর্য্যাবর্ত্তের অপরার্দ্ধের তীর্থক্ষেত্রের কীর্ত্তিরত্নের কি দশা হইতেছিল, সে দিকে দৃক্পাত করিবারও তাঁহার অবসর ছিল না। সারনাথের লিপি-সম্পাদনের ঠিক পূর্ব্ব বৎসর [১০২৫ খৃষ্টাব্দে] মামুদ সোমনাথের প্রসিদ্ধ মন্দির ধ্বংস করিয়াছিলেন, এবং কয়েক বৎসর পূর্ব্বে, [১০১৮ খৃষ্টাব্দে] মথুরা এবং কান্যকুব্জের মন্দিরনিচয় ভূমিসাৎ করিয়া, সুবর্ণ এবং রজতনির্ম্মিত দেবমূর্ত্তিসমূহ আত্মসাৎ করিয়াছিলেন। সাহি-রাজ্যের পতনে, বা কান্যকুব্জ এবং কালঞ্জর রাজ্যের বিপদে না হউক, মথুরার ন্যায় তীর্থক্ষেত্রের দেবমূর্ত্তি এবং দেবমন্দির নিচয়ের দুর্দ্দশায়, ধর্ম্মপ্রাণ মহীপালের হৃদয় দ্রবীভূত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি স্বীয় রাজ্যের বহির্ভূত তীর্থক্ষেত্র সম্বন্ধে একান্ত উদাসীন ছিলেন। সুলতান মামুদের অভিযাননিচয় সম্বন্ধে গৌড়াধিপ মহীপালের এই প্রকার ঔদাসীন্য উত্তরাপথের সর্ব্বনাশের অন্যতম কারণ। যদি মহীপাল গৌড়রাষ্ট্রের সেনাবল লইয়া সাহি-জয়পাল, আনন্দপাল, বা ত্রিলোচনপালের সাহায্যার্থ অগ্রসর হইতেন, তবে হয়ত ভারতবর্ষের ইতিহাস স্বতন্ত্র আকার ধারণ করিত।
- ↑ Elliott’s History of India, Vol. II, p. 415.
- ↑ Stein’s Rajatarangini, (English Translation); Sachu’s English Translation of Alberuni’s Indica, Vol. II.
- ↑ Raverty’s Tabakat-i-Nasiri, pp. 21-22.
- ↑ বেণ্ডল (Bendall) নেপাল-দরবারের পুস্তকাগারের একখানি হস্তলিখিত রামায়নের (১০৭৯ নং) কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের উপসংহার-ভাগ হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন, (Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. LXXII, 1903, Part 1, page 18):—“সংবৎ ১০৭৬ আষাঢ়বদি ৪ মহারাজাধিরাজ পুণ্যাবলোক—সোমবংশোদ্ভব-গৌড়ধ্বজ-শ্রীমদ্-গাঙ্গেয়দেব-ভুজ্যমান-তীরভুক্তৌ কল্যাণবিজয়রাজ্যে………শ্রীগোপতিনা লেখিদম্।” বেণ্ডল সম্বৎ ১০৭৬ বিক্রম-সম্বৎ রূপে [১০১৯ খৃষ্টাব্দ] গ্রহণ করিয়া, গৌড়ধ্বজ গাঙ্গেয়দেবকে ও চেদীর কলচুরি-বংশীয় রাজা গাঙ্গেয়দেবকে অভিন্ন বলিয়া স্থির করিয়া গিয়াছেন। ১০১৯ খৃষ্টাব্দে তীরভুক্তি বা ত্রিহুত (মিথিলা) কলচুরি-রাজ গাঙ্গেয়দেবের পদানত ছিল, এ কথা স্বীকার করিতে হইলে, তখন বারাণসীকে গৌড়রাজ্যের অন্তর্গত বলিয়া মনে করা যায় না। ফরাসী পণ্ডিত লেভি, স্বরচিত নেপালের ইতিহাসে (Levi’s Le Nepal, Vol. II, p. 202, note, বঙ্গীয় এসিয়াটিক্ সোসাইটীর সুযোগ্য পুস্তকরক্ষক বন্ধুবর শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রচন্দ্র কুমার এই অংশ আমাকে অনুবাদ করিয়া দিয়াছেন), বেণ্ডলের উদ্ধৃত পাঠের বিশুদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন, এবং বেণ্ডলের ব্যাখ্যাও গ্রহণ করেন নাই। “গৌড়ধ্বজ” বা গৌড়-রাজ্যের পতাকা অর্থে গৌড়াধিপকেই বুঝাইতে পারে। চেদীর কলচুরি-বংশীয় কোনও রাজা কর্ত্তৃক কখনও গৌড়াধিপ-উপাধি ধারণের প্রমাণ বিদ্যমান নাই। চেদীরাজ গাঙ্গেয়দেবের সময়ে মগধ যে গৌড়াধিপ মহীপালের পদানত ছিল, তাহার প্রমাণ আছে, এবং মগধের পশ্চিম-দিগ্বর্ত্তী জেজাভুক্তি (বুন্দেলখণ্ড) চন্দেল্ল-রাজগণের অধিকৃত ছিল। সুতরাং মগধ ও জেজাভুক্তি ডিঙ্গাইয়া, চেদী-রাজের পক্ষে মিথিলায় “কল্যাণবিজয়রাজ্য”-প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নহে। নেপালী-লেখক কর্ত্তৃক উল্লিখিত এই সোমবংশীয় গাঙ্গেয়দেব হয়ত মিথিলার একজন সামন্ত নরপাল ছিলেন।