গৌড়রাজমালা/রাজেন্দ্রচোলের অভিযান

 চোলরাজ প্রথম রাজেন্দ্রচোলের তিরুমলয়-পাহাড়ে উৎকীর্ণ তামিল ভাষার লিপিতে উক্ত হইয়াছে—[]

 “পরকেশরীবর্ম্মা বা শ্রীরাজেন্দ্র-চোলদেবের (রাজত্বের) ত্রয়োদশ বৎসরে—যিনি……তাঁহার মহান্ সমরপটু সেনাদ্বারা (নিম্নোক্ত দেশ সকল) অধিকার করিয়াছেন—দুর্গম ওড্‌ড-বিষয়, (যাহা তিনি) প্রবল যুদ্ধে (পদানত করিয়াছিলেন); মনোরম কোশল-নাডু, যেখানে ব্রাহ্মণগণ মিলিত হইয়াছিল; মধুকর-নিকর-পরিপূর্ণ-উদ্যানবিশিষ্ট তন্দবুত্তি, ভীষণযুদ্ধে ধর্ম্মপালকে নিহত করিয়া তিনি যে দেশ অধিকার করিয়াছিলেন; সকলদিকে প্রসিদ্ধ তক্কণলাড়ম্, সবেগে রণশূরকে আক্রমণ করিয়া তিনি যে দেশ অধিকার করিয়াছিলেন; বঙ্গালদেশ, যেখানে ঝড়বৃষ্টির কখনও বিরাম নাই, এবং গজ-পৃষ্ঠ হইতে নামিয়া যেখান হইতে গোবিন্দচন্দ্র পলায়ন করিয়াছিলেন; কর্ণভূষণ, চর্ম্মপাদুকা এবং বলয় বিভূষিত মহীপালকে ভীষণ সমরক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিতে বাধ্য করিয়া, যিনি তাঁহার অদ্ভুত বলশালী করিসমূহ এবং রত্নোপমা রমণীগণকে হস্তগত করিয়াছিলেন; সাগরের ন্যায় রত্নসম্পন্ন উত্তিরলাড়ম্; বালুকাময়-তীর্থধৌতকারিণী গঙ্গা।”[]

 প্রথম রাজেন্দ্র-চোলদেব ১০১২ খৃষ্টাব্দে চোল-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, এবং তিরুমলয়পর্ব্বতের লিপি তাঁহার রাজত্বের ত্রয়োদশ বৎসরে [১০২৪ খৃষ্টাব্দে] উৎকীর্ণ হইয়াছিল। প্রথম রাজেন্দ্র-চোলের রাজত্বের নবম বর্ষে সম্পাদিত মেলপাড়ির চোলেশ্বর-মন্দিরের লিপিতে বিজিত দেশসমূহের যে তালিকা প্রদত্ত হইয়াছে, তন্মধ্যে ওড্‌ড-বিষয়াদির নাম নাই।[] সুতরাং অনুমান করিতে হইবে, প্রথম রাজেন্দ্র-চোল তাঁহার রাজত্বের নবম ও ত্রয়োদশ বৎসরের [১০২০ হইতে ১০২৪ খৃষ্টাব্দের] মধ্যে ওড্‌ড-বিষয়, কোশল-নাডু, বঙ্গাল-দেশ প্রভৃতি আক্রমণ করিয়াছিলেন। সারনাথের শিলালিপি হইতে জানা যায়, গৌড়াধিপ মহীপাল ১০৮৩ সম্বতে [১০২৬ খৃষ্টাব্দে] জীবিত ছিলেন। সুতরাং প্রথম রাজেন্দ্র-চোল “ওড্‌ড বিষয়” বা উড়িষ্যা, “তক্‌কণ-লাড়ম্” বা দক্ষিণরাঢ়[] এবং “বঙ্গাল-দেশ” বা বঙ্গ আক্রমণ করিতে গিয়া, যে মহীপালের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, সেই মহীপাল অবশ্যই পালবংশীয় গৌড়াধিপ মহীপাল। প্রথম রাজেন্দ্র-চোল প্রকৃত প্রস্তাবে মহীপালকে পরাভূত করিয়া, তাঁহার হস্তী এবং রমণীগণকে হস্তগত করিতে পারিয়াছিলেন কিনা, সুধু এক পক্ষের কথা শুনিয়া, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় না। কিন্তু তিরুমলয়ের লিপিতে যে ভাবে প্রথম রাজেন্দ্র-চোলের দিগ্বিজয়-বৃত্তান্ত বর্ণিত হইয়াছে, তাহা পাঠে মনে হয়, তিনি গৌড়রাজ্যের দক্ষিণাংশ আক্রমণ করিয়াছিলেন। তারানাথ লিখিয়া গিয়াছেন,—উড়িষ্যার রাজা মহীপালকে করপ্রদান করিতেন।[] চোলরাজ সম্ভবত উড়িষ্যা, বঙ্গ, এবং রাঢ়ের সামন্তগণকে পরাভূত করিয়াছিলেন; এবং মহীপালের সহিত সম্মুখযুদ্ধের পরেই হউক, বা পূর্ব্বেই হউক, আর অধিকদূর অগ্রসর হওয়া যুক্তিযুক্ত বিবেচনা না করিয়া, স্বরাজ্যে ফিরিয়া গিয়াছিলেন। দিগ্বিজয়ী চোলরাজ গৌড়রাজ্যের কোন অংশ স্থায়ীভাবে অধিকার করিয়াছিলেন, এরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় না।

 মহীপাল যে উপায়েই চোলরাজের আক্রমণ হইতে গৌড়রাজ্যের উদ্ধারসাধন করিয়া থাকুন, তিনি যে সমরানুরাগী শশাঙ্ক, ধর্ম্মপাল এবং দেবপালের ন্যায় উচ্চাভিলাষী ছিলেন না, শান্তিই ভালবাসিতেন, এরূপ মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। মহীপালের গৌড়-সিংহাসনলাভের অনতিকাল পরেই, উত্তরাপথের সর্ব্বনাশের—মুসলমান-ধর্ম্মাবলম্বী তুরূষ্কগণকর্ত্তৃক উত্তরাপথ বিজয়ের—সূত্রপাত হইয়াছিল। তুরূষ্ক-আক্রমণকারিগণের গৌড়রাষ্ট্রের সীমায় পদার্পণ করিবার তখনও প্রায় দুই শতাব্দ বিলম্ব থাকিলেও, তুরূষ্কগণ কর্ত্তৃক পরিণামে গৌড়বিজয়-রহস্য উদ্‌ঘাটনার্থ, এই দুই শতাদের গৌড়রাষ্ট্রের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাপথে তুরূষ্ক-প্রভাব-বিস্তারের ইতিবৃত্তও সংক্ষেপে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয়।

  1. Epigraphia Indica, Vol. IX, pp. 232—233.
  2. তিরুমলয়-পর্ব্বত মান্দ্রাজ-প্রেসিডেন্সির উত্তর-আর্কট জেলার অন্তর্ভুক্ত। এই লিপির মূল উদ্ধৃত করা অসম্ভব। তৎপরিবর্ত্তে উদ্ধৃত অংশের ডাক্তার হুল্‌জ্ (Hultzsch) কৃত ইংরাজী অনুবাদ প্রদত্ত হইল—
     “In the 13th year (of the reign) of king Parakesarivarman alias the lord Sri Rajendra-Choladeva, who………seized by (his) great, warlike army (the following)………Odda vishaya which was difficult to approach, (and which he subdued in) close fights; the good Kosalai-nadu, where Brahmanas assembled; Tandabutti, in whose gardens bees abounded, (and which he acquired) after having destroyed Dharmapala (in) a hot battle; Takkanaladam, whose fame reached (all) directions, (and which he occupied) after having forcibly attacked Ranasura; Vangala-desa, where the rain-wind never stopped, (and from which) Govindachandra fled, having descended from his male elephant; elephants of rare strength and treasures of women, (which he seized) after having been pleased to put to flight on a hot battle-field Mahipala, decked (as he was) with ear-rings, slippers and bracelets; Uttiraladam, as rich in pearls as the ocean; and the Ganga, whose waters dashed against bathing-places covered with sand.”
  3. Epigraphia Indica, Vol. VII, Appendix, List of Ins. of S. India, No. 729 (also see Nos. 727 and 728.)
  4. রায় বাহাদুর বেঙ্কয় এবং ডাক্তার হুল্‌জ্ “তক্‌কণ-লাড়ম্” দক্ষিণ-বিরাট বা দক্ষিণ-বেরার অর্থে এবং “উত্তির-লাড়ম্” উত্তর বেরার অর্থে গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু ওড্‌ড-বিষয়, বঙ্গালদেশ, এবং গঙ্গার সহিত উল্লিখিত দেখিয়া “লাড়”কে রাঢ় অর্থে গ্রহণই সমীচীনতর বোধ হয়।
  5. Cunningham’s Archæological Survey of India, Vol. III, p. 134.