গৌড়রাজমালা/ধর্ম্মপাল ও মিহিরভোজ
নাগভট্টের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী রামভদ্র কান্যকুব্জ অধিকার করিয়াছিলেন, এরূপ উল্লেখও গোয়ালিয়রের প্রশস্তিতে দেখিতে পাওয়া যায় না। রামভদ্রের সহিত কান্যকুব্জের অধিরাজ “বঙ্গপতি”র সংঘর্ষেরও উল্লেখ নাই। কিন্তু রামভদ্রের পুত্র মিহির-ভোজ সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—
“यस्य वैरि-वृहद्वङ्गा न्दहतः कोप-वह्निना।
प्रतापादर्णसां राशीन् पातु र्व्वै तृष्ण माबभौ॥“ (२१ श्लोकः)
“কোপাগ্নির দ্বারা পরাক্রান্ত শত্রু বঙ্গগণকে দহনকারী এবং প্রতাপের দ্বারা সাগরের জলরাশী পানকারী তাঁহার তৃষ্ণাভাব শোভা পাইয়াছিল।”
ধর্ম্মপালের সহিত প্রতীহার-রাজ ভোজের যে সমর উপস্থিত হইয়াছিল, সৌরাষ্ট্রের মহাসামন্ত দ্বিতীয় অবনীবর্ম্মার ৯৫৬ সম্বতের [৮৯৯ খৃষ্টাব্দের] তাম্রশাসনের একটি শ্লোকে তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। মহাসামন্ত দ্বিতীয় অবনীবর্ম্মা, ভোজদেবের পাদানুধ্যাত মহেন্দ্রপালদেবের, সৌরাষ্ট্রের মহাসামন্ত ছিলেন। ৫৭৪ বলভী সম্বতের [৮৯৩ খৃষ্টাব্দের] একখানি তাম্রশাসন হইতে জানা যায়,—দ্বিতীয় অবনীবর্ম্মার পিতা বলবর্ম্মাও ভোজদেব-পাদানুধ্যাত মহেন্দ্রায়ুধের [মহেন্দ্রপালের] মহাসামন্ত ছিলেন।[১] ইহাতে অনুমান হয়,—বলবর্ম্মার পিতামহও প্রতীহার-রাজগণের সামন্ত-শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। প্রথমোক্ত তাম্রশাসনে বলবর্ম্মার পিতামহ-সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—
अजनि ततोऽपि श्रीमान् वाहुकधवलो महानुभावो यः।
धर्म्म मवन्नपि नित्यं रणोद्यतो निनशाद धर्म्मं॥“ (८ श्लोकः)[২]
“তৎপর মহানুভাব শ্রীমান্ বাহুকধবল জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। যিনি নিত্য ধর্ম্মপালন করিলেও, রণোদ্যত হইয়া, ধর্ম্মকে ধ্বংস করিয়াছিলেন।”
এই তাম্রশাসনখানিতে অনেক ভুল আছে। এ স্থলে ডাঃ কিল্হর্ণের সংশোধিত পাঠই উদ্ধৃত হইল। কিল্হর্ণ মনে করেন, বাহুকধবল মিহির-ভোজের সামন্ত ছিলেন, এবং এই ধর্ম্ম, বঙ্গ-পতি ধর্ম্মপাল। গোয়লিয়র-প্রশস্তিতে মিহির-ভোজ কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ-অধিকারের উল্লেখ নাই; কিন্তু তাঁহার [যোধপুর-রাজ্যের অন্তর্গত দৌলতপুরায় প্রাপ্ত] ৯০০ বিক্রম সম্বতের [৮৪৩ খৃষ্টাব্দের] তাম্রশাসন মহোদয়ে বা কান্যকুব্জে সম্পাদিত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।[৩] সুতরাং গোয়লিয়র-প্রশস্তি-রচনার পরে, এবং দৌলতপুরার তাম্রশাসন সম্পাদনের [৮৪৩ খৃষ্টাব্দের] পূর্ব্বে, কোন সময়ে ভোজকর্ত্তৃক কান্যকুব্জ অধিকৃত হইয়াছিল। যে যুদ্ধে ধর্ম্মপালকে পরাজিত করিয়া, ভোজ কান্যকুব্জ-অধিকারের পথ প্রশস্ত কবিযাছিলেন, সেই যুদ্ধেই সম্ভবত মহাসামস্ত বাহুকধবল উপস্থিত ছিলেন।
হৰ্ষবর্দ্ধনের রাজধানী [কান্যকুব্জ] অধিকারে সমর্থ হইলেও, প্রতীহার-রাজ মিহির-ভোজ হৰ্ষবর্দ্ধনের ন্যায় “সকলোত্তরা-পথেশ্বর” হইতে সমর্থ হইয়াছিলেন না। উত্তরাপথের পূর্ব্বভাগে অবস্থিত গৌড়-রাজ্যে ভোজ কখনও হস্তক্ষেপ করিতে সাহসী হইয়াছিলেন, এরূপ কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। মধ্যভারতে রাষ্ট্রকূট-পরবল, গৌড়াধিপ ধর্ম্মপালের আশ্রয়ে, স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে পারিয়াছিলেন। পশ্চিমভাগে লাটপ্রদেশ [বর্ত্তমান গুজরাত] মান্যখেটের রাষ্ট্ৰকূট-রাজের “মহাসামন্তাধিপতির” অধিকৃত ছিল। লাটের রাষ্ট্ৰকূট-মহাসামন্তাধিপতি দ্বিতীয় ধ্রুবরাজের [৮৬৭ খৃষ্টাব্দের] একখানি শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায়,—ধ্রুবরাজ যুদ্ধে মিহিরভোজকে পরাজিত করিয়াছিলেন। সুতরাং ধর্ম্মপাল এবং মিহির-ভোজ এই উভয় প্রতিদ্বন্দ্বীর কাহারও আশা সম্পূর্ণরূপে ফলবতী হইয়াছিল না। কিন্তু ধর্ম্মপালের সুদীর্ঘ রাজত্বকালে, গৌড়মণ্ডলে সুখশান্তি বিরাজমান ছিল। খালিমপুরে-প্রাপ্ত তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—“গ্রামোপকণ্ঠে বিচরণশীল গোপালকগণের মুখে, প্রতি গৃহের চত্বরে ক্রীড়াশীল শিশুগণের মুখে, প্রতি বাজারে মানাধ্যক্ষগণের মুখে, এবং প্রতি প্রমোদগৃহে পিঞ্জরাবদ্ধ শুকপক্ষিগণের মুখে নিজের প্রশংসাগীতি শ্রবণ করিয়া, ধর্ম্মপাল সর্ব্বদা লজ্জাবনত মুখ ফিরাইয়া থাকিতেন।” এই শ্লোকটি স্তাবকোক্তি বলিয়া উপেক্ষিত হইতে পারে না। কারণ, আর কোনও প্রশস্তিতে রাজার সম্বন্ধে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রজার অভিমত এরূপ ভাবে উল্লিখিত হইতে দেখা যায় না; এবং বিশেষ কারণ ব্যতীত, এরূপ বিশেষোক্তি ধর্ম্মপালের প্রশস্তিতে স্থান পাইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। প্রজাপুঞ্জ যাঁহার পিতাকে রাজলক্ষ্মীর পাণিগ্রহণ করাইয়াছিলেন, সেই ধর্ম্মপাল যে প্রজারঞ্জনে যত্নবান্ হইবেন, এবং তাঁহার যে প্রতিভা এক সময় তাঁহাকে উত্তরাপথের সার্ব্বভৌম-পদলাভে সমর্থ করিয়াছিল, সেই প্রতিভাবলে তিনি যে প্রজারঞ্জনে সফলমনোরথ হইবেন, ইহাতে আর আশ্চর্য্যের বিষয় কি?