গৌড়রাজমালা/ধর্ম্মপাল ও নাগভট্ট
ধর্ম্মপাল পিতৃ-সিংহাসনে আরোহণ করিবার পূর্ব্বেই, গুর্জ্জরের অধীশ্বর বৎসরাজ পরলোক গমন করিয়াছিলেন; এবং তদীয় পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট [নাগভট] গুর্জ্জর-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। যোধপুর-রাজ্যের অন্তর্গত বুচকলা নামক স্থানে প্রাপ্ত ৮৭২ সম্বতের [৮১৫ খৃষ্টাব্দের] একখানি শিলালিপিতে[১] “মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর শ্রীবৎসরাজদেব-পাদানুধ্যাত পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর শ্রীনাগভট্টদেবের প্রবর্দ্ধমান-রাজ্যের” উল্লেখ দৃষ্ট হয়। নাগভট্ট পিতৃরাজ্যের ন্যায় উত্তরাধিকারিসূত্রে পিতার উচ্চাভিলাষও লাভ করিয়াছিলেন। সুতরাং ধর্ম্মপাল ও নাগভট্টের মধ্যে সংঘর্ষ উপস্থিত হইতে বিলম্ব হইল না। পাল-রাজগণের তাম্রশাসনে পাল-প্রতীহার-যুদ্ধের কোনও বিবরণ পরিরক্ষিত হয় নাই। নাগভট্টের পৌত্র মিহিরভোজের [গোয়ালিয়রে প্রাপ্ত] শিলালিপিতে নাগভট্টের কীর্ত্তিকলাপের এইরূপ পরিচয় পাওয়া যায়—[২]
“आद्यः पुमान् पुनरपि स्फुटकीर्त्ति रस्मा-
ज्जात स्स एव किल नागभट स्तदाख्यः।
यत्रान्ध्र-सैन्धव-विदर्भ-कलिङ्ग-भूपेः
कौमार-धामनि पतङ्गसमै रपाति॥
त्रय्यास्पदस्य सुकृतस्य समृद्धि मिच्छु-
र्यः क्षत्रधाम-विधिबद्ध-बलि-प्रबन्धः।
जित्वा पराश्रयकृत-स्फुटनीचभावं
चक्रायुधं विनयनम्र-वपु र्व्व्यराजत्॥
दुर्व्वार-वैरि(?)वरवारण-वाजिवार-
याणौघ-संघटन-घोर-घनान्धकारं।
निर्ज्जित्य वङ्गपति माविरभू द्विवस्वा-
नुद्यन्निव त्रिजगदेक-विकाश-कोषः॥
आनर्त्त-मालव-किरात-तुरूष्क-वत्स-
मत्स्यादिराज-गिरिदुर्ग-हठापहारैः।
यस्यात्म-वैभव मतीन्द्रिय माकुमार-
माविर्ब्बभूव भुवि विश्वजनीन-वृत्तेः॥” (८—११ श्लोकाः)
“আদিপুরুষ (বিষ্ণু) পুনরায় বৎসরাজ হইতে জন্মগ্রহণ করিয়া, বিখ্যাতকীর্ত্তি এবং গজসেনাবিশিষ্ট হইয়াছিলেন বলিয়া, সেই [নাগভট] নামধারী হইয়াছিলেন। (তাঁহার) কৌমার-কালের প্রজ্জ্বলিত প্রতাপবহ্নিতে অন্ধ্র, সৈন্ধব, বিদর্ভ এবং কলিঙ্গের ভূপতিগণ পতঙ্গের মত পতিত হইয়াছিলেন।
“বেদোক্ত পুণ্যকর্ম্মের সমৃদ্ধি ইচ্ছা করিয়া, তিনি ক্ষত্রিয়ের নিয়মানুসারে করধার্য্য করিয়াছিলেন। পরাধীনতা যাঁহার নীচভাব প্রকাশ করিয়াছিল, সেই চক্রায়ুধকে পরাজিত করিয়াও, তিনি বিনয়াবনতদেহে বিরাজ করিতেন।
“দুর্জ্জয় শক্রর (বঙ্গপতির স্বকীয়) শ্রেষ্ঠ গজ, অশ্ব, রথসমূহের একত্র সমাবেশে গাঢ় মেঘের ন্যায় অন্ধকাররূপে প্রতীয়মান বঙ্গপতিকে পরাজিত করিয়া, তিনি ত্রিলোকের একমাত্র আলোকদাতা উদীয়মান সূর্য্যের ন্যায় আবির্ভূত হইয়াছিলেন।
“বিশ্ববাসিগণের হিতে রত তাঁহার অসাধারণ [অতীন্দ্রিয়] পরাক্রম [আত্মবৈভব] আনর্ত্ত, মালব, তুরূষ্ক, বৎস, মৎস্য প্রভৃতি দেশের রাজগণের গিরিদুর্গ বলপূর্ব্বক অধিকার দ্বারা, শৈশব কাল হইতে [আকুমারং] পৃথিবীতে প্রকাশ প্রাপ্ত হইয়াছিল।”
এই পরাশ্রিত চক্রায়ুধ যে ধর্ম্মপালকর্ত্তৃক কান্যকুব্জের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত চক্রায়ুধ, এবং এই “বঙ্গপতি” যে স্বয়ং ধর্ম্মপাল, এ বিষয়ে কোন সংশয়ই উপস্থিত হইতে পারে না। ধর্ম্মপাল এবং তাঁহার অনুগত কান্যকুব্জেশ্বরের সহিত নিশ্চয়ই প্রতীহার-রাজ নাগভট্টের বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল; এবং পাল-রাজগণের তাম্রশাসনে যখন ধর্ম্মপাল কর্তৃক নাগভট্টের পরাজয়ের উল্লেখ নাই, পক্ষাত্তরে প্রতীহার-রাজগণের প্রশস্তিতে নাগভট্ট কর্তৃক চক্রায়ুধ এবং ধর্ম্মপাল উভয়েরই পরাজয়ের উল্লেখ আছে, তখন প্রতীহার রাজগণের প্রশস্তিকারের কথায় অবিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু যাঁহারা বলেন, নাগভট্টই চক্রায়ুধকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া, স্বয়ং কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন,[৩] তাঁহাদের সিদ্ধান্তের অনুকূল প্রমাণ গোয়ালিয়রের প্রশস্তিতে দেখিতে পাওয়া যায় না। এখানে চক্রায়ুধ-সম্বন্ধে “জিত্বা” বা “জয় করিয়া”, এই মাত্রই বলা হইয়াছে; তাঁহার পদচ্যুতির কোনও আভাস পাওয়া যায় না। প্রশস্তিকার, নাগভট্ট কর্ত্তৃক আনর্ত্ত, মালব, তুরূষ্ক, বৎস, মৎস্যাদি-রাজ্যের গিরিদুর্গ-অধিকারের উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু কান্যকুব্জ-অধিকারের উল্লেখ করেন নাই। এই সকল কারণে অনুমান হয়, নাগভট্ট কান্যকুব্জ অধিকার করিয়াছিলেন না, মৎস্য প্রভৃতি কান্যকুব্জ-রাজের অনুগত রাজ্যনিচয় আক্রমণ করায়, তাঁহার সহিত “বঙ্গপতির” এবং চক্রায়ুধের যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছিল, এবং সেই যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করিয়াছিলেন।