গৌড়রাজমালা/ধর্ম্মপাল
গোপাল গৌড়মণ্ডল একছত্র করিয়া, কালগ্রাসে পতিত হইলে, তদীয় উত্তরাধিকারী ধর্ম্মপাল পিতৃ-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই, গৌড়াধিপ শশাঙ্কের ন্যায় উত্তরাপথের সার্ব্বভৌমের পদলাভের জন্য যত্নবান হইয়াছিলেন। শশাঙ্ক যেখানে ব্যর্থ-মনোরথ হইয়াছিলেন, ধর্ম্মপাল সেখানে কৃতকার্য্য হইলেন। ধর্ম্মপালের [খালিমপুরে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—“তিনি [ধর্ম্মপাল] মনোহর ভ্রূভঙ্গি-বিকাশে (ইঙ্গিতমাত্রে) ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গন্ধার, কীর প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদের নরপালগণকে প্রণতিপরায়ণ চঞ্চলাবনত মস্তকে সাধু সাধু বলিয়া কীর্ত্তন করাইতে করাইতে, হৃষ্টচিত্ত পঞ্চালবৃদ্ধ কর্ত্তৃক মস্তকোপরি আত্মাভিষেকের স্বর্ণকলস উদ্ধৃত করাইয়া, কান্যকুব্জরাজকে রাজশ্রী প্রদান করিয়াছিলেন।” এই ঘটনাটি নারায়ণপালের [ভাগলপুরে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে আরও সহজ ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে। যথা—“ইন্দ্ররাজ প্রভৃতি শত্রগণকে পরাজিত করিয়া, পরাক্রান্ত [ধর্ম্মপাল] মহোদয়ের [কান্যকুব্জের] রাজশ্রী উপার্জ্জন করিয়াছিলেন; এবং পুনরায় উহা প্রণত এবং প্রার্থী চক্রায়ুধকে প্রদান করিয়াছিলেন।” পণ্ডিতগণ অনুমান করেন,—এই ইন্দ্ররাজই জৈন-হরিবংশে উল্লিখিত উত্তর-দিক্পাল ইন্দ্রায়ুধ। গুর্জ্জর এবং মালবের বহির্ভাগে অবস্থিত, গান্ধার [পেশোয়ার প্রদেশ] হইতে মিথিলার সীমান্ত পর্য্যন্ত বিস্তৃত সমস্ত উত্তরাপথ ইন্দ্রায়ুধের করতলগত ছিল। ধর্ম্মপাল ইন্দ্রায়ুধ এবং তাঁহার সামন্তগণকে পরাজিত করিয়া, উত্তরাপথের সার্ব্বভৌমের সমুন্নত পদ লাভ করিয়াছিলেন। এত বৃহৎ সাম্রাজ্য স্বয়ং শাসন করিতে সমর্থ হইবেন না মনে করিয়া, তিনি আয়ুধ-রাজবংশীয় আর এক জনকে [চক্রায়ুধকে] স্বকীয় মহাসামন্তরূপে কান্যকুব্জে প্রতিষ্ঠাপিত করিয়াছিলেন। তারানাথ পালরাজগণের যে বংশতালিকা প্রদান করিয়া গিয়াছেন, তাহা বহু প্রমাদপূর্ণ। তারানাথ ধর্ম্মপালকে গোপালের প্রপৌত্র, দেবপালের পৌত্র, এবং রসপালের পুত্র বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন; কিন্তু ধর্ম্মপালের সাম্রাজ্যের যে বিবরণ প্রদান করিয়া গিয়াছেন, তাহা অনেকাংশে তাম্রশাসনের প্রমাণের অনুযায়ী। তারানাথ লিখিয়াছেন,—“ধর্ম্মপাল ৬৪ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। তিনি কামরূপ, তিরহুতি, গৌড় প্রভৃতি অধিকার করিয়াছিলেন, অতএব তাঁহার রাজ্য পূর্ব্বদিকে সমুদ্র হইতে পশ্চিমে তিলি (দীল্লি?) পর্য্যন্ত, এবং উত্তরে জলন্ধর হইতে দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্ব্বত পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাঁহার সময়ে রাজা চক্রায়ুধ পশ্চিমদিকে রাজত্ব করিতেন।”[১]
কোন্ সময়ে যে ধর্ম্মপাল পিতৃ-সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন, এবং ইন্দ্রায়ুধকে পরাভূত করিয়া উত্তরাপথের সার্ব্বভৌম হইয়াছিলেন, তাহা নিরূপণ করা সুকঠিন। রাষ্ট্রকূট-রাজ অমোঘবর্ষের একখানি অপ্রকাশিত তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—অমোঘবর্ষের পিতা তৃতীয় গোবিন্দ উত্তরাপথ আক্রমণ করিলে—
“स्वयमेवोपनतौ च यस्य महत स्तौ धर्म्मचक्रायुधौ॥”[২]
“ধর্ম্ম[পাল] এবং চক্রায়ুধ এই উভয় নৃপতি স্বয়ং আসিয়া, (গোবিন্দের নিকট) নতশির হইয়াছিলেন।” ধর্ম্মপাল প্রকৃত প্রস্তাবে তৃতীয় গোবিন্দের নিকট নতশির হইয়া থাকুন আর নাই থাকুন, এই পংক্তিটি প্রমাণ করিতেছে,—রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় গোবিন্দের মৃত্যুর পূর্ব্বে, ধর্ম্মপাল চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠাপিত করিয়াছিলেন। তৃতীয় গোবিন্দ ৭৯৪ হইতে ৮১৩ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত, এবং অমোঘবর্ষ ৮১৭ হইতে ৮৭৭ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাষ্ট্রকূট-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান আছে।[৩] অনেকে মনে করেন,—৮১৭ খৃষ্টাব্দের ২।৩ বৎসর পূর্ব্বে, তৃতীয় গোবিন্দ পরলোকগমন করিয়াছিলেন, এবং অমোঘবর্ষ পিতৃরাজ্য লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু যাঁহার রাজত্ব সুদীর্ঘ ৬১ বৎসরকাল স্থায়ী হওয়ার বিশিষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান আছে, তাঁহার রাজ্যাভিষেককাল আরও পিছাইয়া ধরিয়া, ৬১ বৎসরেরও অধিককাল-ব্যাপী রাজত্ব কল্পনা অসঙ্গত। তৃতীয় গোবিন্দ ৮১৭ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন, এরূপ ধরিয়া লইয়া, ইহার ২।১ বৎসর পূর্ব্বে, [৮১৫ কি ৮১৬ খৃষ্টাব্দে] ধর্ম্মপাল ইন্দ্রায়ুধকে পরাভূত এবং চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠাপিত করিয়াছিলেন, এবং ঐ ঘটনার অব্যবহিত পূর্ব্বেই, পিতৃ-সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।
৮১৭ খৃষ্টাব্দের এত অল্পকাল পূর্ব্বে, ধর্ম্মপালের রাজ্যলাভ অনুমানের কারণ, ধর্ম্মপালের পুত্র দেবপালের মুঙ্গেরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে—ধর্ম্মপাল রাষ্ট্ৰকূট-তিলক শ্রীপরবলের দুহিতা রণ্ণাদেবীর পাণি-গ্রহণ করিয়াছিলেন। মধ্যভারতের অন্তর্গত “পথরি” নামক করদ-রাজ্যের প্রধান নগর পথরিতে অবস্থিত একটি প্রস্তর-স্তম্ভ-গাত্রে উৎকীর্ণলিপি হইতে জানা যায়;—রাষ্ট্রকূট পরবলের রাজত্ব-কালে [সম্বৎ ৯১৭ বা ৮৬১ খৃষ্টাব্দে] পরবলের প্রধান মন্ত্রী কর্ত্তৃক এই স্তম্ভ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এ পর্য্যন্ত এই স্তম্ভ-লিপিতে উক্ত পরবল ভিন্ন আর কোন রাষ্ট্রকূট-বংশীয়-পরবলের পরিচয় পাওয়া যায় নাই। এই নিমিত্ত, কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন,—এই স্তম্ভলিপির পরবলই ধর্ম্মপালের পত্নী রণ্ণাদেবীর পিতা। এই অনুমানই সঙ্গত বলিয়া বোধ হয়। ধর্ম্মপাল দীর্ঘকাল সিংহাসনে আরূঢ় ছিলেন। খালিমপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসন তাঁহার “অভিবর্দ্ধমান-বিজয়-রাজ্যের ৩২ সম্বতে” সম্পাদিত হইয়াছিল; এবং তারানাথ লিখিয়াছেন, ধর্ম্মপাল ৬৪ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। ৮১৫ সালে রাজ্যের আরম্ভ ধরিলে, তারানাথের মতানুসারে, ৮৭৯ খৃষ্টাব্দে ধর্ম্মপালের রাজত্বের অবসান মনে করিতে হয়। খালিমপুরের শাসনোক্ত ৩২ বৎসর, এবং জনশ্রুতির ৬৪ বৎসরের মধ্যে, ধর্ম্মপাল অন্যূন ৫০ বৎসর বা ৮৬৫ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন, এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। পক্ষান্তরে, [৮৬১ খৃষ্টাব্দে] পথরির লিপি সম্পাদনকালে, পরবল যে বার্দ্ধক্যে উপনীত হইয়াছিলেন, এরূপ মনে করিবার কারণ আছে। এই লিপিতে উক্ত হইয়াছে,—রাষ্ট্র-কূটবংশীয় জেজ্জ নামক নরপতির অগ্রজ অসংখ্য কর্ণ্ণাটসৈন্য পরাজিত করিয়া, লাটাখ্য রাষ্ট্র অধিকার করিয়াছিলেন। জেজ্জের পুত্র কর্ক্করাজ নাগাবলোক নামক নরপালকে পরাজিত, এবং তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করিয়া, ধ্বস্তবিধ্বস্ত করিয়াছিলেন। পরবল এই কর্ক্করাজের পুত্র। ডাক্তার কিল্হর্ণ পথরি-স্তম্ভলিপির ভূমিকায় লিখিয়া গিয়াছেন,—তিনি ভৃগুকচ্ছে ৮১৩ সম্বতে [৭৫৬ খৃষ্টাব্দে] শ্রীনাগাবলোকের বিজয়রাজ্যে জনৈক চাহমান মহাসামন্তাধিপতি-সম্পাদিত একখানি তাম্রশাসনের ফটোগ্রাফ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই তাম্রশাসন যদি প্রামাণ্য বলিয়। স্বীকৃত হয়, এবং পথরি-স্তম্ভলিপির নাগাবলোক এবং এই শাসনোক্ত নাগাবলোক যদি একই ব্যক্তি হয়, তবে কর্ক্করাজ এবং তদীয় পুত্র পরবলকে ৭৫৬ হইতে ৮৬১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে স্থাপন করিতে হয়। আমাদের কাছে এখন যে কিছু প্রমাণ উপস্থিত, তাহার উপর নির্ভর করিয়া, ইহা ভিন্ন অন্য কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না; এবং নাগাবলোকের প্রতিদ্বন্দ্বী কর্ক্করাজের পুত্র পরবল [৮৬১ খৃষ্টাব্দে] দীর্ঘকালব্যাপী রাজত্বের পর, বার্দ্ধক্যে উপনীত হইয়াছিলেন, ইহাও স্বীকার করিতে হয়। সুতরাং পরবল এবং ধর্ম্মপাল প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন, এবং ধর্ম্মপাল কর্ত্তৃক পরবলের কন্যার পাণিগ্রহণ অসম্ভব বোধ হয় না। ধর্ম্মপাল সম্ভবতঃ প্রৌঢ়াবস্থায় রণ্ণাদেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। ধর্ম্মপাল ও রণ্ণাদেবীর পুত্র দেবপালও দীর্ঘকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন। দেবপালদেবের [মুঙ্গেরে প্রাপ্ত] তাম্রশাসন তাঁহার রাজত্বের ৩৩ বৎসরে সম্পাদিত হইয়াছিল; এবং তারানাথ লিখিয়া গিয়াছেন,—দেবপাল ৪৮ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। যৌবনে রাজ্যলাভ না করিলে, দেবপালদেবের পক্ষে এত দীর্ঘকাল রাজ্যভোগ ঘটিয়া উঠিত না। ধর্ম্মপালের মৃত্যুসময়ে দেবপালদেব যুবক ছিলেন, এই কথা স্বীকার করিলে, পরবলের প্রথম যৌবনে জাত দুহিতা রণ্ণাদেবীকে ধর্ম্মপাল প্রৌঢ়বয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন,ইহা অনুমান করা যাইতে পারে। রাষ্ট্রকূট পরবলের পক্ষে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া, ধর্ম্মপালের ন্যায় পরাক্রমশালী নৃপতির আশ্রয় গ্রহণ করিবার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্ৰকূট-মহাসামন্তাধিপতি কর্ক্করাজ সুবর্ণবর্ষের [বরোদায় প্রাপ্ত] ৭৩৪ শকাব্দের [৮১২ খৃষ্টাব্দের] তাম্রশাসন হইতে জানা যায়,—রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় গোবিন্দ, কর্ক্করাজের পিতা ইন্দ্ররাজকে “লাট”-মণ্ডলের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়াছিলেন। সুতরাং এই নিমিত্তই হয়ত রাষ্ট্রকূট-পরবলকে লাট (গুজরাত) ত্যাগ করিয়া, পথরি-প্রদেশে সরিয়া আসিতে হইয়াছিল। গুর্জ্জরের উচ্চাভিলাষী প্রতীহার-রাজগণ এখানে হয়ত পরবলকে উৎপাত করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। সুতরাং প্রতীহার-রাজের প্রবল-প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্ম্মপালের আশ্রয় গ্রহণ ভিন্ন, পরবলের আত্মরক্ষার উপায়ান্তর ছিল না। সম্ভবতঃ এই সূত্রেই পরবল রণ্ণাদেবীকে ধর্ম্মপালের হস্তে সম্প্রদান করিয়াছিলেন।
- ↑ Indian Antiquary, Vol. IV, p. 366.
- ↑ Journal of the Bombay Branch of the Royal Asiatic Society, 1906, p. 116.
- ↑ Epigraphia Indica, Vol. VIII, app. II. p. 3.