গৌড়রাজমালা/মাৎস্যন্যায়—গোপাল

 “শৈলবংশীয়” গৌড়পতির অভ্যূদয় হইতে আরম্ভ করিয়া, বৎসরাজের আক্রমণ-পর্য্যন্ত পুনঃ পুনঃ বহিঃশত্রুর আক্রমণের এবং রাজবিপ্লবের ফলে, গৌড়-মণ্ডলের আভ্যন্তরীণ অবস্থা যে কিরূপ শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। কার্য্যত দেশে রাজশাসন ছিল না। সুযোগ পাইয়া, সবল দুষ্টগণ অবশ্যই দুর্ব্বল প্রতিবেশীর উৎপীড়ন করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এই সময়ের গৌড়মণ্ডলের অবস্থা লক্ষ্য করিয়া, তারানাথ লিখিয়া গিয়াছেন—“উড়িষ্যা, বঙ্গ এবং প্রাচ্যদেশের আর পাঁচটি প্রদেশের বিভিন্ন অংশে প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, প্রত্যেক ব্রাহ্মণ এবং প্রত্যেক বৈশ্য পার্শ্ববর্ত্তী ভূভাগে আপন আপন প্রাধান্য স্থাপিত করিয়াছিলেন; কিন্তু সমগ্র দেশের কোনও রাজা ছিল না।”[] সস্কৃত ভাষায় এইরূপ অরাজক-অবস্থাকেই “মাৎস্যন্যায়” কহে। এই “মাৎস্যন্যায়ের” ফলে গৌড়মগুলে পালরাজগণের অভ্যুদয়।

 “মাৎস্য-ন্যায় দূর করিবার অভিপ্রায়ে, জনসাধারণ [প্রকৃতিভিঃ] বপ্যটতনয় গোপালকে রাজলক্ষ্মীর করগ্রহণ করাইয়াছিলেন,”—গোপালের পুত্র ধর্ম্মপালের খালিমপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে গোপালের রাজপদ-লাভের এইরূপ বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে। তারানাথও এই নির্ব্বাচনের উল্লেখ করিয়াছেন; এবং গোপাল প্রথমে বাঙ্গালা দেশে রাজপদে নির্ব্বাচিত হইয়া, পরে মগধ বশীভূত করিয়াছিলেন, এইরূপও লিখিয়া গিয়াছেন।[] গৌড়রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শশাঙ্ক বাঙ্গালী ছিলেন; এবং তারানাথের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইলে, মনে করিতে হয়—বাঙ্গালার জনসাধারণ কর্ত্তৃকই [অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগে গোপালের নির্ব্বাচনসূত্রে] “মাৎস্য-ন্যায়” বিদুরিত এবং গৌড়রাষ্ট্র পুনরুজ্জীবিত হইয়াছিল। যদিও তারানাথ গোপালের নির্ব্বাচনের আট শতাব্দেরও অধিক কাল পরে [১৬০৮ খৃষ্টাব্দে] মগধের ইতিহাস সঙ্কলন করিয়া গিয়াছেন, তথাপি তাঁহার এই বিবরণ যে অমূলক নহে, সমসাময়িক লিপিতেও তাহার আভাস পাওয়া যায়। আমরা ধর্ম্মপালের] প্রসঙ্গে দেখিতে পাইব, প্রতীহার-রাজ ভোজের সাগর-তালের শিলালিপিতে ধর্ম্মপালকে “বঙ্গপতি” এবং তাঁহার সেনাগণকে “বাঙ্গালী” [বঙ্গাণ্] বলা হইয়াছে। বাঙ্গালাদেশকে পালরাজগণের আদি-নিবাস না ধরিয়া লইলে, এইরূপ উল্লেখ নিরর্থক হয়।

 খালিমপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে গোপালের পিতামহ “সর্ব্ববিদ্যাবিদ্” [সর্ব্ববিদ্যাবদাত] এবং তাঁহার পিতা বপ্যট “খণ্ডিতারাতি” (জিতশত্রু) এবং কীর্ত্তিকলাপ দ্বারা সসাগর-ধরা-মণ্ডনকারী বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। ইহা হইতে অনুমান হয়,—বপ্যট সমৃদ্ধ এবং সমর-কুশল ছিলেন। গোপাল রাজপদে নির্ব্বাচিত হইয়াই, সম্ভবত গৌড়মণ্ডল একচ্ছত্র করিতে যত্নবান হইয়াছিলেন; এবং গুর্জ্জরপতি বৎসরাজ [৭৮৪ হইতে ৭৯৪ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময়ে] যখন রাষ্ট্ৰকূট-রাজ ধ্রুব কর্ত্তৃক রাজপুতনার মরুভূমিতে বিতাড়িত হইয়াছিলেন, তখন স্বীয় উদ্দেশ্য সাধনের অবসর লাভ করিয়াছিলেন। দেবপালের [মুঙ্গেরে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—গোপাল সমুদ্র পর্য্যন্ত ধরণীমণ্ডল অধিকার করিয়াছিলেন; এবং তারানাথ লিখিয়াছেন,—গোপাল মগধ অধিকার করিয়াছিলেন। হয়ত মিথিলা বা তীরভুক্তি [ত্রিহুত]ও তাঁহার পদানত হইয়াছিল। তীরভুক্তি যে পাল-নরপালগণের অধিকারভুক্ত ছিল, নারায়ণপালের [ভাগলপুরে প্রাপ্ত] তাম্রশাসন তাহার সাক্ষ্যদান করিতেছে; অথচ কখন্ যে তীরভুক্তি অধিকৃত হইয়াছিল, তাহা কোনও তাম্রশাসনে উল্লিখিত হয় নাই। সুতরাং গোপালই তীরভুক্তি অধিকার করিয়াছিলেন, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।

  1. “In Odivisa, in Bengal, and the other five provinces of the east, each Kshatriya Brahman and merchant constituted himself a king of his surroundings, but there was no king ruling the country.”—The Indian Antiquary, Vol. IV, pp. 365-366.
  2. “The writer tells how the wife of one of the late kings by night assassinated every one of those who had been chosen to be kings, but after a certain number of years Gopala, who had been elected for a time, delivered himself from her and was made king for life. He began to reign in Bengal, but afterwards reduced Magadha also under his power. He built the Nalandara temple not far from Otantapur, and reigned forty-five years.”—Indian Antiquary, Vol. IV, p. 366.