গৌড়রাজমালা/ভট্ট ভবদেব
ভুবনেশ্বরের প্রশস্তিতে উল্লিখিত ভট্টভবদেবের বংশ-বৃত্তান্তের সহিত আদিশূর কর্ত্তৃক ব্রাহ্মণানয়ন-বৃত্তান্তের সামঞ্জস্য অসম্ভব। ভবদেব সাবর্ণ-গোত্রীয়, তাঁহার পূর্ব্বপুরুষগণ সিদ্ধলগ্রামবাসী, এবং তাঁহার জননী বন্দ্যঘটী-বংশীয়া ছিলেন। সুতরাং ভবদেব যে রাঢ়িশ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন, তদ্বিষয়ে আর সংশয় হইতে পারে না। প্রশস্তির রচয়িতা, ভবদেবের সুহৃদ্ বাচস্পতি, যে ইদানীন্তনকালের ঘটকগণের অপেক্ষা ভবদেবের পূর্ব্বপুরুষগণসম্বন্ধে অনেক অধিক খবর রাখিতেন, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। প্রশস্তিতে ভবদেব-বালবলভীভুজঙ্গকে ধরিয়া, সাত পুরুষের বিবরণ আছে। প্রশস্তিতে উল্লিখিত প্রথম ভবদেব খৃষ্টীয় দশম শতাব্দের শেষপাদে বর্ত্তমান ছিলেন, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে; এবং এই প্রথম ভবদেব যে গৌড়-নৃপ হইতে হস্তিনীভিট্টগ্রাম প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তিনি সম্ভবত প্রথম মহীপাল। বাচস্পতি যে ভাবে প্রশস্তির সূচনায় সিদ্ধলগ্রামবাসী সাবর্ণগোত্রীয় ব্রাহ্মণগণের প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়াছেন, তাহাতে মনে হয়, যেন স্মরণাতীত কাল হইতে সাবর্ণগোত্রীয় শ্রোত্রিয়েরা তথায় বাস করিতেছিলেন। এখন যেমন সাবর্ণগোত্রীয় রাঢ়ীয়-বারেন্দ্র ব্রাহ্মণমাত্রই আদিশূর-আনীত বেদগর্ভ বা পরাশর হইতে বংশপরিচয় দিয়া থাকেন, তখন এই প্রবাদ প্রচলিত থাকিলে, বাচস্পতি বোধ হয় প্রিয়-সুহৃদের প্রশস্তিতে তাহার উল্লেখ করিতে বিস্মৃত হইতেন না। ভবদেবের ভুবনেশ্বরের প্রশস্তিতে আদিশূরকর্ত্তৃক সাবর্ণগোত্রীয় ব্রাহ্মণ আনয়নের প্রতিকূল প্রমাণ দেখিয়া, আদিশূর-বৃত্তান্তের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে ঘোর সংশয় উপস্থিত হয়। যত দিন না কোনও তাম্রশাসন বা শিলালিপি দ্বারা এই সংশয় অপসারিত হয়, ততদিন পরস্পর-বিরোধী কুলশাস্ত্রের প্রমাণ অবলম্বনে, আদিশূরের ইতিহাস-উদ্ধারের যত্ন বিড়ম্বনামাত্র।
ভবদেব-বালবলভীভুজঙ্গের অতিবৃদ্ধ-বৃদ্ধ-প্রপিতামহ প্রথম ভবদেবের সময়ে, রাঢ় গৌড়রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত এবং গৌড়-নৃপের পদানত ছিল, এবং প্রথম ভবদেব গৌড়-নৃপের প্রসাদে হস্তিনীভিট্টগ্রাম লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু ভবদেবের পিতামহ আদিদেবের সময়ে, রাঢ়ে-বঙ্গে “বঙ্গরাজের” প্রাধান্য স্থাপিত হইয়াছিল, এবং আদিদেব তাঁহার সন্ধিবিগ্রহী ছিলেন। ভট্ট গুরবের এবং বৈদ্যদেবের বংশবৃত্তান্ত হইতে জানা যায়, তৎকালে মন্ত্রিপদ বংশানুগত ছিল। আদিদেব যে বঙ্গ-রাজের সন্ধিবিগ্রহী ছিলেন, তিনি সম্ভবত হরিবর্ম্মদেবের পিতা (?) জ্যোতিবর্ম্মা। জ্যোতিবর্ম্মা হয়ত গৌড়েশ্বর কুমারপালের সময়ে, দক্ষিণ বঙ্গে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বনে যত্নবান্ হইয়াছিলেন, এবং তাঁহার দমনার্থ প্রেরিত বৈদ্যদেবকর্ত্তৃক নৌ-যুদ্ধে পরাভূত হইয়াছিলেন। কুমারপালের মৃত্যুর পর, জ্যোতিবর্ম্মার অভিলাষপূরণের আর কোন বাধা ছিল না। আদিদেবের পুত্র গোবর্দ্ধন যুদ্ধক্ষেত্রে [বীরস্থলীষু] বাহুবলে রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন [বর্দ্ধয়ন্ বসুমতী;] বলিয়া কথিত হইয়াছেন; কিন্তু তিনি কখন মন্ত্রিপদ লাভ করিয়াছিলেন, এরূপ কোনও প্রমাণ নাই। গোবর্দ্ধন হয়ত জ্যোতিবর্ম্মা বা হরিবর্ম্মার একজন সেনানায়ক ছিলেন, এবং পিতার জীবদ্দশায় পরলোক গমন করায়, মন্ত্রিপদে উন্নীত হইবার অবসর পাইয়াছিলেন না। সুতরাং আদিদেবের মৃত্যুর পর, ভট্টভবদেব বালবলভীভুজঙ্গ হরিবর্ম্মার মন্ত্রিপদ লাভ করিয়াছিলেন; এবং হরিবর্ম্মার মৃত্যুর পর, তাঁহার অনুল্লিখিতনামা পুত্রের এবং উত্তরাধিকারীর সময়েও, সেই পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রশস্তিকার বাচস্পতি ১৮টি শ্লোকে ভবদেব বালবলভীভুজঙ্গের গুণগ্রামের এবং কীর্ত্তিকলাপের বর্ণন করিয়াছেন; তিনি কি কি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, তাহারও পরিচয় দিয়াছেন। কিন্তু ভবদেবের বাহুবলে এবং নীতিকৌশলে তাঁহার প্রভুর রাজ্য কতটা উন্নতি এবং বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল, এই সুদীর্ঘ প্রশস্তিমধ্যে তাহার কোনও উল্লেখ নাই। ইহাতে অনুমান হয়, সেনবংশের অভ্যুদয়ের পর, ভবদেব স্বীয় প্রভুকে সেনবংশীয় গৌড়াধিপের অধীনতা স্বীকারে উপদেশ দিয়া, স্বয়ং অগস্ত্যবৎ বৌদ্ধাম্ভোনিধি-গণ্ডুষকরণে, পাষণ্ড-তার্কিক-দলনে, এবং স্মৃতি, জ্যোতিষ, এবং মীমাংসা-শাস্ত্রের চর্চ্চায়, মনোনিবেশ করিয়ছিলেন।