গৌড়লেখমালা (প্রথম স্তবক)/গরুড়স্তম্ভ-লিপি

বর্তমান ঐতিহাসিক মতে এই লিপির সপ্তম শ্লোকে সুররাজকল্প শব্দে এবং ত্রয়োদশ শ্লোকে গৌড়েশ্বর শব্দে দেবপাল-পুত্র মহেন্দ্রপালকে এবং সপ্তদশ শ্লোকে গোপাল শব্দে প্রথম শূরপালের পুত্র দ্বিতীয় গোপালকে বোঝানো হয়েছে। পঞ্চদশ শ্লোকের শূরপাল ছিলেন মহেন্দ্রপালের ছোটভাই প্রথম শূরপাল। এই লিপিতে প্রথম বিগ্রহপালের নাম নেই, সরাসরি তাঁর পুত্র নারায়ণপালের নাম আছে। বিগ্রহপালের রাজ্যাভিষেক আদৌ হয়েছিল কিনা, তাতেও বর্তমান ঐতিহাসিকদের সন্দেহ আছে। বিস্তৃত বিবরণের জন্য দেখুন: ভট্টাচার্য, সুরেশচন্দ্র, Pāla Kings in the Badal Praśasti — A Stock-Taking, Journal of Ancient Indian History, Vol. XXIV, 2007-08, pp. 73-82.

গরুড়স্তম্ভ-লিপি।

[বাদাল-প্রস্তরলিপি]
প্রশস্তি-পরিচয়।

 দিনাজপুরের অন্তর্গত বাদাল নামক স্থানে কোম্পানী-বাহাদুরের একটি কুঠীবাড়ী বর্ত্তমান ছিল। তাহার অধ্যক্ষ [স্যর] চাৰ্লস্ উইল্‌কিন্স ১৭৮০ খৃষ্টাব্দের শীতকালে বাদালের তিন মাইলআবিষ্কার-কাহিনী। দূরবর্ত্তী একটি বনভূমির মধ্যে [প্রায় দ্বাদশ ফুট উচ্চ একটি ধ্বংসাবশিষ্ট প্রস্তর-স্তম্ভের গাত্রে] এই পুরাতন প্রশস্তি উৎকীর্ণ থাকিবার সন্ধান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সেই সময় হইতে, এই স্তম্ভ-লিপির কথা ক্রমে বিদ্বৎসমাজে সুপরিচিত হইয়াছে। বাদালের নিকটবর্ত্তী স্থানে অবস্থিত বলিয়া, ইহা “বাদাল-প্রস্তরলিপি” নামে কথিত হইত। ইহা বাদাল অপেক্ষা মঙ্গলবারি-হাটের অধিক নিকটবর্ত্তী বলিয়া, “মঙ্গলবারি-প্রস্তরলিপি”-নামেও কথিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে। প্রকৃত প্রস্তাবে, এই প্রশস্তি একটি গরুড়-স্তম্ভের গাত্রে উৎকীর্ণ রহিয়াছে বলিয়া, ইহা “গরুড়স্তম্ভ-লিপি” নামেই কথিত হইবার যোগ্য।

 এই স্তম্ভলিপি আবিষ্কৃত হইবার পর, মালদহের কুঠীর অধ্যক্ষ জৰ্জ উড্‌নী [১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে] এবং মালদহের অন্তর্গত গুয়ামালতী কুঠীর অধ্যক্ষ ক্রেটন্‌ [১৭৮৬ খৃষ্টাব্দে] পরিদর্শন করিতেপাঠোদ্ধার-কাহিনী। আসিয়া, স্তম্ভ-গাত্রে আপন আপন নাম উৎকীর্ণ করিয়া গিয়াছিলেন; তাহা অদ্যাপি দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু উইল্‌কিন্স ভিন্ন, আর কাহারও, তৎকালে পাঠোদ্ধার-সাধনের চেষ্টা করিবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। উইল্‌কিন্স কিরূপ পাঠ উদ্ধৃত করিয়াছিলেন, তাহা আর জানিবার উপায় নাই। তিনি ইংরাজী ভাষায় যে মর্ম্মানুবাদ লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহাই [১৭৮৮ খৃষ্টাব্দে] এসিয়াটিক্ সোসাইটির পত্রিকায়[১] প্রকাশিত হইয়াছিল। সেই মর্ম্মানুবাদ পাঠে জানিতে পারা যায়,—উইল্‌কিন্স সকল শ্লোকের বিশুদ্ধ পাঠ উদ্ধৃত করিতে পারেন নাই। [১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে] দিনাজপুরের কলেক্‌টর ওয়েষ্টমেকট্‌ পণ্ডিতবর হরচন্দ্র চক্রবর্ত্তি-সম্পাদিত একটি পাঠ প্রেরণ করায়, [শ্রীযুক্ত প্রতাপচন্দ্র ঘোষজকৃত ইংরাজী অনুবাদ সহ] তাহা সোসাইটীর পত্রিকায়[২] প্রকাশিত হইয়া, নানা গ্রন্থে ও প্রবন্ধে উদ্ধৃত হইতেছিল। কিন্তু চক্রবর্ত্তী মহাশয়, সপ্তম এবং ত্রয়োদশ শ্লোক ভিন্ন, আর একটি শ্লোকও 

৭০ পৃষ্ঠা]
গরুড় স্তম্ভ-লিপি।
K. V. Seyne & Bros.

যথাযথভাবে উদ্ধৃত করিতে পারেন নাই; বরং অধিকাংশ স্থলেই, স্বকপোল-কল্পিত পাঠ সংযুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন। অবশেষে অধ্যাপক কিল্‌হর্ণের অধ্যবসায়বলে একটি মূলানুগত পাঠ মুদ্রিত হইয়াছে।[৩]

 যাঁহারা এই প্রস্তর-লিপির পাঠোদ্ধারে ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই ইহার বাখ্যা-কার্য্যেও হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন। কিন্তু প্রকৃত পাঠ উদ্ধৃত করিতে অসমর্থ হইয়া, অনেকেই প্রকৃতব্যাখ্যা-কাহিনী। ব্যাখ্যার সন্ধানলাভ করিতে পারেন নাই। অধ্যাপক কিল্‌হর্ণের উদ্ধৃত পাঠেও দুই এক স্থলে সংশয়ের অভাব ছিল না। অনুসন্ধান-সমিতি উপর্য্যুপরি এই স্তম্ভ-লিপির পাঠ সংকলনের চেষ্টা করিয়া, এবং স্তম্ভগাত্রে উৎকীর্ণ লিপির সহিত প্রচলিত পাঠ মিল করিয়া দেখিয়া, একটি বিশুদ্ধ পাঠ মুদ্রিত করিয়া, বিনামূল্যে বিতরণ করিয়াছিলেন। এই লিপির সহিত বাঙ্গালার ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্ত্তমান থাকিলেও, এ পর্য্যন্ত ইহার বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয় নাই।

 এই প্রস্তর-স্তম্ভটি এক দিকে ঈষৎ হেলিয়া পড়িয়াছে, এবং ইহার বজ্রদীর্ণ শীর্ষভাগ দ্বিধা বিভক্ত হইয়া গিয়াছে। তজন্য ইহার মূলদেশে সম্প্রতি একটি ইষ্টক-বেদিকা সংযুক্ত হইয়াছে। তাহারলিপি-পরিচয়। পরিধি ১৮ ফুট ১০ ইঞ্চ। বেদিকা-সংলগ্ন প্রস্তরস্তম্ভ-মূলের পরিধি ৫ ফুট ১০ ইঞ্চ। বেদিকার উপর হইতে ১ ফুট ৪ ইঞ্চ ঊর্দ্ধে প্রস্তর-লিপিটি সমাপ্তি লাভ করিয়াছে। তাহা সংস্কৃত ভাষা-নিবদ্ধ অষ্টাবিংশতি-পংক্তি-বিন্যস্ত অষ্টাবিংশতি-শ্লোকাত্মক ক্ষুদ্র কাব্য বলিয়া কথিত হইতে পারে। পংক্তিগুলি প্রায় ১ ফুট ৯ ইঞ্চ দীর্ঘ, অক্ষরের আয়তন অর্দ্ধ ইঞ্চ হইবে। ১।২।২৩।২৫।২৭ সংখ্যক শ্লোকের কোন কোন অক্ষর বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে; অন্যান্য অক্ষরাবলী যেরূপ সুদৃশ্য, সেইরূপ সুখপাঠ্য। স্তম্ভটি এক অখণ্ড কৃষ্ণাভ ধূসর প্রস্তরে নির্ম্মিত; তাহার সর্ব্বাঙ্গে যে “বজ্রলেপ” সংযুক্ত ছিল, স্থানে স্থানে তাহা উঠিয়া গিয়াছে। তথাপি স্তম্ভ-গাত্র বিলক্ষণ মসৃণ। এই প্রস্তর-লিপিতে যে সকল ঐতিহাসিক বিবরণ উল্লিখিত আছে, তাহা বঙ্গানুবাদে দ্রষ্টব্য।


প্রশস্তি-পাঠ।

٭ ٭: शाण्डिल्यवंशेभूद्वीरदेव स्तदन्वये
पाञ्चालो नाम तद्गीत्रे गर्ग स्तस्मादजायत॥(১)

शक्रः पुरोदिशि पति र्न दिगन्तरेषु
तत्रापि दैत्यपतिभि र्जित एव
[सद्य]ः
धर्म्मः कृत स्तदधिप स्त्वखिलासु दिक्षु
स्वामी मयेति विजहास बृहस्पतिं यः॥(২)
पत्नीच्छानाम तस्यासी दिच्छेवान्त-र्व्विवर्त्तिनी।
निसर्ग्ग-निर्म्मल-स्निग्धा कान्ति श्चन्द्र-
मसो यथा॥(৩)
विद्या-चतुष्टय-मुखाम्बु-रुहात्त-लक्ष्मा
नैसर्ग्गिकोत्तम-पदा-धरित-त्रिलोकः।
सूनु स्तयोः कमल-योनि रिव द्विजेशः
श्रीदर्भपाणि रिति नाम निज न्दधा-
नः॥(৪)
आरेवा-जनकान्मतङ्गज-मद-स्तिम्यच्छिला-संहते-
रागौरी-पितु-रीश्वरेन्दु-किरणैः पुष्यत् सितिम्नो गिरेः।
मार्त्तण्डास्तमयोदयारुण-जलादावारि-रा-
शि-द्वयात्
नीत्या यस्य भुवं चकार करदां श्रीदेवपालो नृपः॥(৫)
माद्यन्नाना-गजेन्द्र-स्रवदनवरतोद्दाम-दान-प्रवाहो-
न्मृष्ट-क्षोणी-विसर्पि-प्रबल-
घनरजः-सम्वृताशावकाशं।
दिक्‌चक्रायात-भूभृत्-परिकर-विसरद्वाहिनी-दुर्व्विलोक-
स्तस्थौ श्रीदेवपालो नृपति रवसरापेक्षया द्वारि
यस्य॥(৬)


दत्त्वा प्यनल्पमुड़ुप-च्छवि-पीठ मग्रे
यस्यासनं नरपति: सुरराजकल्पः।
नाना-नरेन्द्र-मुकुटाङ्कित-पादपांसुः
सिंहासनं सच-
कितः स्वय माससाद॥(৭)
तस्य श्रीशर्क्करादेव्या मत्रेः सोम इव द्विजः।
अभूत् सोमेश्वरः श्रीमान् परमेश्वर-वल्लभः॥(৮)
न भ्रान्तं विकटं
धनञ्जय-तुला मारुह्य विक्रामता
वित्यान्यर्थिषु वर्षता स्तुति-गिरो नोद्गर्व्व माकर्ण्णिताः।
नैवोक्ता मधुरं बहु-प्रणयिनः सम्वल्गिताश्च श्रि-
१० या
येनैवं स्वगुणै र्ज्जगद्विसदृशै श्चक्रे सतां विस्मयः॥(৯)
शिव इव करं शिवाया हरिरिव लक्ष्म्या गृहाश्रम-प्रेप्सुः।
अनुरूपाया विधि-
११ वत् रल्लादेव्याः स जग्राह॥(১০)
आसन्नाजिह्म-राजद्बहल-शिखिशिखा-चुम्बि-दिक्चक्रवालो
दुर्व्वार-स्फारशक्तिः स्वरस-परिणता-शेष-विद्या-
१२ प्रतिष्ठः।
ताभ्यां जन्म प्रपेदे त्रिदशजन-मनो-नन्दनः स्व-क्रियाभिः
श्रीमान् केदारमिश्रो गुह इव विकशज्जातरूप-प्रभाव:॥(১১)

१३ सकृद्दर्शन-सम्पीतान् चतुर्व्विद्या-पयोनिधीन्।
जहासागस्त्य-सम्पत्ति मुद्गिरन् बाल एव यः॥(১২)
उत्कीलितोत्कलकुलं हृत-हूणगर्व्वं
खर्व्वीकृ-
१४ त-द्रविड़-गुर्ज्जर-नाथ-दर्पं।
भूपीठ-मब्धि-रशनाभरण म्बुभोज
गौड़ेश्वर श्चिर मुपास्य धियं यदीयां॥(১৩)
स्वयमपहृतवित्तानर्थिनो यो-
१५ नुमेने
द्विषदि सुहृदि चासीन्निर्व्विवेको यदात्मा।
भवजलधि-निपाते यस्य भीश्च त्रपा च
परिमृदित-कशा(षा)यो यः परे धाम्नि रेमे॥(১৪)
यस्ये-
१६ ज्यासु बृहस्पति-प्रतिकृतेः श्रीशूरपालो नृपः
साक्षादिन्द्र इव क्षताप्रियबलो गत्वैव भूयः स्वयं।
नानाम्भोनिधि-मेखलस्य जगतः
१७ कल्याण-सङ्गी (?)चिरं
श्रद्धाम्भः-प्लुत-मानसो नत-शिरा जग्राह पूत म्पयः॥(১৫)
देवग्राम-भवा तस्य पत्नी वव्वाभिधाऽभवत्।
अतुल्या चलया ल-
१८ क्ष्म्या सत्या चाप्य[नपत्य]या॥(১৬)



सा देवकीव तस्मात् यशोदया स्वीकृतं पतिं लक्ष्म्याः।
गोपाल-प्रियकारक मसूत पुरुषोत्तमं तनयं॥(১৭)
१९ जमदग्नि-कुलोत्पन्नः सम्पन्नक्षत्र-चिन्तकः।
यः श्रीगुरवमिश्राख्यो रामो राम इवापरः॥(১৮)
कुशलो गुणवान् विवेक्तुं विजिगीषु र्यन्नृप-
२० श्च बहुमेने।
श्रीनारायणपालः प्रशस्ति रपरास्तु का तस्य॥(১৯)
वाचा म्बैभव मागमेष्वधिगमं नीतः परां निष्ठतां
वेदार्थानुगमा-दसी-
२१ ममहसो वंशस्य सम्वन्धितां।
आसक्तिं गुणकीर्त्तनेषु महतां निष्णाततां ज्योतिषो
यस्यानल्पमते रमेय यशसो धर्म्मावतारोऽवदत्॥(২০)
२२ यस्मिन् मिथः श्रीभृति वागधीशे
विहाय वैराणि निसर्ग्गजानि।
उभे स्थिते सख्यमिवादि(धि)गन्त्र्या-
वेकत्र लक्ष्मीश्च सरस्वती च॥(২১)
शास्त्रानुशील-
२३ न-गभीरगुणै र्वचोभि-
र्व्विद्वत्-सभासु परवादि-मदावलेपः।
उद्वासितः सपदि येन युधि द्विषाञ्च
निस्सीम-विक्रम-धनेन [भ]टाभिमानः॥(২২)

२४ [आविर्ब्बभ्रू]व सहसैव फलं न यस्य
य स्तादृशं व्यधित कर्णसुख न्न किञ्चित्।
यत् प्राप्य दानपति मर्थिजनोन्य मेति
तत् केलिदानमपि यस्य न जातु
२५ ٭ ٭॥(২৩)
अतिलोमहर्षणेषु कलियुग-वाल्मीकि-जन्म-पिशुनेषु।
धर्म्मेतिहासपर्व्वसु पुण्यात्मा यः श्रुती र्व्व्यवृणोत्॥(২৪)
असिन्धु-प्रसृता यस्य स्वर्धुनी
२६ ٭ ٭ [धा]।
वाणी प्रसन्न-गम्भीरा धिनोति च पुनाति च॥(২৫)
पितृत्वं स्वय मास्थाय पुत्रत्व मगमत् स्वयं।
ब्रह्मेति पुरुषान् यस्य वंशे यञ्च प्रपेदिरे॥(২৬)
शोभो
२७ ٭ ٭ ٭ ٭ स्वकीय-वपुषो लोकेक्षण-ग्राहिणि
स्वाभिप्राय इवातुलोन्नतिमति स्वप्रेमबन्ध-स्थिरे।
स्पष्टं शल्य इवार्पिते कलि-हृदि स्तम्भेत्र ते-
२८ [न] ٭ ٭
٭ ٭ ٭ फणिनां हरेः प्रियसख स्तार्क्ष्योय मारोपितः॥(২৭)
भ्रान्त्वा दिगन्त मखिलं गत्वा पातालमूल मप्यस्मात्
यश इ[ह्र] तस्योत्तस्थौ हृताहि-गरुड़च्छलादमल[म्॥](২৮)
२९ सूत्रधारविष्णुभद्रेण٭ प्रशस्ति क्षणितं॥

বঙ্গানুবাদ।

(১)

 শাণ্ডিল্যবংশে[৪] [বিষ্ণুঃ?],[৫] তদীয় অন্বয়ে বীরদেব, তদ্‌গোত্রে পাঞ্চাল, এবং পাঞ্চাল হইতে [তৎপুত্র] গর্গ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।

(২)

 সেই গর্গ এই বলিয়া বৃহস্পতিকে উপহাস করিতেন যে,—[শক্র] ইন্দ্রদেব কেবল পূর্ব্বদিকেরই অধিপতি, দিগন্তরের অধিপতি ছিলেন না; [কিন্তু বৃহস্পতির ন্যায় মন্ত্রী থাকিতেও] তিনি সেই একটিমাত্র দিকেও [সদ্যঃ][৬] দৈত্যপতিগণ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন; [আর] আমি সেই পূর্ব্বদিকের[৭] অধিপতি ধর্ম্ম[৮] [নামক] নরপালকে অখিল দিকের স্বামী করিয়া দিয়াছি।

(৩)

 নিসর্গ-নির্ম্মল-স্নিগ্ধা চন্দ্রপত্নী কান্তিদেবীর[৯] ন্যায়, অন্তর্ব্বিবর্ত্তিনী ইচ্ছার অনুরূপা, তাঁহার ইচ্ছানাম্নী পত্নী ছিলেন।

(৪)

 বেদচতুষ্টয়রূপ-মুখপদ্ম-লক্ষণাক্রান্ত, স্বাভাবিক উৎকৃষ্ট পদগৌরবে ত্রিলোকশ্রেষ্ঠ, কমল-যোনি ব্রহ্মার ন্যায়, তাঁহাদের দ্বিজোত্তম[১০] পুত্র,[১১] নিজের “শ্রীদর্ভপাণি” এই নাম ধারণ করিয়াছিলেন।

(৫)

 সেই দর্ভপাণির নীতি-কৌশলে[১২] শ্রীদেবপাল [নামক] নৃপতি মতঙ্গজ-মদাভিষিক্ত-শিলা-সংহতিপূর্ণ রেবা (নর্ম্মদা] নদীর জনক [উৎপত্তিস্থান বিন্ধ্যপর্ব্বত] হইতে [আরম্ভ করিয়া] মহেশ-ললাট-শোভি-ইন্দু-কিরণ-শ্বেতায়মান গৌরীজনক [হিমালয়] পর্ব্বত পর্য্যন্ত, সূর্য্যোদয়াস্তকালে অরুণরাগ-রঞ্জিত [উভয়] জল-রাশির আধার পূর্ব্ব-সমুদ্র এবং পশ্চিম-সমুদ্র [মধ্যবর্ত্তী] সমগ্র ভূভাগ কর-প্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

(৬)

 নানা-মদমত্ত-মতঙ্গজ-মদবারি-নিষিক্ত ধরণিতল[১৩]-বিসর্পি-ধূলিপটলে দিগন্তরাল সমাচ্ছন্ন করিয়া, দিক্‌চক্রাগত-ভূপালবৃন্দের চিরসঞ্চরমান সেনাসমূহ যাঁহাকে নিরন্তর দুর্ব্বিলোক করিয়া রাখিত, সেই দেবপাল [নামক] নরপাল [উপদেশ গ্রহণের জন্য] দর্ভপাণির অবসরের অপেক্ষায়, তাঁহার দ্বারদেশে দণ্ডায়মান থাকিতেন।

(৭)

 সুররাজকল্প [দেবপাল] নরপতি [সেই মন্ত্রিবরকে] অগ্রে চন্দ্রবিম্বানুকারী[১৪] [মহার্হ] আসন প্রদান করিয়া, নানা-নরেন্দ্র-মুকুটাঙ্কিত-পাদপাংসু হইয়াও, স্বয়ং সচকিত[১৫] ভাবেই সিংহাসনে উপবেশন করিতেন।

(৮)

 অত্রি হইতে[১৬] যেমন চন্দ্রের উৎপত্তি হইয়াছিল, সেইরূপ তাঁহার এবং শর্করা দেবীর পরমেশ্বর-বল্লভ[১৭] শ্রীমান্ সোমেশ্বর [নামক] পুত্র উৎপন্ন হইয়াছিল।

(৯)

 তিনি বিক্রমে ধনঞ্জয়ের সহিত তুলনা লাভের উপযুক্ত [উচ্চ] স্থানে আরোহণ করিয়াও, [বিক্রম প্রকাশের পাত্রাপাত্র-বিচার-সময়ে ধনঞ্জয়ের ন্যায়] ভ্রান্ত বা নির্দ্দয় হইতেন না; তিনি অর্থিগণকে বিত্তবর্ষণ করিবার সময়ে, [তাহাদের মুখের] স্তুতি-গীতি শ্রবণের জন্য উদ্গর্ব্ব হইতেন না; তিনি ঐশ্বর্য্যের দ্বারা বহু বন্ধুজনকে [সংবল্গিত] নৃত্যশীল[১৮] করিতেন; [বৃথা মধুরবচন-প্রয়োগেই তাঁহাদিগের মনস্তুষ্টির চেষ্টা করিতেন না। [সুতরাং] এই সকল জগদ্-বিসদৃশ-স্বগুণগৌরবে তিনি সাধুজনের বিস্ময়ের উৎপাদন করিয়াছিলেন।

(১০)

 শিব যেমন শিবার, [এবং] হরি যেমন লক্ষ্মীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনিও সেইরূপ গৃহাশ্রম-প্রবেশ-কামনায় আত্মানুরূপা রল্লাদেবীকে[১৯] যথাশাস্ত্র [পত্নীরূপে] গ্রহণ করিয়াছিলেন।

(১১)

 তাঁহাদিগের কেদারমিশ্র নামে তপ্ত-কাঞ্চন-বর্ণাভ কার্ত্তিকেয়-তুল্য[২০] [এক] পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার [হোমকুণ্ডোত্থিত] অবক্র-ভাবে বিরাজিত সুপুষ্ট হোমাগ্নি-শিখাকে চুম্বন করিয়া, দিক্‌চক্রবাল যেন সন্নিহিত হইয়া পড়িত। তাঁহার বিস্ফারিত শক্তি দুর্দ্দমনীয় বলিয়া পরিচিত ছিল। আত্মানুরাগ-পরিণত অশেষ বিদ্যা [যোগ্যপাত্র পাইয়া] তাঁহাকে প্রতিষ্ঠা দান করিয়াছিল। তিনি স্ব-কর্ম্মগুণে দেব-নরের হৃদয়-নন্দন হইয়াছিলেন।[২১]

(১২)

 তিনি বাল্যকালে একবারমাত্র দর্শন করিয়াই, চতুর্ব্বিদ্যা-পয়োনিধি[২২] পান করিয়া, তাহা আবার উদ্গীর্ণ করিতে পারিতেন বলিয়া, অগস্ত্য-প্রভাবকে[২৩] উপহাস করিতে পারিয়াছিলেন।

(১৩)

 [এই মন্ত্রিবরের] বুদ্ধি-বলের উপাসনা করিয়া, গৌড়েশ্বর [দেবপালদেব][২৪] উৎকল-কুল উৎকিলিত করিয়া, হূণ-গর্ব্ব খর্ব্বীকৃত করিয়া, এবং দ্রবিড়-গুর্জ্জর-নাথ-দর্প চূর্ণীকৃত করিয়া, দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত সমুদ্র-মেখলাভরণা বসুন্ধরা উপভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

(১৪)

 তিনি যাচকগণকে যাচক মনে করিতেন না;—মনে করিতেন, তাঁহার দ্বারা অপহৃত-বিত্ত[২৫] হইয়াই, তাহারা যাচক হইয়া পড়িয়াছে। তাঁহার আত্মা শত্রু-মিত্রে নির্ব্বিবেক ছিল। [কেবল] ভব-জলধি-জলে পতিত হইবার ভয় এবং লজ্জা [ভিন্ন] অন্য উদ্বেগ ছিল না। তিনি [সংযমাদি অভ্যাস করিয়া] বিষয়-বাসনা ক্ষালিত[২৬] করিয়া, পরম-ধাম-চিন্তায় আনন্দ লাভ করিতেন।

(১৫)

 সেই বৃহস্পতি-প্রতিকৃতি [কেদারমিশ্রের] যজ্ঞস্থলে, সাক্ষাৎ ইন্দ্র-তুল্য শত্রু-সংহারকারী নানা-সাগর-মেখলাভরণা বসুন্ধরার চির-কল্যাণকামী শ্রীশূরপাল[২৭] [নামক] নরপাল, স্বয়ং উপস্থিত হইয়া, অনেকবার শ্রদ্ধা-সলিলাপ্লুত-হৃদয়ে, নতশিরে, পবিত্র [শান্তি] বারি[২৮] গ্রহণ করিয়াছিলেন।

(১৬)

 তাঁহার দেবগ্রাম-জাতা[২৯] বব্বা [দেবী] নাম্নী পত্নী ছিলেন। লক্ষ্মী চঞ্চলা বলিয়া, এবং [দক্ষ-দুহিতা] সতী অনপত্যা[৩০] [অপুত্রবতী] বলিয়া, তাঁহাদের সহিত [বব্বা দেবীর] তুলনা হইতে পারে না।

(১৭)

 দেবকী গোপাল-প্রিয়কারক পুরুষোত্তম তনয় প্রসব করিয়াছিলেন; যশোদা সেই লক্ষ্মীপতিকে [আপন পুত্ররূপে] স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। বব্বা দেবীও, সেইরূপ, গো-পাল-প্রিয়কারক পুরুষোত্তম তনয় প্রসব করিয়াছিলেন; যশো-দাতারা[৩১] তাঁহাকে লক্ষ্মীর পতি বলিয়াই স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন।

(১৮)

 তিনি জমদগ্নিকুলোৎপন্ন সম্পন্ন-ক্ষত্র-চিন্তক[৩২] [অপর] দ্বিতীয় রামের [পরশুরামের] ন্যায়, রাম [অভিরাম], শ্রীগুরবমিশ্র[৩৩] এই আখ্যায় [পরিচিত ছিলেন]।

(১৯)

 [পাত্রাপাত্র-বিচার]-কুশল গুণবান্ বিজিগীষু শ্রীনারায়ণপাল [নরপতি] যখন তাঁহাকে মাননীয়[৩৪] মনে করিতেন, তখন আর তাঁহার অন্য [প্রশস্তি] প্রশংসা-বাক্য কি [হইতে পারে?]

(২০)

 তাঁহার বাগ্‌বৈভবের কথা, আগমে[৩৫] ব্যুৎপত্তির কথা, নীতিতে পরম নিষ্ঠার কথা, মহতের গুণ-কীর্ত্তনে আসক্তির কথা, জ্যোতিষে অধিকারের কথা, এবং বেদার্থ-চিন্তা-পরায়ণ অসীম-তেজঃসম্পন্ন তদীয় বংশের কথা, ধর্ম্মাবতার[৩৬] ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন।

(২১)

 সেই শ্রীভৃৎ [ধনাঢ্য] এবং বাগধীশ [সুপণ্ডিত] ব্যক্তিতে একত্র মিলিত হইয়া, পরস্পরের সখ্য-লাভের জন্যই, স্বাভাবিক শত্রুতা পরিত্যাগ করিয়া, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী উভয়েই যেন [একত্র] অবস্থিতি করিতেছেন।

(২২)

 শাস্ত্রানুশীলন-লব্ধ-গভীর-গুণ-সংযুক্ত বাক্যে [তর্কে] তিনি বিদ্বৎ-সভায় প্রতিপক্ষের মদগর্ব্ব[৩৭] চূর্ণ করিয়া দিতেন; এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও[৩৮] অসীম-বিক্রম-প্রকাশে, অল্পক্ষণের মধ্যেই, শত্রুবর্গের “ভটাভিমান” [যোদ্ধা বলিয়া অভিমান] বিনষ্ট করিয়া দিতেন।

(২৩)

 যে বাক্যের ফল তৎক্ষণাৎ প্রতিভাত হইত না, তিনি সেরূপ [বৃথা] কর্ণ-সুখকর বাক্যের অবতারণা করিতেন না। যেরূপ দান পাইয়া [অভীষ্ট পূর্ণ হইল না বলিয়া] যাচককে অন্য ধনীর নিকট গমন করিতে হয়, তিনি কখনও সেরূপ [কেলি-দানের][৩৯] দান-ক্রীড়ার অভিনয় করিতেন না।

(২৪)

 কলিযুগ-বাল্মীকির[৪০] জন্ম-সূচক, অতি রোমাঞ্চোৎপাদক, ধর্ম্মেতিহাস-গ্রন্থ-সমূহে, সেই পুণ্যাত্মা শ্রুতির বিবৃতি [ব্যাখ্যা] করিয়াছিলেন।

(২৫)

 তাঁহার সুর-তরঙ্গিণীর ন্যায় অ-সিন্ধু-গামিনী প্রসন্ন-গম্ভীরা বাণী [জগৎকে] যেমন তৃপ্তিদান করিত, সেইরূপ পবিত্র করিত।[৪১]

(২৬)

 তাঁহার বংশে ব্রহ্মা স্বয়ং পিতৃত্ব গ্রহণ করিয়া, আবার স্বয়ং পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন; [ইতি] এইরূপ মনে করিয়া, [লোকে] তাঁহার পূর্ব্ব-পুরুষগণের এবং তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করিত।[৪২]

(২৭)

 তাঁহার [সুকুমার] শরীর-শোভার ন্যায় লোক-লোচনের আনন্দদায়ক, তাঁহার উচ্চান্তঃকরণের অতুলনীয় উচ্চতার ন্যায় উচ্চতা-যুক্ত, তাঁহার সুদৃঢ় প্রেম-বন্ধনের ন্যায় দৃঢ়সংবদ্ধ, কলি-হৃদয়-প্রোথিত-শল্যবৎ সুস্পষ্ট [প্রতিভাত] এই স্তম্ভে, তাঁহার দ্বারা হরির প্রিয়সখা ফণিগণের [শত্রু] এই গরুড়মূর্ত্তি [তার্ক্ষ্য] আরোপিত হইয়াছে।[৪৩]

(২৮)

 তাঁহার যশ অখিল দিগন্ত পরিভ্রমণ করিয়া, এই পৃথিবী হইতে পাতাল-মূল পর্য্যন্ত গমন করিয়া, [আবার] এখানে হৃতাহি-গরুড়চ্ছলে উত্থিত হইয়াছে।[৪৪]

 [এই] প্রশস্তি সূত্রধার বিষ্ণুভদ্র কর্ত্তৃক উৎকীর্ণ হইয়াছে।[৪৫]


মূল পাঠের টীকা সম্পাদনা

^(১)  অনুষ্টুভ্। “বংশে” প্রস্তর-লিপিতে সকল স্থলেই “বঙ্শে” রূপে উৎকীর্ণ রহিয়াছে।

^(২)  বসন্ততিলক। অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ “কৃতস্তধিপ” পাঠ মুদ্রিত করিয়া গিয়াছেন।

^(৩)  অনুষ্টুভ্।

^(৪)  বসন্ততিলক।

^(৫)  শার্দ্দূলবিক্রীড়িত। “সংহতে” প্রস্তর লিপিতে “সঙ্ঘতে” রূপে উৎকীর্ণ রহিয়াছে।

^(৬)  স্রগ্ধরা। “সম্বৃতাশাবকাশং” প্রথমে “সম্বৃতাশাবিকাশং” রূপে উৎকীর্ণ হইয়া, পরে সংশোধিত হইয়াছিল; প্রস্তর-স্তম্ভে তাহার চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায়। (উইকিসংকলন টীকা: সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য এই ই-কারযুক্ত পাঠটিই গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।)

^(৭)  বসন্ততিলক। অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ “দক্চা”-পাঠ উদ্ধৃত করিয়া গিয়াছেন।

^(৮)  অনুষ্ঠুভ্।

^(৯)  শার্দ্দূলবিক্রীড়িত। এই শ্লোকের “মধুরং বহুপ্রণয়িনঃ” প্রস্তরস্তম্ভে “মধুরম্বহুপ্রণয়িনঃ”-রূপে, “ভ্রান্তং বিকটং” ভ্রান্তম্বিকটং-রূপে এবং “সতাং বিস্ময়ঃ” সতাম্বিস্ময়ঃ-রূপে উৎকীর্ণ রহিয়াছে।

^(১০)  আর্য্যা।

^(১১)  স্রগ্ধরা।

^(১২)  অনুষ্ঠুভ্। “মুদ্গিরন্ বাল এব” প্রস্তরস্তম্ভে “মুদ্গিরন্বাল এব”-রূপে উৎকীর্ণ রহিয়াছে।

^(১৩)  বসন্ততিলক।

^(১৪)  মালিনী।

^(১৫)  শার্দ্দূল-বিক্রীড়িত। এই শ্লোকের “কল্যাণসঙ্গী”-শব্দ কল্যাণ“শংসী”-রূপে পাঠ করিবার জন্য অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ উপদেশ করিয়া গিয়াছেন। প্রস্তর-স্তম্ভে কিন্তু দন্ত্য স আছে। তথাপি “শংসী”-পাঠ গ্রহণ করিলে, অর্থ-সঙ্গতি সুরক্ষিত হয় বলিয়া, তাহাই গৃহীত হইয়াছে। প্রস্তর-স্তম্ভের “সঙ্গী”-শব্দ “সঙ্শী”-রূপেও প্রতিভাত হয়।

^(১৬)  অনুষ্ঠুভ্। বন্ধনী-মধ্যস্থ তিনটি অক্ষর কিছু অস্পষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। (উইকিসংকলন টীকা: কেদারমিশ্রের স্ত্রীর নাম বর্তমান মতে চব্বা; বব্বা নয়।)

^(১৭)  আর্য্যা।

^(১৮)  অনুষ্ঠুভ্।

^(১৯)  আর্য্যা।

^(২০)  শার্দ্দূল-বিক্রীড়িত। “আসক্তিং গুণকীর্ত্তনেষু” প্রস্তর-স্তম্ভে “আসক্তিঙ্গুণকীর্ত্তনেষু” রূপে উৎকীর্ণ রহিয়াছে।

^(২১)  উপজাতি। প্রস্তর-স্তম্ভে “সখ্যমিবাদি” উৎকীর্ণ আছে।

^(২২)  বসন্ততিলক।

^(২৩)  বসন্ততিলক।

^(২৪)  আর্য্যা।

^(২৫-২৬)  অনুষ্টুভ্।

^(২৭)  শার্দ্দূল-বিক্রীড়িত।

^(২৮)  আর্য্যা।

  বিষ্ণুভদ্র আপন নাম উৎকীর্ণ করিতে গিয়া, ভ-অক্ষরটি উৎকীর্ণ করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন; পরে ঐ অক্ষরটি নীচে বসাইয়া দিয়া গিয়াছেন!


প্রশস্তি-পরিচয় ও অনুবাদ-অংশের টীকা সম্পাদনা

  1. Asiatic Researches Vol. I, pp. 133-144.
  2. J. A. B. B. 1874.
  3. Epigraphia Indica, Vol. II., pp. 160-167.
  4. এই বংশোদ্ভব গুরব মিশ্র [অষ্টাদশ শ্লোকে] “জমদগ্নিকুলোৎপন্ন” বলিয়া উল্লিখিত থাকায়, এই বংশ রাঢ়ী বারেন্দ্র-ব্রাহ্মণ-সমাজের সুপরিচিত শাণ্ডিল্য-বংশ হইতে পৃথক্ বলিয়াই বোধ হয়।
  5. এই শ্লোকের প্রথম দুইটি অক্ষরে একটি বিসর্গান্ত শব্দে যে বীজি-পুরুষের নাম উৎকীর্ণ হইয়াছিল, তাহার বিসৰ্গ-চিহ্ন মাত্রই বর্ত্তমান আছে। অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ তাহাকে “বিষ্ণু” বলিয়া অনুমান করিয়া লইয়াছেন, কিন্তু এরূপ অনুমানের কারণ কি, তাহা প্রতিভাত হয় না।
  6. দ্বিতীয় চরণের শেষেও দুইটি অক্ষরে একটি বিসর্গান্ত শব্দ উৎকীর্ণ ছিল; তাহারও বিসর্গ-চিহ্ন মাত্রই অবশিষ্ট আছে। অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ তৎসম্বন্ধে কোন রূপ অনুমানের অবতারণা করেন নাই। অন্বয়, অর্থ এবং ছন্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া, এই বিলুপ্ত শব্দটিকে [সদ্যঃ] বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।
  7. অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ ধৃত [“धर्म्मः कृतस्तदधिपः” স্থলে] “धर्म्मः कृतस्तधिपः”-পাঠ লিপিকর-প্রমাদের নিদর্শন বলিয়াই বোধ হয়। পালবংশীয় নরপালগণ প্রথমে বঙ্গদেশে অধিকার লাভ করিয়া, পরে মগধ জয় করিবার যে কিংবদন্তী তারানাথের গ্রন্থে উল্লিখিত আছে, “तदधिप” শব্দে তাহা সমর্থিত হইতেছে। পাল-নরপালগণ যে বাঙ্গালী ছিলেন, এই বিশেষণ হইতে তাহার আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়।
  8. এই শ্লোকোক্ত ধর্ম্ম নামক রাজা ইতিহাস-বিখ্যাত ধর্ম্মপাল। তাঁহার [খালিমপুবে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসন তদীয় বিজয়-রাজ্যের [দ্বাত্রিংশবর্ষীয় দ্বাদশ মার্গ দিনে] পাটলিপুত্রের জয়স্কন্ধাবার হইতে প্রদত্ত হইয়াছিল। তাঁহার বিজয়-রাজ্যের ষড়্-বিংশতিবর্ষে বুদ্ধগয়াধামে তাঁহার নামাঙ্কিত একটি প্রস্তর-লিপি [কেশব-প্রশস্তি] উৎকীর্ণ হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। ইহার পূর্ব্বে আর কখনও পালবংশীয় নরপালগণের শাসন-ক্ষমতা মগধে প্রতিষ্ঠিত থাকিবার প্রমাণ এ পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। ধর্ম্মপালের পিতা গোপালদেবকে প্রকৃতিপুঞ্জ “মাৎস্য-ন্যায়” দূরীভূত করিবার উদ্দেশ্যে, সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিবার কথা ধর্ম্মপালের [খালিমপুরে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে [৩য় শ্লোকে] উল্লিখিত আছে। তারানাথের গ্রন্থেও তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। গরুড়স্তম্ভ-লিপির এই শ্লোকের বর্ণনায়, ধর্ম্মপালের সময়েই [তাঁহার মন্ত্রিবর গর্গের মন্ত্রণা-বলে] মগধাদি অন্যান্য প্রদেশে পাল-সাম্রাজ্য বিস্তৃত হইবার আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়।
  9. অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ “কান্তি”-শব্দে চন্দ্রের “শোভাকেই” গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু দাম্পত্য-সম্পর্ক বর্ণনা করিবার সময়ে, সেরূপ সাধারণ অর্থে “কান্তি”-শব্দ প্রযুক্ত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। ধর্ম্মপালের [খালিমপুরে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে [পঞ্চম শ্লোকে] তাঁহার মাতা “शीतांशोरिव रोहिणी” বলিয়া বর্ণিতা। এখানেও, শব্দান্তরের সাহায্যে, সেইরূপ উপমাই সূচিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। পুরীধামের লোকনাথ-মন্দিরের প্রাঙ্গনে চন্দ্র-মূর্ত্তির দক্ষিণে, চন্দ্র-পত্নী কান্তি-দেবীর মূর্ত্তি অদ্যাপি দেখিতে পাওয়া যায়। শাস্ত্রেও তাহার নির্দ্দেশ আছে। যথা—

    “चन्द्रः श्वेतवपुः कार्य्यः श्वेताम्बरधरः प्रभुः।
    चतुर्व्वाहु र्म्महातेजाः सर्व्वाभरण-भूषितः॥
    कुमुदौ च सितौ कार्य्यौ तस्य देवस्य हस्तयोः।
    कान्ति र्म्मूर्त्तिमती कार्य्या तस्य पार्श्वे तु दक्षिणो॥”

  10. অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ এই শ্লোকের “দ্বিজেশ”-শব্দের চন্দ্র-বাচক অর্থ গ্রহণ করিয়া, [Epigraphia Indica Vol. II, p. 3.] লিখিয়া গিয়াছেন “and the epithet dvijesha, applied to him, besides suggests, that he was like the Moon” কিন্তু যে কবি [পূর্ব্ব-শ্লোকেই] দর্ভপাণির মাতাকে চন্দ্র-পত্নীর সহিত তুলনা করিয়া গিয়াছেন, সেই কবি, তাহা বিস্মৃত হইয়া, [পর শ্লোকে] দর্ভপাণির জন্য চন্দ্র-বাচক “দ্বিজেশ”-বিশেষণের চিন্তা করিতেই পারিতেন না। এখানে “দ্বিজ-শ্রেষ্ঠ” বুঝাইবার জন্যই দ্বিজেশ-শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে।
  11. [सूनुः] কর্ত্তৃপদের [आसीत्] ক্রিয়া পদ উহ্য থাকায়, “दधान”-শব্দই ক্রিয়া-পদের আকাঙ্খা নিবৃত্ত করিতেছে। এরূপ প্রয়োগ সংস্কৃত-সাহিত্যে অনেক দেখিতে পাওয়া যায়।
  12. নারায়ণপালদেবের [ভাগলপুরে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে [৫-৬ শ্লোকে] দেবপালের ভ্রাতা জয়পাল নামক বিজয়ী বীর পুরুষের বাহুবলই সাম্ৰাজ্য-বিস্তারের একমাত্র সহায় বলিয়া উল্লিখিত আছে। তাহার সহিত যে নীতি-কৌশলেরও সম্বন্ধ বর্ত্তমান ছিল, এই শ্লোকে তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।
  13. ধরণি-বিজ্ঞাপক “ক্ষোণী”-শব্দ বৈদিক-সাহিত্যে [ঋগ্বেদ ১।৫।৪।১] দেখিতে পাওয়া যায়। লৌকিক সাহিত্যে “ক্ষৌণী” এবং “ক্ষোণী”-শব্দের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। অমর কোষের [২।১।২]

    “धरा-धरित्री-धरणी-क्षोणी-ज्या-काश्यपी-क्षितिः”

    স্মরণীয়। এই শ্লোকের বর্ণনা-কৌশলে রাজ-ভবনের নিকটেই মন্ত্রি-ভবন অবস্থিত থাকিবার আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়। যেখানে গরুড়-স্তম্ভটি অদ্যাপি তাহার পুরাতন প্রতিষ্ঠাভূমির উপর দণ্ডায়মান আছে, তাহা যে মন্ত্রি-ভবনের একাংশমাত্র, তদ্বিষয়ে সংশয় উপস্থিত হইবার কারণ নাই; সুতরাং রাজধানীও তাহার অনতিদূরেই বর্ত্তমান ছিল।

  14. “उड़ुपच्छवि-पीठं” এই বিশেষণের “উড়ুপ”-শব্দের অর্থ—চন্দ্র। এরূপ অর্থে “উড়ুপ” শব্দের প্রয়োগ কাব্যাদিতে বিরল হইলেও, নক্ষত্র-বাচক উড়ু-শব্দের প্রয়োগ জ্যোতিঃশাস্ত্রে সুপরিচিত। মহাভারতে [বনপর্ব্ব] চন্দ্র-বাচক “উড়ুপ”-শব্দের প্রয়োগ দেখিতে পাওয়া যায়। যথা—

    “अपश्यद्वदनं तस्य रश्मिवन्तमीवोड़ुपम्।”

  15. প্রবল পরাক্রান্ত পাল-সাম্রাজ্যের সিংহাসনে [স্বকীয় মন্ত্রিবরের সম্মুখে] দেবপালদেবের “সচকিত ভাবে” উপবেশন করিবার কারণ কি, তাহা উল্লিখিত হয় নাই। প্রকৃতিপুঞ্জ কর্ত্তৃক দেবপালের পিতামহ গোপালদেব সিংহাসনে প্রতিষ্ঠাপিত হইবার কথা স্মরণ করিলে, লোক-নায়ক মন্ত্রিগণকেই [King-maker] রাজ-নির্ব্বাচনকারী বলিয়া অনুমান করা যাইতে পারে। “সচকিত” শব্দের প্রয়োগে [ইঙ্গিতে] সেই ঐতিহাসিক-তত্ত্ব সূচিত হইয়া থাকিতে পারে। নচেৎ কেবল মন্ত্রিবরের প্রতি পদোচিত সম্মান-প্রদর্শন-বিজ্ঞাপনার্থ “সচকিত” শব্দ ব্যবহৃত হইতে পারে না। ইহাতে বৌদ্ধ-নরপালগণের শাসন-সময়ে বাঙ্গালাদেশে ব্রাহ্মণের সমুচিত পদমর্য্যাদার অভাব না থাকিবারই প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ “অগ্রে”-শব্দের অর্থ কারিয়াছেন,—first offered to him a chair of state. মন্ত্রিবংশের কিরূপ প্রাধান্য ছিল, ইহাতেও তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।
  16. সপ্তর্ষির একতম ঋষি অত্রির নয়ন হইতে ধ্যান-পরম্পরা-পরিণত-পরম-জ্যোতিরূপে চন্দ্র আবির্ভূত হইবার যে পৌরাণিক আখ্যায়িকা প্রচলিত আছে, এই শ্লোকে এবং লক্ষ্মণসেনের তাম্রশাসনে তাহার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়।
  17. “পরমেশ্বর-বল্লভ”-শব্দ দ্ব্যর্থ;—[সোমেশ্বর পক্ষে] “রাজার প্রিয়”, [চন্দ্রপক্ষে] “মহাদেবের প্রিয়।”
  18. গতিবোধক বল্‌গ ধাতু হইতে “সংবল্গিত” হইয়াছে। অশ্বের গতিবিশেষ “বল্গিত” নামে পরিচিত। ইহার ভাবার্থ, “নৃত্যশীল” বলিয়া গৃহীত হইল।
  19. পণ্ডিত হরচন্দ্র চক্রবর্ত্তী মহাশয় “তরলাদেবী” পাঠ উদ্ধৃত করিয়াছিলেন। উইল্‌কিন্সের ইংরাজী অনুবাদে “রন্নাদেবী” পাঠ দেখিতে পাওয়া যায়। প্রকৃত পাঠ [রল্লা] স্তম্ভগাত্রে স্পষ্টাক্ষরে উৎকীর্ণ আছে। এই নাম এ কালের পক্ষে রুচিকর না হইলেও, সেকালে সুপরিচিত ছিল বলিয়াই, ইহার ব্যুৎপত্তি রঘুনাথ-চক্রবর্ত্তী-কৃত অমর-টীকায় ব্যাখ্যাত আছে। “রল্লা” শব্দের অর্থ, রমণীয়া—ইচ্ছাবিবর্দ্ধিনী।
  20. এই শ্লোকে এক অর্থে কার্ত্তিকেয়কে, অন্য অর্থে কেদার মিশ্রকে, সূচিত করিবার জন্য অনেকগুলি দ্ব্যর্থ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। মিশ্র-পক্ষে “শিখি-শিখা” হোমাগ্নিশিখা; কার্ত্তিকেয়-পক্ষে “ময়ূর-পিচ্ছ”। মিশ্র-পক্ষে স্ফার-শক্তি” বাহুবল; কার্ত্তিকেয়-পক্ষে “শক্তি” নামক অস্ত্র। মিশ্র-পক্ষে “বিদ্যা” জ্ঞান; কার্ত্তিকেয-পক্ষে “মাতৃকাগণ”। মিশ্র-পক্ষে “স্বক্রিয়া” যাগ যজ্ঞ, কার্ত্তিকেয়-পক্ষে “অসুর-নিপাত”। মিশ্র-পক্ষে “জাতরূপ” প্রশস্তরূপ; কার্ত্তিকেয়-পক্ষে “কাঞ্চন”—এইরূপ অর্থ গ্রহণ করিলে, শ্লিষ্ট-প্রয়োগ-কৌশল বুঝিতে পারা যাইবে। কার্ত্তিকেয়ের ধ্যানের সঙ্গেও ইহার কিছু সম্পর্ক আছে। যথা—

    “कार्त्तिकेयं महाभागं मयूरोपरि-संस्थितं।
    तप्त-काञ्चन-वर्णाभं शक्ति-हस्तं वर-प्रदं॥
    द्विभुजं शत्रु-हन्तारं नानालङ्कार-भूषितं।
    प्रसन्न-वदनं देवं सर्व्व-सेना-समावृतम्॥”

  21. এই শ্লোকের প্রথম চরণোক্ত সমাসান্ত পদটি অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ কর্ত্তৃক ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ বলিয়া নিন্দিত হইয়াছে। তিনি ইহাকে ব্যাকরণ-দুষ্ট বলিষা, লিখিয়া গিয়াছেন,—“As regards grammar I need draw attention only to the first compound in verse 11, which is formed incorrectly.” “শিখি-শিখা দিক্-চক্রবালকে চুম্বন করিতেছে” বলিয়া ব্যাখ্যা করিলে, ব্যাকরণ-দোষ সজ্ঞাটিত হইতে পারে; কিন্তু কবি বলিয়াছেন,—“দিক্‌চক্রবালই শিখি শিখা চুম্বন করিতেছে।” হোমাগ্নি-শিখা [অজিহ্ম] অবক্র হইলে, “যোগ-ক্ষেম” সূচিত করে। অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ তৎপ্রতি লক্ষ্য না করিষা, লিখিয়া গিয়াছেন,—“None of the ordinary meanings of ajimha appears very appropriate”. “অজিহ্ম”-শব্দের প্রয়োগ দুর্লভ হইলেও, অপরিচিত বলিয়া কথিত হইতে পারে না। যখা—

    “अजिह्मामशठां शुद्धां जीवेत् ब्राह्मण जीविकाम्।”

  22. চতুর্থ শ্লোকের ন্যায় এই শ্লোকেও “বেদ”-অর্থে “বিদ্যা”-শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। বিদ্যার সংখ্যা চতুর্দ্দশ, মতান্তরে অষ্টাদশ। এখানে সে অর্থ সূচিত হয় নাই। সুতরাং কেদারমিশ্র বেদজ্ঞ ছিলেন বলিয়াই বুঝিতে হইবে।
  23. অগস্ত্য [সমুদ্রপান-কালে] বালক ছিলেন না। তিনি একটিমাত্র সমুদ্র পান করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহাকে আর উদ্গীর্ণ করিতে পারেন নাই;— ইহাই [ইঙ্গিতে] উপহাসের কারণ বলিয়া ধ্বনিত হইয়াছে। অগস্ত্য ঋষি বলিয়া, উপহাসের অযোগ্য; তাঁহাকে উপহাস করা শিষ্টাচার-বিরুদ্ধ। তজ্জন্যই “বাল এব” বলিয়া, কবি বুঝাইয়াছেন,—কেদারমিশ্র বালক বলিয়াই, এরূপ করিয়াছিলেন;—তাহা ক্ষমার্হ।
  24. এই শ্লোকোক্ত “গৌড়েশ্বরের” নাম উল্লিখিত হয় নাই। পূর্ব্বাপর-সামঞ্জস্য-রক্ষার্থ, তাঁহাকে “দেবপালদেব” বলিয়াই বুঝিতে হইবে। “চিরং”-শব্দেও তাহাই সূচিত হইয়াছে। দেবপালদেবের [মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে ৩৩ সংবৎ লিখিত থাকায়, তাঁহার দীর্ঘকাল রাজ্যভোগের প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। নারায়ণপালদেবের [ভাগলপুরে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে [৬ শ্লোকে] দেবপালদেবের শাসন-সময়েই [তদীয় ভ্রাতা জয়পাল কর্ত্তৃক] উৎকল বিজিত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।
  25. “स्वयमपहृतवित्तान्” এই বিশেষণ-পদের ব্যাখ্যা করিবার জন্য অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ চেষ্টা করেন নাই। তিনি কেবল লিখিয়া গিয়াছেন,—“He allowed suppliants to take freely away his riches.” উইল্‌কিন্স কিন্তু প্রকৃত তাৎপর্য্যের আভাস দিয়া লিখিয়া গিয়াছেন,—“He considered his own acquired wealth the property of the needy,” এই বিশেষণটি সমাজ-তত্ত্বের নিগূঢ় রহস্য উদ্ঘাটিত করিয়া, সেকালের বাঙ্গালার ধনাঢ্য ব্রাক্ষণের উচ্চ হৃদয়ের পরিচয় প্রদান করিতেছে।
  26. অধ্যাপক কিল্‌হর্ণের অনুবাদে “পরিমৃদিত”-শব্দের [বৈদ্যকশাস্ত্র-সম্মত] চূর্ণীকৃত [crushed] অর্থ গৃহীত হইয়াছে; এবং তজ্জন্যই শ্লোকার্থ বিকশিত হয় নাই। উপনিষৎ ও দর্শনাদিতে ব্যবহৃত “মৃদিত-কষায়”-শব্দ সুপরিচিত। ছান্দোগ্যোপনিষদে দেখিতে পাওয়া যায়;—“आहार-शुद्धौ सत्वशुद्धिः, सत्वशुद्धौ ध्रुवा स्मृतिः, स्मृतिलभ्ये सर्व्वग्रन्यीनां विप्रमोक्ष स्तस्मात् मृदित-कषायाय तमसः दर्शयति।” ইহার ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার লিখিয়া গিয়াছেন,—“রাগ-দ্বেষাদি দোষের নাম কষায়; জ্ঞানবৈরাগ্যাভ্যাসরূপ ক্ষার-জলে তাহা [মৃদিত] ক্ষালিত হইয়া থাকে।” যথা,—“कषायो राग-द्वेषादि दोषः [तस्य रञ्जन-रूपत्वात्], ज्ञानवैराग्याभ्यासरूप क्षारेण क्षालितो मृदितो विनाशितः” इत्यादि।
  27. এই শ্লোকের “শূরপালকে,” ডাক্তার হরণ্‌লি “প্রথম বিগ্রহপাল” বলিয়া গ্রহণ করায়, সকলেই তাহা স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ লিখিয়া গিয়াছেন,—“As to Surapála I readily adopt Dr. Hœrnle’s suggestion that he is indentical with the Vigrahapála of the Bhágalpur copper-plate, the immediate predecessor of Náráyanapála.” (উইকিসংকলন টীকা: ১৯৭০ সালে মির্জ়াপুর তাম্রশাসন আবিষ্কারের পর থেকে এই রাজা প্রথম শূরপাল নামে আলাদা রাজা হিসেবে গণ্য।)
  28. অনেকে এই শ্লোকে [ডাক্তার রাজেন্দ্রলালের মতানুসরণ করিয়া,] শূরপালদেবের “অভিষেক-ক্রিয়ার” সন্ধান লাভ করিয়া থাকেন। কিন্তু “ভূয়ঃ”-শব্দ তাহার প্রবল অন্তরায়। বহুলোকে আত্মকল্যাণ-কামনায় যজ্ঞ-স্থলে উপস্থিত হইয়া, মস্তকে শান্তি-বারি গ্রহণ করিয়া থাকে। “নানাসাগর-মেখলাভরণা বসুন্ধরার চির-কল্যাণকামী” শূরপাল নামক নরপালও সেইরূপ করিতেন। “ভূয়ঃ”-শব্দে, কেদারমিশ্রের অনেক বার যজ্ঞ করিবার, এবং শূরপালদেবেরও অনেকবার [যজ্ঞ-স্থলে] মস্তকে শান্তি-বারি গ্রহণ করিবার পরিচয় প্রকাশিত হইতেছে। এই শ্লোকে যদি কোন ঐতিহাসিক তথ্য পরিস্ফুট হইয়া থাকে, তবে তাহা এই,—(১) শূরপালদেবের শাসন-সময়েও, বরেন্দ্র-মণ্ডলে যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইত। (২) বৌদ্ধ-মতাবলম্বী রাজা যজ্ঞ-স্থলে উপস্থিত হইয়া, মস্তকে শান্তি-বারি গ্রহণ করিতে শ্রদ্ধা প্রকাশ করিতেন; এবং (৩) তাহাতে রাজ্যের কল্যাণ হইবে বলিয়াই বিশ্বাস করিতেন। কেদারমিশ্রকে বৃহস্পতির সহিত এবং শ্রীশূরপালদেবকে ইন্দ্রদেবের সহিত তুলনা করিয়া, কবি তাহারই আভাস প্রদান করিয়া গিয়াছেন।
  29. মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এম, এ, [রামচরিত কাব্যের ভূমিকায়] দেবগ্রামকে নদীয়া জেলার অন্তর্গত বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন কেন, তাহার কোন কারণের উল্লেখ করেন নাই।
  30. এই শ্লোকের “অতুল্যা”-শব্দ রচনা-কৌশল-বিজ্ঞাপক। দক্ষ দুহিতা সতী সন্তান-লাভের পূর্ব্বেই, দক্ষ-যজ্ঞে প্রাণ বিসর্জ্জন করায়, “অনপত্যা” ছিলেন। লক্ষ্মীও চঞ্চলা বলিয়াই সুপরিচিতা। সুতরাং, ইহাদের সহিত তুলনা দিতে না পারিয়া, কবি “অতুল্যা” শব্দের প্রয়োগ করিয়াছেন।
  31. এই শ্লোকে শ্লিষ্ট প্রয়োগের অভাব নাই। দেবকীনন্দন-পক্ষে অর্থ সুব্যক্ত। বব্বানন্দন-পক্ষে “গো-পাল-প্রিয় কারকের” অর্থ পৃথিবী পালক “রাজার” প্রিয়কারক; “পুরুষোত্তমের” অর্থ “পুরুষশ্রেষ্ঠ”; এবং “যশোদার” অর্থ “যশোদাতা”। এই অর্থে “যশোদা”-শব্দ তৈত্তিরীয়-সংহিতায় [৪।৪।৬।২] ব্যবহৃত হইয়াছে। যথা,—

    “यशोदां त्वा यशसि तेजोदां त्वा तेजसीति।”

  32. পরশুরাম-পক্ষে অর্থ—“সম্পন্ন ক্ষত্রিয়দিগের নিধন-চিন্তাকারী”; মিশ্র-পক্ষে অর্থ—“সম্পৎ-নক্ষত্রচিন্তক” [জ্যোতিষিক গণনাকারী]।
  33. অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ ইঁহার নাম “রামগুরব মিশ্র” বলিয়া লিখিবার পর হইতে, অনেকেই “রামগুরব” লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন। “শ্রীগুরব মিশ্রাখ্য” বলিয়া কবি প্রকৃত নামেরই উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন; রাম-শব্দ তাহার বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হইয়াছে।
  34. নারায়ণপালদেবের [ভাগলপুরে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে [৫২-৫৩ পংক্তিতে] ভট্টগুরব “দূতক” বলিয়া উল্লিখিত। ধর্ম্মপালের এবং দেবপালের তাম্রশাসনে যুবরাজ ত্রিভুবনপাল এবং যুবরাজ রাজ্যপাল “দূতক” বলিয়া উল্লিখিত। ভট্টগুরব কিরূপ সমাদরের পাত্র ছিলেন, ইহাতেই তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।
  35. অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ “traditional lore” বলিয়া “আগম”-শব্দের ব্যাখ্যা করিয়া গিয়াছেন। এরূপ অর্থে “আগম”-শব্দের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায় না। সকল শাস্ত্রই “আগম”; তন্মধ্যে তন্ত্র-শাস্ত্রই “আগম” নামে প্রসিদ্ধ। সকল তন্ত্র “আগম” নহে; সপ্ত-লক্ষণ-সংযুক্ত কোন কোন তন্ত্রই “আগম” নামে কথিত। যথা—

    “आगतं पञ्चवक्त्रात्तु गतञ्च गिरिजानने।

    मतञ्च वासुदेवस्य तस्माद् आगम उच्यते।”

    यह्वा

    “आगतः शिववक्त्रेभ्यो गतञ्च गिरिजामुखे।

    मग्नस्तस्या हृदम्भोजे तस्मादागम उच्यते।”

    “আগম” বেদাঙ্গ বলিয়াই ব্যাখ্যাত হইত। মেরুতন্ত্রে তাহা উল্লিখিত আছে। যথা—

    “न वेदः प्रणवं त्यक्ता मन्त्रो वेदाङ्ग श्चागमः स्मृतः।”

    বিচার-কার্য্যে ব্যবহৃত সাক্ষ্যপত্রাদি “আগম” নামে ব্যবহার-মাতৃকায় উল্লিখিত আছে। মনুসংহিতায় পারিভাষিক অর্থে “আগম” শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। যথা—

    “नाधर्म्मेनागमः कश्चिन्मनुष्यान् प्रति वर्त्तते।”

  36. এই শ্লোকের “ধর্ম্মাবতার”-শব্দ রাজাকে সূচিত করিতেছে বলিয়াই বোধ হয়। তিনি যে আপন তাম্রশাসনে ভট্টগুরবের প্রশংসা করিয়াছিলেন, তাহা “ভাগলপুর-লিপিতে” দেখিতে পাওয়া যায়।
  37. এই শ্লোকের “परवादि-मदावलेपः” প্রযোগটি উল্লেখযোগ্য। প্রতিবাদী বা বিরুদ্ধবাদীর নাম “পরবাদী”। “অবলেপ”-শব্দের অর্থ “লেপন” এবং “গর্ব্ব”। এখানে আত্ম-প্রাধান্য-বিজ্ঞাপক গর্ব্ব বুঝাইবার জন্যই “মদাবলেপ” ব্যবহৃত হইয়াছে। এরূপ অর্থে “অবলেপ”-শব্দের ব্যবহারের সুপরিচিত নিদর্শন [মেঘদূতের]

    “दिङ्नागानां पथि परिहरन् स्थूलहस्तावलेपान्।”

  38. ব্রাহ্মণ-মন্ত্রীর যুদ্ধক্ষেত্রে বিক্রম-প্রকাশের এই আখ্যায়িকা কবি-কাহিনী বলিয়া প্রত্যাখ্যাত হইতে পারে না। সেকালে বাঙ্গালা দেশেও যে ইহা সত্য-ঘটনা বলিয়া সুপরিচিত ছিল, তাহা কুমারপালদেবের ব্রাহ্মণ-মন্ত্রী বৈদ্যদেব কর্ত্তৃক [বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনোক্ত] কামরূপ-জয়ের বৃত্তান্ত পাঠ করিলে বুঝিতে পারা যায়।
  39. এই শ্লোকের চতুর্থ চরণের শেষ দুইটি অক্ষর বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। ভট্টগুরব যাঁহার মন্ত্রিত্ব করিতেন, সেই নারায়ণপালদেবও এইরূপ দানশীল ছিলেন বলিয়া, তদীয় [ভাগলপুরে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে [১৪শ শ্লোকে], পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।
  40. এই শ্লোকে “সূচক”-অর্থে “পিশুন”-শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। অধাপক কিল্‌হর্ণ এই শ্লোকের প্রথম চরণের শেষে একটি (চ) অক্ষর সংযুক্ত করিয়া দিয়াছেন। মূল লিপিতে তাহা না থাকায়, ছন্দোভঙ্গ ঘটিতে পারে মনে করিয়া, অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ এরূপ করিয়া থাকিতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে এরূপ স্থলে চরণান্ত অক্ষরটি গুরুবর্ণ-রূপে ধরিয়া লইবার রীতি প্রচলিত থাকায়, ছন্দোভঙ্গের আশঙ্কা উপস্থিত হইতে পারে না।
  41. এই শ্লোকের বিলুপ্ত অক্ষরগুলির মধ্যে উইল্‌কিন্স “ত্রিধা”-শব্দটি পাঠ করিয়া, “flowing in a triple course, বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়া গিয়াছেন। এক্ষণে কেবল “ধা”-অক্ষরটি কোন ক্রমে দৃষ্টিগোচর হয়। “স্বর্ধুনী” [মন্দাকিনী] সমুদ্রে পতিত হয় নাই বলিয়া, “অসিন্ধু-প্রসৃতা”। কিন্তু বাণী পক্ষে তাহার অর্থ কি, তাহা প্রতিভাত হয় না। তৎকালে সিন্ধুদেশ যবনাক্রান্ত থাকায়, তথায় পাল-সাম্রাজোর প্রধান মন্ত্রীর আদেশবাণী প্রসৃত হইত না,—এইরূপ অর্থ ইঙ্গিতে সূচিত হইয়াছে কি না, তাহা চিন্তনীয়।
  42. এই শ্লোকের “প্রপেদিরে” ক্রিয়াপদের অনুক্ত কর্ত্তৃপদ “লোকা” ধরিয়া লইযা, অধ্যাপক কিল্‌হর্ণ মর্ম্মানুবাদ করিয়াছেন। ব্রহ্মার নব-মানস-পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করিবার পৌরাণিক আখ্যায়িকা অবলম্বন করিয়া, এই শ্লোক রচিত হইয়া থাকিতে পারে।
  43. অক্ষর-বিলোপ এই শ্লোকের ভাব-প্রকাশের অন্তরায় হয় নাই; কিন্তু বিলুপ্ত অক্ষরগুলির দ্বারা কি কি শব্দ উৎকীর্ণ হইয়াছিল, তাহা নিঃসংশয়ে অনুমান করিবার উপায় নাই।
  44. যাহারা অন্যের যশঃ সহ্য করিতে পারে না, তাহারা সর্পবৎ খল বলিয়া, সংস্কৃত-সাহিত্যে সুপরিচিত। তাহাদের পরাভব সূচিত করিবার জন্য, স্তম্ভের উপর “হৃতাহি-গরুড়-মূর্ত্তি” স্থাপিত হইয়া থাকিতে পারে। যশের বর্ণ শুভ্র বলিয়া সুপরিচিত; তাহার সহিত গরুড়ের বর্ণের কোনরূপ সাদৃশ্য আছে কি না, তাহা চিন্তনীয়। তান্ত্রিক পদ্ধতিক্রমে গরুড় পূজার যে ধ্যান উল্লিখিত আছে, তাহা এইরূপ, যথা—

    “वर्स्मान्त-वह्नियुग्माक्षर-कमलगतं पञ्चभृताद्यवर्णं
    कॢप्ताकल्पं फणीन्द्रैरभयवरकरं पद्मनेत्रं सुवक्त्रम्।
    दुष्टाहिच्छेदितुण्डं स्मरदखिलविषप्रोषणं प्राणभृतं
    प्राणश्रेण्यां त्रिवेदीतनुसमृतमयं पक्षिराजं भजेऽहम्॥”

  45. ইহা সূত্রধারের চ্যুত-সংস্কৃত-রচনার নিদর্শনমাত্র।