চন্দ্রলোকে যাত্রা/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ

পরীক্ষা

 খনো কেহ কেহ সন্দেহ করিয়া কহিতেছিলেন, গোলকের ভিতরে মানুষ যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নহে। তাঁহাদের সন্দেহ ভঞ্জন করিবার জন্য বার্বিকেন একটা ৩২ ইঞ্চি কামান আনিলেন। একটী ফাঁপা-গোলা প্রস্তুত করিয়া বার্বিকেন তাহার ভিতরটা অতিশয় কোমল গদি দ্বারা আবৃত করিলেন। গদির ভিতর অতি উৎকৃষ্ট স্প্রীং বসানো হইল। গোলকের মধ্যে একটী জীবিত মার্জ্জার ও একটী শজারু রাখিয়া বার্বিকেন ঢাকনাটী স্ক্রু দিয়া বন্ধ করিলেন এবং কামানে ২ মণ বারুদ ঢালিয়া মহাশূন্যে গোলা নিক্ষেপ করিলেন। শত সহস্র নরনারী সাগরতীরে দাঁড়াইয়া দেখিল যে গোলাটী সহস্র ফিট উর্দ্ধে উঠিয়া বজ্রগতিতে সমুদ্রগর্ভে পতিত হইল। উহাকে কুড়াইয়া আনিয়া দেখা গেল, মার্জ্জার সামান্য একটু আহত হইয়াছে মাত্র, কিন্তু গোলার মধ্যে বসিয়াই শজারুকে খাইয়া ফেলিয়াছে।

 পরীক্ষার ফল দেখিরা অনেকেই সন্তুষ্ট হইলেন। ম্যাট্‌সন্ বারংবার বলিতে লাগিলেন—“আমাকেও সঙ্গে নিন্—আমিও চন্দ্রলোকে যাব।” বার্বিকেন গম্ভীরকণ্ঠে বলিলেন—“তা’ কি হয়—অত স্থানই যে হবে না!” ম্যাট্‌সন্ অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন এবং তাঁহাকে সঙ্গে লইবার জন্য বারবার আর্দ্দানকে অনুরোধ করিতে লাগিলেন।

 আর্দ্দানের এক নূতন বিপদ উপস্থিত হইল। প্রত্যহ এত লোক তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিতে লাগিল যে তাঁহার জীবন দুর্ব্বহ হইয়া উঠিল। একদিন কতকগুলি পাগল আসিয়া বলিল—“আমরা চন্দ্রলোকেরই অধিবাসী। স্বদেশে যাবার জন্য আমরা বড় ব্যস্ত হয়েছি—অনেকদিন দেশ ছাড়া! আপনি যদি আমাদের সঙ্গে নিতেন!”

 আর্দ্দান্ তাহাদিগকে কহিলেন—"এবার বড়ই স্থানাভাব। এবার আপনাদের চিঠিপত্র আমার সঙ্গে দিন্। আমি সেখানে যেয়ে আপনাদেরও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব।”

 যাহারা আর্দ্দানের দেখা পাইল না, তাহারা তাঁহাকে পত্র লিখিতে আরম্ভ করিল! প্রতিদিন এত পত্র আসিতে লাগিল যে, সে সমুদয় পাঠ করিবারই সময় হইল না। ধনকুবের আমেরিকান্‌দিগের কুমারী কন্যাগণ আর্দ্দানকে বিবাহ করিবার জন্য প্রতিদিন পত্র লিখিতে লাগিলেন! আর্দ্দান্ মনে মনে ভাবিলেন, কি আপদেই পড়িলাম!

 ১০ই নভেম্বর যখন ব্রেড্‌উইল কোম্পানীর নিকট হইতে গোলাটী আসিয়া পৌঁছিল, তখন উহা দেখিবার জন্য ষ্টোনিহিলের নরনারী পাগলের মত ছুটিল। বার্বিকেন উহা মুক্ত প্রান্তরে স্থাপিত করিয়াছিলেন। তপন-কিরণে গোলাটী দিনের পর দিন জ্বলিতে লাগিল।

 আর্দ্দান্ গোলাটী দেখিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন বটে, কিন্তু কহিলেন——“এতে ললিত শিল্পের কোনো চিহ্ন দেখ্‌ছি না। এমন একটা ন্যাড়া-মুড়া গোলা দেখে চন্দ্রলোকের অধিবাসীরা যে ধিক্কার দিবে!”

 বার্বিকেন এ কথাটা হাসিয়া উড়াইয়া দিয়া কহিলেন—“বাহিরের সৌষ্ঠব না হয় না-ই হ’লো। ভিতরটা আপনার পছন্দ সই করে নিন।”

 আর্দ্দান স্বীকৃত হইলেন।

 বার্ধিকেন মনে মনে বুঝিয়াছিলেন যে লোহার স্প্রীং যতই কেন ভালো না হউক, তাহাতে কাজ হইবে না। তাই তিনি জলের ব্যবহার করিলেন। গোলার মধ্যে তিন ফিট পর্য্যন্ত জল ঢালা হইল। সেই জলের উপর কাষ্ঠের একখানি চাক্‌তি রহিল। ইহা গোলার গায়ে এমন ভাবে লাগান হইল যে, ইচ্ছা মাত্রেই খুলিতে পারা যায়। এই নবীন ভেলার উপর বার্বিকেন যাত্রীদিগের বসিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। জলকে থাকে থাকে কয়েকভাগে বিভক্ত করিবার মানসে বার্বিকেন জলের মধ্যে পর পর কয়েকখানি কাষ্ঠচক্র রক্ষা করিলেন। সকলের উপরে রহিল যাত্রীদিগের চক্র। সেই চক্রের নিম্নেই অতি দৃঢ় স্প্রীং ছিল। বার্বিকেন বুঝিয়াছিলেন যে কামানের মুখ হইতে গোলা বাহির হইলেই যে প্রবল বাক্কা লাগিবে তাহাতে কাঠের চক্রগুলি একে একে ভাঙ্গিয়া গিয়া এক থাকের জল অপর থাকের জলের সহিত মিশিবে, কাজেই আরোহিদিগকে কোনো ধাক্কা সহ্য করিতে হইবে না! গোলক নিক্ষিপ্ত হইলে প্রথমে সম্মুখের দিকে এবং পরক্ষণেই পশ্চাতে ধাক্কা লাগিবার কথা। জলের এই অদ্ভুত স্প্রীং থাকিবার জন্য সম্মুখের ধাক্কা যে লাগিতে পারবে না ইহা বার্বিকেন দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করিয়াছিলেন। পশ্চাতের ধাক্কাকে শক্তিহীন করিবার জন্য অতি উৎকৃষ্ট স্প্রীংএর উপর নির্ভর করিতে হইল। গোলকের ভিতরটী পকেট-ঘড়ীর স্প্রীংএর ন্যায় কোমল অথচ সুদৃঢ়, স্প্রীংএর উপর পুরু গদি বসাইয়া মণ্ডিত হইয়াছিল।

 এই সকল আয়োজন দেখিয়া মাইকেল আর্দ্দান্ কহিলেন,—“এততেও যদি ধাক্কা লেগে আমাদের হাড়-গোড় ভাঙ্গে, তবে তা ভাঙ্গুক।”

 গোলকে প্রবেশ করিবার দ্বার উহার ক্রমশঃ সূক্ষ্ম শিরোভাগে গঠিত হইয়াছিল। যাহাতে ভিতরদিক হইতে অতি দৃঢ়ভাবে সে দ্বার রুদ্ধ করিতে পারা যায় বার্বিকেন ভালো করিয়া সে ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।

 গোলকে উঠিয়া চন্দ্রলোকে গমন করিলেইত যথেষ্ট হইল না। যাইতে যাইতে চতুর্দ্দিকের পরিদৃশ্যমান জগৎ বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিবারও আবশ্যক ছিল। সেই জন্য স্প্রীংএর গদির নিম্নে কাচের ৪টী জানালা বসানো হইয়াছিল! দুইটী গবাক্ষ দুই পার্শ্বে, একটা শিরোদেশে এবং আর একটা তলে নির্ম্মিত হওয়ায় মহাশূন্যে গমনকালে পরিত্যক্তা ধরণী, ক্রমোজ্জ্বল চন্দ্রলোক এবং গ্রহ-নক্ষত্রখচিত অনন্তব্যোম দেখিবার আর কোনো অসুবিধা ছিল না। এই কাচগুলি যাহাতে ভাঙ্গিয়া না যায়, সে জন্য ধাতুর আবরণ দ্বারা সেগুলি এরূপভাবে আবৃত ছিল যে, গোটাকতক স্ক্রু খুলিলেই জানালার কাচ আপনা হইতেই খুলিয়া যাইত।

 গোলকে যাহাতে আলোক ও উত্তাপের অভাব না হয় সে জন্য অত্যন্ত অধিক চাপে আবদ্ধ গ্যাস লওয়া হইল। একটী নলের মুখ খুলিলেই গ্যাস বাহির হইত। বার্বিকেন ছয়দিনের যোগ্য আহার্য্য, পানীয় ও গ্যাস লইলেন। কোনোরূপে জীবনধারণের জন্য যাহা প্রয়োজন শুধু যে সেই সকল দ্রব্যই গোলকে লওয়া হইল তাহা নহে, যাহাতে বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকিতে পারা যায় তাহারও বন্দোবস্ত করা হইল। যদি স্থান থাকিত তাহা হইলে মাইকেল আর্দ্দান্ সুকুমার শিল্পের একটী কর্ম্মশালাই সঙ্গে লইতেন।

 আহার্য্য পেয়ঃ এবং আলোকের পরই বাতাসের ব্যবস্থা করা হইল। গোলকের মধ্যে স্বভাবতঃ যে বাতাসটুকু ছিল, তাহা তিন জনের চারি দিনের শ্বাসপ্রশ্বাস কার্য্যেরও যোগ্য ছিল না। বার্বিকেনের সঙ্গে তাঁহার কুকুর দুইটীও যাইতেছিল। সুতরাং পাঁচটী প্রাণীর জন্য প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় অন্ততঃ ৩২ সের অক্সিজেন গ্যাসের প্রয়োজন ছিল। একুশ ভাগ অক্সিজেন এবং ঊন-আশি ভাগ এজোটের মিশ্রণে বাতাস জন্মে। আমরা যখন নিশ্বাস লই, তখন অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করে এবং প্রশ্বাসের সঙ্গে এজোট বাহির হয়। বদ্ধস্থানে শ্বাসপ্রশ্বাস-ক্রিয়া বেশীক্ষণ চলিলে বাতাসের অক্সিজেন ফুরাইয়া গিয়া শুধু কার্ব্বনিক এসিড, গ্যাস থাকে। উহা তখন তীব্র বিষের কার্য্য করে। বার্বিকেন দেখিলেন, গোলকে যে পরিমাণ অক্সিজেন ব্যয়িত হইবে তাহা প্রস্তুত এবং প্রশ্বাসিত কার্ব্বনিক এসিড্ গ্যাসের ধ্বংস সাধন করিতে পারিলেই গোলক মধ্যে বায়ুর অভাব হইবে না।

 বার্বিকেন স্থির করিলেন, ক্লোরেট্‌-অব্-পটাশ এবং কষ্টিক-পটাশ ব্যবহার করিলেই এ উদ্দেশ্য সফল হইবে। চারি শত ডিগ্রী উত্তাপে ক্লোরেট্-অব্-পটাশ, ক্লোরিণ-অব্-পটাশিয়মে রূপান্তরিত হয় এবং উহার ভিতর যে অক্সিজেন থাকে, তাহা বাহির হইয়া পড়ে। নয় সের ক্লোরেটৃ-অব্-পটাশে সাড়ে তিন সের অক্সিজেন গ্যাস পাওয়া যায়। বার্বিকেন দেখিলেন, ২৪ ঘণ্টার জন্য উহাই যথেষ্ট। বাতাসে যে কার্ব্বনিক এসিড্ গ্যাস থাকে, ক্লোরেট্‌-অব্-পটাশ প্রতি মুহূর্ত্তে তাহা টানিয়া লয়। সুতরাং যথেষ্ট পরিমাণে ক্লোরেট্‌-অব্-পটাশ এবং কষ্টিক-পটাশ লইবার ব্যবস্থা করা হইল।

 ম্যাট্‌সন্ কহিলেন,—“যদিও বৈজ্ঞানিক হিসাবে দেখা গেল যে বাতাসের অভাব ঘটিবে না, কিন্তু একবার পরীক্ষা করিয়া নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত।”

 সকলেই বলিলেন,—“হাঁ!——হাঁ—তা’ ঠিক। পরীক্ষা করাই উচিত।” তখন সপ্তাহকালের যোগ্য খাদ্য ও পানীয় এবং যথেষ্ট পরিমাণে ক্লোরেট্ অব্-পটাশ এবং কষ্টিক-পটাশ দিয়া সকলে ম্যাট্‌সন্‌কে গোলকমধ্যে আবদ্ধ করিলেন। সপ্তাহ পর দেখা গেল, ম্যাট্‌সন্ বেশ সুস্থ দেহে গোলকমধ্যে বিরাজ করিতেছেন। তাঁহাকে ওজন করিয়া বার্বিকেন দেখিলেন, দেহভার পূর্ব্বাপেক্ষা বৃদ্ধিই হইয়াছে!