চন্দ্রলোকে যাত্রা/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ
যাত্রার আয়োজন
চন্দ্রলোক লক্ষ্য করিয়া গোলাটী নিক্ষিপ্ত হইলেই যাহাতে পৃথিবী হইতে উহার গতি দেখিতে পাওয়া যায়, প্রথম হইতেই বৈজ্ঞানিকগণ সে চেষ্টা করিতেছিলেন। চন্দ্র হইতে ৩৯ মাইল দূরে থাকিয়া আমরা উহার সকল অংশ যে ভাবে দেখিতে পারি, সে সময় যে সকল দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছিল, তাহাদের সাহায্যে তদপেক্ষা স্পষ্টতর দেখিবার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু চন্দ্রের তুলনায় কামানের গোলাটী বিন্দুবৎ। সেই বিন্দুকে মহাব্যোমে ধাবিত দেখিতে হইলে দূরবীক্ষণকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন বুঝিয়া বৈজ্ঞানিকগণ প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছিলেন। ইতঃপূর্ব্বে যে যন্ত্রে কোন পদার্থকে ছয় হাজার গুণ বৃহত্তর করিয়া দেখা যাইত, তাঁহারা তাহার শক্তিকে ছয়গুণ বৃদ্ধি করিবার আয়োজন করিয়াছিলেন। কেম্ব্রিজ মান-মন্দিরের অধ্যক্ষগণ যে দূরবীক্ষণ প্রস্তুত করিলেন, তাহার নলটীই দৈর্ঘ্যে ২০০ ফিট হইল। নলের অভ্যন্তরে যে দূরদর্শন কাচ বসিল, তাহার ব্যাস হইল ১৬ ফিট!
বায়ুস্তর ভেদ করিয়া পৃথিবীতে আসিতে চন্দ্রকর অনেকাংশে আপন ঔজ্জ্বল্য হারায়। সুতরাং দূরবীক্ষণ যত ঊর্দ্ধে স্থাপিত করিতে পারা যাইবে, চন্দ্রকরকে অন্ততঃ ততটুকু স্থানের বায়ুভেঙ্গ করিতে হইবে না। কাজেই স্থির হইল যে কেম্ব্রিজের নবাবিষ্কৃত দূরবীক্ষণটী কোনো একটী উচ্চ শৈলের শৃঙ্গোপরি স্থাপিত করিতে হইবে। অনেক গবেষণার পর নির্দ্ধারিত হইল যে যুক্ত-রাজ্যের রকি-মাউণ্টেনের চূড়ার উপর দূরবীক্ষণ বসাইতে হইবে। সে চুড়া ভূপৃষ্ঠ হইতে ১০৭০১ ফিট উচ্চ।
সে পথ অতি দুর্গম। দুর্ভেদ্য কানন, দুরতিক্রম্য মরু-প্রান্তর, কোথাও ভীমবেগশালিনী গিরিনদী, সুতীক্ষ্ণ অস্ত্রধারী রাক্ষসতুল্য বর্ব্বর মানুষ সেই দুর্গম পথকে আরো ভীষণ করিয়া রাখিয়াছিল। কখনো যেখানে মনুষ্য সমাগমের সম্ভাবনা ছিল না, সেইখানে বহু যন্ত্রাদি সহ শিল্পিগণ গমন করিলেন। এক বৎসরের অক্লান্ত শ্রমে বিরাট কায় নবনির্ম্মিত লৌহ-স্তম্ভাবলীর উপর শেষে অতিকায় দূরবীক্ষণটী যন্ত্র স্থাপিত হইল।
সমস্তই যখন ঠিক হইয়া গেল তখন ষ্টোনিহিলে ভারে ভারে বারুদ আসিতে লাগিল। বার্বিকেন্ দেখিলেন, দশ সহস্র মণ বারুদ একযোগে ষ্টোনিহিলে আসিলে হয়ত কাহারো অসাবধানতার একটা মহাপ্রলয় ঘটিতে পারে। তিনি অল্পে অল্পে বারুদ আনিতে লাগিলেন। তখন ষ্টোনিহিলের চারিদিকে দুই মাইলের মধ্যে কোন কারণেই অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা নিষিদ্ধ হইয়াছিল। সুদক্ষ কৌশলী শিল্লিগণ নগ্নপদে কার্য্য করিতে লাগিলেন, পাছে জুতার ঘর্ষণে বারুদের কণা জ্বলিয়া উঠে। শুধু রজনীতে বিদ্যুতের আলোকে কলের সাহায্যে কার্ত্তুস্ প্রস্তুত হইতে লাগিল। কার্ত্তুসগুলি একে একে লোহার তারে আবদ্ধ হইল এবং অতি সাবধানে কামানের মধ্যে স্থাপিত হইতে লাগিল। কার্ত্তুসের তারের সহিত আর একটী তার লাগাইয়া কামানের গাত্রেস্থিত অতি সূক্ষ্ম একটী ছিদ্রপথে তাহার অপর প্রান্তটী বাহিরে আনা হইল। একটী শক্তিশালী বৈদ্যুতিক যন্ত্র ষ্টোনিহিল হইতে দুই মাইল দুরে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। বহু লৌহ-স্তম্ভের শিরে আবদ্ধ করিয়া সেই তারটী বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সহিত সংযুক্ত করা হইল। বার্বিকেন স্থির করিয়াছিলেন যে উপযুক্ত সময়ে এই যন্ত্রের সাহায্যে বারুদে আগুন দিবেন।
বারুদের কার্ত্তুসগুলি নিরাপদে কামানে স্থাপিত হইলে পর কাপ্তান নিকল্ পরাজয় স্বীকার করিয়া তাঁহার তৃতীয় বাজির টাকা বার্বিকেনের হস্তে প্রদান করিলেন।
মাইকেল আর্দ্দানের তখন আদৌ অবসর ছিল না। তিনি নানাবিধ আবশ্যক দ্রব্যাদি সংগ্রহ করিতেছিলেন। তাপমান যন্ত্র, দুরবীক্ষণ, সৌর-জগতের মানচিত্র, বন্দুক, গুলি, কোদালি, কুঠার প্রভৃতি সমস্তই তিনি গোলার মধ্যে তুলিলেন। সাধারণ ও অসাধারণ শীত এবং গ্রীষ্মের উপযুক্ত পরিচ্ছদাদিও সংগৃহীত হইল। ছোট ছোট কৌটায় নানারূপ শস্যের বীজ এবং কয়েকটী গাছের চারা পর্য্যন্ত লওয়া হইল। মাংস এবং অন্যান্য খাদ্য-সামগ্রী ইতিপূর্ব্বেই কলের সাহায্যে পিষ্ট হইয়া ক্ষুদ্রকায় বর্ত্তুলাকার করা হইয়াছিল। আর্দ্দান্ এক বৎসরের উপযুক্ত খাদ্যসামগ্রী লইলেন। দুই মাস চলিতে পারে, এই পরিমাণে জল ও ব্রাণ্ডি লওয়া হইল। বার্বিকেন্ তখন পূর্ব্ব কথিত মত জলের স্প্রিংএর উপর বসিবার আসন প্রস্তুত করিলেন এবং বাতাসের অভাব দূর করিবার জন্য দুই মাসের উপযুক্ত ক্লোরেট-অব্-পটাশ ও কষ্টিক্-পটাশ লইলেন।
তখনো কাপ্তান নিকল্ কহিতেছিলেন,—“কিছুতেই গোলা চল্বে না!”
বার্বিকেন্। কেন?
নিকল্। ক্রমে ক্রমে গোলাটা যেমন ওজনে ভারি হয়ে উঠল, কামানের মধ্যে বসাতে গেলেই সব কার্ত্তুসগুলো জ্ব’লে উঠবে ৷
এ কথা শুনিয়া বার্বিকেন্ গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আচ্ছা দেখা যাক্।”
তিনি পূর্ব্বেই অতিশয় দৃঢ় ভার-উত্তোলক একটী ক্রেণ আনিয়াছিলেন। তাহার শিকলগুলি অতি সাবধানতার সঙ্গে পরীক্ষা করিয়া বার্বিকেন্ গোলাটী তুলিবার ব্যবস্থা করিলেন। তখন তাঁহার ও গান্ ক্লাবের সদস্যদিগের চিত্তে যে কি আকুলতা উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করা যায় না। সকলেই ভাবিতে লাগিলেন, শিকল ত ছিঁড়িবে না? যদি ছিঁড়িয়া যায়, তবেইত সর্ব্বনাশ! গোলা বিপুল বেগে কামানের তলদেশে যাইয়া পড়িবে এবং তৎক্ষণাৎ সেই আঘাতেই কার্ত্তুস জ্বলিয়া উঠিবে! ধীরে—অতি ধীরে যন্ত্রের সাহায্যে গোলকটী কামানের মধ্যে নামিতে লাগিল—ক্রমে ক্রমে উহা পাতালে প্রবেশ করিতে লাগিল—ক্রমে উহা চক্ষের অন্তরাল হইল। সমিতির সদস্যগণ তখন নিরুদ্ধ-নিশ্বাসে শেষ মুহূর্ত্তের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। বার্বিকেনের সাধনা শেষে সিদ্ধিলাভ করিল। গোলকটী নির্ব্বিঘ্নে কামানের তলদেশে স্থাপিত হইল। কাপ্তান নিকল্ টাকা লইয়া বার্বিকেনের নিকটেই দাঁড়াইয়াছিলেন। তিনি বার্বিকেনের কর ধারণ করিয়া কহিলেন—
“বন্ধু! আমি আর একটা বাজিও হারলাম। এই নিন্ তার টাকা।”
বার্বিকেন্ সহাস্য বদনে বলিলেন,——“আপনিও ত এখন আমাদেরই একজন। আপনার কাছ থেকে কি বাজির টাকা লওয়া উচিত?”
নিকল্। নিশ্চয় উচিত। বাজি—চিরদিনই বাজি। নিজের কথা ঠিক রাখতে হ’বে ত? নিন্—টাকা নিন্।
বার্বিকেন্ অর্থের থলি হস্তে লইয়া বলিলেন,—“তা’ হ’লে দেখ্ছি, আপনাকে আর দুটো বাজিও হারতেই হ’বে।”
নিকল্। দেখা যাক্—যদি হারতেই হয়ত হারব!