চন্দ্রলোকে যাত্রা/প্রথম পরিচ্ছেদ

চন্দ্রলোকে যাত্রা

প্রথম পরিচ্ছেদ

সমিতি

মেরিকায় বাল্টিমোর নগর। সেই নগরের একটী প্রশস্ত গৃহে—সালের ৩রা অক্টোবর সায়ংকালে একটী সভা বসিয়াছিল। সভায় যত লোক উপস্থিত ছিল, তাহাদের কাহারও অঙ্গই সম্পূর্ণ ছিল না। কাহারও হাত ছিল, একখানা পা ছিল না—কাহারও পা ছিল, হাত ছিল না। কাহারও হস্ত এবং পদ দুই-ই ছিল—একটী চক্ষু, কি একটী কর্ণ ছিল না। কাহারও কাঠের হাত, কাহারও কাঠের পা, কাহারও পাথরের চক্ষু! সে দিনের সভায় হাত-কাটা সভ্যের সংখ্যাই ছিল বেশী।

 এই সভার সদস্যদিগের একমাত্র কাজই ছিল কামান, বারুদ ও গোলাগুলি নির্ম্মাণ করা। সেই জন্য সভার নাম ছিল গান্-ক্লাব। সভার সদস্যগণ সকলেই ছিলেন সুবিখ্যাত গোলন্দাজ। কেমন করিয়া কামান গড়িলে প্রকাণ্ড একটী গোলাকে বহুদুরে ফেলিতে পারা যায়— যায়—কি করিলে সেই দূর-নিক্ষিপ্ত অগ্নি-গোলক মুহূর্ত্তে বহু লোককে নিহত করিতে পারে, ইহাই ছিল গান্-ক্লাবের সদস্যদের একমাত্র চিন্তার বিষয়। কামান, বারুদ এবং গোলাগুলির পরীক্ষা করিতে যাইয়াই তাঁহারা দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারাইতেন। কিন্তু সেদিকে কাহারও লক্ষ্য ছিল না! কিসে বেশী মানুষ মারিতে পারা যায়, কামান, গোলা ও বারুদের সেইরূপ ব্যবস্থা করিতে পারিলেই তাঁহারা নর-জন্ম সার্থক বলিয়া মনে করিতেন!

 দেশে যে সকল যুদ্ধ-বিগ্রহ হইতেছিল, সহসা একদিন তাহা থামিয়া গেল। বিদেশেও চারিদিকে শান্তি স্থাপিত হইল। গান্‌-ক্লাবের সদস্যেরা দেখিলেন সর্ব্বনাশ উপস্থিত! আর ত’ নরহত্যা করিবার সুযোগ নাই! নব-আবিষ্কৃত কামান ও গোলার শক্তি যে কত উন্নত হইল, তাহা ত’ আর পরীক্ষা করিবার উপায় নাই! মর্টার, হাউইজার প্রভৃতি তখন গড়ের মধ্যে কর্ম্মহীন হইয়া পড়িয়া রহিল, গোলাগুলি স্তূপীকৃত হইয়া মুক্ত প্রান্তরে মরিচা ধরিতে লাগিল। গান্-ক্লাবের, নির্ম্মিত কামানের গোলায় একদিন যেখানে রণক্ষেত্রে ছোট-বড় শত শত গভীর গর্ত্ত হইয়াছিল, কৃষকগণ সে সকল পূর্ণ করিয়া আবার হলকর্ষণ করিতে লাগিল। সদস্যেরা দেখিলেন একে একে তাঁহাদের কীর্ত্তি-চিহ্নগুলিও বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে! সমরক্ষেত্রে সে শোণিত লেখা নাই—গভীর গহ্বর নাই—পুঞ্জীকৃত কঙ্কালরাশি আর তাঁহাদের গোলার শক্তি প্রচার করে না! সর্ব্বনাশ! এ কি হইল। আমেরিকার সকল যুদ্ধ-বিগ্রহ একেবারে মিটিয়া গেল!

 ক্লাবের কক্ষে আর সভা বসিত না। কেনই বা বসিবে কাজ ত’ কিছু ছিল না। দুই চারিজন প্রধান প্রধান সদস্য ভিন্ন কেহ আর তখন ক্লাবে আসিত না। দেশী-বিদেশী রাশি রাশি সংবাদপত্র টেবিলের উপর পড়িয়া থাকিত, কেহ মোড়ক পর্য্যন্ত খুলিত না। কক্ষের প্রান্তে বেশ উজ্জ্বল হইয়া আগুন জ্বলিতেছিল। সেই আগুন পোহাইতে পোহাইতে মিষ্টার হাণ্টার বলিলেন,—“কি আপ্‌শোষের কথা! আমরা যে একেবারেই কুঁড়ে হ’য়ে পড়্‌লাম! হায় রে সেদিন, যেদিন কামানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গত—আবার কামানের ধ্বনিতে অভিনন্দিত হ’য়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। উঃ! জীবনটা দুর্ব্বহ ব’লে মনে হচ্ছে।” মিষ্টার হাণ্টার এতই উত্তেজিত হইয়াছিলেন যে তাঁহার কাঠ-নির্ম্মিত চরণখানি যে অগ্নি-স্পর্শে দগ্ধ হইতেছে, মোটেই সেদিকে তাঁহার দৃষ্টি ছিল না!

 নিজের ভগ্ন-বাহুখানি প্রসারিত করিবার চেষ্টা করিয়া মিঃ বিল্‌স্‌বি কহিলেন,—“আর কি ভাই সে দিন ফির্‌বে! একটা কামান তৈরি হ’তে না হ’তেই অমনি তার পরীক্ষা আরম্ভ হ’তো। তারপর যেই শিবিরে ফিরেছি, অমনি বন্ধুদের মুখে কত জয়ধ্বনি! কি আনন্দ তাদের যে আমার কামানে সে দিন অনেক বেশী মানুষ মেরেছে! অমন আর হয় না—হ’বে না!”

 মিষ্টার ম্যাট্‌সন্ ছিলেন এই সমিতির সম্পাদক। গাটাপার্চ্চায় নির্ম্মিত তাঁহার দক্ষিণ করটি চুলকাইতে চুলকাইতে নিতান্ত দুঃখিত চিত্তে তিনি কহিলেন,—

 “তাই ত’ ভাই! নিকট ভবিষ্যতে যুদ্ধের ত’ কোনো সম্ভাবনা দেখ্‌ছি না। আজ সকালে চুপ করে বসে থাক্‌তে থাক্‌তে আমি একটা নূতন কামানের ছবি এঁকেছি! শুধু ছবি নয়—ছবি, মাপ, ওজন সব! এ যদি ব্যবহার ক’র্‌তে পারা যেত—তা’ হ’লে দেখ্‌তে যে বর্ত্তমান রণনীতিই বদ্‌লে গেছে!”

 কর্ণেল ব্লুম্‌স্‌বি তাঁহার পাথরের দক্ষিণ চক্ষুটী একবার বাহির করিয়া রুমাল দিয়া মুছিতে মুছিতে কহিলেন,—

 “তাই নাকি?”

 ম্যাট্‌সন্ বলিলেন,—“তা’ বৈকি। এই দেখনা ছবি খানা! কিন্তু এত অধ্যয়ন, এত চিন্তা, এত শ্রম আর কিসের জন্য? আমেরিকার লোক ত’ আর যুদ্ধ-টুদ্ধ ক’র্‌বে বলে’ বোধ হ’চ্ছে না!”

 কর্ণেল। চলনা ভাই, আমেরিকা ছেড়ে য়ুরোপে যাই। তারা আমাদের মত নয়, কথায় কথায় যুদ্ধ করে।

 হাণ্টার। তা’তে আর আমাদের কি?

 কর্ণেল। কেন? তাদের হ’য়েই কামান তৈরি ক’র্‌ব। মানুষ মারার পরীক্ষা—সে যেখানে-সেখানে ক’রলেই হ’লো ৷

 হাণ্টার। তাই কি হয়? আমেরিকান্ হ’য়ে বিদেশীর জন্য কামান গড়্‌বো!

 কর্ণেল। কিছু না করার চেয়ে ত ভালো। অনভ্যাসে জানা বিদ্যাও যে ভুলে’ যেতে হয়!

 ম্যাট্‌সন্ গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “বিদেশে, বিশেষ য়ুরোপে যাবার আশা ছাড়। জাতীয় উন্নতি কিসে হ’বে, সে কথা বুঝ্‌তে তাদের এখনো অনেক দেরি! আমেরিকার সঙ্গে তাদের ধ্যান-ধারণা কিছু-মাত্র মিল্‌বে না।”

 পকেট হইতে ছুরি বাহির করিয়া তাহার দ্বারা চেয়ারের হাতল্‌টা অল্পে অল্পে কাটিতে কাটিতে মিষ্টার হাণ্টার একটী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন—

 “তবে আর কি! চল এখন লাঙ্গল নিয়ে তামাকের আবাদ করিগে—নয় ত’ তিমি মাছ ধ’রে তার তেলটাকে জ্বালে চড়াই গে!”

 ম্যাট্‌সন্ উত্তেজিত-কণ্ঠে বলিলেন,—“অতটা ক’র্‌তে হ’বে না। আমার ত’ মনে হয়, এমন দিন আস্‌বেই যে আবার অতি সত্বরেই আমাদের কামানের ধ্বনিতে গগন কম্পিত হ’য়ে উঠ্‌বে। চিরদিনই কি এমনি শান্তিতে কাট্‌বে? যুদ্ধ লাগ্‌বেই। ফ্রান্স কি ভুল ক’রেও আমাদের দু’-একখানা জাহাজ আট্‌কাবে না! আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন ক’রে, ইংলণ্ডও কি দু’চারজন আমেরিকানকে ফাঁসি-কাঠে লট্‌কাবে না! একটা কিছু হ’লো বলে!”

 হাণ্টার। তুমি যা’ ব’ল্‌লে ম্যাট্‌সন্, তা’ আর হ’চ্ছে না। আমেরিকার চামড়া এখন বড় পুরু হয়েছে। সূঁচের ঘায়ে আর লাগে না। আমরা কি আর মানুষ আছি ভাই—আমরা গোল্লায় গেছি! নইলে এতদিনও একটা যুদ্ধ বাধে না! হোক্ না ছোট-খাটো রকম। কিন্তু তাই বা কৈ?”

 কর্ণেল। একটা যুদ্ধ বাধালে কেমন হয়?

 হাণ্টার। কেমন ক’রে?

 কর্ণেল। কারণের অভাব কি? এই দেখনা—উত্তর আমেরিকা কি একদিন ইংরাজদের দেশ ছিল না?

 কাষ্ঠের নির্ভর-যষ্টি দ্বারা চিম্‌নীর অগ্নি উদ্দীপিত করিতে করিতে মিষ্টার হাণ্টার কহিলেন,—

 “ছিল বৈ কি?”

 “তবে?”

 “তবে কি?”

 “বুঝ্‌লে না—সেই সূত্রে ইংলণ্ডই বা আমাদের দেশ হ’বে না কেন?”

 সমগ্র দশন-পংক্তির মধ্যে যুদ্ধান্তে যে চারিটী মাত্র অবশিষ্ট ছিল, তাহাই নিষ্পেষণ করিতে করিতে মিষ্টার বিল্‌সবি কহিলেন,—

 “যাও না একবার কথাটা নিয়ে প্রেসিডেণ্টের কাছে! মজা দেখ্‌বে এখন। আমি ভাই কিছুতেই আর এবার ওঁকে ভোট দিচ্ছিনে।”

 হাণ্টার। আমিও না।

 সকলেই তখন উচ্চ-কণ্ঠে কহিলেন,—“আমিও না—আমিও না।”

 ম্যাট্‌সন্ বলিলেন,—“আমার নূতন কামানের বল পরীক্ষা ক’র্‌তেই হ’বে। যদি দেশ সে জন্য একটা যুদ্ধ না বাধায়, আমি তা’ হ’লে আর তোমাদের সমিতির সদস্য থাক্‌ছিনে। পদত্যাগ ক’রে কোনো দূর-দেশের নিবিড় বনে চ’লে যাব।”

 উত্তেজিত-কণ্ঠে সকলেই কহিলেন, ‘আমরাও যাব—আমরাও যাব। হয় যুদ্ধ——না হয় বনে গমন।”

 সমিতির ভিতরকার অবস্থা যখন এইরূপ, তখন সমিতির সভাপতি সহসা একদিন নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপন প্রচার করিলেন,—

 গান্-ক্লাবের সভাপতির সবিনয় নিবেদন যে, আগামী ৫ই অক্টোবর সন্ধ্যা ৮টার সময় তিনি সদস্যদিগকে একটী বিস্ময়কর সংবাদ শুনাইবেন। সভাপতি ভরসা করেন যে সদস্যগণ সকল কার্য্য ত্যাগ করিয়া সেদিন সভায় উপস্থিত হইবেন।