চন্দ্রলোকে যাত্রা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
নূতন প্রস্তাব
৫ই অক্টোবর সায়ংকালে সমিতির গৃহে লোকারণ্য হইল। সমিতির সদস্যের সংখ্যা ত’ কম ছিল না-ত্রিশ সহস্রেরও অধিক। ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রতি ট্রেণে লোক আসিতে লাগিল। সভা-মন্দিরে আর তিল ধারণের স্থান রহিল না। কক্ষে কক্ষান্তরে, অলিন্দে—দ্বিতলে ত্রিতলে সকল স্থানেই লোক। উদ্যানে প্রাঙ্গণে এমন কি রাজপথে পর্য্যন্ত লোক! সমিতির প্রাসাদতুল্য গৃহ—গৃহ-প্রবেশের সিংহদ্বারে সতর্ক প্রহরী বসিল। সমিতির সদস্য ভিন্ন কেহই প্রবেশ করিতে পারিল না।
সমিতির বিরাট সভাগৃহ আলোকে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। এখানে রিভল্ভারের নলমুখে গ্যাসের আলোক—সেখানে পিস্তলের অদ্ভুত আলোকাধার—মাথার উপরে বন্দুকের ঝাড়ে প্রজ্জ্বলিত শত শত বর্ত্তিকা, সেই বৃহৎ কক্ষকে আলোকোদ্ভাসিত করিয়াছিল। সেই তীব্র আলোকরাশি সুদীর্ঘ কামানের নলের সারি সারি স্তম্ভগাত্রে পতিত হইয়া চতুর্দ্দিকে বিচ্ছুরিত হইতেছিল! কক্ষ-প্রাচীরে একালের ও সেকালের নানাবিধ আগ্নেয়াস্ত্র স্তরে স্তরে শোভা পাইতেছিল। কোথাও ব্লাণ্ডার্বাস্, ম্যাচ্লক,—কোথাও আরকুইবাস, কার্বাইন—এখানে কামানের ছাঁচ, সেখানে গোলার আঘাতে ছিন্ন বর্ম্ম—স্থানান্তরে গোলা ও গুলির হার—কোথাও বা হাউইজারের মালা সজ্জিত থাকিয়া সমিতির সদ্যদিগের কর্ম্মনিষ্ঠা ও গৌরব সূচিত করিতেছিল।
কক্ষের প্রান্তে একটী সুবিস্তৃত উচ্চ বেদীর উপর সভাপতির আসন নির্দ্দিষ্ট ছিল। সে আসন কামান বহিবার গাড়ীর উপর নির্ম্মিত। আসনের সম্মুখে টেবিল এবং টেবিলের সম্মুখে সদস্যদিগের বসিবার আসনগুলি তির্য্যগ্ভাবে সজ্জিত হইয়াছিল।
সভাপতি ইম্পে বার্বিকেনকে কে না জানিত। ধীর, স্থির, গম্ভীর তিনি। তাঁহার প্রতিকার্য্য ক্রণোমিটার ঘড়ীর কাঁটার মত চলিত। অন্যে যে কার্য্যকে মনে করিত অত্যন্ত বিপজ্জনক, তিনি অনায়াসে তাহা করিতে পারিতেন। সমিতির সদস্যদিগের মধ্যে কেবল তাঁহারই কোন দিন অঙ্গহানি হয় নাই। অথচ নানাবিধ আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কার করিয়া তিনি যেরূপে সমিতির গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছিলেন, আর কেহ তাহা পারে নাই।
কৃষ্ণবর্ণের রেশমে নির্ম্মিত কামানের নলের ন্যায় দীর্ঘ একটা টুপী মাথায় দিয়া সভাপতি বার্বিকেন মঞ্চে আরোহণ করিলেন। তখনো ৮টা বাজিতে ১ মিনিট্ ৪৫ সেকেণ্ড বাকি ছিল। বার্বিকেন ঘড়ীর দিকে চাহিয়া রহিলেন। উৎসুক জনমণ্ডলী তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সভাস্থল নীবব! সেই নীরবতা ভঙ্গ করিয়া যেই ৮টার প্রথম ঘণ্টা বাজিল ঢং, অমনি বার্বিকেন তড়িদ্বেগে আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন এবং জলদ্গম্ভীরে বলিতে লাগিলেন—
“বীর সহকর্ম্মিগণ! সমিতির সদস্যগণ এখন দুঃসহ কার্য্যহীনতার মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছেন। কি দুর্দ্দৈব! সহসা যে সন্ধি হইবে, ইহা কে জানিত! সন্ধি যে ভাঙ্গিবে না, তাহাই বা কে ভাবিয়াছিল! আমি জানি, আজই যদি যুদ্ধ উপস্থিত হয়, তবে সর্ব্বাগ্রে আমরাই তাহাকে সাদরে বরণ করিয়া লইব”।
সহস্রকণ্ঠে ধ্বনিত হইল—“ঠিক ঠিক তাহা ঠিক।” সভাপতি বলিতে লাগিলেন,—“এখন দেখিতেছি, সকালে যে কোন যুদ্ধ ঘটিবে তাহা ত’ বোধ হয় না। আমরা কি তবে নীরবে বসিয়া থাকিব! আগ্নেয়াস্ত্রের কি আর উন্নতি ঘটিবে না?”
“হে বীর সহকর্ম্মিগণ! আমি ভাবিতেছিলাম, যুদ্ধ যদি না-ই হয় তাহা হইলে, কি আমরা এই ঊনবিংশ শতাব্দীর যোগ্য—পৃথিবীখ্যাত এই সমিতির যশের ও প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত কোনো বিশেষ কার্য্যে নিযুক্ত হইতে পারিব না। আমি অনেক চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি যে আমরা এমন একটী কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে পারি, যাহা শুধু গান্ক্লাবেরই যোগ্য—যাহা শুধু আমেরিকার পক্ষেই সম্ভব। সমস্ত পৃথিবী সে সংবাদ শুনিলে স্তম্ভিত হইয়া যাইবে।”
সহস্র সদস্য বলিয়া উঠিলেন—“কি—কি—কি—সে কাজটা কি?” মাথার টুপীটা ভালো করিয়া মাথার উপর বসাইয়া সভাপতি কহিলেন,—
“বন্ধুগণ! আপনারা মনোযোগপূর্ব্বক সেই সংবাদটী শুনুন্। সেই কথা নিবেদন করিবার জন্যই আজ আমি আপনাদিগকে আহ্বান করিয়াছি। আামার দৃঢ় বিশ্বাস আছে, আপনারা সকলেই চন্দ্র দেখিয়াছেন। কেহ যদি নাও দেখিয়া থাকেন, তবে উহার কথা নিশ্চয়ই শুনিয়াছেন। বন্ধুগণ! আমরা সেই চন্দ্রলোক জয় করিব। আমরাই সেই চন্দ্রলোক আবিষ্কর্ত্তা কলম্বস্। ছত্রিশটী মিলিত রাজ্যে আমাদের এই প্রাণপ্রিয় যুক্তরাজ্যটী গঠিত। সমিতির চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের ফলে অচিরে চন্দ্রলোকও আমাদের আয়ত্ত হইবে।”
সদস্যগণ সমস্বরে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। মনে হইল যেন কক্ষের ছাদ ভাঙ্গিয়া পড়িল।
“বন্ধুগণ! আপনারা জানেন যে চন্দ্রলোক সম্বন্ধে যথেষ্ট আলোচনা হইয়া গিয়াছে। উহার গুরুত্ব, ঘনত্ব, অবস্থা—উহার গঠনপ্রণালী, গতি, পৃথিবী হইতে দূরত্ব কিছুই জানিতে বাকি নাই। সৌরজগতে চন্দ্রের কার্য্য কি তাহাও আমরা জানি। আপনারা নিশ্চয়ই শুনিয়াছেন যে চন্দ্রলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ-সম্বন্ধ ঘটাইবার জন্য ইতিপূর্ব্বে অনেকেই অনেক কথা লিখিয়াছেন—কিন্তু কেহই কার্য্যে অগ্রসর হইতে পারেন নাই। সুতরাং চন্দ্রলোক এখনো অনাবিষ্কৃত। সেই অনাবিষ্কৃত সাম্রাজ্য আবিষ্কার ও অধিকার করিয়া আমরাই পৃথিবীর জয়মাল্য গ্রহণ করিব! আপনারা হয় ত ভাবিতেছেন—ইহা অসম্ভব! কিন্তু মোটেই তাহা নহে, বরং অত্যন্ত সহজ।”
চারিদিকে ঘোর রোলে করতালিধ্বনি হইতে লাগিল। শ্রোতৃবর্গ আনন্দে অধীর হইয়া কেবলই চীৎকার করিতে লাগিল। উত্তেজনা কমিলে পর সভাপতি পুনরায় বলিলেন,—
“আপনারা সকলেই জানেন অতীত কয়েক বৎসরে গোলক প্রণয়নবিদ্যা কতদুর উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে। আপনারা জানেন যে, দক্ষলোকের হস্তে বারুদ কত শক্তি ধরে, কামান কত সুদৃঢ় হয়। আমি তাই ভাবিতেছিলাম যে, চন্দ্রলোকে একটী কামানের গোলা প্রেরণ করিলে ক্ষতি কি?”
সম্মুখে সহসা বজ্র পড়িলে মানুষ যেরূপ স্তম্ভিত হয়, এই প্রস্তাব শুনিয়া সদস্যগণ সেইরূপ স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। কিন্তু পরমুহূর্ত্তেই সেই সভাগৃহ ভেদ করিয়া এমন একটী উন্মত্ত আনন্দ-কোলাহল উত্থিত হইল যে, মনে হইল যেন সেই বিশাল মিলন-মন্দির তৎক্ষণাৎ ভাঙ্গিয়া পড়িবে। উহা কম্পিত হইতে লাগিল ৷
সভাপতি বার্বিকেন পুনরায় কথা কহিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু পারিলেন না। আরও কিছুক্ষণ অতিবাহিত হইয়া গেল! সভাতল কথঞ্চিৎ শান্ত-মূর্ত্তি ধরিল। সভাপতি তখন বলিলেন,—
“বন্ধুগণ! আর দুই একটা কথা, তাহা হইলেই শেষ হয়। আমি বিশেষ অধ্যবসায়ের সহিত হিসাব করিয়া দেখিয়াছি, প্রতি সেকেণ্ডে দ্বাদশ সহস্র গজ যাইতে পারে এমন একটা গোলা চন্দ্রকে লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িতে পারিলেই উহা চন্দ্রলোকে পৌঁছিবে। আমি তাই সবিনয়ে প্রস্তাব করি আপনারা আপাততঃ কর্ম্মহীন বসিয়া না থাকিয়া এই সামান্য কার্য্যটীতে মনঃসংযোগ করুন।”
সভাপতির প্রস্তাবটী সমিতির সদস্যদিগের হৃদয়ে তড়িৎ ছুটাইয়া দিল। চারিদিকে তখন জয়ধ্বনি করতালি, নৃত্য এবং উল্লম্ফন আরম্ভ হইল! সেই চঞ্চল, সংক্ষুব্ধ, ক্ষিপ্ত, দোদুল্যমান জনসমুদ্রের মধ্যে সভাপতি অটল অচলের ন্যায় দণ্ডায়মান রহিলেন! ইচ্ছা ছিল, আরও কিছু বলেন। কিন্তু সদ্যগণ তাহার অবসর দিল না— তাঁহার ঘণ্টা-নিনাদ কেহ গ্রাহ্যও করিল না। সকলে হর্ষোৎফুল্ল হইয়া মুহূর্ত্তে সভাপতিকে সবেগে স্কন্ধে তুলিয়া নৃত্য করিতে লাগিল। পরমুহূর্ত্তেই দেখা গেল, তিনি এক স্কন্ধ হইতে স্কন্ধান্তরে এবং তথা হইতে অন্য স্কন্ধে নিক্ষিপ্ত হইতেছেন! অবিলম্বে একটী বিরাট শোভাযাত্রা বাহির হইল। শত সহস্র মশালের আলোকে বাল্টীমোর নগর আলোকিত হইয়া উঠিল! বাল্টীমোরবাসীরা ত’ সে শোভা-যাত্রায় যোগ দিলই—বিদেশীরাও আপন আপন মাতৃভাষায় কলরব করিতে করিতে আসিয়া শোভা-যাত্রার অঙ্গপুষ্টি করিতে লাগিল।
সহসা তখন আকাশ মেঘমুক্ত হইল—চন্দ্র করে চারিদিক হাসিয়া উঠিল। বিমুগ্ধ জনমণ্ডলী সহস্র লোচনে চন্দ্রের দিকে চাহিল—সহস্রবদনে চন্দ্রের নামে জয়ধ্বনি করিল। বাল্টীমোরে যেন একটী জাতীয় উৎসব আরম্ভ হইয়া গেল। গৃহে গৃহে জিন্ ও হুইস্কির তরঙ্গ খেলিল— নৃত্য ও গীতের ধ্বনি উঠিল——জাহাজে জাহাজে শত দীপ জ্বলিয়া জ্বলিয়া জলে সোণা ছড়াইল। একজন চতুর দোকানদার এই সুযোগে শত শত দুরবীক্ষণ-যন্ত্র বিক্রয় করিয়া ফেলিল—কারণ তখন সকলেরই ইচ্ছা যে, নিত্যপ্রত্যক্ষের বিষয় হইলেও সেদিন চন্দ্রকে একবার ভালো করিয়া দেখে। রাজপথে, বিপণীতে, পান্থশালায়, চা’র দোকানে—পোতাশ্রয়ে, উদ্যানে যেখানে দশজন মিলিল, সেইখানেই চন্দ্রলোকের কথা আলোচিত হইতে লাগিল। সেইখানেই তর্ক উঠিল—সেইখানেই আবার তর্কের সীমাংসাও হইয়া গেল। রাত্রি যখন দুইটা বাজিল, তখন সহর কতকটা শান্ত হইল। সভাপতি বার্বিকেন বার বার স্কন্ধ হইতে স্কন্ধান্তরে নিক্ষিপ্ত হইবার জন্য নানা স্থানে আহত হইয়া ক্লান্তদেহে গৃহে ফিরিলেন।
সভাপতি বার্বিকেন যখন সমিতির কক্ষে বক্তৃতা করেন, তখনই তাহার প্রত্যেকটী শব্দ তারযোগে ওয়াসিংটন, ফিলাডেল্ফিয়া, নিউইয়র্ক, বোষ্টন প্রভৃতি বিখ্যাত নগরে প্রেরিত হইতেছিল। যখন বাল্টীমোর আনন্দে মত্ত—তখন ঐ সকল নগরেও উৎসব আরম্ভ হইয়াছিল। সমগ্র যুক্তরাজ্য এই জাতীয় গৌরব লাভ করিবার জন্য সেই দিন হইতে মত্ত হইয়া উঠিল। পরদিনই যুক্তরাজ্যের শত শত সংবাদপত্রে চন্দ্রলোকে কামানের গোলা প্রেরণ সম্বন্ধে আলোচনা আরম্ভ হইয়া গেল। কেহ সামাজিক, কেহ রাজনৈতিক, কেহ বৈজ্ঞানিক, কেহ দার্শনিক তত্ত্ব তুলিয়া, কেহ বা স্বাস্থ্যের দিক দিয়া প্রস্তাবটা’ বিচার করিল। সকলেই কহিল—সভাপতি বার্বিকেনের প্রস্তাবের মধ্যে অসম্ভব কিছুই নাই—এমন কিছুই নাই যাহা আমেরিকানের পক্ষে অসম্ভব। এই জন্যই ত আমেরিকা—আমেরিকা!