চন্দ্রলোকে যাত্রা/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
যুক্তি-তর্ক
সভাপতি বার্বিকেন যুক্তরাজ্যে যে প্রবল বৈদ্যুতিক-শক্তি পরিচালিত করিয়াছিলেন তাহা সকলকেই স্পর্শ করিয়াছিল, কেবল তাঁহাকে ছুঁইতে পারে নাই। লোকে যখন কল্পনার চন্দ্রলোক জয় করিয়া আনন্দে মগ্ন হইতেছিল—বার্বিকেন তখন নানা বৈজ্ঞানিক সমিতির নিকট পত্রাদি লিখিয়া পন্থা স্থির করিতেছিলেন। জ্যোতির্ব্বিদ্যার কেন্দ্র কেম্ব্রিজের মানমন্দির হইতে তিনি যে পত্র পাইলেন তাহাতে জানা গেল যে, যে গোলা প্রতি সেকেণ্ডে বারো হাজার গজ যাইতে পারিবে, তাহা অনায়াসেই চন্দ্রে পৌঁছিবে। মাধ্যাকর্ষণ তাহাকে পৃথিবীতে টানিয়া নামাইতে পারিবে না। ক্রমে উর্দ্ধে যাইয়া গোলাটী এমন স্থানে আসিয়া পৌঁছিবে, যেখানে চন্দ্রের আকর্ষণ প্রবল হইয়া উহাকে ক্রম-বর্দ্ধিত-বেগে চন্দ্রলোকে পৌঁছাইয়া দিবে। গোলাটী যদি বরাবর সমান বেগে ধাবিত হইতে পারিত, তাহা হইলে উহা ৯ ঘণ্টার চন্দ্রে যাইত, কিন্তু তাহা ত’ হইবে না। মাধ্যাকর্ষণ আছে, বায়ুমণ্ডলের বাধা আছে। সুতরাং উহার বেগ ক্রমে কমিতে থাকিবে। পণ্ডিতগণ অঙ্কপাত করিয়া কহিলেন যে, যেখানে পৃথিবীর আকর্ষণ শেষ হইয়া চন্দ্রের আকর্ষণ আরম্ভ হইয়াছে, সেখানে পৌঁছিতে গোলার ৮৩ বণ্টা ২০ মিনিট লাগিবে। সে স্থান হইতে চন্দ্রে পৌঁছিতে আরও ১৩ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট ২০ সেকেণ্ড প্রয়োজন হইবে বলিয়া সিদ্ধান্ত হইয়া গেল।
চন্দ্র বৃত্তাভাসে পৃথিবীর চতুর্দ্দিক ভ্রমণ করে বৃত্তাকারে নহে। ভ্রমণ করিতে করিতে যখন পৃথিবী হইতে দূরে সরিয়া যায়, তখন সে দুরত্ব ২৪৭৫৫২ মাইল। যখন উহা পৃথিবীর নিকটে আসে, তখনো পৃথিবী ১৮৬৫৭ মাইল দূরে থাকে। কাজেই চন্দ্র যখন পৃথিবীর নিকটে আসিবে, তখনই কামান ছুঁড়িবার উপযুক্ত সময়। প্রতি মাসে চন্দ্র একবার করিয়া পৃথিবীর অতি নিকটে আসে—কিন্তু সকল মাসেই শিরোবিন্দু বা Zenith অতিক্রম করে না। দীর্ঘকাল পর পর চন্দ্রের এই দুইটী অবস্থা যুগপৎ ঘটে। গণ্ডিতগণ সভাপতি বার্বিকেনকে জানাইলেন যে, আগামী বর্ষের ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে দ্বিপ্রহর রজনীতে বহুকাল পর চন্দ্রের এই বাঞ্ছিত অবস্থা ঘটিবে। তাহার পূর্ব্বে ১লা ডিসেম্বর রাত্রি ১০টা ৪৬ মিনিট ৪০ সেকেণ্ডের সময় চন্দ্রলোকে গোলা প্রেরণ করিতে হইবে—উহাই সর্ব্বাপেক্ষা উপযুক্ত সময়— কারণ তখন পৃথিবী হইতে চন্দ্রের দূরত্ব আরও কিছু কমিয়া যাইবে। এই মাহেন্দ্রক্ষণ ছাড়িয়া দিলে ১৮ বৎসর ১১ দিনের পূর্ব্বে চন্দ্র আর পৃথিবীর নিকটতম স্থানে আসিবে না। যখন তর্ক উপস্থিত হইল যে আকাশের কোন্ অংশ লক্ষ্য করিয়া কামান স্থাপন করিতে হইবে, তখন সিদ্ধান্ত হইল যে দক্ষিণ বা উত্তর অক্ষরেখার ০ (শূন্য) ডিগ্রী হইতে ২৮ ডিগ্রীর মধ্যে চন্দ্রকে লক্ষা করিয়া গোলা না ছুঁড়িলে উহার গতি ক্রমেই বক্র হইয়া উহাকে চন্দ্র হইতে বহুদূরে সরাইয়া লইয়া যাইবে। আবার প্রশ্ন হইল—গোলকটী যখন মহাশূন্যে নিক্ষিপ্ত হইবে, তখন চন্দ্র আকাশের কোন্ স্থানে থাকা আবশ্যক? এই প্রশ্নের সমাধান করিয়া পণ্ডিতগণ বলিলেন—চন্দ্র প্রতিদিন ১৩ ডিগ্রী ১০ মিনিট ৩৫ সেকেণ্ড করিয়া ভ্রমণ করে। উহা যখন শিরোবিন্দু বা Zenith হইতে ৬৪ ডিগ্রী দুরে থাকিবে, ঠিক সেই মুহূর্ত্তেই গোলকটী নিক্ষেপ করিতে হইবে।
এই সকল বিষয় স্থির হইয়া গেলে পর সমিতির অধ্যক্ষগণ একটা বিশেষ সভার অধিবেশন করিলেন। সে সভায় স্থির হইল যে লৌহ বা পিত্তলের গোলকে চলিবে না,—কারণ উহার ব্যাস ৯ ফিট্ করা প্রয়োজন। আয়তন উহা অপেক্ষা ক্ষুদ্র হইলে গোল। যখন চলিবে, তখন সর্ব্বাপেক্ষা উত্তম দূরবীক্ষণ যন্ত্রেও উহাকে দেখা যাইবে না। লৌহ বা পিত্তল অত্যন্ত ভার ধাতু, সুতরাং মীমাংসা হইয়া গেল যে এলুমিনিয়মের ফাঁপা গোলা প্রস্তুত করিতে হইবে। উহা এক ফুট পুরু এবং উহার ব্যাস ৯ ফিট্ হইবে।
এ কথা শুনিয়া সমিতির সম্পাদক ম্যাট্সান সাগ্রহে কহিলেন— “আমিও ফাঁপা গোলাই চাই। তাহ’লে ওর ভিতর চিঠি-পত্র পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। সেই সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর দ্রব্য-সম্ভারেরও দু’চারটী নমুনা দেওয়া চল্বে। ৯ ফিট্ ব্যাসের ফাঁপা গোলকের ওজন কত হ’বে?”
সভাপতি বার্বিকেন কহিলেন——“আমি সে হিসাব করেছি। ২৪০ মণ ২৫ সের! এইটে লোহার হ’লে ৮৪৩ মণ হ’তো!”
একজন সদস্য বলিলেন,—“এলুমিনিয়মের অনেক গুণ আছে। রৌপ্যের বর্ণ, লৌহের দার্ঢ্য, তাম্রের দ্রবণীয়তা, স্ফটিকের লঘুত্ব, স্বর্ণের অবিনশ্বরতা—এ সবই এলুমিনিয়মের আছে বটে—কিন্তু বড় মূল্যবান্ ধাতু।”
সভাপতি ধীরকণ্ঠে বলিলেন,—“তা হোক না। আমাদের গোলার কতই আর দাম হবে! আমি তা’ও হিসাব করেছি। এই দেখুন—৫৪৫৭৮১ টাকা। এ সামান্য টাকা তুল্তে ক’দিন লাগ্বে? আপনারা দেখ্বেন, চারদিক থেকে বৃষ্টির ধারার মত টাকা এসে প’ড়বে।”
সমিতির মন্তব্যগুলি যখন সাধারণ্যে প্রচারিত হইল, তখন কেহ কেহ বলিলেন, প্রায় ২৫০ মণ ভার একটা গোলা নিক্ষেপ করিতে পারা যায় এমন কামান প্রস্তুত করা কি সম্ভব? কামানেরই বা অত শক্তি কোথায় —বারুদেরই বা এমন ক্ষমতা কোথায়। সভাপতি বার্বিকেন শুনিয়া হাসিলেন। মনে মনে কহিলেন, সেই মধ্যযুগে, ১৪৫৩ সালে, দ্বিতীয় মহম্মদের রাজত্বকালে কনষ্টাণ্টিনোপল যখন অবরুদ্ধ হয়, তখন ২৩ মণ ৩০ সের ওজনের এক একটা পাথরের গোলা শত্রুদের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, আর এই সুসভ্যযুগে ২৫০ মণ ওজনের গোলা চালাইতে পারা যাইবে না? মল্টার সেণ্ট-এলেম্ দুর্গ হইতে যে গোলা নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাহার ওজন ছিল ৩১ মণ ১০ সের। একালে কামানের পাল্লা বাড়িয়াছে বটে, কিন্তু গোলা-গুলির ওজন কমিয়াছে। আমরা পাল্লাও বাড়াইব—ওজনও বাড়াইব।
পরদিন আবার সভা বসিল। বার্বিকেন কহিলেন—
“বন্ধুগণ! সেদিন আমরা গোলা তৈরি করেছি,—আজ কামান গড়বো। কামানটা হয়ত খুব প্রকাণ্ডই করতে হবে। কিন্তু আমেরিকার শিল্প-নৈপুণ্য জগদ্বিখ্যাত। প্রথম কথা হচ্ছে এই যে, ৯ ফিট্ ব্যাস এবং ২৫০ মণ ওজনের যে গোলা তাকে কেমন ক’রে প্রথমেই প্রতি সেকেণ্ডে ১২০০০ গজ বেগে চালিয়ে দেওয়া যাবে।”
মেজর এল্ফিন্ষ্টোন্ বলিলেন,—“সেইটাই ত বিশেষ ভাব্বার কথা!”
বার্বিকেন মৃদু-হাস্য করিয়া কহিলেন,— “এমন বেশী কিছু নয়। শূন্যে একটা গোলা ছুঁড়লে কি ঘটে? সে যে বায়ুস্তর ভেদ ক’রে অগ্রসর হয়, সে বায়ু তাকে বাধা দেয়—পৃথিবী তাকে আকর্ষণ করে—আর আমরা তাকে যে বেগ দিয়েছি, সে বেগ তাকে গন্তব্যপথে নিয়ে যেতে চায়! বায়ুর স্তর পৃথিবী থেকে ৪০ মাইলের উপরে আর নাই, কাজেই তাকে উপেক্ষা করা চল্তে পারে। যে গোলা সেকেণ্ডে বারো হাজার গজ ছুট্বে, সে পাঁচসেকেণ্ডেই বায়ুস্তর ছেড়ে উঠ্বে। তারপর পৃথিবীর আকর্ষণ। বিজ্ঞান আমাদের ব’লে দিচ্ছে যে, একটা জিনিষ যতই উপরে উঠ্বে, তার ওজনও ততই দূরত্বের বর্গের বিপরীত অনুপাতে কম্তে থাকবে। গোলোকের বেগ বাড়াতে পার্লেই মাধ্যাকর্ষণ অনায়াসে কেটে যাবে। আপনারা সকলেই জানেন যে কামানের দৈর্ঘ্য এবং বারুদের শক্তির উপর সেটা নির্ভর করে।”
মেজর কহিলেন, “সে কথা সত্য। কিন্তু কামানট। ত তা’ হ’লে বড় বেশী লম্বা কর্তে হবে।”
সভাপতি। তা’ হ’বে বৈ কি? এ কামান নিয়ে ত’ আমরা যুদ্ধ কর্তে যাব না, ওকে টেনে নিয়েও বেড়াতে হ’বে না—হোক না যত ইচ্ছা বড়। আজ পর্য্যন্ত ২৫ ফিটের অধিক লম্বা কামান দেখা যায় নাই। সে কামানও আমাদেরই তৈরি সেই কলম্বৈড, এটা ত’ জানা আছে যে, কামানের নল যত লম্বা হবে তার গোলার পশ্চাতে বারুদের গ্যাস্ তত বেশী সঞ্চিত হবে—কাজেই গোলার বেগও বাড়বে।
ম্যাট্সন্। আমি বলি আমাদের কামান আধ মাইল লম্বা হোক্!”
মেজর। আধ মাইল! বলেন কি?
ম্যাট্সন্। বেশী কি বলেছি, এ ত’ আর দু হাজার চার হাজার গজ পাল্লা মারা নয়—পৃথিবী থেকে চন্দ্রে যাওয়া।
মেজর। কামান নির্ম্মাণের সাধারণ নিয়ম কি? গোলার ব্যাস যত, কামানের দৈর্ঘ্য তার ২০ কি ২৫ গুণ হয়। গোলকের ওজন যত, কামানের ওজন তার ২৩৫ থেকে ২৪০ গুণের মধ্যে থাকে।
ম্যাট্সন্ উত্তেজিত হইয়া বলিলেন,—“সে কথা সকলেই জানে। কিন্তু সে নিয়ম এখানে খাট্বে না। অসাধারণ কাজের নিয়মও অসাধারণ।”
মেজর। অসাধারণ হোক্, কিন্তু অসম্ভব হলে ত চল্বে না। মানুষের শক্তি ত দেবশক্তি নয়, যে যা’ ইচ্ছা তাই করা যাবে!
ম্যাট্সন্। দেবতার কাছে মানুষ দুর্ব্বল বটে, কিন্তু তার শক্তি দুর্ব্বল নয়! আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখুন—আমি হাতে-কলমে প্রমাণ করে’ দিচ্ছি। ভগবানের বিদ্যুৎ আছে, আলোক-রেখা আছে, গ্রহ উপগ্রহ আছে, নক্ষত্রাদি আছে—ধ্বনি ও বাতাস আছে। মানি, এ সমস্তই তীব্র গতিশীল। কিন্তু আমাদেরও কামানের গোলা আছে—গোলার অমিত শক্তি আছে—বারুদের অসীম তেজ আছে! এই ধরুন না কেন, একটা সাধারণ ২৪ পাউণ্ডার কামানের গোলা! সে আর কতটুকু? তার গতির বেগ বিদ্যুতের চেয়ে ৮০,০০০ গুণ কম বটে—আলোক রশ্মির বেগ অপেক্ষা ৬৪০০০ গুণ কম বটে—পৃথিবী যে বেগে সূর্য্যের চারিদিকে ঘোরে তার চেয়েও ৭৩ গুণ কম বটে—কিন্তু ধ্বনি যে বেগে চলে তার চেয়ে’ত অনেক বেশী! ওর গতি মিনিটে ১৪ মাইল, ঘণ্টায় ৮৪০ মাইল, দিনে ২০১০০ মাইল—বৎসরে ৭৩৩৬৫০০ মাইল! অর্থাৎ ভ্রমণ কালে বিষুবরেখার উভয় পার্শ্বে পৃথিবীর যে বেগ হয় তাই। সুতরাং মনুষ্য নির্ম্মিত সামান্য একটা ২৪ পাউণ্ডার গোলার চন্দ্রে যেতে ১১ দিন, সূর্য্যে পৌঁছিতে ১২ বৎসর এবং সৌর জগতের প্রান্ত সীমায় নেপচুণে উপস্থিত হ’তে মাত্র ৩৬০ বৎসর লাগে। তা হ’লে নরশক্তি দেবশক্তি অপেক্ষা দুর্ব্বল কিসে?
সভাপতি বার্বিকেন কহিলেন,—“বন্ধুগণ, বিবাদে কাজ হবে না—স্থিরচিত্তে বিচার করুন। নতুবা মীমাংসায় আসা যাবে না। আমিও জানি, কামান নির্ম্মাণের সাধারণ নিয়ম অবলম্বন ক’র্লে আমাদের চ’ল্বে না। আমার বিবেচনা হয়, আমাদের কামানের দৈর্ঘ্য হ’বে ৯০০ ফিট্।”
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর সকলে সভাপতির প্রস্তাবই গ্রহণ করিলেন। বার্বিকেন বলিলেন,—“৯০০ ফিট্ লম্বা হ’লে নলটা অন্ততঃ ৬ ফিট্ পুরু হওয়া চাই—নৈলে গ্যাসের চাপ সইবে কেন। আমি মনে করি, এ কামানটা মাটীতেই ছাঁচে ঢালা হ’বে। ঢাল্বার সময়ে হিসেব ক’রে নলের ছিদ্র ক’র্তে হ’বে। তারপর যখন উর্দ্ধমুখে বসাব, তখন অষ্টে-পৃষ্ঠে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে, ভারী পাথর দিয়ে গোড়াটা গেঁথে দিলেই চ’ল্বে।”
মেজর। কামানের নল কি রাইফেলের মত পাক দেওয়া হ’বে?
বার্বিকেন। না—সাদা মসৃণ নলই ভালো। পাক দেওয়া নল থেকে গোলা বাহির হ’লেই তার বেগ কিছু কমে।
ম্যাট্সন্ আনন্দে করতালি দিয়া বলিলেন,—“কি চমৎকার! কামান ত’ তবে গড়া হ’য়েই গেল দেখ্ছি।” বাধা দিয়া বার্বিকেন বলিলেন,—“না বন্ধু, এখনো অনেক দেরি।”
ম্যাট্সন্। কেন?
বার্বিকেন। কোন্ ধাতুতে কামান হবে, সেটা ত’ স্থির করা চাই।
ম্যাট্সন্। তা’ ত’ চাই-ই। কিন্তু আমার যে আর দেরি সয় না!
বার্বিকেন ঈযৎ হাসিয়া বলিলেন,—“কামানটী যে খুবই দৃঢ় হওয়া চাই এ কথা সকলেই ব’ল্বে। কিন্তু শুধু দৃঢ় হ’লেই চল্বে না। উত্তাপে গল্বে না— আগুনে জ্বল্বে না-অল্পে মর্চে ধর্বে না, এমন হওয়া চাই।”
ম্যাট্সন্। তা’ চাই বৈকি।
বার্বিকেন। ঢালাই লোহার কামান ক’র্লে কেমন হয়? ঢালা লোহার অনেক সুবিধা আছে। সহজে গলে, সহজে ছাঁচে দেওয়া চলে—তাড়াতাড়ি কাজ হয়। সময় এবং অর্থ এতে দু’য়েরই সংক্ষেপ করা যাবে। মিশ্রিত ধাতু ভালো বটে, কিন্তু বড় দাম বেশী।
মেজর। ৯০০ ফিট লম্বা, ৯ ফিট ব্যাসের ৬ ফিট পুরু কামানের ওজন কত হ’বে?
ম্যাট্সন্ মুহূর্ত্তে হিসাব করিয়া কহিলেন,—“তেমন বেশী নয়— ১৯১৫২০০ মণ!”
মেজর। কত খরচ পড়্বে?
ম্যাট্সন্। ১১৪৯১২০ টাকা।
সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন,—“এত খরচ!”
বার্বিকেন। তা’ হ’বে বৈ কি। তবে টাকার জন্য ভাব্বেন না।
কামানের পরই বারুদের কথা উঠিল। স্থির হইল যে মোটা দানার বারুদ ব্যবহার করিতে হইবে কারণ উহা তাড়াতাড়ি জ্বলে। কেহ বলিলেন ২৫০০ মণ বারুদ চাই—কেহ বলিলেন, তাহাতে হইবে না ৬২৫০ মণ চাই। আর একজন বলিলেন, উহাতেও হইবে না—বিশ হাজার মণ ত’ চাই-ই! বার্বিকেন কহিলেন,—“ওতে ত’ হবে না, চল্লিশ হাজার মণ বারুদ ত’ নিতেই হ’বে।”
সম্পাদক ম্যাট্সন্ অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া মুহূর্ত্তে আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কহিলেন—"চল্লিশ হাজার!”
বার্বিকেন। “হাঁ। এক সের কমেও চ’ল্বে না।”
ম্যাট্সন্। চল্লিশ হাজার মণ বারুদে বাইশ হাজার ঘনফুট যায়গা জুড়বে। আপনাদের কামানেত মোট-মাট চুয়ান্ন হাজার ঘনফুট স্থান আছে। তার অর্দ্ধেকেরও বেশী যদি বারুদেই পূর্ণ হয়, তবে বারুদের গ্যাস থাক্বে কোথায়? আপনাদের গোলাটত তা’ হ’লে চ’ল্বে না।
সদস্যগণ এ কথা শুনিয়া কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। কাহারও মুখে আর বাক্য সরিল না।
বার্বিকেন স্থির-কণ্ঠে কহিলেন,—“বন্ধুগণ! হতাশ হবেন না। বৃক্ষ, লতা, গুল্মাদির যে অসংখ্য কোষ আছে তা আপনারা জানেন। তূলায় এই কোষের আদৌ অভাব নাই। অত্যন্ত উষ্ণ নাইট্রিক এসিডে ১৫ মিনিট কাল তূলা ভিজিয়ে জলে ধুয়ে শুকিয়ে নিলেই হ’লো। এর চেয়ে তীব্র বিস্ফোরক ত’ আর নাই। বারুদ জ্বলে ২৪০ ডিগ্রী উত্তাপ লাগ্লে, আর এই তূলা জ্বল্বে ১৭০ ডিগ্রীতে! কত সুবিধা দেখুন। সাধারণ বারুদ একটা গুলিকে যত বেগ দেয়—এ তূলা দিবে তার চারগুণ! যতটা তূলা লাগ্বে, তার ৮/১০ ভাগ নাইট্রেট্ অব্ পটাশ তূলার গায়ে লাগিয়ে দিলে গ্যাসের সম্প্রসারণ-শক্তি আরও বেড়ে যাবে। তা’ হ’লেই দেখুন, চল্লিশ হাজার মণ বারুদের পরিবর্ত্তে আমরা পাঁচ হাজার মণ তূলা চাই। চাপ দিলে ৬ মণ ১০ সের তূলাকে ২৭ ঘন ফুটের মধ্যে রাখা যায়। কাজেই আমাদের যতটা তূলা চাই, আমরা সে সমস্তই ১৮০ ফিটের মধ্যে রাখ্তে পার্ব। কামানের নলে গ্যাসের স্থানাভাব হ’বে না।”
সদস্যগণ সভাপতি বার্বিকেনের কথা শুনিয়া দেহে প্রাণ পাইলেন এবং তাঁহার জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন।