চন্দ্রলোকে যাত্রা/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
স্থান নির্ব্বাচন
সভাপতি বার্বিকেন যাঁহার নিন্দা এবং প্রশংসাকেই কেবল গ্রাহ্য করিতেন, তিনিও বার্বিকেনের মতই শ্রমশীল, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সাহসী ছিলেন। তিনিও বিপদের মুখে অগ্রসর হইতে পশ্চাৎপদ হইতেন না। সমগ্র যুক্তরাজ্য যখন বার্বিকেনের জয়গানে পরিপূর্ণ হইয়া গেল, তখন ফিলাডেল ফিয়া নগরে বসিয়া সেই কাপ্তান নিকল হিংসায় জ্বলিতে লাগিলেন!
নিকলে ও বার্বিকেনে জীবনে কখনো সাক্ষাৎ হয় নাই বটে, কিন্তু কি জানি কেন, বার্বিকেনকে বিফল মনোরথ হইতে দেখিলে নিকলের আনন্দ হইত। বার্বিকেন যতই শক্তিশালী কামান প্রস্তুত করিতেন, নিকলও ততই সুদৃঢ় বর্ম্ম নির্ম্মাণ করিতেন। বার্বিকেনের জীবন-ব্রত ছিল অছিদ্র স্থানকে কামানের গোলায় সছিদ্র করা, আর নিকলের কার্য্য ছিল বার্বিকেনের ব্রতভঙ্গ। এই প্রতিদ্বন্দিতার ফলে বর্ম্ম এবং কামান যেরূপ উন্নতি লাভ করিয়াছিল, তাহাতে নিকল্ বড়, কি বার্বিকেন বড় তাহা বলা সম্ভব ছিল না।
নিকল্ যখন শুনিলেন যে বার্বিকেনের নূতন কামানের নল ৯০০ ফিট দীর্ঘ হইবে—উহার গোলার ওজন হইবে ২৫০ মণ, তখন তিনি একেবারেই ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। কেবলই ভাবিতে লাগিলেন, এমন বর্ম্ম প্রস্তুত করা কি সম্ভব, যাহা এ গোলার আঘাতেও ছিন্ন হইবে না! তাঁহার মনে হইল উহা অসম্ভব। নিকলের রোষ ও হিংসা আরো বাড়িয়া উঠিল! তিনি নানা অঙ্ক কষিয়া, নানা বৈজ্ঞানিক আলোচনা করিয়া প্রমাণ করিতে চাহিলেন যে, বার্বিকেন পাগল হইয়াছেন বলিয়াই এমন অসম্ভব প্রস্তাব করিয়াছেন! তবুও যখন বার্বিকেন নিরস্ত হইলেন না, তখন নিকল্ গবর্ণমেণ্টের আশ্রয় লইলেন। জানাইলেন যে, এমন করিয়া কামানের শক্তি পরীক্ষা করা অন্যায়। পরীক্ষাকালে যদি কামান ফাটিয়া যায়, বহুলোক প্রাণ হারাইবে! যে স্থানে পরীক্ষা হইবে, তাহাও একেবারে ধ্বংস হইয়া যাইতে পারে! গবর্ণমেণ্ট এ ব্যাপারে নীরব রহিলেন দেখিয়া রোষে নিকল্ একেবারে জ্ঞান হারাইলেন এবং সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখিয়া নিম্নলিখিত বাজি ধরিলেন:—
(১) সমিতির প্রস্তাবটী কার্য্যে পরিণত করিতে যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, কখনই তাহা সংগৃহীত হইবে না। —বাজি ৩১২৫৲ টাকা। (২) নয়শত ফিট দীর্ঘ কামান ঢালাই করা অসম্ভব। সমিতি নিশ্চয়ই অকৃতকার্য্য হইবেন। —বাজি ৬২৫০৲ টাকা। (৩) কামানে বারুদ ঢালা অসম্ভব হইবে। যদি ঢালাও হয়, তবে অমন গুরুভার গোলকের চাপে উহা আপনা হইতেই জ্বলিয়া উঠিবে। —বাজি ৯৩৭৫৲ টাকা। (৪) বারুদে আগুন দিবামাত্রই কামানটী ফাটিয়া রেণু রেণু হইবে। —বাজি ১২৫০০৲ টাকা। (৫) চন্দ্রলোক ত দূরের কথা, কামানের গোলা ছয় মাইল পথও যাইবে না। —বাজি ১৫৬২৫৲ টাকা।
মোট বাজি ৪৬৮৭৫৲ টাকা।
কয়েকদিন পরই নিকল্ বার্বিকেনের নিকট হইতে অতি ক্ষুদ্র কিন্তু অতিশয় ভয়ানক একখানি পত্র পাইলেন। পত্রে লেখা ছিল—‘আমি বাজি ধরিলাম—বার্বিকেন।’
নিকলের সঙ্গে বাজি ধরিয়াই বার্বিকেন সমিতির সভা আহ্বান করিলেন। কোথায় কামান প্রস্তুত হইবে, এবং কোন্ স্থান হইতেই বা গোলক চন্দ্রলোকে নিক্ষিপ্ত হইবে তাহার মীমাংসার জন্য সভার প্রয়োজন হইয়াছিল। অনেক বাদানুবাদের পর স্থির হইল যে, হয় টেক্সাস না হয় ফ্লোরিডা এই দুই স্থানের এক স্থান হইতেই চন্দ্রলোকে গোলক প্রেরণ করা হইবে।
টেক্সাসে এবং ফ্লোরিডায় তখন বিবাদ বাধিয়া গেল! টেক্সাস কহিল এ জয়মাল্য আমার—ফ্লোরিডা কহিল উহা আমার। টেক্সাসের নানা নগর হইতে দলে দলে লোক আসিতে লাগিল—ফ্লোরিডা হইতেও লোক আসিবার বিরাম ছিল না। দুই দলের যুক্তি-তর্ক শুনিতে শুনিতে গান্-ক্লাব ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। কোন নীমাংসাই হইল না। শেষে এমন হইল যে, এক পক্ষের সহিত অপর পক্ষের দেখা ঘটিলেই নগরের রাজপথে যুদ্ধের বাদ্য বাজিয়া উঠিতে লাগিল! ক্রমে নানাস্থানের লোক এই কলহে যোগ দিল। কেহ বা টেক্সাসের হইয়া কহিতে লাগিল—ইস্! ভারি ত’ ফ্লোরিডা—বারোটী বই জেলা নাই তার আবার কথা! ফ্লোরিডার দল কহিল, টেক্সাসের লজ্জা হয় না! লোক-সংখ্যা যার মোটেই তেত্রিশ হাজার, তারও কত প্রতি বৎসর জ্বরে মরিতেছে—সে দেশও চায় এত বড় একটা গৌরবের জয়মাল্য!
বিবাদ যখন ক্রমে গুরুতর হইয়া উঠিল, তখন বার্বিকেন নিজ সহকর্ম্মিদিগকে ডাকিয়া কহিলেন,—“টেক্সাস্ প্রদেশে ১১টী নগর আছে আর ফ্লোরিডায় আছে একটী। আমরা যদি ফ্লোরিডাকে মনোনীত না করি, তা’ হ’লে দেখছি, টেক্সাসের এগারটা নগরের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হ’বে। প্রত্যেক নগরের লোকেই ব’ল্বে—এই খানেই কামান তৈরি হোক্।”
সদস্যগণ বার্বিকেনের প্রস্তাবই গ্রহণ করিলেন। টেক্সাসের লোকেরা যখন এই কথা শুনিল তখন কুপিত হইয়া বাল্টিমোর নগর ত্যাগ করিল।
পৃথিবীর নানা দেশ হইতে তখন চাঁদা আসিতে আরম্ভ হইয়াছিল। অল্পকাল মধ্যেই বার্বিকেন দেখিলেন যে সমিতির হস্তে ১৭৫২০৮৫৯ টাকা জমিয়াছে।
সদস্যগণ তখন মহোৎসাহে কার্য্যারম্ভ করিলেন।
স্থান নির্ব্বাচন করিবার জন্য বার্বিকেন কয়েকজন সহকর্ম্মীকে লইয় অবিলম্বে ফ্লোরিডায় গমন করিলেন। যাইয়া দেখিলেন, ফ্লোরিডার ভূমি উর্ব্বর। বার্বিকেন কহিলেন,—“বন্ধুগণ, এ উর্ব্বর ভূমিতে কাজ হ’বে না।”
ম্যাট্সন্। কেন?
বার্বিকেন। ভূমি উর্ব্বর হ’লেই বুঝতে হবে নীচে জল আছে। মনে রেখো যে নয় শত ফিট্ দীর্ঘ একটা কূপ আমাদের খুঁড়্তে হ’বে! যদি জল উঠে পড়ে তবেই ত’ বিপদ।
ম্যাট্সন্। যদি জল উঠেই পড়ে, কল লাগিয়ে ছেঁচে ফেল্বো।
এঞ্জিনিয়র মার্চিসন্ কহিলেন, “তা’ পারা যাবে বৈ কি! দু’ একটা ঝরণা যদি পাই, শুকিয়ে ফেল্তে সময় লাগ্বে না—চাই কি ঝরণার গন্তব্যপথও ফিরিয়ে দিতে পারি। তবে জল থেকে দূরে থাক্তে পারলেই ভালো হয়।”
বার্বিকেন আবার অগ্রসর হইলেন। উর্ব্বর ভূমি ত্যাগ করিয়া তাঁহারা কাননে প্রবেশ করিলেন। সে ত কানন নয়, যেন কুঞ্জভবন। প্রকৃতির সেই কুঞ্জবনে কত ফুল ফুটিয়াছিল—কত পাখী নৃত্য করিতেছিল। তাল, খর্জ্জুর, কমলালেবু, ডুম্বর ও দ্রাক্ষা প্রভৃতি তাঁহাদের নয়ন মন হরিতে লাগিল,—কিন্তু সে সকল বৃক্ষলতার দিকে না চাহিয়া বার্বিকেন নগ্ন শুষ্ক কঠিন স্থানের সন্ধানে অগ্রসর হইলেন। কয়েকটী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদ-নদী অতিক্রম করিয়া তাঁহারা অবশেষে এক জনহীন পার্ব্বত্য প্রদেশে আসিয়া উপনীত হইলেন।
বার্বিকেন কহিলেন,—“এইবার ঠিক হয়েছে—এই আমাদের যোগ্যস্থান। এর নাম কি?”
ফ্লোরিডার একজন নাগরিক কহিলেন,—“এ স্থানের নাম ষ্টোনিহিল্।”
বার্বিকেন। বাঃ বেশ নাম—ষ্টোনিহিল্। এই ষ্টোনিহিলের চূড়া থেকেই চন্দ্রলোকের উদ্দেশ্যে কামানের গোলা ছুট্বে।