চন্দ্রলোকে যাত্রা/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
কামান নির্ম্মাণ
বার্বিকেন পরিতৃপ্ত-হৃদয়ে ষ্টোনিহিল্ হইতে নিকটবর্ত্তী টম্পানগরের পান্থশালায় ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার তখন মুহূর্ত্ত মাত্র অবসর ছিল না। এঞ্জিনিয়র মাচিসন্ সপ্তাইমধ্যে দুই সহস্র মজুর লইয়া কার্য্যারম্ভ করিলেন। জনহীন ষ্টোনিহিল অচিরে একটী নগর হইয়া উঠিল।
কয়েক দিন ধরিয়া জাহাজ হইতে কেবল যন্ত্রাদি নামিল। কোদালি, কুঠার, খণিত্র—হাতুড়, বাটাল কত যে নামিল কে তাহার ইয়ত্তা করে। ভেদন-বস্তু, ছেদন-যন্ত্র—ছিদ্র করিবার, চাঁছিবার এইরূপ কত কার্য্যের জন্য কত যন্ত্র জাহাজে বোঝাই হইয়া আসিয়াছিল। ক্রেণ, এঞ্জিন, বয়লার, উলুন, রেলপথ—এমন কি লৌহ-নির্ম্মিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহ পর্য্যন্ত টম্পানগরের বন্দরে নামানো হইল। ষ্টোনিহিল্ টম্পাবন্দর হইতে ১৫ নাইল দূর। বার্বিকেন এই ১৫ মাইল রেলপথ প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলেন। একা বার্বিকেন এক সহস্র হইলেন। যেখানে অসুবিধা যেখানে মজুরদিগের মধ্যে অসন্তোষ, যেখানে কর্ম্মহানির লেশমাত্র সম্ভাবনা, সেইখানেই বার্বিকেন। কোনো বাধাই তাঁহার নিকট বাধা বলিয়া গণ্য হইত না। আবশ্যক হইলে তিনিও স্বহস্তে কুঠার ধরিতে লাগিলেন। স্বহস্তে মাটি কাটিতে লাগিলেন। তাঁহার অধ্যবসায় ও শ্রমশীলতা মজুরদিগের হৃদয়ে উৎসাহ আনিয়া দিল।
বার্বিকেন ১লা নভেম্বর টম্পানগর পরিত্যাগ করিয়া ষ্টোনিহিলে আসিয়াছিলেন। সেখানে তখন সারি সারি গৃহ উঠিয়াছে—গৃহে গৃহে কুলি-মজুর, স্থপতি, হুত্রধর, কর্ম্মকার প্রভৃতি বাস করিতেছে। কাষ্ঠের প্রাচীরে সেই নব-নির্ম্মিত নগর তখন সুরক্ষিত হইয়াছে। নগরের স্থানে স্থানে বৈদ্যুতিক আলোক জ্বলিয়া সকল অন্ধকার দুর করিয়া দিতেছে।
ষ্টোনিহিলে আসিয়া বার্বিকেন সমুদয় মজুরদিগকে ডাকিয়া মিষ্ট বাক্যে কহিলেন,—“বন্ধুগণ! তোমরা বোধ হয় শুনেছ যে আমরা ৯০০ ফিট্ লম্বা একটী কামান তৈরি করে’ ঠিক সোজাভাবে মাটীর ভিতর বসাতে চাই। পাথরের কুড়ি ফিট্ বেষ্টনী দিয়ে কামানটী ঘেরা থাক্বে। কাজেই ৬০ ফিট্ প্রশস্ত এবং ৯০০ ফিট্ দীর্ঘ একটী কূপ খনন করা প্রয়োজন। এই বৃহৎ ব্যাপারটী সুসম্পন্ন হলে তবে আমাদের সকল শ্রম ও অর্থব্যয় সার্থক হবে। যদি তোমরা প্রতিদিন দশ হাজার ঘন ফুট্ মাটি কাট্তে পার তবেই উপযুক্ত সময়ে কাজটা শেষ হ’বে। আমি তোমাদেরই অধ্যবসায় ও কার্য্যপটুতার উপর নির্ভর করে’ বসে’ আছি।”
মজুরগণ প্রাণপণে কাজ করিতে লাগিল। ওক-কাষ্ঠের একটী অতি সুদৃঢ় ও বৃহৎ চক্রের উপর প্রস্তরের বেষ্টনিটী সিমেণ্ট দ্বারা গ্রথিত হইতে লাগিল। কূপ খননের সঙ্গে সঙ্গে উহা ভূগর্ভে নামিতে লাগিল। এই বিপজ্জনক ও দুঃসাহসিক কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া মধ্যে মধ্যে দুই চারি জন গুরুতররূপে আহত হইতে লাগিল,—দুই একজন মরিয়াও গেল। কিন্তু সে জন্য কেহ নিরুৎসাহ হইল না। দিবসে দিবালোকে এবং রাত্রিতে অতি-তীব্র বৈদ্যুতিক আলোকে কাজ চলিতে লাগিল। হাতুড়ির ঠন্ ঠন্, এঞ্জিনের সোঁ সোঁ, অন্য কল-কারখানার হুড়্ হুড়্ দুড়্ দুড়্ শব্দে সকলের কর্ণ বধির হইবার উপক্রম হইল।
প্রথম মাসে কূপটী ১১২ ফিট্ নামিল। ডিসেম্বরে উহা দ্বিগুণ হইল—পরমাসে ত্রিগুণ দাঁড়াইল। ফেব্রুয়ারি মাসে কূপ খনন করিতে করিতে ভূগর্ভে বারি দেখা দিল। তখনই দমকল বসাইয়া বার্বিকেন সেই জলরাশি বহুদুরে নিক্ষেপ করিলেন, এবং যে পথে জল উঠিতেছিল, তাহা দৃঢ়রূপে বন্ধ করিলেন। খননকার্য্য যেমন চলিতেছিল তেমনি চলিতে লাগিল। অকস্মাৎ একদিন ওক-কাষ্ঠের চক্রটার কিয়দংশ ভাঙ্গিয়া গেল—মুহূর্ত্তে অনেকগুলি মজুরের জীবলীলা শেষ হইল। তিন সপ্তাহের জন্য সকল কার্য্য বন্ধ হইয়া গেল।
ম্যাট্সন্ অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িলেন, কিন্তু বার্বিকেনকে কেহ চঞ্চল দেখিতে পাইল না। তাঁহার ও ইঞ্জিনিয়র মার্চিসনের বুদ্ধিবলে চক্রের ভগ্ন-অংশ আবার জোড়া লাগিল। এইরূপে খনন করিতে করিতে ১০ই জুন কূপটী নয় শত ফিট্ নামিল। গান্-ক্লাবের সদস্যদিগের আনন্দ তখন দেখে কে!
কূপকে কেন্দ্র করিয়া উহা হইতে ছয়শত গজ দূরে বারো শত বৃহদাকার উনুন প্রস্তুত করা হইয়াছিল। গোল্ডস্প্রিং কোম্পানী কামান প্রস্তুত করিবার ভার লইয়াছিলেন। আটষট্টিখানি জাহাজে তখন তাহাদের সতের লক্ষ মণ লৌহ আসিল। কোম্পানী নিজেদের বৃহৎ চুল্লাতে উহা একবার গলাইয়া কয়লা ও বালুকার মধ্যে ঢালিয়াছিলেন। উহাকে সম্পুর্ণ- রূপে কার্য্যোপযোগী করিবার জন্য দ্বিতীয়বার গলাইবার প্রয়োজন হইয়াছিল। সেই গলিত লৌহরাশি ছিদ্রমুখে কটাহ হইতে বাহির হইয়া দ্বাদশ শত নালায় কামানের বৃহৎ কূপে প্রবাহিত হইবে এইরূপ ব্যবস্থা করা হইয়াছিল!
যেদিন স্থপতির কার্য্য শেষ হইল, বার্বিকেন তাহার পরদিন কর্দ্দম, বালুকা এবং খড়-কূটা একত্র মিলাইয়া কূপের ঠিক মধ্যস্থলে ৯ ফিট্ ব্যাসের ৯০০ ফিট্ দীর্ঘ কামানের একটা নল প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলেন। এই নল এবং প্রস্তর বেষ্টনীর মধ্যে যে শূন্য স্থান ছিল, তাহারই ভিতর গলিত লৌহ ঢালিয়া কামান প্রস্তুতের বন্দোবস্ত হইয়াছিল।
কামান ঢালাই করিবার দিন প্রভাতে ভীষণ অগ্নিকাণ্ড উপস্থিত হইল। সেই দ্বাদশ-শত চুল্লী দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে লাগিল। চিম্নীর মুখে হু হু করিয়া ধুম নির্গত হইতে লাগিল। ঊনিশ লক্ষ মণ কয়লার ধূমে দিঙ্মণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া গেল! চুল্লীগুলি দুই মাইল স্থান ব্যাপিয়া বৃত্তাকারে সজ্জিত ছিল। অগ্নিশিখার শব্দ বজ্রের ন্যায় ধ্বনিত হইতে লাগিল। স্থির হইল যে সাঙ্কেতিক কামানের শব্দ হইবামাত্রই একযোগে সকল কটাহ হইতে লৌহের স্রোত প্রবাহিত হইবে।
সকল বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া বার্বিকেন বন্ধুগণসহ নিকটবর্ত্তী একট উচ্চস্থানে কামান লইয়া দাঁড়াইলেন। বেলা ঠিক বারোটার সময় কামান দাগা হইল। কামানের ধ্বনি বাতাসে মিলাইতে না মিলাইতেই বারোশত কটাহের মুক্ত ছিদ্র-মুখে লৌহের স্রোত বহিতে লাগিল দ্বাদশশত অগ্নি-জিহ্ব সর্প যেন দ্বাদশ শত নালার ভিতর দিয়া কেন্দ্রস্থিত কূপের দিকে অগ্রসর হইল,—যেন তরল অগ্নি তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলিয়া নৃত্য করিতে করিতে ধাইল! এ দৃশ্য কি ভীষণ—কি প্রাণোন্মাদকারী— কি বিস্ময়কর! সেই তরল লৌহরাশি যখন হু হু করিয়া কুপমধ্যে নামিতে লাগিল,—যখন লক্ষ লক্ষ অগ্নিকণা ঊর্দ্ধমুখে ছুটিতে লাগিল তখন মনে হইল, সহসা যেন একটী আগ্নেয়গিরি শির তুলিল! চারিদিকে ভূকম্পন আরম্ভ হইল।
সত্য সত্যই কি কামানটী প্রস্তুত হইয়াছে? যদি না হইয়া থাকে তবেই ত সর্ব্বনাশ! আঠারো বৎসরের পূর্ব্বে চন্দ্রত আর পৃথিবীর নিকটতম হইবে না! নূতন কামান দেখিবার জন্য সকলেই তখন অত্যস্ত ব্যস্ত হইলেন। বার্বিকেনও যে না হইয়াছিলেন তাহা নহে—কিন্তু লোকে তাহা বুঝিতে পারিল না। লৌহ ঢালিবার পর এক সপ্তাহ গেল, সমিতির সদস্যগণ অধৈর্য্য হইয়া উঠিলেন। জারও এক সপ্তাহ গেল, তখনো কামানের নল দিয়া উত্তপ্ত বাষ্পরাশি ঊর্দ্ধে উত্থিত হইতেছিল—তখনো নিকটবর্ত্তী ভূমি স্পর্শ করিলে চরণতল দগ্ধ হইতেছিল! কাহার সাধ্য নিকটে যায়। কাহারও বারণ না মানিয়া ম্যাট্সন্ নিকটে যাইবার চেষ্টা করিলেন, এবং পুড়িয়া মরিতে মরিতে বাঁচিয়া গেলেন। ষ্টোনিহিলে তখন কাহারো প্রবেশাধিকার ছিল না। বার্বিকেনের আদেশে পূর্ব্ব হইতেই তাহার প্রবেশপথগুলি রুদ্ধ করা হইয়াছিল।
একদিন প্রাতে ম্যাট্সন্ বিমর্ষচিত্তে কহিলেন,—
“আর ত’ ৪ মাস মাত্র বাকি! কবেই বা কামানের ছাঁচটা সরিয়ে ফেলা হ’বে—কবেই বা নলটা মসৃণ হবে—আর কতদিনেই বা বারুদ ঢালা হ’বে। আজো কামানের কাছে যাবার যোটী নাই—”
বার্বিকেন নীরবে এ কথা শুনিলেন, কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। আরও কিছু দিন অতিবাহিত হইলে পর বার্বিকেন কামানের দিকে দশ ফিট্ মাত্র অগ্রসর হইতে পারিলেন। তখনো মৃদু ভূকম্পন চলিতেইছিল— তখনো চতুর্দ্দিকের ভূমিতল ভেদ করিয়া স্থানে স্থানে উষ্ণ-বাষ্প পূর্ব্ববৎই উত্থিত হইতেছিল। আগষ্ট মাসের শেষভাগে ভূমিতল শীতল হইল। কালবিলম্ব না করিয়া বার্বিকেন কার্য্যারম্ভ করিলেন। কর্দ্দমের ছাঁচটী প্রস্তরবৎ কঠিন হইয়াছিল, বহুশ্রমে তাহা অপসৃত হইল। ক্রমে কামানের অভ্যন্তরটী যথোপযুক্তরূপে মসৃণ করা হইতে লাগিল। ২২শে সেপ্টেম্বর দেখা গেল কামান ব্যবহারোপযোগী হইয়াছে। মুহূর্ত্তে সেই সংবাদ পৃথিবীর নানা স্থানে প্রচারিত হইয়া পড়িল। কাপ্তেন নিকল্ তাঁহার দ্বিতীয় বাজি হারিয়া ক্রোধে ফুলিতে লাগিলেন!
পরদিন যখন ষ্টোনিহিলের রুদ্ধদ্বার সর্ব্বসাধারণের জন্য মুক্ত করা হইল, তখন সেখানে যেন একটা বিরাট মেলা বসিয়া গেল। সাত সহস্র নর-নারী বিস্ফারিত-নেত্রে ভূ-প্রোথিত কামানের দিকে চাহিয়া রহিল। ক্ষুদ্র নগর টম্পা। তাহারই সন্নিকটে এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিতেছে! নগরে দর্শকের স্থান সঙ্কুলান হইতেছে না দেখিয়া নগরের কর্ত্তাগণ পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও মাঠ লইয়া নগরের আয়তন বৃদ্ধি করিতেছিলেন। এখন ক্ষুদ্র টম্পা একটী বৃহৎ রাজ-নগরীরূপে শোভা পাইতে লাগিল। কত বিপণি বসিল, রাজপথে গাড়ী-ঘোড়া ছুটিল—বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, পানাগার, পান্থশালা কত যে স্থাপিত হইল তাহার ইয়ত্তা নাই। সমগ্র আমেরিকা আসিয়া যেন টম্পায় বাস করিতে লাগিল। আমেরিকান্গণ নীরবে বসিয়া থাকিয়া আলস্যে দিন কাটাইবার লোক নহে! তাহারা বাণিজ্যকুশল জাতি। চন্দ্রলোকে কামানের গোলা প্রেরণ দেখিবার জন্য আসিয়া তাহার। টম্পায় বাণিজ্য করিতে আরম্ভ করিল। সঙ্গে সঙ্গে বিপুলায়তন এক একটী মালগুদাম নির্ম্মিত হইল, বাণিজ্য-বিষয়ক দৈনিক সংবাদপত্র পর্য্যন্ত বাহির হইতে আরম্ভ হইল। তখন যুক্তরাজ্যের দক্ষিণাংশের সহিত টম্পানগরের সংযোগ ঘটাইবার জন্য নূতন রেলপথ প্রস্তুত হইয়া গেল।
ধর্ম্মপিপাসু মানব যেমন একটী তীব্র আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা লইয়া তীর্থ-দর্শনে গমন করে, সাত-সহস্র নর-নারী সেইরূপ আবেগের সঙ্গে ষ্টোনিহিলের দিকে ধাবিত হইল। তাহারা বাহির হইতে কামানটী দেখিয়াই নিরস্ত হইল না, ভূগর্ভে নয়শত ফিট্ নামিয়া কামানের তলদেশ পর্য্যন্ত দেখিতে লাগিল। নামিবার সুবিধার জন্য বৃহৎ বৃহৎ ক্রেণ আনাইয়া বার্বিকেন তাহার সঙ্গে আসন সংযুক্ত করিলেন। দর্শকগণ দর্শনী দিয়া সেই আসনে বসিয়া নির্বিঘ্নে পাতালে প্রবেশ করিতে লাগিল। বার্বিকেন পরে হিসাব করিয়া দেখিয়াছিলেন যে পাতালগামী যাত্রিগণের নিকট হইতেই তিনি ১৫৬২৫০০ টাকা দর্শনী পাইয়াছিলেন! এক শুভদিনে সমিতির কর্ম্মবীর সদ্যগণ কামানের তলদেশে, ভূ-পৃষ্ঠের নয়শত ফিট্ নীচে মহা সমারোহে ভোজন করিলেন। বৈদ্যুতিক আলোকে সেই অন্ধকার পাতাল দিনের মত হইয়া উঠিল। সদস্যগণ ঘোররবে জয়ধ্বনি করিতে লাগিলেন! সেই ধ্বনি মসৃণ নলের গাত্রে আহত হইতে হইতে পাতাল হইতে নয়শত ফিট্ ঊর্দ্ধে উঠিয়া বিপুল কামান গর্জ্জনের ন্যায় প্রতীয়মান হইল!
ম্যাট্সন্ আনন্দে আত্মহারা হইয়া কহিলেন,—
“সমস্ত পৃথিবীর রাজত্ব পেলেও আজ আমি এ স্থান ত্যাগ ক’র্ব না। এখনই যদি কেহ এই বিশাল কামানে বারুদ ভরে’ গোলা পূরে’ আগুন দেয়—আমি তা’তেও রাজি। বরং রেণু রেণু হয়ে যাব—তবুও এক ইঞ্চি নড়্ব না। জয় গান্-ক্লাবের জয়—জয় যুক্তরাজ্যের জয়—জয় চন্দ্রলোকের জয়।”
সদস্যগণ সুরাপাত্র-করে কামানের অভ্যন্তরে গর্জ্জিয়া উঠিলেন,—“জয় গান্-ক্লাবের জয়—জয় যুক্তরাজ্যের জয়—জয় চন্দ্রলোকের জয়।”
তখন ধরণীপৃষ্ঠে সহস্র-কণ্ঠে ধ্বনিত হইল,—“জয় গান্-ক্লাবের জয়—জয় যুক্তরাজ্যের জয়—জয় চন্দ্রলোকের জয়।”
পাতালে ভোজন সমাপন করিয়া প্রফুল্ল ও গর্ব্বিতচিত্তে বার্বিকেন উপরে উঠিয়াই দেখিলেন, তাঁহার জন্য একখানি টেলিগ্রাম অপেক্ষা করিতেছে। বার্বিকেন ভাবিলেন, কেহ হয়ত আনন্দ জ্ঞাপন করিয়াছেন। টেলিগ্রামখানি খুলিয়া পড়িবামাত্রই বার্বিকেনের মুখশ্রী পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল। রুমালে মুখ মুছিয়া তিনি আবার উহা পড়িলেন—আবার পড়িলেন—আাবার পড়িলেন! ভাবিলেন, অর্থ-বোধ হইল না! তাই ত’! এও কি সম্ভব!
বার্বিকেন কম্পিত-করে টেলিগ্রামখানি ম্যাট্সনের হস্তে দিলেন। ম্যাট্সন্ উচ্চ-কণ্ঠে পাঠ করিলেন,—
৩০ সেপ্টেম্বর—প্রভাত।
বার্বিকেন। টম্পানগর। ফ্লোরিডা। যুক্তরাজ্য।
আপনার গোলাকার গোলকের পরিবর্ত্তে ফাঁপা ডিম্বাকৃতি গোলা প্রস্তুত করুন। আমি উহার ভিতরে বসিয়া চন্দ্রলোকে যাইব! আমি আসিতেছি। আজই ‘আট্লাণ্টা’ জাহাজে লিভারপুল ছাড়িব।
গৃহ হইতে গৃহান্তরে, রাজপথ হইতে পথান্তরে—উদ্যানে, বিপণিতে, কর্ম্মশালায়, জাহাজ-ঘাটায়, রেল-ষ্টেশনে, ডাকঘরে সর্ব্বত্র এক কথা—চন্দ্রলোকে মানুষ যাবে! কেহ বলিল, মাইকেল আর্দ্দান নামে লোকই নাই—ওটা দুষ্ট-লোকের তামাসা মাত্র! কেহ বলিল, ওটা ফরাসী জাতির পাগলামীর নমুনা। ইহাও কি কখনো সম্ভব যে পৃথিবীর মানুষ চন্দ্রলোকে যাইবে! বাতাস পাইবে কোথায়? নিঃশ্বাস লইবে কি প্রকারে? আাবার ফিরিয়া আসিবে কেমন করিয়া?
তৎক্ষণাৎ লিভারপুলের জাহাজ-ঘাটায় তারে সংবাদ গেল। এক ঘণ্টার মধ্যে উত্তর আসিল,—“টম্পানগরে যাইবার জন্য আট্লাণ্টা জাহাজ বন্দর ছাড়িয়াছে। সেই জাহাজে ফরাসী বৈজ্ঞানিক মাইকেল আর্দ্দান্ যাইতেছেন।”
সংবাদ পাইয়া বার্বিকেনের নয়নদ্বর জ্বলিয়া উঠিল—হস্ত মুষ্টিবদ্ধ হইল।
ম্যাট্সন্ কহিলেন,—“তবে দেখ্ছি এ সেই দুঃসাহসিক মাইকেল আর্দ্দান!”
আমেরিকার নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে মাইকেল আর্দ্দানের নাম মুখে মুখে ফিরিতে লাগিল। অনেকেই কহিল,—“আহা! অতবড় বৈজ্ঞানিক, দেখছি—উন্মাদ-রোগগ্রস্ত হ’য়েছেন!”
বার্বিকেন নিজের মতামত প্রকাশ না করিয়া তাঁহার কণ্ট্রাক্টর ব্রেড-উইল্ কোম্পানীকে জানাইলেন,—“আমি পুনরায় সংবাদ না দিলে গোলা প্রস্তুত করিবেন না।”
এ কথা যাহারা শুনিল, তাহারা কহিল—“ধীর স্থির বার্বিকেনও দেখ্ছি পাগল হ’য়ে গেলেন। আমেরিকার কামানের গোলা আর তবে চন্দ্রলোকে যায় না।”
দেখিতে দেখিতে টম্পানগরের লোক সংখ্যা দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণ হইয়া উঠিল। নগরে খাদ্যের অভাব হইতে আরম্ভ হইল। মাইকেল আর্দ্দানকে দেখিবার জন্য কেহ জাহাজে, কেহ রেলে, কেহ লঞ্চে টম্পামুখে ছুটিল! টম্পার পার্শ্ববর্ত্তী ক্ষেত্রসমূহ শত সহস্র পট্টাবাসে আচ্ছাদিত হইয়া বস্ত্রের নগররূপে প্রতিভাত হইতে লাগিল।
২০শে অক্টোবর প্রভাতে দেখা গেল, দূরে দিগ্বলয়ের কাছে জাগজের ধূম। সমুদ্র-তীরে লোকারণ্য হইল। সন্ধ্যার সময় বিপুল হলহলা রব মধ্যে যখন জাহাজ আসিয়া ঘাটে ভিড়িল, তখন ক্ষুদ্র বৃহৎ পাঁচ ছয় শত তরণী উহাকে ঘিরিয়া ধরিল।
সর্ব্বাগ্রে জাহাজে উঠিয়া বার্বিকেন কহিলেন,—“মাইকেল আর্দ্দান!”
একজন আরোহী উত্তর দিলেন,—“এই যে হাজির!”
বার্বিকেন নিরুদ্ধ-নিঃশ্বাসে তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, আর্দ্দানের বয়স চল্লিশের অধিক হইবে না। তাঁহার দীর্ঘ দেহ, মস্তক অপেক্ষাকৃত বৃহৎ। সেই বৃহৎ মস্তকে ধূসরবর্ণ কেশদাম মন্দ পবনে উড়িতেছে—যেন সিংহের কেশর দুলিতেছে। তাঁহার আয়ত ললাট একটু উচ্চ। গুম্ফ মার্জ্জার-গুম্ফের ন্যায় দীর্ঘ, নাসিকা বংশীর ন্যায়, নয়নদ্বয় উজ্জ্বল। তাঁহার বাহুযুগল সবল—দেহ সুগঠিত—চলনভঙ্গী শক্তি জ্ঞাপক। তাঁহার পরিচ্ছদ শ্লথ-বিন্যস্ত, জামার আস্তিন্ বোতানশূন্য!
ফ্রান্সে এবং য়ুরোপে মাইকেল আর্দ্দানকে সকলেই জানিত। তাহারা জানিত যে সেই সরলপ্রাণ অনাড়ম্বর দুঃসাহসিক ব্যক্তির হৃদয়ে একটা কর্ম্ম-ব্যাকুলতা সর্ব্বদা তপ্ত অনলের মত প্রজ্জ্বলিত থাকিত। তিনি শুধু এই কথাই বলিতেন যে আমরা যাহাকে অসম্ভব বলি, পৃথিবীতে তাহাও সম্ভব হইয়া দাঁড়ায়।
বার্বিকেন আত্ম-বিস্মৃত হইয়া এই অদ্ভুত লোকটীকে দেখিতেছিলেন, সহসা বহুলোকের সমবেত কণ্ঠে জয়ধ্বনি শুনিয়া তাঁহার চমক ভাঙ্গিল। তিনি দেখিলেন জাহাজ লোকে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আর্দ্দান শত শত ব্যক্তির সহিত করমর্দ্দন করিতেছেন। করমর্দ্দন করিতে করিতে আর্দ্দান যখন দেখিলেন যে সে জনস্রোতের অন্ত নাই—তখন তিনি কালবিলম্ব না করিয়া আপন কক্ষে পলায়ন করিলেন। বার্বিকেন নীরবে তাঁহার অনুগমন করিলেন।
কক্ষে প্রবেশ করিয়াই বার্বিকেন কহিলেন,—
“আপনি তা’ হ’লে চন্দ্রলোকে যাওয়াই স্থির ক’রেছেন?”
“নিশ্চয়।”
“কিছুতেই নিবৃত্ত হ’বেন না।”
“না। কিছুতেই নয়।”
“আপনার প্রস্তাব যে কত গুরুতর সে বিষয়ে অবশ্যই সকল কথা ভেবে দেখেছেন?”
“কি আর ভাব্বো? আমার কি অত সময় নষ্ট করার উপায় আছে? যেই শুন্লেম যে চন্দ্রলোকে কামানের একটা গোলা যা’চ্ছে, ভাব্লেম এই সুযোগে একবার বেড়িয়ে এলে হয়। এ আর এমনই বা কি একটা গুরুতর কাজ যে এত ভাব্তে হবে!
“যাবার একটা উপায় বোধ হয় ঠাউরেছেন?”
“হাঁ, তা’ স্থির ক’রেছি বৈকি। তবে জনে জনে সে কথা বলার অবসর আমার নাই। কালই একটা সভা ডাকুন। যদি ইচ্ছা হয় সেই সভায় আপনার সমুদয় যুক্তরাজ্যটাকেই নিমন্ত্রণ করুন। যা’ কিছু বল্বার সেই সভাতেই ব’ল্বো। কেমন, এতে আপনি রাজি?”
বার্বিকেন মন্ত্রমুগ্ধের মত কহিলেন, “হাঁ, রাজি।”
বার্বিকেনের সহিত সে দিন রাত্রি বারোটা পর্য্যন্ত আর্দ্দানের অনেক কথা হইয়াছিল বটে, কিন্তু কি কথা হইয়াছিল কেহ তাহা বলিতে পারে না।
দ্বিপ্রহর রজনীতে লোকে দেখিল, বার্বিকেন হৃষ্টচিত্তে জাহাজ হইতে নামিতেছেন। তাঁহার মূর্ত্তি দেখিয়া মনে হইল, হৃদয়ের গুরুভার আর নাই।