চন্দ্রলোকে যাত্রা/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
মাইকেল আর্দ্দান
পরদিন প্রভাতে বার্বিকেন একটী বিরাট সভা আহ্বান করিলেন। টম্পানগরের নূতন বৃহৎ টাউনহলে স্থান হইবে না বুঝিয়া বার্বিকেন উন্মুক্ত ক্ষেত্রের মধ্যে জাহাজের পর্দ্দা দিয়া একটী প্রকাণ্ড মণ্ডপ প্রস্তুত করিলেন। সভা আরম্ভ হইবার বহু পূর্ব্ব হইতেই লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল। যখন সভা আরম্ভ হইল, তখন মনে হইল একটী বিরাট জনসমুদ্র হেলিতেছে দুলিতেছে—কখনো বা কাঁপিয়া উঠিতেছে। কেহ কেহ অনুমান করিয়াছিলেন যে সভাতলে তিন লক্ষ লোক উপস্থিত হইয়াছিল। যাহারা মণ্ডপে স্থান পায় নাই তাহারা মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়াইয়াছিল!
মাইকেল আর্দ্দান ও বার্বিকেন একটী মঞ্চের উপর আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই বিশাল জনতার সম্মুখে মাইকেল আর্দ্দান নিঃশঙ্কচিত্তে দাঁড়াইলেন এবং বলিলেন,—
“বন্ধুগণ! আমি যে কেমন ক’রে চন্দ্রলোকে যেতে চাই, তার একটা কৈফিয়ৎ দিবার জন্যই আজ সভা আহূত হ’য়েছে। আমি আগেই ব’লে রাখি, প্রশংসা বা নিন্দা কিছুই আমাকে স্পর্শ ক’র্বে না।”
“আমি বিশ্বাস করি যে একদিন না একদিন চন্দ্রলোকে যাবার অনেক সুব্যবস্থা হ’বে। উন্নতিই সংসারের রীতি। এই দেখুন না, প্রথমে গোযান, তারপর অশ্বযান, তারপর রেলগাড়ী! আমি বলি ভবিষ্যতে মানুষ কেবল কামানের গোলায় চড়েই যাতায়াত ক’র্বে। এতে সময় লাগে কম, অথচ পথশ্রম নাই।”
“আপনারা ব’ল্বেন, গোলকটী যে ভয়ানক বেগে চ’ল্বে, তা’তে ওর ভিতর থাক্তে পারে কার সাধ্য! কিন্তু এ কথাটা আদৌ ভাব্বার কথা নয়। আমাদের পৃথিবী—এই যে সব চেয়ে ছোট এতটুকু পৃথিবী—সে ত ঘণ্টায় ২৯১০০ মাইলের কম চলে না! আর দেখুন দেখি, আমরা কত অলস। কেহ কেহ বলেন, মানুষ একটা সীমাবদ্ধ জীব। তাকে সেই গণ্ডীর ভিতর থাক্তেই হ’বে! পৃথিবী ছেড়ে গ্রহলোকে যাবার অধিকার তার নাই। কিন্তু এটা মস্ত ভুল। সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে সে উপায়ও আবিষ্কৃত হ’বে। আজ আমরা যেমন পৃথিবীর সমুদ্রটা হেলায় উত্তীর্ণ হচ্ছি, কালে তেমনি আকাশ-সমুদ্রও পার হ’য়ে যাব! তখন বিশ বৎসরের মধ্যে দেখা যাবে, পৃথিবীর অর্দ্ধেক লোক চন্দ্রমণ্ডলে বেড়াতে চ’লেছে।”
একজন শ্রোতা কহিলেন, “গ্রহাদিতে কি কোন জীব-জন্তু আছে?”
আর্দ্দান। আছে বৈ কি! কুটার্ক, সুয়েডেনবার্গ, বার্ণাডিন প্রভৃতি পণ্ডিতগণ পরীক্ষায় স্থির ক’রেছেন যে গ্রহাদিতেও জীব-জন্তু আছে!”
আর একজন দর্শক কহিলেন,—“গ্রহাদি যে বাসোপযোগী নয়—এরও ত অনেক প্রমাণ আছে। আর যদি সেগুলি বাসের যোগ্যই হয়, তা’ হ’লে জীবনধারণের উপায়গুলিকেও বদ্লে নিতে হ’বে।”
আর্দ্দান। তা’ ত’ বটেই! তা’ যেটা যেমন উপস্থিত হ’বে, তেমনি করা যাবে। আমি ত’ একজন মূর্খ অজ্ঞ লোক। গ্রহাদিতে কোন জীব বাস করে কিনা তা’ ঠিক জানি না। জানি না বলেই ত’ দেখ্তে যাচ্ছি।”
চারিদিক হইতে তখন একটী বিপুল হল্হলা রব উত্থিত হইল। শ্রোতৃমণ্ডলী একটু শান্ত হইলে পর মাইকেল আর্দ্দান বলিলেন,—
“বন্ধুগণ! গ্রহ নক্ষত্রাদিতে যে জীব বাস করে, ইচ্ছা করলে তার অনেক প্রমাণ দিতে পারা যায়। সে উপদেশ দিবার জন্য ত’ আমি এখানে আসি নাই। যদি কেহ বিশ্বাস করেন যে সৌরজগৎ বাসের যোগ্য নয়, তাঁকে এই কথাই ব’ল্তে চাই যে আমাদের এই ক্ষুদ্র পৃথিবীটাই যে বাস্তবিকই বাসের যোগ্য তার প্রমাণ কি? আপনারা দেখ্ছেন ত’ যে পৃথিবীর উপগ্রহ মাত্র একটী। আর এমন গ্রহও আছে যাদের উপগ্রহের সংখ্যা একের অধিক। তবুও সেগুলি হ’লো না বাসের যোগ্য—এ কথা কি কেহ বিশ্বাস ক’র্তে পারে? পৃথিবীর ঋতুভেদ দেখুন কি একটা অসুবিধার ব্যাপার! কখনো দারুণ গ্রীষ্ম, কখনো দারুণ শীত! পৃথিবী আপন অক্ষ-রেখার উপর একটু বেশী বক্রভাবে অবস্থিত থেকে সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে বলেই ত’ দিন ও রাত্রি এবং ঋতুভেদ। এই ঋতু পরিবর্ত্তনের সময়েই যত রোগ এসে আমাদের ধরে! কিন্তু জুপিটারকে দেখুন দেখি। সে তার অক্ষরেখার উপর সামান্য বক্রভাবে অবস্থিত। সুতরাং সে স্থানে ঋতুভেদ নাই—রোগও তাই কম হ’বেই! জুপিটার যে এই বিষয়ে পৃথিবী অপেক্ষ শ্রেষ্ঠ তা’ ত’ বোঝাই যাচ্ছে।”
মাইকেল আর্দ্দানের কথা শুনিয়া সভার লোক উৎসাহে করতালি দিতে লাগিল। সভা যখন আবার শান্ত হইল, তখন একজন শ্রোতা গুরু-গভীর-কণ্ঠে কহিলেন,—
“মহাশয়, আপনি ব’ল্ছেন যে চন্দ্রে জীবের বাস আছে। তা’ হ’লে তারা নিশ্চয়ই নিঃশ্বাস লয় না। চন্দ্রলোকে ত’ বাতাস নাই।”
“তাই নাকি? কেমন করে’ সেটা জান্লেন?”
“পণ্ডিতেরা বলেন।”
“বটে?”
“নিশ্চয়ই।”
“দেখুন, যাঁরা জেনে শুনে দেখে পণ্ডিত, তাঁদের উপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। যাঁরা কিছু না জেনেই পণ্ডিত তাঁরা ঘৃণার পাত্র! আপনি বোধ হয়, মনে মনে ভাব্ছেন যে চন্দ্রে বাতাস নাই!”
“তার অসংখ্য অখণ্ডনীয় প্রমাণ আমি দিতে পারি। আপনি বোধ হয় জানেন যে, যখন সূর্যের কর বাতাসের ভিতর দিয়ে আসে, তখন ঠিক সরল রেখায় আাসতে পারে না—একটু বক্রভাবে আসে। একেই বলে আলোক রশ্মির পরাবৃত্তি। চন্দ্র যখন নক্ষত্রকে আবৃত করে, তখন নক্ষত্রের আলোক-রেখা চন্দ্রমণ্ডলের প্রান্তভাগ ঘেঁসে আসে, কিন্তু তিল মাত্র পরাবৃত্তি ঘটে না। এতেই ত’ প্রমাণ হ’চ্ছে চন্দ্রে বাতাস নাই।”
একটু বিদ্রূপের কণ্ঠে আর্দ্দান কহিলেন, “তাই নাকি?”
প্রশ্নকারী গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন,—“তা’ বৈ কি। ১৭১৫ সালে জ্যোতির্ব্বিদ্ লুভিলে এবং হেলি চন্দ্রগ্রহণ পর্য্যবেক্ষণ ক’রেছিলেন। তাঁরা দেখ্লেন, চন্দ্রে এক অদ্ভুত আলোক রশ্মি দেখা যাচ্ছে। তাঁরা উল্কা প্রভৃতির আলোক দেখেই চন্দ্রের আলোক ব’লে মনে ক’রেছিলেন।”
“বেশ, ও কথা তবে ছেড়ে দিন। ১৭৮৭ সালে কি হার্সেলের ন্যায় জগন্মান্য পণ্ডিত চন্দ্রে আলোক-বিন্দু দেখেন নাই?”
“দেখেছিলেন, কিন্তু সেগুলি যে কি, তা’ তিনি নিজেই ঠিক ক’র্তে পারেন নাই।”
আর্দ্দান কহিলেন,—“চন্দ্র সম্বন্ধে আপনার অনেক অভিজ্ঞতা আছে দেখছি ত’।”
“হাঁ, আছে বৈ কি। মুসেঁবিয়ার বা মড্লারের মত বিচক্ষণ পর্য্যবেক্ষকও স্বীকার ক’রেছেন যে চন্দ্রে বাতাস নাই।”
আর্দ্দান গম্ভীর-কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন,—
“ফরাসী জ্যোতির্ধ্বিৎ মুসেঁ লসেদতের নাম বোধ হয় জানা আছে?”
“আছে বৈ কি?”
“তাঁর পর্য্যবেক্ষণের উপরও শ্রদ্ধা আছে?”
“আছেই ত’।”
“চন্দ্রে যে বাতাস নাই, তিনি ত’ এ কথা বলেন নাই। বরং বলেন বাতাস আছে।” “থাক্তে পারে, কিন্তু সে বাতাস নিশ্চয়ই লঘু—মানুষের যোগ্য নয়।”
“যতই লঘু হোক্, একজনের মত বাতাস পাওয়াই যাবে। একবার চন্দ্রলোকে যেতে পার্লে হয়, বাতাসের ব্যবস্থা সেখানেই করে নেবো। না হয়, নিতান্ত আবশ্যক না হ’লে নিঃশ্বাসই নেবো না। চন্দ্রে যেমন বাতাসই থাক্, বাতাস আছে এটা যখন স্বীকার ক’র্ছেন, তখন এটাও স্বীকার ক’র্ছেন যে জলও আছে। কারণ জল না থাক্লে ত’ বাতাস থাকে না।”
“তা’ যেন হলো—গোলাটা যখন বায়ুস্তর ভেদ করে’ উঠ্বে, তখন সেই ঘর্ষণে যে উত্তাপ হবে তাতেই—”
বাধা দিয়া আর্দ্দান বলিলেন—“আমি পুড়ে’ মরবো, কেমন? তা’ পুড়ছিনে! বায়ুস্তর পার হ’তে কয় সেকেণ্ড লাগ্বে তা জানেন ত? গোলকের পাশটাও খুবই পুরু।”
“খাদ্যসামগ্রী—জল—এ সবের কি হবে?”
“এক বৎসরের মত সঙ্গে নিয়ে যাব। পথে ত মোটেই ৪ দিন থাক্তে হবে, তারপর সেখানে যেয়ে ব্যবস্থা করা যাবে!”
“পথে নিশ্বাস নেবার বাতাস পাবেন কোথায়?”
“রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করে’ নেবো।”
“চন্দ্রলোকে যদি যেতেই পারেন, তা’ হ’লে সেখানে যেয়ে যখন আছাড় খেয়ে পড়বেন তখন—”
“পৃথিবীতে পড়লে যতটা বেগে প’ড়তাম,বেগ তার চেয়ে ত অন্ততঃ ছয় গুণ কম হবে!”
“তা’ হো’ক্—কিন্তু তাতেই যে আপনি কাচের টুক্রার মত রেণু রেণু হবেন!”
“ইচ্ছা কর্লেই ত পতন-বেগ কমাতে পার্বো। আমি কতকগুলো হাউই-বাজি সঙ্গে নেবো। উপযুক্ত সময়ে তাতে আগুন দিলেই গোলার একটা বিপরীত বেগ আস্বে। কাজেই আমি ধীরে ধীরে যেয়ে চন্দ্রলোকে প’ড়বো!”
“আচ্ছা, ধরে নিলাম আপনি নির্ব্বিঘ্নে গেলেন—কিন্তু ফির্বেন কেমন ক’রে?”
“এ-ই কথা! আমি যে আর ফিরবই না!”
যাহারা শুনিল তাহারা স্তম্ভিত হইয়া গেল। ভাবিল—এ বলে কি!
প্রশ্নকারী কহিলেন—
“আমি দেখ্ছি আপনার ঘোর বিপদ অতি নিকটে। আপনি ভাব্ছেন না যে, যে মুহূর্ত্তে অতবড় একটা গোলা কামানের বাহির হবে, অমনি এমন একটা ধাক্কা লাগ্বে যে তা’তেই আপনার হাড়-গোড় ভেঙ্গে চুর্ণ হ’বে!”
“এতক্ষণে আপনি একটী প্রকৃত বাধার কথা বলেছেন দেখ্ছি। তা’ সেজন্য কোনো চিন্তা নাই। আমার বন্ধু এর একটা উপায় ক’র্বেনই।”
“কে তিনি, জান্তে পারি কি?” উত্তর হইল—“বার্বিকেন”।
“যে নির্ব্বোধ এই অসম্ভব প্রস্তাবটী তুলে সমস্ত পৃথিবীটাকে মত্ত করেছে?”
কাহারও আর বুঝিতে বাকি রহিল না যে প্রশ্নকারী বার্বিকেনকে লক্ষ্য করিয়াই এ কথা কহিলেন। বার্বেকিন আর আত্মসংযম করিতে পারিলেন না। মঞ্চ হইতে নামিয়া প্রশ্নকারীর দিকে ধাবিত হইবার উপক্রম করিতেই দেখিলেন প্রশ্নকারী জনসমুদ্রে বুদ্বুদের মত মিশিয়া গিয়াছেন।
মাইকেল আর্দ্দানের দুঃসাহসিকতায় উন্মত্ত জনসঙ্ঘ বার্বিকেনকে আর মঞ্চ হইতে নামিবার অবসর দিল না। তাহারা মাইকেল আর্দ্দান ও বার্বিকেনকে মঞ্চসহ স্কন্ধে তুলিয়া লইয়া মহা-সমারোহে জাহাজ-ঘাটার দিকে অগ্রসর হইল। মঞ্চ-বহনের গৌরব লাভ করিবার জন্য একটা বিষম কাড়াকাড়ি মারামারি লাগিয়া গেল!
প্রশ্নকারী এই গোলযোগের সুযোগে পলায়ন না করিয়া মঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ-ঘাটার দিকে অগ্রসর হইলেন।
জনসঙ্ঘ যখন মঞ্চটী বহিয়া আনিয়া টম্পানগরের বন্দরে নামাইল তখন বার্বিকেন ও আর্দ্দান ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করিলেন। বার্বিকেন দেখিলেন তাঁহার সম্মুখেই সেই প্রশ্নকারী! তিনি রুষ্টকণ্ঠে কহিলেন—
“এদিকে আসুন—কথা আছে।”
প্রশ্নকারী বিনা বাক্যব্যয়ে বার্বিকেনের অনুসরণ করিয়া সমুদ্রতীরের একটী নির্জ্জন স্থানে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। বার্বিকেন তীব্রকণ্ঠে কহিলেন—
“মহাশয়ের নাম জান্তে পারি কি?”
“আমার নাম কাপ্তান নিকল্।”
“নিকল্!”
“হাঁ।”
সহসা তথায় বজ্রপতন হইলেও বার্বিকেন এত চমকিত হইতেন না। তিনি কহিলেন—
“আজই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ।”
“আমি নিজেই সাক্ষাৎ কর্তে এসেছি!”
“আপনি আজ আমাকে অপমানিত করেছেন!”
“হাঁ করেছি। দশের শতের লক্ষের সম্মুখে করেছি।”
“তার প্রতিশোধ চাই!”
“বেশ ত এখনই—আমি প্রস্তুত।”
“না এখন নয়—আমি গোপনে শোধ নিতে চাই। টম্পা থেকে তিন মাইল দূরে একটা বন আছে জানেন?”
“খুব জানি।”
“কাল প্রভাত ৫টায় সেখানে আস্তে পারেন কি?”
“নিশ্চয় পারি, যদি আপনি অনুগ্রহ করে আসেন।”
“আপনার বন্দুকটা সঙ্গে আন্তে ভুল্বেন না।”
“আপনিও যেন না ভোলেন!”
বার্বিকেন তীরের ন্যায় তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। সমস্ত রজনী তাঁহার অনিদ্রায় কাটিল। প্রভাতের দ্বৈরথ সমরের অপেক্ষায় নহে— কামান হইতে গোলা বাহির হইবার সময় গোলার গায়ে যে ধাক্কা লাগিবে, কি করিলে তাহার বেগ যথাসম্ভব কম হয় সেই চিন্তায়!