চরিতাবলী/উইলিয়ম গিফোর্ড

উইলিয়ম গিফোর্ড

ইংলণ্ডের অন্তঃপাতী ডিবনশায়র প্রদেশে অশবর্টন নামে এক নগর আছে। তথায় গিফোর্ডের জন্ম হয়। গিফোর্ডের পিতা সভ্রান্ত ও সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন; কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা ও অমিতব্যয়িত দ্বারা নিতান্ত নিঃস্ব হইয়া গিয়াছিলেন। চল্লিশ বৎসর বয়স না হইতেই, তাঁহার মৃত্যু হইল। এই সময়ে, গিফোর্ডের তের বৎসর মাত্র বয়স। তিনি অতিশয় দুঃখে পড়িলেন। তাঁহার পিতা সর্ব্বস্ব নষ্ট করিয়া গিয়াছিলেন; সুতরাং প্রতিপালনের কোন উপায় ছিল না, এবং এমন কোন আত্মীয় কুটুম্বও ছিলেন না যে, তাঁহার প্রতিপালনের ভার লয়েন।  কারলাইল নামে এক ব্যক্তি তাঁহাদের আত্মীয় ছিলেন। তিনি গিফোর্ডকে কহিলেন, আমি তোমার জননীকে কিছু টাকা ধার দিয়াছিলাম, তিনি তাহা পরিশোধ করিয়া যান নাই। তিনি, এই ছল করিয়া, অবশিষ্ট যা কিছু ছিল, সমুদয় লইলেন এবং গিফোর্ডকে আপন বাটতে লইয়া রাখিলেন। গিফোর্ড ইতিপূর্ব্বে কিছু লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন; এক্ষণে কারলাইল তাঁহাকে অধ্যয়নার্থ বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিলেন; কিন্তু আর খরচ যোগাইতে পারা যায় না, এই বলিয়া, তিন চারি মাস মধ্যেই, তাঁহাকে বিদ্যালয় হইতে ছাড়াইয়া লইলেন।

 কারলাইল, এই রূপে গিফোর্ডকে পাঠশালা হইতে ছাড়াইয়া লইয়া, কৃষিকর্ম্মে নিযুক্ত করা স্থির করিলেন। কিন্তু পূর্ব্বে তাঁহার বক্ষঃস্থলে এক আঘাত লাগিয়াছিল; লাঙ্গলচালনপ্রভৃতি উৎকট পরিশ্রমের কর্ম্ম তাঁহা দ্বারা নির্বাহ হওয়া কঠিন। সুতরাং কারলাইল কৃষিকর্ম্মে নিযুক্ত করার পরামর্শ পরিত্যাগ করিলেন। পরে, তিনি তাঁহাকে এক ব্যক্তির নিকটে নিযুক্ত করিবার প্রস্তাব করিলেন। এই ব্যক্তি অতি দূর দেশান্তরে বাণিজ্য করিতেন। ইনি গিফোর্ডকে নিযুক্ত করিলে, ইঁহার বাণিজ্যস্থানে গিয়া তাঁহাকে থাকিতে হইত। কিন্তু ঐ ব্যক্তি গিফোর্ডকে নিতান্ত বালক দেখিয়া, কারলাইলের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না।

 তৎপরে, কারলাইল তাঁহাকে ব্রিকসহম বন্দরের এক জাহাজে নিযুক্ত করিয়া দিলেন। গিফোর্ড কহিয়াছেন, “আমি জাহাজে নিযুক্ত হইয়া, যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইয়াছিলাম; কিন্তু আমি যে লেখা পড়া করিতে পাইতাম না, সেই ক্লেশ সর্ব্বাপেক্ষায় অধিক বোধ হইয়াছিল।” কারলাইল, গিফোর্ডকে জাহাজে নিযুক্ত করিয়া দিয়া, এক বারও তাহার সংবাদ লইতেন না।

 ব্রিকসহমের জেলের মেয়েরা, সপ্তাহে দুই বার, অশবর্টনে মৎস্য বিক্রয় করিতে যাইত। তাহারা গিফোর্ডের ক্লেশ দেখিয়া, দুঃখিত হইয়া, অশবর্টনে সকলের কাছে গল্প করিত। ঐ সকল গল্প শুনিয়া, গিফোর্ডের আত্মীয়েরা কারলাইলের অত্যন্ত নিন্দা করিতে লাগিলেন। তখন কারলাইল, তাঁহাকে আনিয়া, পুনরায় এক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতে দিলেন।

 গিফোর্ড লেখা পড়ায় অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন; এক্ষণে বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া, নিরতিশয় যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে, অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন। তিনি কহিয়াছেন, “আমি অল্প দিনের মধ্যেই এত শিখিয়া ফেলিলাম যে, বিদ্যালয়ের প্রধান ছাত্র বলিয়া গণ্য হইলাম, এবং আবশ্যক মতে মধ্যে মধ্যে শিক্ষকের সহকারিতা করিতে লাগিলাম। যখন যখন সহকারিতা করিতাম, শিক্ষক মহাশয় আমাকে কিছু কিছু দিতেন। আমি মনে মনে স্থির করিলাম, রীতিমত ইঁহার সহকারী নিযুক্ত হইব, এবং অন্য সময়ে অন্যান্য ছাত্রদিগকে শিক্ষণ দিতে আরম্ভ করিব। ইহাতে যাহা লাভ হইবেক, তাহাতেই খাওয়া, পরা, ও লেখা পড়ার ব্যয় নির্বাহ করিব। আর, আমার প্রথম শিক্ষক বৃদ্ধ ও রুগ্ন হইয়াছিলেন, সুতরাং তিনি ষে তিনি চারি বৎসরের অধিক বাঁচিবেন, এমন সম্ভাবনা ছিল না। আমি মনে মনে আশা করিয়াছিলাম, তাঁহার মৃত্যু হইলে, তদীয় পদে নিযুক্ত হইতে পারিব। এই সময়ে আমার বয়স পনরবৎসরমাত্র।

 “আমি কারলাইলকে এই সকল কথা জানাইলাম; কারলাইল শুনিয়া অত্যন্ত অবজ্ঞাপ্রদর্শন করিয়া কহিলেন, তুমি ষথেষ্ট শিথিয়াছ; ষত শিক্ষা করা আবশ্যক, তাহা অপেক্ষা বরং অধিক শিথিয়াছ। আমার যাহা কর্ত্তব্য, করিয়াছি; এক্ষণে তোমায় এক পাদুকাকারের বিপণিতে নিযুক্ত করিয়া দিতেছি। তথায় থাকিয়া, মনোযোগ দিয়া কাজ শিখিলে, উত্তর কালে অনায়াসে জীবিকা নির্বাহ করিতে পরিবে। আমি শুনিয়া অত্যন্ত বিষন্ন হইলাম। এরূপ জঘন্য ব্যবসায় অবলম্বন করিতে আমার কোন মতেই ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু তৎকালে সাহস করিয়া আপত্তি, বা অনিচ্ছাপ্রকাশ, করিতে পারিলাম না। সুতরাং, ছয় বৎসরের নিমিত্ত এক পাদুকাকারের বিপণিতে নিযুক্ত হইলাম।

 “এই জঘন্য ব্যবসায়ের উপর আমার অত্যন্ত ঘৃণা ছিল; সুতরাং শিখিবার নিমিত্ত যত্ন ও প্রবৃত্তি হইত না; এবং ভাল করিয়া শিখিতেও পারিতাম না। প্রথম শিক্ষকের মৃত্যু হইলে, তাঁহার কর্ম্মে নিযুক্ত হইতে পারিব এই যে আশা করিয়াছিলাম, এখন আমার সে আশা যায় নাই। এজন্য, কর্ম্ম করিয়া অবসর পাইলেই লেখা পড়া করিতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সর্ব্বদা অবসর পাইতাম না। আমি অবসর পাইলেই পড়িতে বসি দেখিয়া, প্রভু অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইতেন, এবং যাহাতে অবসর না পাই, এরূপ চেষ্টা করিতেন। কি অভিপ্রায়ে তিনি সেরূপ করেন, আমি প্রথমে তাহা বুঝিতে পারি নাই। অবশেষে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, আমি যে কর্ম্মের আকাঙ্ক্ষায় লেখা পড়ায় যত্ন করিতেছিলাম, তিনি আপন কনিষ্ঠ পুত্ত্রকে ঐ কর্ম্মে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত চেষ্টিত ছিলেন।

 “এই সময়ে, এক স্ত্রীলোক অনুগ্রহ করিয়া আমায় একখানি বীজগণিত পুস্তক দিয়াছিলেন; আমার নিকট এতদ্ব্যতিরিক্ত আর কোন পুস্তক ছিল না। প্রথমে উপক্রমশিকা না পড়িলে, ঐ পুস্তক পড়িতে পারা যায় না। কিন্তু আমার নিকট বীজগণিতের উপক্রমণিকা ছিল না; আর এমন সঙ্গতিও ছিল না যে, ঐ পুস্তক ক্রয় করি। আমার প্রভু আপন পুত্ত্রকে একখানি উপক্রমণিকা ক্রয় করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি সাবধানে গোপন করিয়া রাখিতেন; আমায় দেখিতে দিতেন না। তিনি যে স্থানে লুকাইয়া রাখিতেন, আমি তাহার সন্ধান পাইয়াছিলাম; সন্ধান পাইয়া, কয়েক দিন প্রায় সমস্ত রাত্রি জাগিয়া, তাঁহার অজ্ঞাতসারে ঐ পুস্তক পড়িয়া লইলাম।

 “ঐ পুস্তক পাঠ করিয়া বীজগণিতপাঠে অধিকারী হইলাম এবং যত্নপূর্বক পাঠ করিতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু অত্যন্ত অসুবিধা ঘটিল। অঙ্ক কসিবার নিমিত্ত কালি কলম কাগজের অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু ঐ সময়ে আমার এক পয়সারও সঙ্গতি ছিল না, এবং এমন কোন আত্মীয়ও ছিলেন না যে, কিছু দিয়া সাহায্য করেন; সুতরাং ঐ সমুদয়ের সংযোগ ঘটিয়া উঠিত না। পরিশেষে অনেক ভাবিয়া, এক উপায় স্থির করিয়াছিলাম। চর্ম্মখণ্ডকে মন্থণ করিয়া কাগজ করিয়া লইতাম, এবং এক ভোঁতা আল লইয়া কলম করিতাম। এই রূপে, মসৃণ চর্ম্মখণ্ডের উপর অঙ্ক কসিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম। কিন্তু ইহা অত্যন্ত গোপনে সম্পন্ন করিতে হইত। কারণ, আমার প্রভু সন্ধান পাইলে, নিঃসন্দেহ বন্ধ করিয়া দিতেন ও তিরস্কার করিতেন।”

 এ পর্য্যন্ত, গিফোর্ড যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ভোগ করিয়াছিলেন। অতঃপর, তাঁহার সে ক্লেশের কিঞ্চিৎ লাঘব হইয়াছিল। তাঁহার এক পরিচিত ব্যক্তি কতকগুলি শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন। তদ্দৃষ্টে তাঁহারও শ্লোকরচনা করিতে ইচ্ছা হয়, এবং অবিলম্বে কতকগুলি শ্লোক রচনা করেন। তিনি আপন সহচরদিগকে ঐ শ্লোক শুনাইতেন। শুনিয়া সকলে প্রশংসা করিত। কেহ কেহ কিছু পুরস্কারও দিত। এক দিন, বিকাল বেলায়, তিনি চারি আনা পান। মধ্যে মধ্যে, তিনি এই রূপে কিছু কিছু পাইতে লাগিলেন। যাহার এক পয়সা পাইবার উপায় ছিল না, মধ্যে মধ্যে এরূপ প্রাপ্তি তাঁহার পক্ষে ঐশ্বর্য্যলাভ জ্ঞান হইত। এ পর্য্যন্ত, কালি, কলম, কাগজ ও পুস্তকের অভাবে তাঁহার লেখা পড়ার অত্যন্ত ব্যাঘাত হইত; এক্ষণে, আবশ্যকমত কিছু কিছু কিনিতে আরম্ভ করিলেন। শ্লোকরচনা ও শ্লোকপাঠ করিয়া, কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ লাভ অতি গোপনে সম্পন্ন করিতে হইত।

 দুর্ভাগ্যক্রমে, এই বিষয় অধিক দিন গোপনে রহিল না; ক্রমে ক্রমে তাঁহার প্রভুর কর্ণগোচর হইল। আমার কাজ ক্ষতি করিয়া এই সকল করিয়া বেড়ায়, এই মনে ভাবিয়া তিনি তাঁহার রচিত শ্লোক সকল এবং কাগজ, কলম, কালি ও পুস্তক সমুদয় কাড়িয়া লইলেন এবং অত্যন্ত তিরস্কার করিয়া এক বারে তাঁহার লেখা পড়া বন্ধ করিয়া দিলেন। এই সময়েই তাঁহার প্রথম শিক্ষকের মৃত্যু হইল, এবং তাঁহার স্থলে অন্য এক ব্যক্তি নিযুক্ত হইলেন। এ পর্য্যন্ত, তিনি যে ঐ পদে নিযুক্ত হইবার আশা করিয়া ছিলেন, সে আশা এক বারে উচ্ছিন্ন হইয়া গেল। এই দুই ঘটনা দ্বারা তিনি যৎপরোনাস্তি দুঃখিত ও সর্ব্ব বিষয়ে নিতান্ত নিরুৎসাহ হইলেন। তিনি মনের দুঃখে কাহার নিকটে যাইতেন না, কর্মের সময় কর্ম্মমাত্র করিতেন, অবশিষ্ট সময়ে একাকী বিরস বদনে বসিয়া থাকিতেন। ফলতঃ, এই সময়ে তাহার মনোদুঃখের আর সীমা ছিল না।

 গিফোর্ডের মনোদুঃখের বিষয় কর্ণপরম্পরায় কুকস্লিনামক এক ব্যক্তির গোচর হইল। তিনি গিফোর্ডের দুঃখের কথা শুনিয়া অতিশয় দুঃখিত হইলেন। গিফোর্ডের মুখে তদীয় অবস্থাসংক্রান্ত আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া, তাঁহার অন্তঃকরণে অত্যন্ত দয়া উপস্থিত হইল। তখন, তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, গিফোর্ডের দুঃখ দূর করিব এবং উহাকে ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখাইব। তদনুসারে তিনি, আত্মীয়বর্গের মধ্যে চাঁদা করিয়া, কিছু টাকা সংগ্রহ করিলেন।

 যে নিয়মে গিফোর্ড পূর্ব্বোক্ত পাদুকাকারের বিপণিতে নিযুক্ত হন, তদনুসারে তাঁহাকে আর কিছু দিন তথায় থাকিতে হইত। কুকস্লি, তাঁহাকে ষাটি টাকা দিয়া, গিফোর্ডকে ছাড়াইয়া আনিলেন, অধ্যয়নের নিমিত্ত এক বিদ্যালয়ে নিযুক্ত করিয়া দিলেন, এবং তাঁহার সমুদয় ব্যয় নির্বাহ করিতে লাগিলেন। এই সময়ে, গিফোর্ডের বয়স কুড়ি বৎসর। বিদ্যাশিক্ষাবিষয়ে গিফোর্ডের অত্যন্ত যত্ন ছিল; কেবল সুযোগ ঘটে নাই বলিয়া, এ পর্য্যন্ত তিনি উত্তম রূপে শিক্ষা করিতে পারেন নাই। এক্ষণে দায়াশীল কুকসি ও তাঁহার আত্মীয়বর্গের অনুগ্রহে বিলক্ষণ শিক্ষা করিতে লাগিলেন। ফলতঃ, তিনি লেখা পড়া বিষয়ে এত যত্ন ও এত পরিশ্রম করিতে লাগিলেন যে, তাঁহার অনুগ্রাহকবর্গ দেখিয়া শুনিয়া অতিশয় প্রীত হইলেন।

 এই রূপে আন্তরিক যত্ন সহকারে, দুই বৎসর দুই মাস অধ্যয়ন করিয়া, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইবার উপযুক্ত হইলেন। কুক্‌স্লি তাঁহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট করিয়া দিলেন। তিনি নিশ্চিত জানিয়াছিলেন, গিফোর্ড অনায়াসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসাপত্র লাভ করিতে পারিবেন; এজন্য, স্থির করিয়াছিলেন, যত দিন গিফোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়া, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, প্রশংসাপত্র না পান, তত দিন সমুদয় ব্যয় দিয়া তাঁহাকে অধ্যয়ন করাইবেন। কুক্‌স্লির নিতান্ত অভিলাষ, গিফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসাপত্র পান। কারণ, তাহা হইলেই, তাহাকে সকলে বিদ্বান বলিয়া গণনা করিবে।

 গিফোর্ড বিশিষ্টরূপ বিদ্যালাভের নিমিত্ত যেমন ব্যগ্র ছিলেন, তাঁহার সৌভাগ্যক্রমে তেমনই সুযোগ ঘটিয়া উঠিল। তিনি কুক্‌স্লির অভিলাষ পূর্ণ করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিতে লাগিলেন। কিন্তু, আক্ষেপের বিষয় এই, গিফোর্ডের প্রশংসাপত্র পাইবার পূর্ব্বেই, কুক্‌স্লির মৃত্যু হইল। কিছু দিন পরে, গিফোর্ড প্রশংসাপত্র প্রাপ্ত হইলেন। কুক্‌স্লি এই সময়ে জীবিত থাকিলে, কি অনির্বচনীয় প্রীতিলাভ করিতেন, বলিতে পারা যায় না।

 কুক্‌স্লি গিফোর্ডের প্রতি যেরূপ দয়া ও স্নেহ করিতেন এবং তাঁহার ভাল করিবার নিমিত্ত যেরূপ যত্নবান্ ছিলেন, অন্য ব্যক্তির সেরূপ হওয়া অসম্ভব। সুতরাং, কুক্‌স্লির মৃত্যু গিফোর্ডের পক্ষে বজ্রপাততুল্য হইল। কিন্তু কুক্‌স্লির মৃত্যু হওয়াতে, গিফোর্ড নিতান্ত নিঃসহায় হইলেন না। গ্রাসবিনরনামক এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁহার সহায় হইলেন। গিফোর্ডের ভাল করিবার বিষয়ে ইঁহার বরং কুক্‌স্লি অপেক্ষা অধিক ক্ষমতা ছিল। এই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সহায়তাতে, গিফোর্ডের উত্তরোত্তর ভাল হইতে লাগিল। তিনি ক্রমে ক্রমে পণ্ডিতসমাজে গণনীয় ও প্রশংসনীয় হইলেন, এবং বিদ্যাবলে ও কায়িক পরিশ্রমে বিস্তর ধন উপার্জন করিয়া, পরম সুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন।

 এই রূপে বিদ্যা, খ্যাতি ও বিপুল সম্পত্তি লাভ করিয়া, গিফোর্ড একাত্তর বৎসর বয়সে তনুত্যাগ করেন। তিনি এক মুহূর্ত্তর নিমিত্তে বিস্মৃত হন নাই যে, কেবল কুক্‌স্লির দয়া ও স্নেহই তাঁহার বিদ্যা, খ্যাতি, সুখ, সম্পত্তি সমুদয়ের মূল। এই নিমিত্ত, মৃত্যুকালে তিনি আপন সমস্ত সম্পত্তি সেই পরম দয়ালু মহাত্মার পুত্ত্রকে দান করিয়া যান। কৃতজ্ঞতার এরূপ দৃষ্টান্ত প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না।

 অতি অন্প বয়সে গিফোর্ডের পিতৃবিয়োগ হয়। সহায় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। তিনি বিংশতি বৎসর বয়স পর্য্যন্ত কত কষ্ট পাইয়াছিলেন। বাল্যকাল অবধি, ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিবার নিমিত্ত তাঁহার অত্যন্ত যত্ন ছিল। কিন্তু, কারলাইল সে বিষয়ে অনুকুল না হইয়া বরং পূর্ব্বাপর প্রতিকূলতাচরণ করিয়াছিলেন। পরিশেষে, তিনি তাঁহাকে পাদুকাকারের বিপণিতে নিযুক্ত করিয়া দেন। তথায় তাঁহার দুরবস্থার সীমা ছিল না। বাস্তবিক, তিনি কুড়ি বৎসর বয়স পর্য্যন্ত যৎপরোনাস্তি ক্লেশে কাল যাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু, বিদ্যাশিক্ষাবিষয়ে তাঁহার পূর্ব্বাপর সমান অনুরাগ ছিল। ভাল করিয়া লেখা পড়া শিথিবার নিমিত্ত তাঁহার যে আন্তরিক যত্ন ছিল, এক মুহূর্ত্তের নিমিত্ত তাঁহার সে যত্নের অণুমাত্র নূন্যতা হয় নাই। এই আন্তরিক যত্নের গুণেই, তিনি অসাধারণ বিদ্যা, খ্যাতি ও সম্পত্তি লাভ করিয়াছিলেন। ইহা যথার্থ বটে, কুক্‌স্লি তাঁহার যথেষ্ট আনুকুল্য করিয়া ছিলেন, এবং সেই আনুকূল্য না পাইলে, তিনি কখন এরূপ হইতে পারিতেন না; কিন্তু তাঁহার আন্তরিক যত্নই কুক্‌স্লির আনুকূল্যের মুল। লেখা পড়া বিষয়ে তাঁহার তাদৃশ আন্তরিক যত্ন না দেখিলে, কুক্‌স্লির কখনই তাঁহার প্রতি সেরূপ দয়া ও স্নেহ প্রদর্শন করিতেন না। অতএব, দেখ! আন্তরিক যত্ন থাকিলে বিদ্যা, খ্যাতি, সুখ, সম্পত্তি সকলই লাভ করা যাইতে পারে; অবস্থার বৈগুণ্য কদাচ প্রতিবন্ধক হইতে পারে না।