চরিতাবলী/উইলিয়ম রস্কো

উইলিয়ম রস্কো


উইলিয়ম রস্কো দুঃখীর সন্তান ছিলেন। তাঁহার পিতা কৃষিকর্ম্ম করিয়া কষ্টে সংসার নির্বাহ করিতেন; পুত্রকে উত্তমরূপ লেখা পড়া শিখান, তাঁহার এমন সংস্থান ছিল না। সুতরাং রস্কো বাল্যকালে অতি সামান্যরূপ লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন।

 রস্কোর পিতার আলুর চাস ছিল। একাকী চাসের সমুদয় কর্ম্ম নির্বাহ করিতে পারেন না, এজন্য তিনি রস্কোকে, বার বৎসর বয়সের সময়,পাঠশালা ছাড়াইয়া, চাসের কর্ম্মে নিযুক্ত করিলেন। তদবধি কয়েক বৎসর পর্যন্ত, রস্কো চাসের কর্ম্মে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি পিতার সঙ্গে চাসের কর্ম্ম করিতেন, এবং আলু প্রস্তুত হইলে আলুর বাজরা মাথায় করিয়া, বাজারে গিয়া বিক্রয় করিয়া আসিতেন।

 রস্কো অতি সুশীল ও সুবোধ ছিলেন; অন্যান্য বালকদিগের মত দুষ্ট ও চঞ্চলস্বভাব ছিলেন না। তিনি লেখা পড়ায় এমন যত্নবান্ ছিলেন যে, চাসের কর্ম্ম করিয়া অবসর পাইলেই, অন্য দিকে মন না দিয়া, কেবল লেখা পড়া করিতেন। তিনি কখন খেলা বা গল্প করিয়া সময় নষ্ট করেন নাই। অসঙ্গতি প্রযুক্ত তাঁহার পিতা পুস্তক কিনিয়া দিতে পারিতেন না; সুতরাং দৈবযোগে যখন যে পুস্তক জুটিত, তিনি তাহাই পাঠ করিতেন। এই রূপে, অবসরকালে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ পাঠ করিয়া, লেখা পড়ায় তাহার এক প্রকার অধিকার জন্মিল। উপদেশ দিবার লোক ও ইচ্ছামত পড়িবার পুস্তক জুটিলে, তিনি এই সময়ে ইহা অপেক্ষা অনেক অধিক শিখিতে পারিতেন, সন্দেহ নাই।

 সর্ব্বদা ইচ্ছামত পুস্তক পড়িতে পাইব, এই অভিপ্রায়ে রস্কো পুস্তকবিক্রয়ের কর্ম্ম করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে, তাঁহার পিতা তাঁহাকে এক প্রধান পুস্তকবিক্রেতার দোকানে রাখিয়া দিলেন। কিছু দিন কর্ম্ম করিয়া পুস্তকবিক্রয়ব্যবসায় তাঁহারে ভাল লাগিল না। তিনি ত্বরায় সে কর্ম্ম পরিত্যাগ করি  লেন। অবশেষে, তাঁহার পিতা তাঁহাকে ওকালতী কর্ম্ম শিখাইবার নিমিত্ত, এক উকীলের নিকট রাখিয়া দিলেন।

 এই সময়ে, সৌভাগ্যক্রমে, হোলডন নামক এক ব্যক্তির সহিত রস্কোর অতিশয় সৌহৃদ্য জন্মিল। হোলডন অতি সুশীল ও অতিশয় বুদ্ধিমান্‌ ছিলেন, এবং অল্প বয়সেই নানা ভাষায় ও নানা বিদ্যায় পণ্ডিত হইয়াছিলেন। রস্কো ও হোলডন উভয়ে প্রায় সমবয়স্ক; উভয়েই বিদ্যানুশীলনবিষয়ে অত্যন্ত অনুরক্ত ও অত্যন্ত যত্নবান। অবসরকালে উভয়ে একত্র হইয়া লেখা পড়ার চর্চ্চা করিতে আরম্ভ করিলেন।

 এ পর্য্যন্ত রস্কো জাতিভাষা ইঙ্গরেজী ভিন্ন আর কোন ভাষা জানিতেন না। হোলডন, পরামর্শ দিয়া, রস্কোকে অন্যান্য ভাষা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করাইয়া দিলেন এবং আপনি শিক্ষা দিতে লাগিলেন। এই সুযোগ পাইয়া রস্কো গ্রীক, লাটিন, ফরাসি ও ইটালীয় ভাষা শিক্ষা করিলেন।  এই রূপে, তিনি ক্রমে ক্রমে নানা ভাষায় ও নানা বিদ্যায় নিপুণ হইয়া উঠিলেন। একুশ বৎসর বয়সে, তিনি ওকালতী কর্মে প্রবৃত্ত হইলেন, এবং কিছু দিন কর্ম করিয়া কিঞ্চিৎ সংস্থান হইলে পর, বিবাহ করিলেন।

 রস্কো ক্রমে ক্রমে দুই উৎকৃষ্ট ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করিয়া প্রচার করিলেন; তদ্দ্বারা তাঁহার নাম এক কালে দেশে বিদেশে বিখ্যাত হইল। এই দুই গ্রন্থের রচনাবিষয়ে তিনি বিস্তর পরিশ্রম করিয়াছিলেন। এই দুই গ্রন্থ এমন উৎকৃষ্ট হইয়াছে যে, তদ্দ্বারা তাঁহার নাম চিরস্থায়ী হইতে পারিবেক। ইহা ভিন্ন, তিনি আরও কতিপয় গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন।

 ক্রমে ক্রমে, রস্কো দেশের মধ্যে এক জন প্রধান লোক বলিয়া গণ্য হইলেন; সর্ব্বত্র মান্য হইলেন; এবং কি বিদ্বান্ কি সম্ভ্রান্ত লোক, সকলের নিকট সমান আদরণীয় হইলেন। রস্কো অতি ধর্ম্মশীল লোক ছিলেন; কখন অধর্ম্মপথে পদার্পণ করেন নাই।

 দেখ! যিনি, পিতার অসঙ্গতি প্রযুক্ত, বাল্যকালে ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিতে পান নাই; যাঁহাকে, বার বৎসর বয়সের সময়, পাঠশালা ছাড়িয়া স্বহস্তে চাসের সমুদয় কর্ম্ম করিতে হইয়াছিল; যিনি, বাজরা মাথায় করিয়া, বাজারে গিয়া, আলু বিক্রয় করিয়া আসিতেন; সেই ব্যক্তি, কেবল আন্তরিক যত্ন ও পরিশ্রমের গুণে, নানা ভাষায় ও নানা বিদ্যায় পণ্ডিত হইয়াছিলেন, দেশের মধ্যে এক জন প্রধান লোক বলিয়া গণ্য ও সর্বত্র মান্য হইয়াছিলেন, এবং গ্রন্থরচনা করিয়া, সর্ব্বত্র বিখ্যাত ও চিরস্মরণীয় হইয়া গিয়াছেন।