হীন

ইয়ুরোপের অন্তর্বর্ত্তী সাক্সনিপ্রদেশে শেমনিজ নামে এক নগর আছে। ঐ নগরে হীনের জন্ম হয়। হীনের পিতা অতি দুঃখী ছিলেন; তন্তুবায়ের ব্যবসায় অবলম্বন করিয়া, অতি কষ্টে বহু পরিবারের ভরণপোষণ নির্বাহ করিতেন। পুত্রকে লেখা পড়া শিখান, তাঁহার এমন সঙ্গতি ছিল না। শেমনিজ নগরের নিকট একটি সামান্য বিদ্যালয় ছিল, হীনের পিতা তাঁহাকে সেই বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিলেন। হীন কিছু দিন তথায় থাকিয়া, সেখানে যত দূর হইতে পারে, লেখা পড়া শিখিলেন।

 অনন্তর, তাঁহার লাটিন পড়িতে অত্যন্ত ইচ্ছা হইল। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের পুত্র লাটিন জানিতেন। তিনি হীনকে কছিলেন, যদি তুমি আমায় কিছু কিছু দিতে পার, আমি তোমায় লাটিন শিখাই। হীনের পিতার এমন সঙ্গতি ছিল না যে, তিনি পুত্রের লেখা পড়ার নিমিত্ত মাসে মাসে কিছু কিছু দিতে পারেন। সুতরাং হীনের লাটিন শিখার সুযোগ হইল না। তিনি যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলেন।

 এই সময়ে, এক দিন, তাঁহার পিতা তাঁহাকে, কোন প্রয়োজনে, এক আত্মীয়ের নিকট পাঠাইয়া দেন। লাটিন শিখিবার সুযোগ হইল না বলিয়া, হীন সর্বদাই দুঃখিত মনে ও ম্লান বদনে থাকেন। ঐ আত্মীয় ব্যক্তি হীনকে অতিশয় ভাল বাসিতেন। তিনি হীনের মুখ ম্লান দেখিয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন, এবং তাঁহার মুখে সমুদয় শুনিয়া কহিলেন, তুমি লাটিন পড়িতে আরম্ভ কর; মাসে মাসে শিক্ষককে যাহা দিতে হইবেক, তাহা আমি দিব। এই কথা শুনিয়া, হীনের আর আহ্লাদের সীমা রহিল না।

 এই রূপে, ঐ আত্মীয় ব্যক্তির সাহায্য পাইয়া, হীন দুই বৎসর লাটিন শিক্ষা করিলেন। পরে তাহার শিক্ষক কহিলেন, আমি যত দূর জানিতাম, তোমায় শিখাইয়াছি; আমার আর অধিক বিদ্যা নাই; আমি তোমায় অতঃপর শিখাইতে পারিব না। সুতরাং আপাততঃ হীনের লাটিনপাঠ রহিত হইল।

 এই সময়ে, হীনের পিতা তাঁহাকে কোন বিষয়কর্ম্মে প্রবৃত্ত করিবার নিমিত্ত অত্যন্ত ব্যগ্র হইলেন। কিন্তু হীনের নিতান্ত মানস, ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখেন। তাঁহার পিতার যেরূপ দুঃখের অবস্থা, তাহাতে তিনি পুত্রের লেখা পড়ার ব্যয় নির্বাহ করিতে পারেন না। ভাগ্যক্রমে তাঁহাদের আর এক আত্মীয় ছিলেন। তিনি, লেখা পড়ায় হীনের কেমন যত্ন ও হীন কেমন শিখিতে পারেন ও কত দূর শিখিয়াছেন, হীনের শিক্ষকের নিকট এই সমুদয় অবগত হইয়া, অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; এবং সেই নগরে যে প্রধান বিদ্যালয় ছিল, হীনকে তথায় প্রবিষ্ট করিয়া দিলেন; কহিলেন, হীনের লেখা পড়া শিখিবার যে ব্যয় হইবেক, সে সমুদয় আমি দিব।

 হীন, এই রূপে প্রধান বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া, লেখা পড়া শিখিতে লাগিলেন। কিন্তু অত্যন্ত অসুবিধা ঘটিতে লাগিল। তাঁহাদের আত্মীয়, সমুদয় ব্যয় দিবার অঙ্গীকার করিয়াও, কৃপণ স্বভাব বশতঃ দিবার সময়ে বিস্তর গোলযোগ করিতেন। হীন পড়িবার পুস্তক পাইতেন না; সহাধ্যায়ীদিগের নিকট হইতে পুস্তক চাহিয়া লইয়া, স্বহস্তে লিখিয়া লইতেন, এবং ঐ লিখিত পুস্তক দেখিয়া পাঠ করিতেন। এই রূপে, অতি কষ্টে, ঐ স্থানে থাকিয়া, তিনি কিছু দিন লেখা পড়া করিলেন। পরিশেষে, ঐ নগরের এক সম্পন্ন ব্যক্তি তাঁহাকে আপন পুত্রের শিক্ষক নিযুক্ত করিলেন। তখন, হীনের কিছু কিছু আয় হইতে লাগিল। তদ্দ্বারা তাঁহার লেখা পড়ার ব্যয়ের বিস্তর আনুকূল্য হইয়াছিল।

 এই রূপে এই বিদ্যালয়ে কিছু দিন থাকিয়া, হীন দেখিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতে না পারিলে, মনের মত লেখা পড়া শিখা হইবেক না। অতএব, তিনি স্থির করিলেন, লিপ্সিক নগরে গিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইব। আর, তাঁহাদের পূর্বোক্ত আত্মীয়ও স্বীকার করিলেন, আমিও কিছু কিছু আনুকুল্য করিব। তিনি, এই প্রতিশ্রুত আনুকূল্যের উপর নির্ভর করিয়া, দুইটিমাত্র টাকা সম্বল লইয়া, লিপ্সিক নগরে গমন করিলেন, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া, লেখা পড়া করিতে লাগিলেন।

 কিন্তু, তাঁহার আত্মীয়, স্বীকার করিয়াও, যথাসময়ে না পাঠাইয়া, অনেক বিলম্ব ও বিস্তর বিরক্তি প্রকাশ করিয়া, খরচ পাঠাইতেন এবং খরচের সঙ্গে, হীনকে অলস ও অমনোযোগী বলিয়া ভৎর্সনা করিয়া পাঠাইতেন। তাহাতে হীনের অত্যন্ত কষ্ট ও মনে অত্যন্ত অসুখ হইত। তিনি যে বাটীতে বাসা করিয়াছিলেন, ঐ বাটীর এক দাসী, দয়া করিয়া, তাঁহার বিস্তর আনুকূল্য করিত। এই দাসীর আনুকূল্য না পাইলে, তাঁহাকে অত্যন্ত ক্লেশ পাইতে হইত। বোধ হয়, পুস্তকের অভাবে পাঠ বন্ধ হইত, এবং অনেক দিন অনাহারে থাকিতে হইত।

 এইরূপ কষ্টে পড়িয়াও, তিনি, ক্ষণ কালের নিমিত্ত, লেখা পড়ায় আলস্য বা ঔদাস্য করেন নাই। এত দুঃখে পড়িয়াও, যে তাঁহার উৎসাহভঙ্গ হয় নাই, তাহার কারণ এই যে, তিনি ভাবিয়াছিলেন, আমি যথেষ্ট কষ্ট পাইতেছি বটে; কিন্তু লেখা পড়া ছাড়িয়া দিলে, আমার কষ্ট দূর হইবেক না; লাভের মধ্যে জন্মের মত মূর্খ হইব; মূর্খ হইলে চির কাল দুঃখ পাইব; চির কাল সকল লোকে মূর্খ বলিয়া ঘৃণা করিবেক। অতএব, যত কষ্ট হউক না কেন, ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিব। তিনি যত কষ্ট পাইতেন, লেখা পড়ায় তত অধিক যত্ন করিতেন। যত্নের কথা কি বলিব, দুই মাস কাল সপ্তাহে দুই রাত্রি মাত্র নিদ্রা যাইতেন, আর পাঁচ দিবস সমস্ত রাত্রি অধ্যয়ন করিতেন।

 ক্রমে ক্রমে, তাঁহার কষ্ট এত অধিক হইয়া উঠিল যে, আর সহ্য হয় না। এই সময়ে কোন সম্পন্ন ব্যক্তির বাটীতে এক শিক্ষকের প্রয়োজন হইল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক, হীনের দুঃখ দেখিয়া দয়া করিয়া, তাঁহাকে ঐ কর্ম্ম দিতে চাহিলেন। ঐ কর্ম্ম স্বীকার করিলে, হীনের এক কালে সকল কষ্ট দূর হইত। কিন্তু, ঐ সম্পন্ন ব্যক্তির বাটী বিশ্ববিদ্যালয় হইতে অনেক দূর। তাঁহার বাটীতে কর্ম্ম করিতে গেলে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়া যাইতে হয়; তাহা হইলে তাঁহার পড়া শুনার সকল সুবিধা যায়। এজন্য তিনি ঐ কর্ম্ম অস্বীকার করিলেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন, যত কষ্ট পাই না কেন, লিপ্সিক পরিত্যাগ করিয়া যাইব না।

 কিছু দিন পরে, ঐ অধ্যাপক লিপ্সিক নগরেই এরূপ আর এক কর্ম্ম উপস্থিত করিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকিয়া পড়া শুনা চলিবেক, অথচ কষ্ট দূর হইবেক, এই বিবেচনায় তিনি ঐ কর্ম্ম স্বীকার করিলেন। এই কর্ম্ম স্বীকার করাতে, আপাততঃ তাঁহার অনেক কষ্ট দূর হইল। কিন্তু ছাত্রদিগকে শিক্ষা দেওয়াতে, এবং স্বয়ং অহোরাত্র অধ্যয়ন করাতে, অতি উৎকট পরিশ্রম হইতে লাগিল। এই কারণে, তাঁহার এমন উৎকট পীড়া জন্মিল যে, ঐ কর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে হইল। এ কর্ম্ম করিয়া, যৎকিঞ্চিৎ যাহা তাঁহার হস্তে হইয়াছিল, রোগের সময় সমুদয় নিঃশেষ হইয়া গেল। যখন সুস্থ হইয়া উঠিলেন, তখন তাঁহার এক কপর্দকও সম্বল ছিল না। সুতরাং পুনর্বার তিনি পূর্বের মত কষ্টে পড়িলেন এবং ঋণগ্রস্তও হইলেন।

 ইতিপূর্ব্বে, তিনি লাটিনভাষায় কতকগুলি শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন। ঐ শ্লোক দেখিয়া, ড্রেসডেনের রাজমন্ত্রীরা প্রশংসা করাতে, তাঁহার আত্মীয়েরা এই বলিয়া তথায় যাইতে পরামর্শ দিলেন যে, সেখানে গেলে, রাজমন্ত্রীরা সহায়তা করিয়া, তোমার যথেষ্ট উপকার করিতে পারেন। তদনুসারে, তিনি, ঋণ করিয়া পথখরচ লইয়া, ড্রেসডেনে গমন করিলেন। কিন্তু যে আশায় ঋণগ্রস্ত হইলেন এবং কষ্ট করিয়া ড্রেসডেনে গেলেন, তাহা সফল হইল না। রাজমন্ত্রীরা প্রথমতঃ তাঁহাকে আশ্বাস দিয়াছিলেন, কিন্তু সে আশ্বাস পরিশেষে কথামাত্র হইল।

 অবশেষে, তিনি, নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, তত্রত্য কোন সভ্রান্ত ব্যক্তির পুস্তকালয়ে লেখকের কর্ম্মে নিযুক্ত হইলেন। এই কর্ম্ম করিয়া যাহা পাইতেন, তাহাতে তাঁহার আহারের ক্লেশও ঘুচিত না। কিন্তু তিনি পরিশ্রমে কাতর ছিলেন না, পুস্তকের অনুবাদ প্রভৃতি অন্যান্য কর্ম্ম করিতে আরম্ভ করিলেন। এই সকল করিয়া, তাহার কিছু কিছু লাভ হইতে লাগিল; তিনি ঐ লাভ দ্বারা পূর্ব্ব ঋণ পরিশোধ করিলেন। পুস্তকালয়ে দুই বৎসর কর্ম্ম করিলে পর, তাঁহার বেতন দ্বিগুণ হইল। কিন্তু ঐ প্রদেশে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ ঘটাতে, নানা উপদ্রব উপস্থিত হইল। এজন্য তাঁহাকে, কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া, পলায়ন করিতে হইল।

 যুদ্ধ উপস্থিত হওয়াতে, ড্রেসডেনে যে সকল উপদ্রব ঘটিয়াছিল, যুদ্ধশেষ হইলে ঐ সকল উপদ্রবের নিবারণ হইল। তখন তিনি ড্রেসডেনে প্রতিগমন করিলেন। তাঁহার পঁহুছিবার কিছু পূর্ব্বে, গটিঞ্জনের বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। তৎকালে রঙ্কিন নামে এক অতি প্রধান পণ্ডিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষীয়েরা প্রথমতঃ তাঁহাকে মনোনীত করেন। কিন্তু তিনি অস্বীকার করিয়া লিখিয়া পাঠান, হীন নামে এক ব্যক্তি আছেন, তিনি এই কর্মের সম্পূর্ণ যোগ্য পাত্র; আমার মতে ঐ ব্যক্তি সর্ব্বাপেক্ষা অধিক উপযুক্ত। রঙ্কিনের সহিত হীনের আলাপ ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁহার বিদ্যা বুদ্ধির বিষয় সবিশেষ অবগত ছিলেন; এই নিমিত্ত, স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া, ঐ কথা লিখিয়া পাঠান।

 রঙ্কিন এইরূপ লিখিয়া পাঠাইবামাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষীয়েরা হীনকে ঐ প্রধান পদে নিযুক্ত করিলেন। তিনি এত দিন, নানা কষ্ট ভোগ ও উৎকট পরিশ্রম করিয়া, যে বিদ্যা উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহার ফললাভ হইল। তিনি যেমন পণ্ডিত, তেমনই সৎস্বভাব ছিলেন। তাঁহার ছাত্রেরা, ও যাবতীয় নগরবাসী লোকেরা, তাঁহাকে স্ব স্ব পিতার ন্যায় স্নেহ ও ভক্তি করিতেন। তিনি পঞ্চাশ বৎসর, অতিশয় সম্মানপূর্বক, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের কর্ম্ম করেন। তাঁহার মৃত্যু হইলে, সকল লোকই অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছিলেন।

 দেখ! হীন অতি দুঃখীর সন্তান। তাঁহার পিতা, তন্তুবায়ের ব্যবসায় করিয়া, কষ্টে জীবিকানির্বাহ করিতেন। কিন্তু হীন, যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন বলিয়া, বিনা চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হইলেন। যদি তিনি ও পরিশ্রম করিয়া লেখা পড়া না শিখিতেন, তাহা হইলে কেহ তাঁহার নামও জানিত না। কিন্তু তিনি, যার পর নাই কষ্টে পড়িয়াও, যে বিদ্যা উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, কেবল সেই বিদ্যার বলে চিরস্মরণীয় হইয়াছেন। যত দিন পৃথিবীতে লেখা পড়ার চর্চ্চা থাকিবেক, তত দিন তাঁহার নাম দেদীপ্যমান থাকিবেক।