জিরোম ষ্টোন


এই ব্যক্তি স্কট্‌ল‌ণ্ড দেশে জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার তিন বৎসর বয়সের সময় পিতৃবিয়োগ হয়। ষ্টোনের পিতা কিছুমাত্র সংস্থান করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার জননী অতি কষ্টে আপনার ও পুত্রের ভরণপোষণ নির্বাহ করিতেন। তিনি পুত্রকে গ্রামস্থ বিদ্যালয়ে সামান্যরূপ কিছু লেখা পড়া শিখাইয়াছিলেন।

 যেরূপ অবস্থা, তাহাতে কিছু কিছু না আনিতে পারিলে কোন মতেই চলে না; সুতরাং ষ্টোনকে, উপার্জ্জনের চেষ্টায়, অল্প বয়সেই বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিতে হইল। তিনি গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, ভ্রমণ করিয়া ছুরী, কাঁচী, ছুঁচ, সুতা, ফিতা প্রভৃতি বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিলেন। এই সামান্য ব্যবসায় দ্বারা যে অল্প লাভ হইতে লাগিল, তদ্দ্বারা জননীর কিছু কিছু আনুকুল্য করিতে লাগিলেন।

 ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিতে ষ্টোনের অতিশয় বাসনা ছিল। জননী কোন রূপেই ভরণপোষণ নির্বাহ করিতে পারেন না, কেবল এই কারণে, নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্ব্বক, তিনি বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। যে ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন, তাহার সঙ্গে লেখা পড়ার কোন সম্পর্ক নাই। এই নিমিত্তে, ঐ ব্যবসায়ের উপযোগী যে সকল জিনিস পত্র কিনিয়াছিলেন, সমুদয় বিক্রয় করিলেন, এবং ব্যবসায় করিবার নিমিত্ত, ঐ মূল্যে কতকগুলি পুস্তক ক্রয় করিলেন। পুস্তকবিক্রয়ের ব্যবসায় অবলম্বন করিবার তাৎপর্য্য এই যে, ব্যবসায় দ্বারা যেমন কিছু কিছু লাভ হয়, তাহাও হইবেক, এবং সর্ব্বদা নানাবিধ পুস্তক নিকটে থাকিলে, ইচ্ছামত পড়াও চলিবেক।

 তৎকালে স্কট্‌লণ্ডের স্থানে স্থানে যে মেলা হইত, তথায় জিনিস পত্র লইয়া গেলে, অনায়াসে বিক্রয় হইত। এই নিমিত্ত ষ্টোন, দোকান না খুলিয়া, কিংবা গ্রামে গ্রামে না বেড়াইয়া, কেবল মেলার সময় পুস্তক বিক্রয় করিতে যাইতেন, অবশিষ্ট সময়ে ক্রমাগত ইচ্ছামত পুস্তক পাঠ করিতেন।

 এই রূপে পুস্তকবিক্রয়ব্যবসায় আরম্ভ করাতে, ষ্টোনের লেখা পড়া শিখিবার বিলক্ষণ সুযোগ হইয়া উঠিল। তিনি, লেখা পড়া শিখিবার নিমিত্ত, এত যত্ন ও এত পরিশ্রম করিতে লাগিলেন যে, অল্প‌ দিনেই হিব্রু ও গ্রীক এই দুই ভাষায় বুৎপন্ন হইয়া উঠিলেন। তিনি, অন্যের সাহায্য ব্যতিরেকেই, এই দুই ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলেন। পরে তাঁহার লাটিন শিখিতে অত্যন্ত ইচ্ছা হইল। তদনুসারে, তিনি লাটিন পড়িতে আরম্ভ করিলেন, এবং অল্প দিনের মধ্যেই এত দূর শিখিলেন যে, লোকে দেখিয়া শুনিয়া চমৎকৃত হইল।

 ডাক্তর টলিডেল্ফ‌নামক এক ব্যক্তি স্কট্‌লণ্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। এই ব্যক্তি বিখ্যাত পণ্ডিত ও বিখ্যাত বুদ্ধিমান ছিলেন। ইনি, ষ্টোনের লেখা পড়া শিখিবার যত্ন এবং অসাধারণ বুদ্ধি ও ক্ষমতা দেখিয়া, তাঁহাকে, ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখাইবার নিমিত্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাইলেন এবং তাহার সমুদয় খরচ পত্রের বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন।

 এই রূপে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া, ষ্টোন, অল্প‌ কালের মধ্যেই, নানা শাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত হইয়া উঠিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের, কি অধ্যাপক, কি ছাত্র, সকলেই তাঁহার বুদ্ধির ও বিদ্যার প্রশংসা করিতেন। তিনি ছাত্র ছিলেন, ইহাতে অধ্যাপকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্লাঘা জ্ঞান করিতেন; আর তাঁহার সঙ্গে অধ্যয়ন করেন, ইহাতে সহাধ্যায়ীরা আপনাদিগের গৌরব জ্ঞান করিতেন।

 ষ্টোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন বৎসর অধ্যয়ন করিলেন; এমন সময়ে, এক লাটিন বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য হইল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদিগের অনুরোধে, ষ্টোন ঐ পদে নিযুক্ত হইলেন। দুই বৎসর পরে, তিনি প্রধান শিক্ষকের পদেও নিযুক্ত হইয়াছিলেন। আক্ষেপের বিষয় এই যে, অতি অল্প‌ বয়সেই তাঁহার মৃত্যু হইল। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসর মাত্র হইয়াছিল।