চিত্ত-মুকুর/অকস্মাৎ সে তারাটি ডুবিল কোথায়

অকস্মাৎ সে তারাটি ডুবিল কোথায়।

জীবন সিন্ধুর তীরে বসি নিরন্তর
হেরিতাম যে তারাটি অনন্য-মানসে,
অকস্মাৎ কোথা গেল আঁধারি অম্বর।
কাঁদিয়া উঠিছে প্রাণ চাহিয়া আকাশে।

নহে কি সে নভঃ ইহা—সে মিশি কি নয়?
কিম্বা ইহা নহে সেই জীবনের তীর?
সে আকাশে সে তারাটি সদত উদয়,
সে তীরে কিরণময় সঙ্গত যে নীর!
এ যে শূন্য নভস্তল, যামিনী আঁধার!
এ তীরে যে সিন্ধু-নীর ভীষণ আকরি!


না না—সেই নভঃ ইহা, ওই চিহ্ন তার౼
বজ্র ভাঙ্গা ঝুলিতেছে নীরদের গায়,
সেই নিশি বটে ইহা౼তেমতি আঁধার,
তীরো সেই,—ভগ্ন কূল এই যে হেথায়।
এই যে সে ছিন্ন লতা জীর্ণ তরু-মূলে
শুষ্ক পল্লবের রাশি এই যে এখানে,
ভগ্ন তরীখানি সেই ওই মগ্ন কূলে,
সে ভাঙ্গা পিঞ্জর খানি পড়ি এই খানে,
সেই নভঃ সেই নিশি, সিন্ধু তীরে সেই।
কেন রে সে জ্যোতির্ম্ময় তারকাটি নেই।


নির্ম্মম সংসারে এক নিভৃত প্রান্তরে
জীবন সিন্ধুর তীরে ছিলাম বসিয়া,

মগ্ন ছিল চতুর্দ্দিক নিবিড় আঁধারে,
ছিল সেই এক তারা নিশি উজলিয়া,
তখন জীবন নীর ছিলনা অধীর,
শান্ত সাগরের মত আছিল নিথর,
আজি অকস্মাৎ কেন এ বাত্যা গভীর
কাঁদিয়া উঠিছে কেন প্রাণের ভিতর?
ওকি চিত্র? সর্ব্বনাশ—একি ভয়ঙ্কর।
সে সুখ-তারাটি এই গ্রাসিল পামর!


চাহিনা দেখিতে আর লুকাও ত্বরায়
হা বিধাতঃ! কি দেখালে নিবিড় আঁধারে!
প্রকৃত এ চিত্র যদি, কেন অভাগায়—
দেখাইলে, ছিল ভাল নিহিত অম্বরে।
ছিল ভাল সে নিবিড় আঁধার অম্বর
ক্ষীণালোকে থাকিতাম পড়ি তরুতলে
জড়াইয়া ছিন্ন লতা বক্ষের উপর;
হেরিতম আজীবন আকাশের তলে।
কি দেখিনু—কি হইল প্রাণের ভিতর,
ফাটে না অথচ যেন ফাটিছে অন্তর!


জীবন আত্মার স্বপ্ন, প্রপঞ্চ বিধির
অনিত্য, অসার সুধু ভ্রান্ত লীলাময়,
মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে গতি যাহার অস্থির
আবর্ত্তে আবর্ত্তে যার বিষম প্রলয়;
কেমনে বলিব তাহা সুখের জীবন,
কেমনে বলিব নহে ভ্রান্তমতি নর!
কোন তর্কে বুঝাইব হৃদয় আপন,
কি যুক্তিতে এ বিশ্বাস করিব অন্তর?
নিত্য, সার, সত্য, যার মুহূর্ত্তও নয়
সে জীবনে নর-ভাগ্যে কি বা ফলোদয়?


“বৃথা জন্ম এ সংসারে” বলে না যে জন,
বিপুল প্রয়াস তাঁর বাসনা গভীর,
কীর্ত্তি যশ লালসায় আকুলিত মন,
চঞ্চল জগতে তাঁর আত্মাও অধীর।
সুখী সেই—কিন্তু যার আঁধার জীবন,
কিরণের রেখা মাত্র নাহি যে জীবনে,
প্রতিপদে নিরাশায় দগ্ধ যার মন
“মানব জনম সার” সে বলে কেমনে!

“উদ্দেশ্য সাধন কর” সুখীর বচন,
দুখীর আজন্ম সুধু করিতে রোদন।


উদ্দেশ্য—তাও কি এত সুখদ জীবনে?
কি উদ্দেশ্য? নরচিত্তে কি সাধ গভীর।
কীর্ত্তি?—গৌরব নিজ,—সে কীর্ত্তি ঘোষণে
কেন ক্ষুদ্রমতি নর সদত অধীর?
ধর্ম্ম মোক্ষ কল্পনার সমষ্টি কেবল।
কিবা ধর্ম্ম কোথা স্বর্গ কিবা দেহান্তর,
অনিশ্চিতে কিসে এত বিশ্বাস প্রবল!
অসম্ভব সত্যে কিসে এতই নির্ভর।
কি বিচিত্র মানবের কুহক আশার!
ধন্য মানবের মোহ—ধন্য ভ্রান্তি তার।


ভ্রান্তি!—এ ভ্রান্তিতে জীব আচ্ছন্ন কেবল।
কেন এ ভ্রান্তিতে চিত্ত হইল মগন?
বিষাদের চিত্র কেন এত সমুজ্জ্বল,
যন্ত্রণার রেখা কেন গভীর এমন।
ডুবিল—ডুবুক তারা, কেন কাঁদে মন?
শোক-দুখ-ক্ষীণ-বৃত্তি কেন এ হৃদয়ে?

পুত্তলিকা রঙ্গভূমে জনম যখন
নিয়তির অত্যাচার লঙ্ঘনীয় নহে,
আত্মায় শরীরে যদি ক্ষণিক মিলন
পার্থিব বিষাদে আত্মা কেন উচাটন!


এইত যন্ত্রণা—চিত্ত সহজে দুর্ব্বল।
মানস বুঝিলে তবু বুঝে না হৃদয়,
শোকপ্রবণতা চিত্তে কেমনি প্রবল
বিষাদে প্রবৃত্তি গুলি সব(ই) চিত্তময়।
যে দিকে ফিরাও মন চিত্ত সেই খানে।
শিক্ষার কঠিন জ্ঞান সেখানে নিস্ফল,
জাগ্রতে স্বপনে সেই ব্যথা বাজে প্রাণে।
প্রকাশিত পরিবর্ত্তে হয় না শীতল।
কালের মন্থর গতি করি নিরীক্ষণ
দগ্ধচিত্তে বহ্নিশিখা করহ গোপন।

১০


অনিত্য জীবনে কেন গভীর প্রণয়?
কেন এত স্নেহ মায়া নশ্বর জীবনে?
যুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে যদি এতই প্রলয়
প্রণয়ের স্মৃতি কেন গভীর স্মরণে?

স্মৃতি—কেন রহে চিত্তে এত দীর্ঘকাল?
ঘটনার সঙ্গে ধ্বংশ কেন নাহি হয়।
সুখের ভাবনা হৃদে জাগে ক্ষণকাল,
দুখের ভাবনা বিন্তু ভুলিবার নয়,
যে অনলে দগ্ধ হয় পাষাণ হৃদয়
সে অনলে স্মৃতি কেন ভস্ম নাহি হয়!