চিত্ত-মুকুর/পুন্দরের দৈত্য
পুন্দরের দৌত্য।
১
বিষয় সমররাজ চিত্রের সভায়
নীরব সচিব-বৃন্দ পারিষদ গণ,
বজ্রনাদ অন্তে যথা সমুদ্র-হৃদয়,
পুন্দর-বচনে স্তব্ধ সদসিভবন।
কহিল পুন্দর তেজে তুলিয়া উচ্ছ্বাস
“যে জল রেখা, দেব, পশ্চিম গগনে
উঠিছে ঈষৎ ভাবে, অনন্ত আকাশ
আচ্ছন্ন হইবে তায় সহায় পবনে।”
২
“যেই ক্ষীণ অগ্নিশিখা ভারত-ভবনে
জ্বালিয়াছে জয়চন্দ্র, পরিণামে হায়—
ভীষণ অনল হয়ে ছুটিবে সঘনে,
হিমাদ্রিকুমারী ব্যাপি ভস্ম হবে তায়।
যদি কাল সর্পশির প্রবেশে বিবরে
কার সাধ্য নিবারিতে সে ভুজঙ্গগতি?
পশে যদি ম্লেচ্ছ আজ ভারত ভিতরে
কাল ভারতের ভাগ্যে অশেষ দুর্গতি।”
৩
“বারেক খুলিয়া দেব স্মৃতির দুয়ার
ভারতের পূর্ব্ব ছবি কর দরশন,
সৌভাগ্যের পূর্ণ জ্যোতি অঙ্গে চারিধার
কেমন অপূর্ব্ব বেশ করেছে ধারণ।
বীর্য্য, ধর্ম্ম, শাস্ত্র আদি নক্ষত্র মণ্ডলে
কেমন শোভিছে, যেন শারদি-নিশায়
নিশানাথ বিরাজিছে তারকার দলে
উজলি ভারত-বক্ষ অতুল আভায়।”
8
“যশের পতাকা ওই উন্নত গগনে
কেমন উড়িছে দেখ শোভা বিকাশিয়া,
সূর্য্য তেজোময় সব আর্য্যসুতগণে
চলেছে কেমন ভাবে গরবে মাতিয়া।
ভীষ্ম, কর্ণ, দ্রোণ, পার্থ, আচার্য্য-তনয়
এখনো নিরখি যেন সাজি রণ বেশে,
রণরঙ্গে মত্ত ভীম ভেদিয়া হৃদয়
দুঃশাসন-রক্ত পান করিতেছে রোষে।”
৫
“হায় আর্য্যসুতগণ! এত যে আয়াসে
তুলিলে যশের কেতু, বুঝি এতদিনে
খসিল ভূমিতে তাহা ম্লেচ্ছের পরশে।
অস্ত যায় সুখ সূর্য্য পশ্চিম গগনে।
একবার এস সবে কুরু-রণস্থলে,
উত্তপ্ত মেদিনী তার কাতর তৃষ্ণায়,
ম্লেচ্ছ-রক্ত তরঙ্গিণী আনি কুতূহলে
শীতল করহ তার উগ্র পিপাসায়।”
৬
নীরব হইল দূত, স্তব্ধ সভাতল,
চতুর্দ্দিকে একবার করিল ঈক্ষণ;
বদনে উৎসাহ-আভা নিরখি সবার
কহিল আবার রোষে করিয়া গর্জ্জন
“জীবিত কি আর্য্যসুত ভারত ভবনে
উত্তপ্ত শোণিত কারো বহে কি শিরায়౼
ক্ষুবধ নহ কি ম্লেচ্ছ পদ-প্রহরণে,
ভারত-কলঙ্কে কারো কাঁপে কি হৃদয়?
৭
“কাঁপে যদি—ওই দেখ পশ্চিম গগনে
ভারতের সুখ সূর্য্য রাহুর গরাসে।
আর্য্যকুল-মান যদি থাকে কার মনে
কর যত্ন যাহে রাহু সূর্য্য না পরশে,
কাঁপে যদি౼চল সবে সিন্ধুনদ-কূলে
ম্লেচ্ছের সমাধিক্ষেত্র করিবে খনন।
পরাঙ্মুখ হও যদি, তরঙ্গিণী-জলে
পশিয়া কলঙ্ক রাশি করে। প্রক্ষালন।”
৮
“পৃথু নহে ভীত একা যুঝিতে সমরে,
কোন্ ক্ষত্র ভীত কবে সমর সজ্জায়?
একক শতক পৃথু ভাবে না অন্তরে,
তবে কিনা জয়চন্দ্র সাহার সহায়।
ক্ষত্রিয়-কলঙ্ক জয় আর্য্য-কুলাঙ্গার
যেই ইষ্টসিদ্ধি-আশে ম্লেচ্ছের সহায়,
ভাসিবে উজান স্রোতে সেই ইষ্ট তার
বুঝে না সর্পের গতি মুঢ় দুরাশয়।”
৯
“সুপবিত্র আর্য্য-ধাম জগত-পূজিত
অশুচি ম্লেচ্ছের পদ পরশিবে তায়
স্মরিলে বিদীর্ণ নহে কোন ক্ষত্র-চিত?
এ সম্বাদে অসি কভু পিধানে কি রয়?
গর্ব্বের তিলক মুছি ললাট হইতে
দাসত্ব কলঙ্ক তায় দিবে মাখাইয়া,
ছিঁড়িয়া সুখের পদ্ম হৃদয় হইতে,
বিষাদ কণ্টক দামে সাজাইবে হিয়া!”
১০
“কি আর বলিব দেব, এই নিবেদন
পাঠাইলা পৃথু রাজ তব সন্নিধানে—
রক্ষিত আর্য্যের মান আর্য্যসুতগণ
মিলি রণক্ষেত্রে যেন যুঝে প্রাণপণে!
নীরব হইল দূত—গভীর বচন
হইল নীরব, কিন্তু প্রতিধ্বনি তার
ছুটিতে লাগিল করি জলদ নিস্বন
সবার হৃদয়ময় বেগে অনিবার।
১১
আঘাতি অনল ছটা কন্দরে কন্দরে
ভ্রমে যথা ক্ষণপ্রভা পর্ব্বত প্রদেশে,
তেমতি চিন্তার শিখা ক্ষত্রিয় অন্তরে
ভ্রমিতে লাগিল হেসে ভয়ঙ্কর বেশে,
কল্পনা অমনি আনি ভবিষ্যত ছবি
ধরিল মানস-পটে সম্মুখে সবার,
(অস্তমিত ভারতের সৌভাগ্যের রবি
নিবিড় গভীর মেঘে ভারত আঁধার)।
১২
কহিল সমররাজ গম্ভীরে তখন౼
“বুঝিনু এখন কেন স্বপ্নে অনিবার
হেরিতেছি কয়দিন সমর-প্রাঙ্গণ,
কেন থেকে থেকে কোষে কাঁপে তরবার।
ভ্রমি গৃহমাঝে যবে অনুভব হয়
শরাসন দেখি মোরে উঠিল নাচিয়া,
যেন পদমূলে শব স্তুপাকারে রয়
ভীষণ রক্তের স্রোত ছুটিছে বাহিয়া।”
১৩
“অহো কি সম্বাদ আজ করিনু শ্রবণ”
নিরবিল ক্ষণে বীর ফেলি দীর্ঘশ্বাস।
ক্ষণেকে চমকি পুন কহিল বচন
প্রাবৃটে গগনে যথা জলদ নিশ্বাস।
“লাহোর-রাজন! আজ করিলাম পণ
রক্ষিতে আর্য্যের মান যদি আর্য-সুত
নাহি বাঞ্ছে, একা আমি ভুতল গগন
ডুবাব সাগর-জলে ম্লেচ্ছের সহিত।”
১৪
“এই দেখ”౼বলি অসি করি নিষ্কাশন
ঝলসিল সভাল উদ্রিক্ত কিরণে।
“এই দেখ এই অসি উলঙ্গ এমন,
এমনি উলঙ্গ ভাবে রবে, যত দিনে,౼
পাপ ম্লেচ্ছ-লোহ-নীরে নাহি করে স্নান।
সাধিতে এ আশা যদি বাদী বিশ্বজন౼
অথবা অমর-বৃন্দ,౼নাহি পরিত্রাণ
দ্বিধা হবে একঘাতে বিশ ত্রিভুবন।”
১৫
“নক্ষত্রে নক্ষত্র ধরি করিব প্রহার,
চূর্ণ হবে সৌরদল পুড়িয়া অনলে,
বাঁধিয়া ভারতে গলে সাগর মাঝার
লুকাইব বারিধির সুগভীর তলে।
কলঙ্ক না স্পর্শে যাহে আর্য্যের ভবনে,
অথবা নির্ম্লেচ্ছ পৃথ্বী করিব এবার
স্তুপাকারে রবে পড়ি সমর-প্রাঙ্গণে
রাবণের চিতা সম ম্লেচ্ছ-ভস্মসার।”
১৬
“যাও চলি—দিল্লীধামে কহ এ বারতা,
মসৃণ করহ সবে ভল্ল খরশান,
ভুলে যাও একবারে প্রাণের মমতা
যত দিন এ অনল না হয় নির্ব্বাণ।
যতদিন ম্লেচ্ছ রক্তে—স্বল্পদিন আর-
সিঞ্চিত না হয় বর্ত্ম, মুহূর্ত্তের তরে
অলসে পলক যেন নাহি পড়ে কার,
বাড়াও ক্রোধের ক্ষুধা আহারে বিহারে।”
১৭
“অভিবাদন আমার দিও দিল্লীশ্বরে
বোলো তাঁরে এ তরঙ্গ যদি সে তরঙ্গে-
মিশে একবার,—ছার ম্লেচ্ছ কলেবরে—
ভাসাইর ভূমণ্ডল সমরের রঙ্গে।”
নীরব হইল রাজা স্তব্ধ সভাতল
পড়ে না একটি শ্বাস নড়ে না পলক
চামরী ব্যজন ভুলি দাঁড়ায়ে অচল
নীরবে কৃপাণ স্কন্ধে স্তম্ভিত রক্ষক।
- ↑ পৃথ্বিরাজের সহিত সাহাব উদ্দীনের যুদ্ধ হইবার পূর্ব্বে পৃথ্বিরাজ লাহোরাধিপতি পুন্দরকে দূত পদে বরণ করিয়া চিতো- রের অধীশ্বর সমরসাহীর নিকট প্রেরণ করেন। পুন্দর সমরসাহীর নিকট যাহা বলিয়াছিলেন এ কবিতাটিতে তাহাই লিখিত হইল। চাঁদ কবির গ্রন্থে এ কথা সবিস্তার লিখিত আছে।