চিত্ত-মুকুর/দুঃখিনী রমণী
দুঃখিনী রমণী।
১
সজীব সৌন্দর্য্যপূর্ণ রমণী-বদন
অতল সুধার উৎস নয়ন যুগল
বিষাদে মলিন দেখি আছে কোন জন—
রহে স্থির? কার নেত্রে নাহি ঝরে জল?
দেখিয়াছি কত শত যন্ত্রণা নয়নে,
অন্ধ খঞ্জ দেখিয়াছি করিতে রোদন,
কিন্তু হায় অশ্রুমুখী রমণী-বদনে
নিরখিয়া কেন আজ কাঁদে মম মন?
২
পূর্ণিমা-যামিনী, ভাসে শশাঙ্ক গগনে,
বিতরি ধরণি-অঙ্গে কৌমুদি বিমল,
আন্দোলিছে ধীরে ধীরে নৈশ সমীরণে
নীরবে তরুর পত্র সরসীর জল,
শ্বেত সোপনের অঙ্কে প্রসারি চরণ,
হেলাইয়া চারু তনু সোপান-প্রাচীরে,
বসিয়া রমণী ওই,—চুম্বিয়া চরণ
আনন্দে সরসী-জল নাচিতেছে ধীরে।
৩
গভীর নিশিতে একা নির্জন উদ্যানে
বসি উদাসিনী বালা সরসীর তীরে,
বিস্তৃত নয়নদুটি চাহি ঊর্দ্ধ পানে,
অপাঙ্গে সলিল ধারা ঝরিতেছে ধীরে;
সে মলিন মুখে পুনঃ জীবন-সঙ্গীত-
তীব্র যন্ত্রণার স্রোত বহিতেছে ধীরে;
পরশি সে উষ্ণ বায়ু সঘনে কম্পিত-
হইতেছে বিম্বাধর তিতি অশ্রুনীরে।
8
“কেন তবে জগদীশ সৃজিলে আমারে!
সৃজিলে যদ্যপি কেন করিলে দুখিনী!
দুখিনী করিলে যদি কেন না অচিরে
জীবনের শেষ অঙ্ক মুছিলে তখনি!
অনন্ত মরুর বক্ষে উষ্ণ বালুকায়
চাপি বক্ষ কত কাল রহিব বাঁচিয়া!
অস্থির পরাণ নাথ দারুণ তৃযায়,
কে রাখিবে প্রাণ মম বারি-বিন্দু দিয়া।
৫
শৈশবে জীবন যদি হ’ত অবসান,
দহিতে হ’ত না আজ এ চির অনলে।
নবীন যৌবনে বক্ষে চাপিয়া পাষাণ,
ভাসিতে হ’ত না এই নিরাশার জলে।
রাজার নন্দিনী আমি আজন্ম সুখিনী,
বালিকা যখন,—ছিল কত সাধ মনে;
সে সাধ পূরিল ভাল, চির অভাগিনী,
আমরণ অশ্রুজল ঝরিবে নয়নে।
৬
ইচ্ছা করে ছুটে যাই কানন-মাঝারে,
পড়িয়া তরুর তলে কাঁদি একাকিনী।
এ দুখ কহিব কারে নির্ম্মম সংসারে,
কে বুঝিবে౼কে শুনিবে౼আমারকাহিনী।
কভু ইচ্ছা করে ছুরী বিন্ধিয়া হৃদয়ে,
জীবনের দুখ-লীলা করি অবসান।
সিহরি আতঙ্কে পুনঃ পরকাল-ভয়ে,
দুখের সাগরে উঠে বিষম তুফান।
৭
হায় পিতঃ কেন আর চির-অভাগিরে,
স্নেহ মমতায় সদা করিছ পালন।
ভাসাইয়া দেহ মেরে জাহ্ণবীর নীরে,
এ মুখ দেখিয়া কেন পাইবে বেদন।
শুষ্ক পল্লবের মত যাইব ভাসিয়া,
প্রবল তরঙ্গ-স্রোতে সাগরের জলে।
এ ভঙ্গ জীবন-তরি যাইবে ডুবিয়া,
দহিতে হবে না আর নিরাশা-অনলে।
৮
মূর্ত্তিমতী দয়া তুমি জননী আমার,
কত যত্নে কত স্নেহে পালিছ আমারে,
কিন্তু মাগো ভাঙ্গিয়াছে কপাল যাহার,
স্নেহ-বিড়ম্বনা কেন অকারণ তারে?
কেন নীলাম্বরী আর কেন অলঙ্কার?
কেন লৌহ হাতে কেন সিন্দূর কপালে?
কেন যত্নে বেঁধে দাও কবরী আমার?
দুখিনীর নাহি সাধ আর এ সকলে!
৯
ফুরায়েছে সব সাধ নবীন যৌবনে,
আশা-সুখ দুখিনীর নাহি কিছু আর;
ফুরাইবে এ যন্ত্রণা আর কত দিনে
সুধু এই এক চিন্তা অন্তরে আমার।
না হ’ত বিবাহ যদি আছিল সে ভাল,
নাহি জানিতাম স্বামী কেমন রতন।
আজন্ম কুমারী হয়ে সুখে চিরকাল,
রহিতাম, দহিত না নিরাশায় মন।
১০
শর-বিদ্ধ বিহঙ্গিনী মর্ম্ম-বেদনায়,
অস্থির যখন পড়ি লতার বিতানে।
কে বুঝে কে দেখে তার তীব্র যন্ত্রণায়,
লুটায় সাপটি পক্ষ একাকী কাননে।
বিলাপে কানন-মাঝে যবে কুরঙ্গিনী,
নিরখিয়া চতুর্দ্দিকে মত্ত দাবানল
কে বুঝে তখন তার কি করে পরাণি,
কে মুছায় দুখিনীর নয়নের জল।
১১
“বারি, বারি” শব্দে করি কাতরে চীৎকার,
নিদাঘ-চাতক যবে হতাশ অন্তরে
পড়ে ভূমে চাপি বক্ষ, অন্তর কাহার
কাঁদে অভাগিনী সেই চাতকের তরে?
অনন্ত সংসারে আমি সামান্যা রমণী,
কোন্ দুঃখে কাঁদি সদা কে সন্ধান করে?
সংসারে নারীর দুখ বুঝে কোন প্রাণী
মৃগতৃষ্ণিকায় কবে সলিল সঞ্চারে?
১২
ঘুচাতে বেদনা যদি দুখিনী কন্যার
থাকে ইচ্ছা, এই ভিক্ষা জননী, অচিরে
জনমের মত আশা বিসর্জ্জিয়া তার,
সাজাইয়া দেহ চিতা জাহ্নবীর তীরে।
সজল নয়নে চাহি সংসারের পানে,
পশিব পরম সুখে জ্বলন্ত চিতায়।
নিবিবে যখন বহ্নি গিয়া সেই খানে।
দেখিও বারেক তব দুখিনী কন্যায়।
১৩
চিতার অনল সহ প্রাণের অনল,
দেখিবে নিষেছে সেই তরঙ্গিনী-তীরে।
দুখিনীর এই মাত্র উপায় কেবল,
মুছাইতে অবিশ্রান্ত নয়নের নীরে।
যত দিন বেঁচে রব এ পোড়া সংসারে,
সমভাবে এ যাতনা দহিবে অন্তরে।
চাপাইয়া দেহ যদি বস্ত্র অলঙ্কারে,
তবু নিবিবে না বহ্নি ক্ষণেকের তরে।
১৪
প্রাণের দোসর তুমি ভগিনী আমার,
কেন কাঁদি প্রতিক্ষণ জিজ্ঞাস আমারে,
কেন যে পরাণ কাঁদে উত্তর তাহার
কি দিব কথায় আজ সরলে তোমারে
সুখ দুঃখ কোন্ সূত্রে নারীর জীবনে-
হয় অভিনিত, যদি বুঝিতে পারিতে,
বুঝিতে কি দুঃখ যদি হতাশের মনে,
কেন দুখী প্রতিক্ষণ নাহি জিজ্ঞাসিতে।
১৫
পেয়েছ গুণের পতি মনের মতন,
নারীর অমুল্য নিধি পেয়েছ প্রণয়;
তুমি কি বুঝিবে দিদী দুঃখিনীর মন?
তুমি কি বুঝিবে তার কি করে হৃদয়?
নির্বাক যাতনা মম ভগিনী তোমারে,
কেমনে বুঝাব বল,—চিরিয়া হৃদয়
দেখাইতে পারি যদি প্রাণের ভিতরে,
বুঝিবে তখন সদা কি যন্ত্রণা হয়।
১৬
রুদ্ধ বিহঙ্গিনী-মত সংসার পিঞ্জরে,
বসন ভূষণে মোরে তুষিছ সদত;
হায় রে মানস মম ভুলাবার তরে;
কিন্তু কেহ নাহি ভাব এ যন্ত্রণা কত।
অস্থি মাংস লোহ দেহে নাহি মম আর,
চর্ম্মাবৃত তুষানল গঠিত আকারে
দহিয়া দহিয়া বহ্নি জীবন আমার,
পরিণত হবে শীঘ্র নির্জীব অঙ্গারে।
১৭
কত অভাগিনী আমি সুখের সংসারে,
কি বলিব ভগ্নী, এই পূর্ণ সপ্তদশ,
নবীন বসন্ত মম হৃদয়-মাঝারে,
কিন্তু হায় নিরাশায় সকলি নীরস।
যুবতী নারীর মন বুঝিবে আপনি,
কত সাধ কত প্রেম নিয়ত উথলে;
কিন্তু মরুভূমে কবে ছছাটে তরঙ্গিনী!
শুকাইয়া যায় স্রোত উত্তপ্ত ভূতলে।
১৮
নয়ন শ্রবণ মন তোমার মতন,
সকলি আমার, কিন্তু প্রভেদ বিস্তর।
সুখের শৈশব আর দুঃখের যৌবন౼
যেমন আমার; সুধু নেত্র-শোভাকর,
দেখি বটে সংসারের শোভা মনোহর।
শুনি বটে মানবের সঙ্গীত মধুর,
হাসি বটে নিরখিয়া দৃশ্য হাস্যকর,
আশাও অন্তরে হায় করেছি প্রচুর।
১৯
সকলি নীরস তাহে সে কুহক নাই,
তোমার অন্তরে যাহে আনন্দ উথলে,
আশায় নয়নে কর্ণে যাতনা যুড়াই
বিরলে আবার প্রাণ সেই রূপ জ্বলে,
মুছি নয়নের জল অন্তুরে আপনি
নির্জন প্রাসাদে কিম্বা গবাক্ষ-সদনে,
উপাধানে চাপি বক্ষ দিবস রজনী
যাপি যন্ত্রণায় আর হতাশ রোদনে!
২০
হেন চিত্রকর যদি থাকিত ভুবনে
হৃদয়ের প্রতিমূর্ত্তি চিত্রিতে পারিত,
আশা তৃষ্ণা সুখ দুঃখ মনের বেদনে,
তুলিকায় চিত্রপটে হইত অঙ্কিত!
দগ্ধ হৃদয়ের ছবি তুলিয়া তোমারে
দেখাতেম সহোদরে যাতনা আমার,
দেখিতে জ্বলিছে চিতা হৃদয়-মাঝারে,
আশা সুখ পরিবর্ত্তে দেখিতে অঙ্গার।
২১
আর তুমি চিরারাধ্য প্রাণেশ আমার!
আসিও না কাছে মোর প্রেম সম্ভাষণে,
হৃদয়ে লুকাও নাথ প্রণয় তোমার,
কাজ নাই প্রকাশিয়া মধুর বচনে।
পত্নী আমি—দাসী আমি আজন্ম তোমার,
অন্তরে পূজিব তব চরণ-যুগল,
কিন্তু পুনঃ পরস্পরে মিলিব না আর,
প্রজ্জ্বলিত হবে নাথ নির্ব্বাণ অনল।
২২
তুমি নহ অপরাধী, আমি অভাগিনী,
হেরিলে তোমায় নাথ কাঁদে মম মন,
নিরখি আপন চিত মুমুর্ষু, যেমনি
বিষাদে হতাশে হায় মুদি দুনয়ন।
ক্ষম প্রাণেশ্বর! এই নিষ্ঠুর বচন,
ক্ষম দুখিনীর এই নয়নের জল,
পারি না লুকাতে আর মনের বেদন,
পারি না নিতে নাথ প্রাণের অনল।
২৩
পঞ্চম বৎসর অজি বিষম যতনে,
লুকায়ে রেখেছি ব্যথা অন্তর-অন্তরে,
কেবল ঝরিত কভু নিশ্বাসে রোদনে,
ফুটি নাই দুঃখ মম একটি অক্ষরে।
পারি না রাখিতে আর যাতনা অন্তরে,
পারি না বহিতে আর হতাশ জীবন,
ছেড়ে দাও যাই চলি কানন-ভিতরে,
চির-সন্ন্যাসিনী হয়ে করিগে রোদন।”
২৪
সুদীর্ঘ নিশ্বাস ত্যজি সোপান-উপরে
লুটায়ে পড়িল ধীরে নীরবে রমণী,
জ্বলিয়া উঠিল বুঝি যন্ত্রণা অন্তরে,
স্মরি জীবনের ঘোর দুখের কাহিনী।
সেই চন্দ্রালোকে—সেই সরসীর তীরে—
বিষাদ-লুণ্ঠিতা সেই কামিনীর পাণে
দেখিলাম কতবার মুছি অশ্রুনীরে,
কতবার ক্লেশ তার ভাবিলাম মনে।
২৫
জীবন আলেখ্য তার নয়ন দর্পণে
হ’ল বিভাসিত মম, রেখায় রেখায়
দেখিনু জ্বলন্ত শিখা ধায় মর্ম্ম-পানে,
দগ্ধ-আশা হত-সুখ পড়ি শুষ্ক-প্রায়।
তখন সহস্র চিন্তা জাগিল অন্তরে,
দেশাচার, শাস্ত্র, ধর্ম্ম করিনু স্মরণ,
কত তর্ক, ভাবিলাম দুখিনীর তরে,
স্মরিয়া সমাজ পুনঃ ঝরিল নয়ন।
২৬
স্বার্থ অন্বেষণে রত সবাই সংসারে,
পর-দুখে কেবা করে অশ্রু বরিষণ!
ধর্ম্মাধর্ম্ম, শাস্ত্রশস্ত্র, কেবল আচারে,
অন্তরে ধার্ম্মিক শাস্ত্রী নহে কোন জন।
দয়ার সাগর তুমি অনাথ সহায়,
অটল বাসনা তব দেশের মঙ্গলে,
সমাজে বক্তৃতা কর দেবতার প্রায়,
সদাহিত শিক্ষা দাও বান্ধব-মগুলে।
২৭
তবে কেন আজ তব বধির প্রবণ?
কেন নেত্রে নাহি আজ বিন্দু মাত্র জল?
দুখিনীর হাহা রবে ফাটিছে গগণ
কাঁদিতেছে তরুলতা সরসীর জল;
তুমি কেন শুষ্ক নেত্রে বসিয়া নীরবে?
নাহি চাও তার পানে নির্মুমের প্রায়?
কাঁদে না কি মন তব দুখিনীর রবে?
অথবা কারুণ্য-লেশ নাহিক তাহায়?
২৮
তাই যদি, হায় তব কি পাষাণ মন!
মূঢ় তারা, কহে যারা হিতৈষী তোমারে,
যশের কিঙ্কর তুমি, দয়া প্রদর্শন
কর সুধু খ্যাতি-লোভে রাজদরবারে।
জানি আমি সমাজের কঠিন বন্ধন,
জানি আমি প্রাচীনের নির্ম্মম আচার,
কিন্তু নিরখিলে এই রমণী-রতন
ইচ্ছা করে বিসর্জ্জিত পাপ দেশাচার।
২৯
নিষ্ঠুর সংসার-স্থানে কি যাচিব আর,
এই যাচি নরকূলে কে আছে এমন—
কে আছ নারীর দুখে অন্তর যাহার
ক্ষণেকের তরে হয় বিষাদে মগন।
সুদূর কানন মাঝে নিরজন স্থানে
শান্ত নির্ঝরিণী-তীরে ভূধরের মূলে,
বেষ্টিয়া বিটপীরাজি লতার বিতানে
নির্ম্মাইয়া দেহ কুঞ্জ ঘন তরুদলে।
৩০
দুখিনীরে ছেড়ে দাও কুঞ্জের ভিতরে,
কাঁদুক মনের সাধে দিবস-রজনী,
বাঁধিয়া চরণ আর রেখোনা উহারে
সুখের সংসারে করি চির অভাগিনী।
ছেড়ে দাও এই দণ্ডে, ক্ষণেকের তরে,
রেখোনা উহারে আর করিয়া বন্ধন,
সহে কি এ ব্যথা তার কোমল অন্তরে
দুখিনী রমণী বড় যতনের ধন।