চিত্ত-মুকুর/আশা তৃষ্ণা প্রণেশ্বরি কর বিসর্জ্জন

আশা তৃষ্ণা প্রাণেশ্বরি কর বিসর্জ্জন।[]


মুছিয়া নয়ন জল গবাক্ষ খুলিয়া
দেখিনু নবীন ভানু হাসিছে গগনে,
নিশার শিশিরে স্নাত,  পাদপ লতিকা যত,
দুলিছে সুমন্দ ভাবে, প্রভাতি পবনে,
সুশীতল ধরাতল ঊষার মিলনে।


নিবিড় তরুর তলে শ্যাম দূর্ব্বাদলে
পড়িয়া শীতল ছায়া শান্তি-স্বরূপিনী,
বৃন্তে বৃন্তে ফুল গুলি,  আনন্দে পড়েছে ঢলি,
অদূরে উঠিছে ধীরে মানবের ধ্বনি,
বোধ হইল যেন আজ নবীন ধরণী।


দেখিনু শিশির বিন্দু গোলাপের দলে
কিরণে উজ্জ্বল হয়ে ঢল ঢল করে,
গোলাপ পড়িল হেলে,  শিশির পড়িল ঝুলে,

দেখিতে দেখিতে বিন্দু খসিয়া পড়িল,
সূক্ষ্ম বৃন্তে চারু পুষ্প নাচিয়া উঠিল।

8


সুন্দর রজনীগন্ধা ফুটিয়া শাখায়,
ভ্রমর নিস্পন্দ-কায় বসিয়া তাহায়,
বাতাসে নড়িল শাখা,  ভ্রমর খুলিয়া পাখা,
উড়ে বসে, ব’সে উড়ে, পুন উড়ে যায়,
স্থির হৈল শাখা অলি বসিল তাহায়।


উদ্যানের প্রান্ত ভাগে দেখিনু প্রাসাদ
নিদ্রিত যেন বা, সব রুদ্ধ বাতায়ন,
সৌধ-শিরে স্বর্ণপ্রভা,  পড়েছে তারুণ আভা,
ক্ষুব্ধ চিত্তে স্থির দৃষ্টি হইল নয়ন,
ইষ্টকে ইষ্টকে যেন আকর্ষিল মন।


ছিল আশা এক দিন উহার ভিতরে
ওই কক্ষে ওই রুদ্ধ গবাক্ষ সদনে,
বক্ষে করে বাসন্তীরে,  মুখচন্দ্র করে ধরে,
বলিব মনের সুখে চুম্বিয়া বদনে,
কত আশা তার তরে জড়ায়েছি প্রাণে।


ছিল আশা একদিন পূর্ণিমা নিশিতে
প্রিয়ার কোমল কর চাপি করতলে,
ওই চারু পুষ্পেদ্যানে,  বেড়াইব দুই জনে,
তুলিয়া কুসুম রাশি প্রিয়ার অঞ্চলে,
দুজনে গাঁথিব মালা বসি তরু তলে।


ছিল আশা——ওই ছাদে নীরব নিশিতে
যামিনী নিস্তব্ধ হলে বসিব দুজনে,
প্রেয়সী গাহিবে গান,  শুনিয়া যুড়াব প্রাণ,
কভু বা মিশায়ে গলা গাব দুই জনে,
দুর্লভ সে সুখ হয় বাঙ্গালি-জীবনে?


ছিল আশা—বাতায়ন হইল মোচন,
পল্যঙ্কে রমণী-মূর্ত্তি!——চিনিনু কাহার,
দ্রুত তড়িদ্দাম মত,  শিরায় শোণিত স্রোত
বহিল ছুটিল বেগে নয়ন আসার,
অশ্রু-নেত্রে দেখিলাম বাসন্তী আমার।

১০


বিষাদিনী বেশ——চূর্ণ আবদ্ধ কুন্তল,
নয়ন সজল মুখ বিষাদ গম্ভীর,

চাপি বক্ষ উপাধানে,  পূর্ণ দৃষ্টি শূন্যপানে,
দুই বিন্দু অশ্রু দুই নেত্র কোলে স্থির
পদ্ম দলে যেন দুই বিলম্ব শিশির।

১১


অকস্মাৎ বাহ্য জ্ঞান হৈল অন্তর্ধান,
অকস্মাৎ মুক্ত হৈল হৃদয়ের দ্বার,
অবস ইন্দ্রিয় চয়,  হইল বাসন্তী-ময়,
হইল সহসা মোহ জীবনে সঞ্চার,
বাসন্তি! বাসন্তি! বলি করিনু চীৎকার।

১২


ভাসি প্রাতঃ সমীরণে বাসন্তী শ্রবণে
প্রবেশিল সেই শব্দ—উঠিয়া ত্বরিত,
দাঁড়ায়ে গবাক্ষ ধারে,  নিরখিল অভাগারে,
নেত্রে নেত্রে পরস্পরে হইনু বিম্বিত,
ক্ষিপ্ত হৃদয়ের স্রোত হইল স্তম্ভিত!

১৩


সপ্তম বৎসর আজ দেশ দেশান্তরে
হেরিয়াছি যেই মূর্ত্তি প্রত্যেক স্মরণে,
যমুনা যাহ্নবী জলে,  শকটে বা বাষ্পকলে,
স্মরিয়া যাহায় অশ্রু ঝরেছে নয়নে,
সেই মূর্ত্তি এক দৃষ্টে চাহি মোর পানে।

১৪


সপ্তম বৎসর আজ যাহার কারণে
ত্যজি গৃহ পরিজন ভ্রমি দেশান্তরে,
জীব ধর্ম্ম উদ্‌যাপন,  করি আশা বিসর্জ্জন,
চিরদুখী উদাসীন আজ যার তরে,
সেই মূর্ত্তি দাঁড়াইয়া সম্মুখে অদূরে।

১৫


তেমতি সরল দৃষ্টি শৈশবের মত
কেবল যৌবনস্পর্শে অধিক উজ্জ্বল,
অর্থশূন্য দরশন,  লজ্জাশূন্য চন্দ্রানন,
দেখিতে দেখিতে নেত্রে উথলিল জল,
অবরুদ্ধ দুখে প্রাণ হইল চঞ্চল।

১৬


বুঝে নাই প্রেম মম এখনো সরলে,
বুঝিবে না এ জনমে নাহি প্রকাশিলে,
হায়রে রমণী-মন,  এত অন্ধ কি কারণ!
বুঝে না প্রণয় কেন নাহি বুঝাইলে,
ভাবে না ভাবনা নাহি প্রকাশ করিলে!

১৭


স্বল্প দিন হৈল গত দুইটি বৎসর,
ভাবী দম্পতীর মত ছিলাম দুজনে

সেই দীর্ঘ দ্বিবৎসরে,  কভু কি মুহূর্ত্ত তরে,
উঠে নাই প্রেম চিন্তা বাসন্তীর মনে,
পতিভাবে ভাবে নাই কভু কি নির্জনে!

১৮


আশার একটি বর্ণ বলিনি তখন,
এই পরিণাম হবে কেই বা জানিত,
প্রেমপূর্ণ দুনয়নে,  দেখিতাম চন্দ্রাননে,
জীবনের সুখ স্বপ্ন-কিন্তু কে ভাবিত
দশম বর্ষীয়া বলা অবোধ যে এত!

১৯


অথবা বিস্মৃতি, যদি তাহাই নিশ্চয়,
খুলিব না সরলার স্মৃতির দুয়ার,
আপনি কাঁদিব দুখে,  বাসন্তী ত রবে সুখে,
সেই চিন্তা সুখময়ী হইবে অপার,
সরল অন্তরে ব্যথা দিব না তার।

২০


কিন্তু কেন অশ্রুমুখী? কি দুখ অন্তরে,
প্রেম যদি নয় তবে অশ্রু কেন ঝরে?
বাজার নন্দিনী মত,  ভুঞ্জে সুখ অবিরত
এত সুখে সুখী যেই, তাহার অন্তরে,
প্রেম-চিন্তা বিনা কোন দুখে অশ্রু ঝরে?

২১


জিজ্ঞাসিব ভাবি পুন দেখিনু চাহিয়া,
উথলিয়া পড়ে অশ্রু উজ্জ্বল নয়নে,
অঞ্চলে মুছি নয়ন,  রুদ্ধ কৈল বাতায়ন,
মূর্খ আমি—প্রেম ইহা অন্তরে গোপনে
গলিয়া গলিয়া আজ ঝরিল নয়নে।

২২


রুদ্ধ গবাক্ষর পানে রহিনু চাহিয়া,
ভাবিনু আবার মুক্ত হবে বাতায়ন,
ছুটিল উন্মত্ত মন,  করিবারে উদ্‌ঘাটন,
নির্দ্দয় কঠিন কাষ্ঠ একটু মোচন,
হইল না দেখাইতে বাসন্তী-বদন।

২৩


আবার সন্ন্যাসী হ’ব বাসন্তীর তরে,
এ জীবনে এ সংসারে ফিরিব না আর,
বাসন্তীর মূর্ত্তি গড়ে,  নিরজনে বক্ষে করে,
গোপনে কাঁদিব সুখে চুম্বি অনিবার,
এ জীবনে বাসন্তী ত হবে না আমার!

২৪


ভাল বেসে থাক যদি দুখিনী সরলে,
জনমের মত তবে হও বিস্মরণ,

বুঝেছি এ জন্মে আর,  হইব না কেহ কার,
আশা মাত্র—চিন্তা মাত্র—অনন্ত জীবন,
আশা চিন্তা প্রাণেশ্বরি কর বিসর্জ্জন।


  1. এরূপ কবিতা যে দুই একটি গ্রন্থ মধ্যে আছে গ্রন্থ- কারের নিজের সহিত ইহাদের কোন সম্পর্ক নাই।