চিত্ত-মুকুর/অকাল কোকিল
অকাল কোকিল।
১
কে বলে নাহিক আর বঙ্গের ভবনে
মধুর নিনাদী পিক, নীরব সে ধ্বনি
কাঁদাইয়া গৌড় জনে শ্রীমধু সূদনে
হরিল ভুবন-ত্রাস শমন যখনি।
নগরের প্রান্তভাগে উন্নত বদনে
অই যে উল্লাসে পিক মধুর ঝঙ্কারে,
“ভারত সঙ্গীত”রাগ সুগম্ভীর তানে
“আর ঘুমাওনা” বুলি জাগায় সবারে।
২
কাব্য বিটপীর শাখে বসিয়া বিরলে
মরি কি মধুর সুরে সুললিত গায়!
কখন আনন্দ ভূরে, কভু অশ্রুজলে
ঢালিয়া সঙ্গীত-স্রোত জগত ভাসায়,
অকাল কোকিল আহা অযত্ন লালিত,
সুবর্ণ পিঞ্জরে বদ্ধ ব্রিটিশ-প্রাঙ্গণে,
সভয়ে মনের ত্রাস না হয় স্ফুরিত
না পারে ভ্রমিতে সুখে সাহিত্য-কাননে।
৩
আজ যদি সেই দিন হ’ত সে কানন
বেদব্যাস কালিদাস বাল্মিকী যেখানে
অবাধে গাহিল গান পূরিয়া গগন,
হিমাদ্রি কুমারী যুড়ি পূরিল নিক্কণে।
কিম্বা সেক্ষপীর যথা বিমোহন স্বরে
ছুটাইল সঙ্গীতের তরঙ্গ প্রবল,
বাইরণ্ মিলটন্ যথা স্বাধীন অন্তরে
গাহিল ললিত স্বরে সঙ্গীত অমল,
8
সে বসন্ত হ’ত যদি, হত সে কানন,
সে সুখ তটিনী যদি রহিত হেথায়,
চরণ শৃঙ্খল যদি হইত মোচন
বুঝিতাম অই পাখি কি মধুর গায়।
অন্তরে মরম দুখ পরাণে যাতনা
পরের প্রসাদ ভোজী অনার্য্য ভবনে,
ফুটালে ফুটেনা ত্রাসে মনের বাসনা
তুষিবে সবার মন সঙ্গীতে কেমনে!
৫
একবার খুলে দাও চরণ শৃঙ্খল
সাজাও তেমতি করে বঙ্গের ভবন,
ফুটাও তেমতি করে জাহ্নবীর জল
সেই রবি শশী শূন্যে করুক প্রমণ।
শান্তির নিকুঞ্জ করি সন্তোষ লতায়
সরস বসন্তে ডাক করিয়া যতন,
তুলিয়া প্রমোদ কলি গাঁথিয়া মালায়
উল্লাস চন্দন তায় করিয়া লেপন—
৬
নিকুঞ্জের চারি ধারে দোলাও যতনে,
শুনিবে তখন পাখি কি মধুর স্বরে
গাহি সুললিত গান হতাশ, শ্রবণে
বর্ষিয়া পীযুষাসার তুষিবে অন্তরে।
হায় রে সে সাধ পূর্ণ হবে কি কখন!
সরস বসন্তে কভু এ বঙ্গ ভিতরে
মাতায়ে আমার মন—মাতায়ে ভুবন
গাহিবে কি পিক আর বিমোহন স্বরে!
৭
হবে না সে সাধ পূর্ণ, শুনিব না আর
পরাণ মাতান গীত কোকিলের স্বরে,
গাও তুমি পিকবর তোমারি ঝঙ্কার
শুনিব আনন্দ ভরে উল্লাস অন্তরে,
নিরব এ বঙ্গে আজ তব কুহুম্বরে
হাসিব কাঁদিব কিম্বা মাতিব হরষে,
জাগে যদি আর্য্যাবর্ত্ত౼তোমারি ঝঙ্কারে
সিন্ধু হতে ব্রহ্ম খত্র জাগিবে উল্লাসে।
৮
হৃদয়ের তুষানল নয়নের জলে
নিবায়ে আনন্দ মনে গাহ একবার,
দুখী বঙ্গবাসী প্রাণে গীত রস ঢেলে
শুষ্ক হৃদয়েতে কর সুধার সঞ্চার।
বন্দী যথা রুদ্ধ বাসে নিবান্ধব পুরে
সুদূর কোকিল কণ্ঠে জুড়ায় যাতনা,
তেমতি এ বঙ্গবাসী তব সুধাস্বরে
ভুলিবে ঈষৎ ভাবে দাসত্ব যাতনা।