চিত্ত-মুকুর/হৃদয়ে হৃদয়ে যদি সম্ভবে উত্তর

হৃদয়ে হৃদয়ে যদি সম্ভবে উত্তর।[১]


হৃদয়ে হৃদয়ে যদি সম্ভবে উত্তর
তবে কেন নাহি বুঝে সে আমার মন।
হৃদয়ের তারে তার   বাজিছে সঙ্গীত যার
সে কেন বুঝে না তার একটি বচন!
নীরবে চীৎকার করে,  ডেকেছি অন্তর ভরে
তথাপি তুলিয়া আঁখি দেখেনি কখন
নীরব উত্তর হায়—প্রেমের স্বপন!


হৃদয়ে হৃদয়ে আর, নয়নে নয়নে।
হায়রে সম্ভব যদি হইত উত্তর
সে অতুল রূপ রাশি,  সে অমিয়মাখা হাসি
হেরিলে ছুটিত আশা প্রাণের ভিতর।
উজ্জ্বল নয়নে তার,  সুনীল তারার পানে
দেখিলে বিদ্যুৎ বেগে নাচিত অন্তর
অমনি আদর করে, সঁপিয়াছি প্রাণ মন
তবুত বুঝেনি তার একটি বচন


সে যদি বুঝেন তবে কেন আশা তার?
“কেন আশা তার”—হায় হায়রে নিষ্ঠুর!
ভাসায়ে দিয়েছি মন যে প্রেমের স্রোতে
যেই প্রেমে আজ মম জীবন মরণ!
তেয়াগি সংসার সুখ,  অন্তরে উদাসী হয়ে
লুকায়ে অন্তরে যারে করি দরশন
কোন্ প্রাণে আশা তার দিব বিসর্জ্জন?

8


দিব বিসর্জ্জন—কিন্তু কিছু দিন পরে
নহে কিন্তু মধু মাখা প্রণয় তাহার
অন্তরে অন্তরে যাহা,  জীবনের স্রোতসহ
বহিয়া বহিয়া আজি হইল অপার
এ জীবনে সেই প্রেম শুকাবে না আর।
বারেক গোপনে তারে,  বলিব প্রাণের দুঃখ
তথাপি সে যদি নাহি হয় রে আমার,
প্রাণ সহ বিসর্জ্জিব দুরাশা তাহার।


নিষ্ঠুর ভাবনা কিন্তু;౼ জাগ্রতে স্বপনে
যেই শশী-মুখ খানি বাসিয়াছি ভাল

তৃষিত চাতক মত, যার প্রেম আস্বাদনে
যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে ভ্রমিনু সংসারে,
যে নিবিড় তনুখানি,  নিরখি শিহরি প্রাণ
ছুটিত উন্মত্ত হয়ে হৃদয়ে রাখিতে
হেন মধুমাখা আশা  হেন জীবনের সুখ
জনমের তরে কিরে হবে বিসর্জ্জিত!


বিসর্জ্জিতে হবে যদি  দেখিলাম কেন?
দেখিলাম যদি—কেন বাসিলাম ভাল!
বুঝে হৃদয় তার,  কেন প্রাণ আপানার
দিলাম ভাসায়ে তার রূপের প্রবাহে,
এতই তরঙ্গ যদি বিরাজিছে তাহে?
বসন্ত মারুত মত,  ছড়ায়ে যৌবন রাশি
প্রণয়ের দেবীরূপে সম্মুখে যখন
দাঁড়াইল, কেন নাহি মুদিনু নয়ন!


নিষ্ঠুর বিধাতা! কেন খণ্ডিলে লিখন,
সুখের সম্বন্ধ সেই প্রেমের অঙ্কুর?
কেন ভাঙ্গি সে রতনে,  সমর্পিলে অন্য জনে?
হায় রে সে যদি আজ হইত আমার!

বক্ষঃস্থলে রাখি তারে,  দিবানিশি দুনয়নে
হেরিতাম শুধু তার রূপের ভাণ্ডার,
ক্ষুধা তৃষ্ণা নিদ্রা ভুলি;  শুধুই অলকা গুলি
সরায়ে বদন খানি চুম্বিতাম তার!


বলরে সমাজ তুমি উন্মাদ আমারে—
পাপ দেশাচার তুমি কর তিরস্কার—
বলিব চীৎকার করে,  শুনুক জগত আজ
পাপের সম্পর্ক নাই এ প্রেমে আমার।
পবিত্র অন্তরে তারে,  কেন না বাসিব ভাল
পাপ-শূন্য প্রেম হয় নাহি কি ভুবনে?
এ স্বর্গীয় প্রেম মম,  বুঝিবে না এ সংসারে
নিষ্ঠুর নরক সম সমাজ যেখানে।


কেন না বাসিব ভাল—কেন দেখিব না
অতুল যে রূপখানি নিখিল ভুবনে?
সুন্দর গোলাপ মত,  শুধু যদি দেখি তারে,
নিষ্ঠুর সমাজ! বল কি দোষ তাহায়?
সুন্দর রতন ভাবি,  চুম্বিলে অধর তার
বিকচ নলিনী ভাবি, রাখিলে হৃদয়ে

জুড়ায় হৃদয় যদি, কি ক্ষতি সমাজ তোর,
কি দোষ তাহাতে হায় বল না আমায়?

১০


দেখিব—বাসিব ভাল জীবনে সতত
বিসর্জ্জিব প্রাণ যদি হয় প্রয়োজন;
কিন্তু দিনেকের তরে,  হবে নাকি সে আমার
লভিব না কিরে তার একটি চুম্বন!
হৃদয় বিদীর্ণ হও,  তাই যদি থাকে ভালে,
কেন মৃগতৃষ্ণিকার কর অন্বেষণ!
দেখ রে জগত আজ,  হৃদয় বিদীর্ণ করি
সহিয়াছি কত ব্যাথা তাহার কারণ;

১১


সেও যদি বাসেল-হায় রে দুরাশা!
সেও বাসিয়াছে ভাল-হায় রে স্বপন!
কেমনে বুঝিলে তুমি,  সেও বাসিয়াছে ভাল?
সেই দৃষ্টি? সেই লজ্জা? সেই সে বচন?
সকলি সরল সে যে,  কোথায় প্রণয় তার?
তুমি ভাল বাস বলে, মধুর তেমন।
বিশাল জগতে আজ  কে আছে সুহৃদ্‌ হেন
কে দিবে বলিয়া তার হৃদয় কেমন!


১২


এক দিন সঙ্গোপনে ডাকিয়া তাহায়
আছাড়ি চরণে পড়ি,  বলিব মনের দুঃখ।
কিন্তু সেই ভাষা হায় পাইব কোথায়?
কত দিন, কত বার  বলিব বলিব ভাবি,
হৃদয়ের কথাগুলি তুলেছি বদনে
নিষ্ঠুর শরম হায়!  চাপিয়া ধরিত মুখ,
মথিত হইত প্রাণ অন্তর বেদনে,
তথাপি সে কথা হয় ফুটেনি বচনে।

১৩


এস তবে শশধর নামিয়া ভূতলে,
লিখেদিই তব অঙ্গে দুইটি চরণ,
হেরিলে তোমার পানে,  পড়িবে নয়নে তার
প্রাণের লুকান কথা, বুঝিবে বেদন।
এস চিত্রপট, লিখি,  তোমার চরণ তলে,
এত অন্ধ কেন, হায় রমণীর মন।
হেরিবে যখন তোরে  হয়ত বুঝিবে হায়
কে লিখিল—কে কাঁদিল—তাহার কারণ।

১৪


আবার আবার মন কেন সে দুরাশা
নহে তাহা ভাল বাসা—নহে তাহা প্রেম।

কেন দুঃখী জিজ্ঞাসিত  হৃদয় কোমল বলে।
হৃদয় কোমল বলে করিত যতন।
কিন্তু সেই দীর্ঘ শ্বাস?—স্থির হও মন।
তবে কি সে বাসে ভাল আমার মতন?
সেই দীর্ঘ শ্বাসে কিন্তু  হৃদয়ের সিন্ধু মম
করিয়াছে আকুলিত জন্মের মতন।

১৫


“কেন দুঃখী?”—হা হৃদয়! পাষাণ পরাণ
কেন না বিদীর্ণ হলি সম্মুখে তাহার,
কেন দুঃখী সুবদনে?  বস তবে এই খানে,
কি দুঃখ আমার মনে বলিব এবার,
কোথা হতে এ অনল,  বলিব কে দিল জ্বালি,
বারেক তাপিত বক্ষেঃ এস এক বার,
বারেক হৃদয়ে ধরি,  বারেক চুম্বন করি,
দেখাব চিরিয়া প্রাণ কি দুঃখ আমার।

১৬


কি দুঃখ আমার মনে বলিব তোমায়-
প্রকৃতি গম্ভীর হও,  পবন নীরবে বও,
যামিনী আঁধার হও, ডোব শশধর,
নীরবে হৃদয়’পরে,  চাপিয়া শ্রবণ তার

বারেক শয়ন কত মুহূর্ত্তের তরে,
হৃদয়ের তারে তারে  বাজিছে দুঃখের গীত,
শুনিবে এখনি, মৃদু প্রতিধ্বনি তার,
বুঝিবে জীবনে মোর সঙ্গীত কাহার


  1. গ্রন্থ মধ্যে এরূপ যে দুই একটি কবিতা আছে, গ্রন্থকারের সহিত তাহাদের কোন সম্পর্ক নাই। অনাদীয় জীবনের ঘটনার সহিত সম্পর্ক থাকিতে পারে।