চিত্ত-মুকুর/সমর সাহীর বিদায়

সমরসাহী-বিদায়।

মধুর সায়হ্নে, প্রমোদ উদ্যানে,
সরসী-সলিলে, সঙ্গিনীর সনে,
সুবর্ণ তরীতে, হরষিত চিতে,
চিতোরের রাণী পৃথা বিহরে।


হৃদয়ের হর্ষ বিকাশে নয়নে,
চারু মৃদু হাসি ফুটিছে বদনে,
কুঞ্চিত কপোলে, যৌবন উথলে,
রজতের দাঁড়, শোভিছে করে।


মত্ত হংসরাজ, গ্রীবা উচ্চ করি,
আসিছে সাঁতারি, পরশিতে তরী,
তরী বহি যায়, ধরিতে না পায়,
উঠে হাস্যধ্বনি, রমণী-মণ্ডলে।

8


হেন কালে আসি এক সহচরী,
কহিলেক উচ্চে আন কূলে তরী,
চিতোর-রাজন, রাজ্ঞী দরশন,
আশয়ে দাঁড়ায়ে, তরুর তলে।


চিতোর-রাজন!—বলি মৃদু স্বরে,
ত্যজি দাঁড় পৃথা, দাঁড়াইল ধীরে,
সোপান তরীতে, নাহি পরশিতে,
ত্বরিত চরণে উঠিল তীরে।


দূরে তরু-তলে, চাহি সরঃ পানে,
ভ্রমিছে সমর সুমন্দ চরণে,
বিষন্ন বদন, নিষ্প্রভ নয়ন,
ম্লান ভানু যেন অস্তের শিরে।


নিরখি সে বেশ হইয়া উতলা,
প্রাণেশের পাশে ছুটিলেক বালা,
কুণ্ডল সঘনে, দুলিল পবনে,
হেরিল সে বেশ রাজন ফিরে।


“নাথ” বলি বক্ষে জড়ায়ে অমনি,
তরুর শাখায় যেমতি ফণিনী,
চাহি মুখ পানে, কাতর বচনে,
জিজ্ঞাসিল কেন মলিন বেশ।


চুম্বিয়া ললাটে, চুম্বিয়া নয়ন,
বিষাদ, গম্ভীরে কহিল রাজন,
“বুঝিবে কি পৃথে, কি ভাবনা চিতে,
রমণী কি বুঝে বীরের ক্লেশ?”

১০


“নারীর হৃদয়, সুধুই কোমল,
প্রেম অভিমান অভিনয়-স্থল,
সমর ভাবনা, প্রেয়সি জান না
বুঝিবে না তুমি চিন্তা আমার।”

১১



“সঙ্গিনীর সনে, সরসী-সলিলে
ভাসি তরি’পরে বড় সুখে ছিলে,
কায নাই শুনে, কি ভাবনা মনে,
চাহি না হরিতে সুখ তোমার।”

১২


“চাই না হরিতে সুখ আমার!
তবে কি হে নাথ, তবে কি আবার,
যাইবে যুঝিতে, যবনের সাথে,
তাই চিন্তাকুল সমর স্মরিছ!”

১৩


“কিন্তু নাথ আমি তোমার রমণী,
দিল্লী-অধিপতি, পৃথুর ভগিনী,
ছার ম্লেচ্ছুরণে, রব তব সনে,
কি চিন্তা?౼আমি কি সমরে ডরি!”

১৪


“নিত্য তুমি যাও করিবারে রণ
নিরখিয়া আমি করিয়া যতন
শিখেছি সমর, দেখ প্রাণেশ্বর!
মম রঙ্গভূমি, কুঞ্জ ভিতরে।”

১৫


“অসি যুদ্ধ করি প্রমীলার সনে,
শৈলবালা সাথে যুঝি ধনুর্ব্বাণে,
সুকোমল-কায়, ভেবোনা পৃথায়,
পৃথা আর নাহি ডরে সমরে।”

১৬


“হাসিয়া রাজন প্রমোদের ছলে,
অঙ্গুলি প্রহারি সুগোল কপোলে,
চারু কর ধরে, কহিল গম্ভীরে,
যাব দিল্লীধামে এই নিশাতে।”

১৭


“শিখেথাক রণ, হইয়াছে ভাল,
শিখ ভালকরে আর কিছু কাল,
যদি রণে পড়ি, তুমি অসি ধরি,
রক্ষিও চিতোর সঙ্গিনীসাথে।”

১৮


“বিদায় প্রেয়সি! দেহ আলিঙ্গন,
বাঁচি যদি রণে পাবে দরশন”
চুম্বিল কপোল, চুম্বিল কুণ্ডল,
চুম্বি ওষ্ঠ পুনঃ বলি “বিদায়।”

১৯


ফিরায়ে নয়ন যেই অগ্রসর
অমনি ত্বরিতে ধরে পৃথা কর,
সজল নয়নে, চাহি ক্ষিতি পানে,
রহিল বিষাদে বিহ্বল প্রায়।

২০


ক্ষণেকের পরে মুছি নে নীরে,
ত্যজি দীর্ঘ শ্বাস বলে ধীরে ধীরে,
“কেন আজ হেন, কেঁদে ওঠে মন,
অশুভ ভাবনা কেন বা হয়!”

২১


“নহে নাথ আজ প্রথম বিদায়,
কত শত বার পাষাণীর প্রায়,
এই কর ধরে এই নে নীরে,
দিয়াছি বিদায় ত্যজিয়া ভয়।”

২২


“স্বহস্তে পরায়ে দিয়েছি বর্ম্মণ,
বাঁধিয়া দিয়েছি নিজে সারসন,
শিরে শিরস্ত্রাণ পৃষ্ঠে ধনুর্ব্বাণ,
তখন ত এত কাঁদেনি মন।”

২৩


“আজ কেন নাথ হেন অলক্ষণ!
পাষাণীর কেন ঝরিল নয়ন!
কে যেন অন্তরে, বলিতেছে ধীরে,
‘ভাঙ্গিল রমণী কপাল তোর।’

২৪


“না না নাথ আজ একাকী-তোমারে,
দিব না যাইতে দুর্ব্বার সমরে,”
বলিয়া ত্বরিতে কটিদেশ হ’তে
খুলিয়া লইল প্রখর অসি।

২৫


বাম করে অসি করিয়া গ্রহণ
কহিল গম্ভীরে সমররাজন,
“এ কি ভাব পৃথে, এত ভয় চিতে,
এত ভীরু আজ কেন প্রেয়সি?”

২৬


“কোথা আজ তব সমরের আশা?
কোথা তব সেই তেজস্বিনী ভাষা?
ভুলিলে সকল? ছি ছি নেত্রে জল!”
মুছাইল নেত্র যতন করি।

২৭


“নহে নাথ ইহা অমূল লক্ষণ”
বলি পৃথা ধীরে তুলিল নয়ন,
সরায়ে কুন্তল, মুছি নেত্র-জল,
গ্রীবা উচ্চ করি দাঁড়াল সরি।

২৮


“অমূল এ ভয় নহে কদাচন,
অকারণে বক্ষ কাঁপেনি কখন
প্রাণেশের কর রাখি বক্ষেপির
“দেখ নাথ হৃদি সঘনে কাঁপে।”

২৯


“নারী আমি কিন্তু হৃদয় আমার
নহে প্রাণেশ্বর! শিশু বালিকার,
শত শত বার, কঠিন প্রহার,
সহেছি কখন তবু না তাপে।”

৩০


“দেখেছি দাঁড়ায়ে প্রাসাদ শিখরে
রণ-বেশে তোমা অশ্বের উপরে,
পার্শ্বে শক্র দল, করে কোলাহল,
তবু তিল মাত্র কাঁদেনি মন।”

৩১


“কোথা দিল্লী কোখা চিতোর নগর!
কোথায় যবন কবে বা সমর!
আজ অকস্মাৎ, কেন প্রাণনাথ?
বালিকার মত ঝরে নয়ন?”

৩২


“নিষেধ করি না করিতে গমন,
যাও প্রাণেশ্বর কর জয় রণ।
কিন্তু যে বিষাদে, আজ প্রাণ কাঁদে,
দুখিনীর ভালে যদি তা ফলে”-

৩৩


“জনমের মত হ’ল উদ্‌যাপন
জীবনের ব্রত, শেষ দরশন,
কিন্তু ভেবে মনে, রণে প্রতিক্ষণে,
দুখিনীরে এই নয়ন-জলে।”

৩৪


“কি বলিব আর ক্ষত্রিয়-রমণী
কি বলিবে নাথ সহজে পাষাণী;
অন্তর পুড়িবে নয়ন ঝরিবে,
নাহি নিষেধিবে পতিরে রণে।”

৩৫


মস্তকের কেশ করিয়া ছেদন,
কৃপাণের গলে করিয়া বন্ধন;
“এই চিহ্ন নাথ লহ তব শাথ,
আর যত চিহ্ন রহিল মনে!”

৩৬


“নারীধন্য তুমি” বলিয়া রাজন,
বাম করে অসি করিয়া গ্রহণ
ত্বরিত চরণে, চলিল তোরণে,
পৃথার অমনি ঝরিল আঁখি।

৩৭


দৃষ্টির অতীত হইলে রাজন,
ত্যজি শ্বাস পৃথা তুলিল নয়ন,
বসি জানু’পর, যুড়ি দুই কর,
চাহি ঊৰ্দ্ধ পানে কহিল ডাকি౼

৩৮


“হে অনাথনাথ! কেন কাঁদে মন?
দুখিনীর ভাগ্যে কি আছে লিখন!
কেন অমঙ্গল, ভাবনা কেবল?
উথলিছে আজ হৃদয়ে মম!”

৩৯


“দুর্ব্বল করিয়া গঠিলে রমণী,
পুনঃ দুঃখ দিতে বীরের পতিনী,
ঢালিয়া প্রণয়, গঠিলে হৃদয়,
পাষাণের বক্ষে কমল সম।”

৪০


“শিখাইলে নাথ সুধু ভাল বাসা
পতির সোহাগ সুধু এক আশা,
মিলনে হাসিতে, বিরহে কাঁদিতে,
কন্দুক-বিলাসী শিশুর মত।”

৪১


“শিখায়েছ যাহা শিখেছি যতনে,
টেলেছি হৃদয় পতির চরণে,
জীবন সম্বল, পতিই কেবল,
তবে কোন্ দোষে যাতনা এত?”

৪২


“রমণী-হৃদয় সৃজিত তোমার,
কিন্তু নাথ তুমি যাতনা তাহার,
পার না বুঝিতে, পাও না দেখিতে,
নারীর যাতনা বিষম কত।”

৪৩


“সাগরের বক্ষ গিরির গহ্বর,
নহে নাথ এত নিভৃত প্রান্তর-
ভীষণ শ্মশান, আরণ্য বিতান,
নহে এত শূন্য—এ প্রাণ যত।”

88


“এত ক্ষুদ্র কিন্তু বিশাল এমন,
কোমল অথচ ইহার মতন
দারুণ কঠিন, দারুণ প্রবীণ,
সৃজিয়াছ কিবা জগতে আর।”

৪৫


“বল জগদীশ জীব-লীলা-স্থলে,
কাঁদিতে কি সুধু রমণী সৃজিলে?
আশা-পূর্ণ মন, করিয়া সৃজন,
সহিষ্ণুতা শিক্ষা সুধুই তার!”

৪৬


সহসা ত্বরিতে মুছিয়া নয়ন
দাঁড়াইল পৃথা বিস্ফারি লোচন,
আবদ্ধ কুন্তল, আরক্ত কপোল,
উন্নত উরসে স্খলিত বাস।

৪৭


স্থল-কমলিনী উন্নত শাখায়,
প্রভায় ভানুর কাঞ্চন আভায়,
শোভিয়া যেমন, নিরখে গগণ,
উছলিয়া দলে ভানুর আস।

৪৮


নিরখি তোরণ কহিল গম্ভীরে
“ধীরের প্রতিজ্ঞা কখন কি ছিঁড়ে?
রে অশান্ত মন, ভ্রান্ত কি কারণ,
কবে দেখিয়াছ ফিরিতে তাঁয়!”

৪৯


“কে বলে দুশ্ছেদ্য নারীর প্রণয়,
নাহি বাঁধে যদি ধীরের হৃদয়,
(পুরুষ ত সেই, রণ-প্রিয় যেই,
বীর বনা প্রেম শোভয়ে কায়?)”

৫০


“অথবা প্রণয় দুর্ব্বল আমার,
নাহি শক্তি হৃদি বাঁধিতে তাঁহার,
কিবা সে প্রণয়, বীর বদ্ধ যায়,
কি সুখী সে নারী জানে যে তাহা।”

“ফিরিলে এ বার প্রাণেশ আমার
শিখিব বাঁধিতে হৃদয় তাঁহার।
হাব ভাব হাসি সঙ্গীত বা বাঁশী
শিখিব তাহার বাসনা যাহা।”