চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/তৃতীয় খণ্ড/বাংলার জাতীয় জীবনে গীতগোবিন্দের স্থান

বাংলার জাতীয় জীবনে
গীতগোবিন্দের স্থান

 বাংলার জাতীয় জীবনের সঙ্গে কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্য একান্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, এক-একটা যুগকে প্রভাবান্বিত করে যেমন এক-একজন মহাপুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন, তেমনি মানুষের এগিয়ে-চলার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক-একখানি বই; সেই এক-একখানি বই-এর ভেতর যে-আলো, যে-শক্তি জমা হয়ে থাকে, তা থেকে পরবর্ত্তী যুগ আলোকিত হয়ে ওঠে। যিশুর আবির্ভাবের আগে যেমন জন দি ব্যাপটিষ্ট এসে তাঁর আগমনের পথকে তৈরী করেছেন, চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগে যেমন এসেছেন অদ্বৈত আচার্য্য, ঠিক তেমনি এক-একটা যুগান্তরকারী আন্দোলনের আগে এসেছে এক-একখানি বই…সেই সব অগ্রগামী বাণীদূতের ভাব-বন্যায় পুরাণো জীর্ণ নোংরামি সব ভেসে গিয়েছে, নতুন করে তৈরী হয়েছে মানুষের মনের ক্ষেত্র, যার ফলে সম্ভব হয়েছে নতুন আন্দোলন।

 পৃথিবীর সমস্ত বড় আন্দোলনের ইতিহাসে দেখা যায় এই একই প্রক্রিয়া, সাহিত্য আগে এসে ক্ষেত তৈরী করেছে, তারপর সেই তৈরী ক্ষেতের ওপর গজিয়ে উঠেছে নতুন আন্দোলনের সবুজ শস্য। ফরাসী বিপ্লবের আগে তাই দেখি ভল্‌টেয়ার আর রুশোর সাহিত্য, রুশ-বিপ্লবের আগে দেখি গোগল থেকে আরম্ভ করে গর্কী পর্য্যন্ত সাহিত্যিকদের অবিরাম সাধনা, বাংলাদেশে স্বদেশী-আন্দোলনের আগে দেখি আনন্দমঠের সৃষ্টি, বন্দেমাতরম্ মন্ত্রের আবির্ভাব।

 ইংরেজ-আগমনের আগে পর্য্যন্ত বাংলার জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় বিপ্লব সংসাধিত হয় চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে। শাস্ত্র, পুঁথি আর জাতিভেদের অপব্যবহারে বাংলা যেদিন ভেতর থেকে প্রাণহীন, শক্তিহীন হয়ে ভেঙ্গে পড়ছিল, বাইরে থেকে যেদিন একটা প্রবল বিরুদ্ধ শক্তি সেই ভেতরের ভাঙ্গনের সুযোগ গ্রহণ করে সমস্ত দেশটার চেহারা বদলাতে চলেছিল, সেই সময় চৈতন্যদেব আচণ্ডাল সকল মানুষকে মানবতার সহজ অধিকারে আহ্বান করে এক মহান্ ধর্ম্ম-বিপ্লব নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর সেই বিপ্লবের অগ্রদূত—জয়দেব কবি এবং তাঁর রচিত অমরকাব্য গীতগোবিন্দ। গীতগোবিন্দের অক্ষরে অক্ষরে, তার সুরে, তার ছন্দে জয়দেব কবি সর্ব্বগ্লানি-শোধক প্রেমের যে পাবক শক্তির উদ্দীপন করলেন, চূর্ণ-বিগ্রহ জীবনের মন্দিরে প্রেমের অমর দেবতার যে নব-আরতি করলেন, তার প্রভাবে সেদিন বাংলার বিভ্রান্ত জনমানসে এক নতুন চেতনা জেগে ওঠে। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে গীতগোবিন্দের প্রভাব বুঝতে হলে, জয়দেবের সময়কার বাংলার জাতীয় ও সামাজিক জীবনের চিত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার।

 রাজনৈতিক পরাধীনতায় বাংলার জাতীয় জীবন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। পরাধীনতা বহু জাতির ভাগ্যে ঘটে কিন্তু সেই সময়কার পরাধীন বাংলার ছবি দেখলে বোঝা যায় যে, যে-জাতির সামাজিক জীবনে ব্যক্তিগত চরিত্রের মূল্য ও মর্য্যাদা নষ্ট হয়ে যায়, সে-জাতির পুনরুদ্ধারের আর কোন আশা থাকে না। একটা সমগ্র জাত তখন ধীরে ধীরে নির্বীর্য্যতার খাদের শেষতলের দিকে গড়িয়ে চলেছিল। এবং এই জাতীয় চরিত্রের অধোগতির সব চেয়ে বড় লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে যৌন-বিকারে ও ব্যভিচারে।

 জীবনের আর সব ক্ষেত্র থেকে সরে এসে, ধর্ম্মের আড়ালে তখনকার বাঙালীরা নিছক কামচর্চ্চা ও যৌন-লিপ্সার মধ্যে ডুবে ছিল। সমাজের উচ্চস্তরে চলেছিল তন্ত্র-সাধনার বিকৃতির ফলে নারী-মাংসের পংক্তি-ভোজন, সমাজের নিম্নস্তরে কোন আড়ালেরই প্রয়োজন ছিল না, প্রকাশ্য দিবালোকে পথেঘাটে চলতো সুরামত্তের আর বারাঙ্গনার দ্বৈতনৃত্য। যে-নদীয়ায় আসেন চৈতন্যদেব, সেই নদীয়ার গঙ্গার ঘাটে ঘাটে বসতো সুরাপায়ীদের আসর, বারাঙ্গনাদের উৎসব-সভা। এই যৌন-বিকার ও ইন্দ্রিয়-আসক্তির নির্লজ্জ প্রসারে ডুবে যেতে বসেছিল জাতির চেতনা। সেই সময় জয়দেব তাঁর অমর সঙ্গীতের ঝংকারে নিয়ে এলেন প্রেমের পাবক বাণী, মানব-জীবনের সামনে তুলে ধরলেন সঞ্জীবনী সুধা। তাঁর চরম বৈশিষ্ট্য হলো, এই আদর্শ তিনি তত্ত্বকথা বা উপদেশের ইষ্টকরূপে বিভ্রান্ত জনতার ওপর নিক্ষেপ করলেন না। জগতের শ্রেষ্ঠ কবি ও শিল্পীদের মত তিনি অন্তর থেকে জানতেন, যে-পিপাসায় বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ নিজের হাতে বিষ-পাত্র গ্রহণ করে, সে-পিপাসা মানুষের জীবনে একান্ত সত্য। সেই পিপাসার একমাত্র তৃপ্তি হলো, রসের আস্বাদনে। তাই মহাকবিরা রসের ভেতর দিয়ে যে সুধা পরিবেশন করেন, তার মূল্য শত উপদেশ গ্রন্থ বা তত্ত্বকথার গ্রন্থের চেয়ে বেশী। এই রসের মন্ত্র হলো সব চেয়ে বড় পাবক মন্ত্র।

 জয়দেব সেই রসের পাবক মন্ত্রে সেই সময়কার বাংলার তৃষ্ণা-বিভ্রান্ত চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে গেলেন। বর্ত্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে এক শ্রেণীর চিকিৎসক যেমন খাদ্যের ভেতর দিয়ে রোগ-চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, খাদ্যের ভেতরেই ওতপ্রোতভাবে থেকে যায় অসুস্থ দেহের প্রয়োজনীয় ঔষধ, তেমনি জগতের মহাকবিরা রসের ভেতর দিয়েই করেন ব্যাধিগ্রস্ত মানবতার চিকিৎসা। তাই প্রতিদিনের জগতের হিসাবী লোকেরা কবিদের রস-সাধনাকে যেখানে অবাস্তব বলে বিজ্ঞতার পরিচয় দেয়, জগতের বিজ্ঞ-লোকেরা সেখানে সুনিশ্চিত ভাবে জানেন মহাকবিদের এই রস-সাধনার মধ্যেই আছে সামাজিক ব্যাধির একান্ত প্রয়োজনীয় পরমৌষধি।

 তাই জয়দেবের গীতগোবিন্দ যেমন একদিক থেকে হলো কাব্যের রসঘনমূর্ত্তি; যে-প্রেম হলো জীবনের ধাত্রী, যাকে আলঙ্কারিকেরা বলেছেন আদিরস, সংস্কৃত ভাষায় সেই আদিরসের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ লিরিক কবিতা, তেমনি আর একদিক থেকে এই কাব্য তার আদি-রসেরই অপূর্ব্ব পাবক রসায়নে বাংলার চিত্তভূমিকে চিরকালের মতন সরস আর্দ্র করে দিয়ে যায়। পুঁথির শুষ্ক অনুশাসন আর বুদ্ধির বন্ধ্যা যুক্তিকে পরিত্যাগ করে পরবর্ত্তী যুগে চৈতন্যদেব প্রেম ও ভক্তির যে মহাবীর্য্য ও প্রাণ-ঐশ্বর্য্যকে জাগিয়ে তুললেন, সাহিত্যে তার ভিত্তি তৈরী করেন তিনজন কবি—বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ও জয়দেব।