চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/তৃতীয় খণ্ড/সাহিত্য হিসাবে গীতগোবিন্দ

সাহিত্য হিসাবে
গীতগোবিন্দ

 ভারতীয় সাহিত্য বলতে একদিন বোঝাত সংস্কৃত-সাহিত্য। হিন্দু-ভারতের সমস্ত সংস্কৃতি, প্রাণ ও মনের সমস্ত ঐশ্বর্য্য পড়ে আছে সংস্কৃতের অক্ষয় ভাণ্ডারে। রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের অভিশাপের ফলে এই বিরাট সাহিত্যের বিপুল অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সংস্কৃত-কাব্যের ইতিহাসে আমরা কালিদাস, ভবভূতি, মাঘ ইত্যাদি কয়েকজনের নাম ও কীর্ত্তির সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত, কিন্তু শত শত প্রতিভাবান্ কবি এই ভারতবর্ষে জন্মেছেন, যাঁদের রচিত গ্রন্থের আজ আর কোন নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন বহু কবি আছেন, যাঁদের হয়ত একটি শ্লোক পড়ে আছে, না হয় দুটী শ্লোক, কিন্তু সেই দু-একটী শ্লোকের ভেতরই তাঁদের অসামান্য প্রতিভার বিদ্যুৎ-দীপ্তি সহজেই চোখে পড়ে। এই বিরাট কাব্যের স্রোতস্বিনী যুগ যুগ ধরে অবিচ্ছেদ ধারায় প্রবাহিত হয়ে যেখানে এসে শেষ হয়েছে, সেখানে বিরাজ করছেন জয়দেব কবি। জয়দেবের পর যে সংস্কৃত ভাষায় কবি জন্মগ্রহণ করেননি, সেকথা বলছি না, জয়দেব হলেন সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্যের শেষতম প্রতিভাধর অমর কবি। জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্য সংস্কৃত সাহিত্য আর দেশজ প্রাকৃতভাষার সাহিত্যের সন্ধিক্ষণে বিরাজ করছে।

 গীতগোবিন্দের ভেতর যেমন একদিকে দেখা যায় বহুকাল বহমান সংস্কৃত ভাষার শেষ-বিবর্ত্তনের রূপ, তেমনি তার মধ্যে দেখা যায় নতুন বাংলা সাহিত্যের জন্মের সূচনা। গীতগোবিন্দের ভাষার সঙ্গে কালিদাস ভবভূতির ভাষার পার্থক্য পড়তে গেলেই চোখে পড়ে। গীতগোবিন্দের বহু শ্লোকে সংস্কৃত-ব্যাকরণের চিহ্ন প্রায়ই চোখে পড়ে না, দু-একটা অনুস্বার আর বিসর্গ বাদ দিলেই সেটা বাংলা ভাষার মতন শোনায়। সেই জন্যে সাহিত্যের ইতিহাসে গীতগোবিন্দ একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

 ভাষা-শিল্পী হিসাবে জয়দেব একদিকে অতুলনীয় কীর্ত্তি অর্জ্জন করেছেন। সংস্কৃত ভাষার শব্দ-বিন্যাসের মধ্যে যতখানি মাধুর্য্য ও ঐশ্বর্য্য থাকা সম্ভব, শব্দ-শিল্পী জয়দেব তা পরিপূর্ণমাত্রায় ফুটিয়ে তুলেছেন। স্থপতি যেমন বাটালির ডগায় কুরে কুরে পাথরকে মোলায়েম করে, জয়দেব তেমনি ভাবে প্রত্যেক অক্ষরটী কুরে কুরে বসিয়েছেন কিন্তু তাঁর প্রতিভার চরম বৈশিষ্ট্য হলো যে এই অতি দুরূহ কাজে কোথাও তাঁর বিন্দুমাত্র চেষ্টা ধরা পড়েনি। শ্রেষ্ঠ স্থপতির তৈরী অনুপম প্রস্তরমূর্ত্তির গায়ে যেমন কোথাও একটা বাটালির ক্ষীণতম আঁচড়ের দাগ দেখা যায় না, তেমনি জয়দেবের শ্লোকের শব্দ-বিন্যাসের মধ্যে কোথাও কবি-শিল্পীর চেষ্টার একটা ক্ষীণতম আঁচড়ের দাগও নেই।

 তাই গীতগোবিন্দের শ্লোকের মধ্যে বীণার ঝংকারের মত, নূপুরের গুঞ্জনের মত, একটা মধুর সুর আপনা থেকে বেজে উঠেছে এবং সে-সুরের বৈশিষ্ট্য হলো, তা প্রাণের সুরের সঙ্গে গাঁথা। ভাষার সুর ধরবার জন্যে যাঁর কাণ তৈরী হয়েছে, তিনি গীতগোবিন্দের ভেতর শুনতে পাবেন অভিসারিকার নূপুর-ধ্বনি, শুনতে পাবেন শুকনো পাতার ওপর দিয়ে ভীরু সলজ্জ পায়ের চলে-যাওয়ার শব্দ, শুনতে পাবেন নিশীথরাতে ফুলন্ত কুঞ্জবনে চাঁদের আলোর জোয়ারের নিঃশব্দ প্রবাহের শব্দ। ভাষাশিল্পী হিসাবে জয়দেবের প্রতিভার আর একটা দিক হলো, ভাষার সাহায্যে ছবি আঁকবার বিস্ময়কর ক্ষমতা। এই বিদ্যায় জগতে অনুপম হলেন দুজন কবি, কালিদাস আর রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু এই দুজনের পাশে জয়দেবও সমান গৌরবে বসতে পারেন। জয়দেবের শ্লোকের চরণে চরণে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে ফুটে উঠেছে এক একটা অপরূপ চিত্র, ডাচ্ চিত্রকরদের মতন গাঢ় রঙের চিত্র। কিন্তু জয়দেবের অমরত্ব নির্ভর করছে, এই অনন্যসাধারণ ভাষা-শিল্পের সঙ্গে তাঁর অপরূপ রসের পরিবেশনে। সেখানেও তিনি কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথের সমধর্ম্মী, যদিও এই তিনজন কবির শিল্প ও রস পরিবেশনের ধারা স্বতন্ত্র।

 কবি হিসাবে জয়দেবের বৈশিষ্ট্য সেখানে, যেখানে ধ্বনির সঙ্গে তিনি সুরকে সংযোজনা করেছেন, চিত্রের সঙ্গে গতিকে রূপ দিয়েছেন, ছন্দের ঝংকারের ভেতর থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রাণের বাণীকে, অলংকারের শত বন্ধনের ভেতর থেকে যেখানে কেঁদে উঠেছে তাঁর লিরিক মন। এই শেষোক্ত বিষয়ে তিনি হলেন চণ্ডীদাসের সমগোত্র।