চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/তৃতীয় খণ্ড/জীবন ও কাব্য

 জয়দেব আর চণ্ডীদাস, দুজনেই জীবনে করেছিলেন যে একান্ত প্রেমের সাধনা, সেই প্রেম-সাধনাই রূপান্তরিত হয়েছে রাধাকৃষ্ণের প্রেমে। তাই চণ্ডীদাস আর জয়দেবের কবিতার ভেতর থেকে যে-সুর বেজে ওঠে, যদিও তার বাইরের রূপ হলো ক্লাসিক, কিন্তু তার অন্তরের রূপ হলো লিরিক এবং সেইজন্যেই তা প্রত্যেক মানুষের মনে একটা স্পন্দন জাগিয়ে তোলে। তাই গীতগোবিন্দ পড়তে পড়তে, রাধাকৃষ্ণের মিলন ও বিরহের আড়ালে ফুটে ওঠে পদ্মাবতী-জয়দেবের মিলন ও বিরহ কাহিনী, কালিন্দীর তীরে নীপকুঞ্জের ছায়ায় ঘুরতে ঘুরতে মন চলে যায় অজয়ের তীরে, বৃন্দাবনের অন্তরে ফুটে ওঠে কেন্দুবিল্ব, ভক্ত আর ভগবান এক হয়ে যায়। নিজের জীবন দিয়ে জয়দেব যে প্রেম-সাধনা করেছিলেন, সেই প্রেমের মহাবার্ত্তাই তিনি রেখে গিয়েছেন তাঁর গীতগোবিন্দ কাব্যে। যার ফলে তাঁর পরবর্ত্তী যুগে সেই প্রেম-সাধনাকে মানবধর্ম্মে পরিণত করেন চৈতন্যদেব।

 মানসচক্ষে দেখছি, পুণ্যধাম জগন্নাথক্ষেত্রে গম্ভীরার ভেতরের এক স্নিগ্ধ কক্ষে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বসে। তাঁর সামনে বসে শ্রীপাদ স্বরূপ-দামোদর আর রায় রামানন্দ। মহাপ্রভুর সামনে খোলা গীতগোবিন্দের পুঁথি। মহাপ্রভু গীতগোবিন্দ পড়ছেন, নিত্য তিনি এই পুঁথি পড়েন। এক-একটী শ্লোক পড়েন, আর তারপর সুরু হয় আলোচনা, আস্বাদন। জগতের তিনজন সর্ব্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও রসিক গম্ভীরার সেই গোপনকক্ষে গীতগোবিন্দ নিয়ে সেদিন যে রসালোচনা করতেন, হায়, তার একটী বর্ণও আমাদের কানে এসে পৌঁছল না। ইতিহাস শুধু এই সাক্ষ্য রেখে গেল, সেযুগের বাংলার তিনটী সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মানুষ জয়দেবের এই অমর কাব্য থেকে নিত্য আহরণ করতেন তাঁদের প্রাণের খোরাক।