চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/তৃতীয় খণ্ড/গীতগোবিন্দে অশ্লীলতার অভিযোগ
এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করবার একটা বিশেষ তাৎপর্য্য আছে। ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে আমাদের দেশের এক শ্রেণীর শিক্ষিত লোক গীতগোবিন্দকে অশ্লীল বলে মনে করতেন বা করেন। গীতগোবিন্দের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের যে মিলন-বর্ণনা আছে, তার মধ্যে তাঁরা যৌন-সম্ভোগের প্রকাশই দেখতে পান এবং সেই জন্যে প্রকাশ্যে নাক সিঁটকে গোপনে পড়ে তার যৌন-স্বাদ গ্রহণ করেন। একথা অবশ্য ঠিকই যে, গীতগোবিন্দ বালক বা শিশুদের জন্যে লেখা নয়, গীতগোবিন্দ হলো তাঁদের জন্যে যাঁদের বস্তু-জ্ঞান হয়েছে, যাঁরা রসের অধিকারী, যাঁরা দেহকে জানেন ও চেনেন এবং জানেন ও চেনেন বলেই দেহের ওপারে দেহাতীতকেও জানেন।
গীতগোবিন্দ কিংবা বৈষ্ণব-কবিতার সম্ভোগ-লীলার বর্ণনার পেছনে যে আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আছে, আমি সেই আধ্যাত্মিক তত্ত্বের ব্যাখ্যার কথা এখানে তুলতে চাই না…সাহিত্যিক হিসাবে, আমার কাছে গীতগোবিন্দ হলো প্রথমত একখানি অমর সাহিত্য-সৃষ্টি এবং জগতের প্রত্যেক সার্থক সাহিত্য-সৃষ্টি যে-রীতি অনুসরণ করে শ্লীলতা ও অশ্লীলতা দুই-এরই ঊর্দ্ধে চলে যায়, গীতগোবিন্দও তেমনি শ্রীলতা ও অশ্লীলতার ঊর্দ্ধে এক পরম রস-বস্তু। সাহিত্যের ইতিহাসে যুগে যুগে দেখেছি, এক শ্রেণীর তত্ত্ব ব্যবসায়ী এই শ্লীলতা আর অশ্লীলতার প্রশ্ন নিয়ে অযথা চীৎকার করে গিয়েছেন এবং এখনো হয়ত করবেন। কিন্তু রসিকজনেরা এই সমস্যার মীমাংসা সর্ব্বকালের জন্যে করে গিয়েছেন। যৌন-ব্যাপারের উল্লেখমাত্রই তা অশ্লীল হয় না, শ্রেষ্ঠ শিল্পী বা কবির কাছে একটা ফুলের বিকাশও যা, যৌন-লীলাও তাই। শ্রেষ্ঠ শিল্প হলো শ্লীলতা এবং অশ্লীলতা দুয়েরই ঊর্দ্ধে।
যে কোন রসিক লোক রচনার উদ্দেশ্য এবং প্রকৃতি থেকেই বুঝতে পারেন সেটা যৌনবস্তু হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে, না, রস-বস্তু হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। চিকিৎসক যখন নগ্ন প্রসূতি নারীর যোনি-পথ থেকে মানব-শিশুকে বের করে আনেন, তখন সেই চিকিৎসকের কাছে নারী-লিঙ্গের কোন যৌন-তাৎপর্য্যই থাকে না, সেই একই যোনি তখন তাঁর কাছে তার সমস্ত কাম-সম্পর্কতা হারিয়ে ফেলে। ঠিক সেই রকম রসের ক্ষেত্রে, শিল্পের ক্ষেত্রে অধিকারী শিল্পী যখন যৌন-বস্তুর উল্লেখ করেন, তখন তাঁর বৃহত্তর উদ্দেশ্যের মধ্যে, তাঁর সৃজন-সৌন্দর্য্যের মধ্যে, যোনি বা সঙ্গম তার প্রাকৃত যৌন-রূপকে হারিয়ে ফেলে, এবং তা হয়ে ওঠে তখন অন্য এক ভাবের প্রতীক, যে-ভাব ঐ প্রতীকের সাহায্য ছাড়া অমন গভীরভাবে, অমন সহজ ও সুন্দরভাবে আর প্রকাশ করা সম্ভব হতো না।
বৈষ্ণব কবিরা তাঁদের অপরূপ কাব্যের ভেতর দিয়ে চেয়েছেন, মানবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের পরিপূর্ণ রূপকে, তার মিলন, বিরহ, বিচ্ছেদ ও আকুতিকে তুলে ধরতে, সোজা কথায় যাকে বলে মানুষের সঙ্গে তার স্রষ্টা ভগবানের মিলন। যুগে যুগে মানুষ চলেছে সেই মহা-অভিসারে, যাকে চোখে দেখা যায় না, অথচ যার বাঁশী শোনা যায়, সেই দেহাতীত প্রিয়তমের অভিসারে। মানব-মনের এই অনন্ত অভিসার, এই নিত্য রাসলীলা ফুটে উঠেছে রাধাকৃষ্ণের প্রেম ও মিলনে। বৈষ্ণব কবিরা তাই পরম-দেবতা রাধাকৃষ্ণের প্রেম, বিরহ ও মিলন লীলার ভেতর দিয়ে চেয়েছেন মানব-মনের সেই পরম-আকুতিকে ফুটিয়ে তুলতে। যিনি দেহাতীত, যিনি সকল ইন্দ্রিয়ের স্পর্শের বাইরে, কেমন করে বুঝবো তাঁকে? কেমন করে বুঝবো তাঁর বিরহে কি জ্বালা? তাঁর স্পর্শে কি শান্তি?
যে-পন্থা অনুসরণ ক’রে বিজ্ঞান চরম সত্যের দিকে এগিয়ে চলে, তা হলো জানা থেকে অজানায়। যেটাকে জানি, সেটাকে আশ্রয় করেই অজানা সত্যের দিকে এগুতে হবে। অজানাকে জানবার সেইটেই হলো মানুষের একমাত্র উপায়। তেমনি তত্ত্বের ক্ষেত্রে, রসের ক্ষেত্রে, মানুষ অজানা পরম দুর্জ্ঞেয়কে জানবার জন্যে, দেহাতীতকে জানবার জন্যে দেহের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দেহের সঙ্গে, তার ব্যথা, বেদনা, সুখ-বিলাস, তৃপ্তি-অতৃপ্তির সঙ্গে আমরা একান্ত সহজভাবেই সম্পৃক্ত। দেহগত স্তরে আমরা জানি বিরহের কি জ্বালা, জানি মিলনের কি সুখ, জানি বাসর-রাত্রির প্রথম প্রিয়-অঙ্গ স্পর্শের কি রোমাঞ্চ। তাই বৈষ্ণব কবিরা পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের ও রমণের স্বাদ বোঝাবার জন্যে সেই দেহগত মিলন-বিরহের প্রকাশকেই প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছেন। তাই জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যে আমরা রাধাকৃষ্ণের রমণের যে বর্ণনা পাই, সে হলো দেহ-প্রতীককে আশ্রয় করে দেহাতীতের সঙ্গে রমণের স্বাদ। মানুষ জীব-দেহে যে চরম-আনন্দের বাস্তব স্বাদ পায়, সে হলো রমণের স্বাদ। সেই এক আত্মবিস্মৃত আনন্দ-মুহূর্ত্তে সমস্ত পার্থিব দৈন্য ও অস্বাচ্ছন্দ্যকে ভুলে মানুষ ক্ষণিকের জন্যে দেহাতিরিক্ত আর-এক আনন্দের কণামাত্র আভাস পায়। সেইটুকু হলো মানুষের জানা আনন্দের অভিজ্ঞতা। বৈষ্ণব কবিরা সেই জানা অভিজ্ঞতার আশ্রয় নিয়ে অজানা সেই মহানন্দকে, অনাস্বাদিতপূর্ব্ব আত্মার রমণের আনন্দকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ব্রহ্মানন্দ-স্বাদকে প্রকাশ-যোগ্য ভাষার প্রতীকে বোঝাতে হলে, এ ছাড়া মানুষের হাতে যোগ্যতর আর কোন উপায় বা অবলম্বন নেই। শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্ন এখানে ওঠে না।