চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/তৃতীয় খণ্ড/রাধাপ্রেম ও চৈতন্যদেব

রাধাপ্রেম

চৈতন্যদেব

 বৈষ্ণবের মতে, একমাত্র যে-প্রেমে ভগবান বাঁধা, সে প্রেমের নাম হলো রাধা-প্রেম। যে-প্রেম দিয়ে, প্রেমের যে বিচিত্র গভীর লীলার বিকাশে, চির-সৌন্দর্য্যের সার শ্রীমতী শ্রীকৃষ্ণকে ভজনা করেছিলেন, সেই প্রেম হলো সাধ্যশিরোমণি । রায় রামানন্দ বিস্তৃতভাবে বলেছেন সাধ্য ও সাধনতত্ত্ব সম্বন্ধে কিন্তু তার সর্ব্ব-পরিশেষে বলেছেন, “রাধার প্রেম সাধ্যশিরোমণি” অর্থাৎ সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সাধনা।

 নিজের জীবনে এই রাধা-প্রেম জীবন্তভাবে ব্যাখ্যা করবার জন্যেই চৈতন্যদেব নীলাচলে অপরূপ লীলা করেন। তাঁর গম্ভীরা লীলার উদ্দেশ্য হলো, নিজে আচরণ করে সাধারণ লোকদের শিক্ষা দেওয়া, রাধা-প্রেম কাকে বলে, কি তার রূপ, কি তার প্রকাশ? কামদগ্ধ পৃথিবী ভুলে গিয়েছিল সেই প্রেমামৃতের স্বাদ, যে-প্রেম একদিন বৃন্দাবনে মূর্ত্ত হয়ে উঠেছিল। চৈতন্যদেব তাঁর নিজের জীবনে রাধার সেই দিব্যপ্রেমের বিচিত্র রূপ-মাধুরীকে আবার সত্য করে তোলেন, তার প্রত্যেকটি অঙ্গকে নিজের প্রত্যক্ষ অনুভূতি দিয়ে সঞ্জীব করে তোলেন। রাধা ভাবে তন্ময় চৈতন্যদেবকে বর্ণনা করে কবি নরহরি গেয়েছেন,

গম্ভীরা ভিতরে গোরা রায়
জাগিয়া রজনী পোহায়।
ক্ষণে করয়ে বিলাপ
ক্ষণে রোয়ত ক্ষণে কাঁপ।

ক্ষণে ভিতে মুখ শির ঘসে
কই নহি রহু পহু পাশে।
ক্ষণে কান্দে তুলি দুই হাত
কোথায় আমার প্রাণনাথ!

 ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ,—সেই ঈশ্বরকে, সেই পরমপুরুষকে, সেই শ্রীকৃষ্ণকে পাবার একমাত্র পথ হলো যে প্রেম, প্রেমাবতার চৈতন্যদেব বিভ্রান্ত মানুষদের জন্যে নিজে সেই প্রেমের আচরণ করে দেখিয়ে গিয়েছেন, নীলাচলে তাঁর গম্ভীরা লীলায়। এই প্রেমই জয়দেব কবি তাঁর গীতগোবিন্দে অপরূপ রসে মূর্ত্ত করে গিয়েছেন।

 এই প্রেমের কথাই বোঝাতে গিয়েই ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, এই প্রেম কি সামান্য জিনিস গা? চৈতন্যদেবের এই প্রেম হয়েছিল। প্রেমের দুটী লক্ষণ। প্রথম, জগৎ ভুল হয়ে যায়। চৈতন্যদেব বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে, সমুদ্র দেখে যমুনা ভাবে। দ্বিতীয় লক্ষণ নিজের দেহ যে এত প্রিয় জিনিস, এর উপরও মমতা থাকবে না, দেহাত্মবোধ একেবারে চলে যাবে। তবে বুঝবে প্রেম হয়েছে।

 নীলাচলে চৈতন্যদেব শ্রীমতীর মতন সর্ব্বদাই মহাভাবে বিভোর হয়ে থাকতেন।

 কৃষ্ণ-প্রেমে বিভোরা শ্রীমতী প্রায়শ‍ই বিভিন্ন দশায় থাকতেন, কখনো অন্তর্দ্দশা, কখনো বাহ্যদশা, কখন বা অর্দ্ধ বাহ্যদশা। নীলাচলে দারুব্রহ্ম নীলমাধবকে দেখে চৈতন্যদেবের নয়নের সামনে বৃন্দাবনবিহারী শ্রীকৃষ্ণের রূপই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সেই অচল দারুমূর্ত্তি তাঁর প্রেমে সজাগ হয়ে ওঠে। কৃষ্ণ-প্রেমে বিভোর হয়ে তিনিও সর্ব্বদাই সেই তিন দশায় অবস্থান করতেন।

 এই মহাভাবের স্বরূপ নীলাচলে তাঁর জীবনের একটি ঘটনায় অপরূপভাবে ফুটে আছে।

 গম্ভীরার কক্ষে রাত্রিতে মহাপ্রভু ঘুমুচ্ছেন। ঘুমের মধ্যে সেদিন তিনি এক অপরূপ স্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন, তিনি যেন বৃন্দাবনে রাসমণ্ডলে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। অনিমেষ নয়নে দেখছেন, গোপীপরিবৃত হয়ে আন্দরসঘনমূর্ত্তি শ্যামনটবর নৃত্য করছেন…নৃত্যের তালে তালে আনন্দের সাগর দুলে উঠছে…সে-আনন্দের তরঙ্গে মহাপ্রভুর সমস্ত দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে…

 এমন সময়, প্রভাত হয়ে গিয়েছে দেখে মহাপ্রভুর সেবক গোবিন্দ মহাপ্রভুকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুল্লো। নিদ্রা-ভঙ্গে বিহ্বল হয়ে মহাপ্রভু চারিদিকে চেয়ে দেখেন, কোথায় গেল সেই শামল কিশোর? কৃষ্ণ-বিরহে তাঁর সারা দেহ জ্বলে ওঠে। কোন রকমে স্নান সেরে তিনি পাগলের মতন ছুটলেন জগন্নাথ-মন্দিরে।

 জগমোহনের একপ্রান্তে গরুড়-স্তম্ভটীর কাছে দাঁড়িয়ে মহাপ্রভু নির্নিমেষ নয়নে পুরুষোত্তমের দিকে চেয়ে দেখেন। ক্রমশ চারদিক থেকে পূজার্থীদের ভিড় জমে আসে। কিন্তু মহাপ্রভুর সেদিকে লক্ষ্য নেই। তিনি শুধু দেখছেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে অপূর্ব্ব সুন্দরতনু শ্যামরায়। দুই চোখ দিয়ে দরদরিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কতক্ষণ যে সেইভাবে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, তার কোন ধারণাই তাঁর ছিল না। হঠাৎ তাঁর চমক ভেঙ্গে গেল চীৎকারে, দেখেন তাঁর সেবক গোবিন্দ এক নারীকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করছে, নারী শুধু ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে আছে। সেদিন জগমোহনের ভেতর ঢুকতে না পেরে এই উড়িয়া নারী গরুড়-স্তম্ভের ওপর কোন রকমে উঠে। বিগ্রহ দেখতে দেখতে নারীটি এমন তন্ময় হয়ে যায় যে, কখন একটা পা মহা প্রভুর কাঁধের ওপর রেখেছে, তা তার হুঁস ছিল না। সেইভাবে মহাপ্রভুর কাঁধে পা রেখে তন্ময় হয়ে সে বিগ্রহ দেখছিল। মহাপ্রভুরও কোন চেতনা ছিল না। মহাপ্রভুর খোঁজে গোবিন্দ এসে সেই দৃশ্য দেখে নারীটিকে টেনে নামায় এবং তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করতে আরম্ভ করে।

 সমস্ত ব্যাপার শুনে চৈতন্যদেব ভাবে স্তব্ধ হয়ে যান, দুই হাত জোড় করে সেই নারীর সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, তুমি ভাগ্যবতী, আমার নমস্য! তোমার এই সকল-ভোলা আর্ত্তি যেন আমি পাই!

 এই তন্ময়তা, অর্থাৎ কৃষ্ণময়তা হলো রাধা প্রেমের প্রধানতম লক্ষণ। এই প্রেম যার ঘটে, “কৃষ্ণ-বাঞ্ছা পূর্ণ করে এই কার্য্য তাঁর।”