চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/তৃতীয় খণ্ড/বৈষ্ণবতত্ত্বের সারকথা

বৈষ্ণবতত্ত্বের

সারকথা

 গীতায় ভগবান আত্মসমর্পণ-যোগের কথা অর্জ্জুনকে বলেন। মুক্তি পাবার যত পথ আছে, যত ক্রিয়া-কাণ্ড, তপস্যা আছে, একে একে তাদের বর্ণনা দিয়ে ভগবান শেষকালে অর্জ্জুনকে বল্‌লেন, হে অর্জ্জুন, এই সব দুরূহ সাধনা বা তপস্যা যদি না করতে চাও, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আমাকে পাবার একমাত্র সহজ যে-পথ, সে-পথ তোমাকে বলে দিচ্ছি, “সর্ব্বধর্ম্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ”—সমস্ত ধর্ম্ম, ক্রিয়াকাণ্ড বিসর্জ্জন দিয়ে তুমি শুধু একান্তভাবে আমার শরণ গ্রহণ কর, তোমার যা কিছু, সব আমাতে সমর্পণ কর, তাহলেই আমি তোমাকে সকল দুঃখ, সকল ব্যথা থেকে মুক্ত করে দেবো অমৃত আনন্দ। বৃন্দাবনে শ্রীমতী আর গোপবধূরা সেই পন্থাই গ্রহণ করেন। মান-অপমান, ভাল-মন্দ, সুবিচার-কুবিচার, নিন্দা-স্তুতি সমস্ত বিসর্জ্জন দিয়ে তাঁরা একমন হয়ে চেয়েছিলেন গোবিন্দকে এবং আনন্দে গোবিন্দ দিয়েছিলেন তাদের কাছে ধরা। শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন-লীলা হলো সেই আত্মসমর্পণ-যোগেরই জীবন-পরীক্ষা। গোপী আর শ্রীমতীর ভালবাসার ভিতর দিয়ে এই আত্মসমর্পণ-যোগের সার কথাই বলা হয়েছে। ভগবানকে পেতে হলে অতি কঠিন যাগ-যজ্ঞ করতে হয়, শত শত বৎসর ধরে কঠোর তপস্যা করেও যোগীরা তাঁর দর্শন পান না। অথচ এই আত্মসমর্পণ-যোগে বলা হয়েছে, তাঁর শরণ নিলেই তাঁকে পাওয়া যায়, কোন দুশ্চর তপস্যা করতে হয় না, কোন কঠোর যজ্ঞ করতে হয় না, কোন ক্রিয়া করতে হয় না। আপাতত শুনতে মনে হয়, এই আত্মসমর্পণ যোগ তো খুবই সহজ। কিন্তু এই যোগ সাধন করতে গেলেই দেখা যায়, যত সহজ মনে হয়, তত সহজ নয়। বাইরে কোন ক্রিয়া করতে হয় না বটে কিন্তু অন্তরকে নিঃশেষে তাঁকে দিতে গেলেই দেখা যায়, অন্তরের ভেতর সংগোপনে বহু ফাঁক থাকে। তাঁর কাছে নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করতে গেলেই দেখা যায় বহু বাধা মনকে জড়িয়ে আছে। সেই সমস্ত বাধাকে অস্বীকার করে একেবারে নিঃশেষ দান না হলে, তিনি ধরা দেন না।

 সেই কথা বোঝাবার জন্যেই শ্রীমতী আয়ান ঘোষের ঘরে কুলবধূ হয়ে আসেন। কুলের বাধা নারীর পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা। সামাজিক লজ্জার বাধা আছে, কুলশীলের বাধা আছে, ফলপ্রাপ্তির লোভের বাধা আছে, অহং গরিমার শত শত সূক্ষ্ম বাধা আছে। তাই আমরা বৃন্দাবন-লীলায় দেখি, গোপীরা কুলের বাধা পেরিয়ে, লজ্জার বাধা পেরিয়ে সমস্ত আত্মসুখের বাধা পেরিয়ে আকুল অন্তরে শুধু বল্‌লে, হে কৃষ্ণ, আমরা শুধু তোমাকেই চাই, সুখের জন্যে তোমাকে চাই না, ঐশ্বর্য্যের জন্য তোমাকে চাই না, তোমার জন্যেই তোমাকে চাই! এই কৃষ্ণের জন্যই কৃষ্ণ প্রীতি হলো নিষ্কাম ভালবাসা। একমাত্র এই নিষ্কাম ভালবাসা দিয়েই ভগবানকে পাওয়া যায়।