চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/একাদশ সর্গ

চিত্রে জয়দেব
গীতগোবিন্দ

একাদশ সর্গ
সানন্দ-গোবিন্দ

একাদশ সর্গ

সানন্দ-গোবিন্দ

 শ্রীমতীর দুর্জয় মানকে ভাঙ্গবার জন্যে শ্রীকৃষ্ণের যত আকুতি, যত মিনতি, এই সর্গে আমরা দেখলাম, তা সার্থক হলো। সখীদের প্রাণান্ত চেষ্টায়, শ্রীকৃষ্ণের চটুল চাটু বচনে শ্রীমতীর মান ভাঙ্গলো। সমস্ত বিশ্ব যাকে চায় সে নিজে নতজানু হয়ে বল্লো, দেহি পদপল্লবমুদারম্…অভিমানিনী শ্রীমতীর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়লেন মাধব। শ্রীমতীর বিষণ্ণ মুখের ওপর জমে উঠেছিল যে অকরুণ মেঘের ছায়া, দূরে উড়ে গেল তা। আবার হেসে উঠলো শ্রীমতীর কমল-আনন। সখীদের ইঙ্গিতে শ্রীকৃষ্ণ অভিসার-বেশে কুঞ্জ-শয্যায় শ্রীমতীর অপেক্ষায় রইলেন। কবি জয়দেব সখীদের হাত ধরে শ্রীমতীকে পৌঁছে দিয়ে এলেন মিলন-শয্যার কাছে। আনন্দে উথলে উঠলো গোবিন্দের অন্তর মিলন-সুখের স্পন্দনে।

সুচিরমনুনয়েন প্রীণয়ত্বা মৃগাক্ষীম্
গতবতি কৃতবেশে কেশবে কুঞ্জশয্যাম্।
রচিতরুচিরভূষাং দৃষ্টিমোষে প্রদোষে
স্ফুরতি নিরবসাদাং কাপি রাধাং জগাদ॥ ১ ॥

বহুক্ষণ ধরে এইভাবে মিনতি জানিয়ে
মৃগাক্ষীকে প্রসন্না করেন শ্রীহরি।
তারপর, প্রদোষের ঘন-অন্ধকারে
নিশি-অভিসারের বেশে
উপস্থিত হন কুঞ্জভবনে।
রুচির সাজে সজ্জিতা শ্রীমতী তখন
ভুলে গিয়েছেন সব অবসাদ, সব বিষাদ।
তাই সখী ডেকে বলে উৎফুল্লা শ্রীমতীকে॥ ১ ॥

গীতম্

বসন্তরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে

বিরচিতচাটুবচনরচনং চরণে রচিত-প্রণিপাতম্
সম্প্রতি মঞ্জুলবঞ্জুলসীমনি কেলিশয়নমনুযাতম্।
মুগ্ধে মধু-মথনমনুগতমনুসর রাধিকে॥ ২ ॥

ওগো সখি,
কত না চাটু বচনে তোমার চরণ ধ’রে
যে-মাধব ভাঙ্গলো তোমার মান,
সে এখন অপেক্ষা ক’রে আছে তোমার জন্যে
কুঞ্জভবনের কেলিশয্যায়।
তাই বলি, ওগো মুগ্ধে,
ওঠ, অনুসরণ কর মাধবকে॥ ২ ॥

ঘনজঘনস্তনভারভরে দরমন্থরচরণবিহারম্।
মুখরিতমণিমঞ্জীরমুপৈহি বিধেহি মরালনিকারম্॥ ৩ ॥

শৃণু রমণীয়তরং তরুণীজনমোহনমধুরিপুরাবম্।
কুসুমশরাসনশাসনবন্দিনি পিকনিকরে ভজ ভাবম্॥ ৪॥

ঘনজঘনে আর স্তনভারে মন্থর তোমার চরণে
বেজে উঠুক মণিময় নূপুর।
মরালের মত গতিতে ধীরে
ওগো মুগ্ধে, অনুসরণ কর তোমার মাধবকে॥ ৩ ॥

কোকিল ডাকছে,—ডেকে বলছে,
ওগো মানিনি, পরিত্যাগ ক’র মান
যুবতীমনোহরণ মধুরিপু মাধবের শোন কথা;
এই বার্ত্তাই ঘোষণা করছে,
কামদেবের স্তাবক কোকিলেরা
অতএব রাগ করো না তাদের ওপর॥ ৪ ॥

অনিলতরলকিশলয়নিকরেণ করেণ লতানিকুরম্বম্।
প্রেরণমিব করভোরু করোতি গতিং প্রতি মুঞ্চ বিলম্বম্॥ ৫ ॥

স্ফুরিতমনঙ্গতরঙ্গবশাদিব সূচিতহরি পরিরম্ভম্।
পৃচ্ছ মনোহরহারবিমলজলধারমমুং কুচকুম্ভম্‌॥ ৬ ॥

হে করভোরু,
ঐ দেখ বায়ুতাড়িত লতারা
করপল্লবে তোমাকে ইঙ্গিত করছে অভিসারে,
অতএব আর বিলম্ব করো না গমনে॥ ৫ ॥

আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয়,
জলধারের মতন মনোহরহার-শোভিত
তোমার ঐ কুচকুম্ভকেই জিজ্ঞাসা কর,
প্রেমের তরঙ্গবেগে কাঁপছে তোমার বক্ষঃস্থল,
ঘন উদ্বেগে কামনা করছে শ্রীহরির আলিঙ্গন॥ ৬ ॥

অধিগতমখিলসখীভিরিদং তব বপুরপি রতিরণসজ্জম্।
চণ্ডি রণিত-রসনা-রব-ডিণ্ডিমমভিসর সরসমলজ্জম্॥ ৭ ॥

আমরা সখীরা সবাই জানি,
রতিরণের সজ্জায় সেজেছে তোমার দেহ।
তাই ওগো প্রেমরণপণ্ডিতা,
দূর ক’রে লজ্জা, কর অভিসার-যাত্রা
সগৌরবে মেখলায় বাজুক প্রেম-রণ-বাদ্য॥ ৭ ॥

স্মর-শর-সুভগ-নখেন করেণ সখীমবলম্ব্য সলীলম্।
চল বলয়ক্বণিতৈরববোধয় হরিমপি নিজগতিশীলম্॥ ৮ ॥

শ্রীজয়দেবভণিতমধরীকৃতহারমুদাসিতবামম্।
হরিবিনিহিত মনসামধিতিষ্ঠতু কণ্ঠতটীমবিরামম্॥ ৯ ॥

কামশরের মতন নখশোভিত করে
অবলম্বন কর সখীকে,
লীলায়িত ভঙ্গিমায় এগিয়ে চল কুঞ্জভবনে,
বলয়ের নিক্বণে ঘোষণা কর আগমন-বার্ত্তা
আহ্বান কর শ্রীহরিকে প্রেম-রণে॥ ৮ ॥

কণ্ঠহারের চেয়ে সুন্দর, রমণীর চেয়ে রমণীয়
কবি জয়দেবের এই কৃষ্ণ-সঙ্গীত,
কৃষ্ণগতপ্রাণ ভক্তদের কণ্ঠে অবিরাম থাকুক লগ্ন॥ ৯ ॥

স মাং দ্রক্ষ্যতি বক্ষ্যতি স্মরকথাং প্রত্যঙ্গমালিঙ্গনৈঃ
প্রীতিং যাস্যতি রংস্যতে সখি সমাগত্যেতি সঞ্চিন্তয়ন্।
স ত্বাং পশ্যতি বেপতে পুলকয়ত্যানন্দতি স্বিদ্যতি
প্রত্যুদ্গচ্ছতি মূর্চ্ছতি স্থিরতমঃপুঞ্জে নিকুঞ্জে প্রিয়ঃ॥ ১০ ॥

ঘন-অন্ধকারে নিকুঞ্জভবনে
শ্রীহরি রয়েছেন তোমার অপেক্ষায়,
ক্ষণে ক্ষণে ভাবছেন যেন তুমি এসে দাঁড়িয়েছ সামনে,
সেই আনন্দের পুলকে হয়ে উঠছেন ঘর্ম্মাক্ত;
কখন বা মনে মনে করছেন আশা,
তুমি আসবে, মধুর আলাপে আর আলিঙ্গনে
নন্দিত ক’রে তুলবে তাঁর চিত্ত;
কখনো বা তুমি আসছো মনে ক’রে
এগিয়ে আসছেন তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে,
তোমাকে না দেখে আবার শোকে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ছেন॥ ১০ ॥

অক্ষ্ণোর্নিক্ষিপদঞ্জনং শ্রবণয়োস্তাপিঞ্ছগুচ্ছাবলীং
মূর্দ্ধ্নি শ্যামসরোজদামকুচয়োঃ কস্তূরিকাপত্রকম্।
ধূর্ত্তানামভিসারসত্বরহৃদাং বিষ্বঙ্নিকুঞ্জে সখি
ধ্বান্তং নীলনিচোলচারু সুদৃশাং প্রত্যঙ্গমালিঙ্গতি॥ ১১ ॥

নয়নে কালো অঞ্জন,
কর্ণে তমাল-গুচ্ছ,
মাথায় নীলোৎপল মালা,
স্তনে মৃগমদপত্র, পরিধানে নীলাম্বর,
চতুরা অভিসারিকা কম্পিতহৃদয়ে
এইভাবে বেশভূষায় সজ্জিতা হয়ে যখন যায় অভিসারে,
মনে হয়,
যেন অন্ধকারও চলেছে তাদের অঙ্গ ঘিরে॥ ১১ ॥

কাশ্মীর-গৌর-বপুষামভিসারিকাণা-
মাবদ্ধরেখমভিতো রুচিমঞ্জরীভিঃ।
এতত্তমালদল-নীলতম‍ং তমিস্রং
তৎপ্রেমহেমনিকষোপলতাং তনোতি॥ ১২ ॥

ঘন আঁধারের পটভূমিকায়
বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছে
কুঙ্কুমবর্ণা অভিসারিকাদের গৌর-দেহের জ্যোতি,—
তমালপাতার মত সেই ঘননীল অন্ধকার
যেন অভিসারিকার প্রেমের নিকষ-পাষাণ;
নিকষ-পাষাণে যেমন উজ্জ্বলতর হয়ে উঠে স্বর্ণ
তেমনি সেই ঘন অন্ধকারে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে
তাদের প্রেম॥ ১২ ॥

হারাবলীতরলকাঞ্চনকাঞ্চিদাম-
মঞ্জীরকঙ্কণমণিদ্যুতিদীপিতস্য।
দ্বারে নিকুঞ্জনিলয়স্য হরিং বিলোক্য
ব্রীড়াবতীমথ সখীমিয়মিত্যুবাচ॥ ১৩ ॥

(শ্রীমতী এসে উপস্থিত হ’লেন কুঞ্জভবনে)
তখন শ্রীমতীর অঙ্গের মণিহার থেকে,
স্বর্ণমেখলা, মঞ্জীর আর মণিকঙ্কণ থেকে
বিচ্ছুরিত হয়ে পড়লো যে আলো,
সে-আলোয় শ্রীমতী দেখলেন দাঁড়িয়ে রয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ।
লজ্জায় নত হয়ে গেল শ্রীমতীর মুখ।
তাই দেখে সখী বলে,…॥ ১৩ ॥

গীতম্

দেশবাড়ীরাগরূপকতালাভ্যাং গীয়তে

মঞ্জুতরকুঞ্জতলকেলিসদনে
বিলস রতি-রভসহসিতবদনে।
প্রবিশ রাধে মাধব-সমীপমিহ॥ ১৪ ॥

নবভবদশোকদলশয়নসারে।
বিলস কুচকলসতরলহারে॥ ১৫ ॥

হে রাধে, আনন্দে প্রবেশ কর
মঞ্জু কুঞ্জভবনে।
হসিত বদনে
গিয়ে দাঁড়াও মাধবের পাশে,
আনন্দে রত হও রতি-রঙ্গে॥ ১৪ ॥

ওগো সখি,
নবীন অশোকপল্লবে রচিত হয়েছে প্রেমশয্যা,
হারতরঙ্গিতবক্ষে গ্রহণ কর সে-শয্যা,
আনন্দে রত হও রতি-বিলাসে॥ ১৫ ॥

কুসুমচয়রচিতশুচিবাসগেহে।
বিলস কুসুমসুকুমারদেহে॥ ১৬ ॥

চলমলয়বনপবনসুরভিশীতে।
বিলস রতিবলিতললিতগীতে॥ ১৭ ॥

হে কুসুমকোমলাঙ্গী,
কুসুমে রচিত ঐ শুচি বাসকশয়নে
আনন্দে রত হও রতিরঙ্গে॥ ১৬ ॥

মলয়পবনে স্নিগ্ধশীতল কুঞ্জভবনে
সঙ্গীতমুখরিত ললিতস্পন্দনে
আনন্দে রত হও সখি রতি-নন্দনে॥ ১৭ ॥

বিততবহুবল্লিনবপল্লবঘনে।
বিলস চিরমলসপীনজঘনে॥ ১৮ ॥

মধুমুদিতমধুপকুলকলিতরাবে।
বিলস মদনরসসরসভাবে॥ ১৯ ॥

ওগো পীনজঘনবতি,
নবপল্লবে ঘন, লতায় আচ্ছন্ন কুঞ্জভবনে
আনন্দে রত হও রতিরঙ্গে॥ ১৮ ॥

মধুমত্ত ভ্রমরের গুঞ্জনে আকুল
ঐ মধুর কুঞ্জভবনে,
আনন্দে সখি পান কর প্রেমঘনরস॥ ১৯ ॥

মধুরতরপিকনিকরনিনাদমুখরে।
বিলস দশনরুচিরুচিরশিখরে॥ ২০ ॥

বিহিতপদ্মাবতীসুখসমাজে
কুরু মুরারে মঙ্গলশতানি।
ভণতি জয়দেব-কবিরাজ-রাজে॥ ২১ ॥

অয়ি শুভ্রদন্তি,
চারিদিকে ঐ শোন উঠছে মধুর পিকরব,
আনন্দে রত হও সখি রতিবিলাসে॥ ২০ ॥

হে মুরারি,
পদ্মাবতীর আনন্দদায়ী এই যে সঙ্গীত
রচনা করলো কবিরাজ-রাজ জয়দেব,
তোমার প্রসাদে সে-সঙ্গীত হোক্ নিখিলের
মঙ্গলবিধায়ক॥ ২১ ॥

শূন্য মন্দির মোর

ত্বাং চিত্তেন চিরং বহন্নয়মতিশ্রান্তো ভৃশন্তাপিতঃ
কন্দর্পেণ চ পাতুমিচ্ছতি সুধাসম্বাধবিম্বাধরম্।
অস্যাঙ্কং তদলঙ্কুরু ক্ষণমিহ ভ্রূক্ষেপলক্ষ্মীলব-
ক্রীতে দাস ইবোপসেবিতপদাম্ভোজে কুতঃ সংভ্রমঃ॥ ২২ ॥

ওগো সখি,
বহুক্ষণ ধরে শ্রীকৃষ্ণ বহন করে আছেন তোমাকে
তাঁর অন্তরে।
তাই তিনি পরিশ্রান্ত, প্রেমদাহে ক্লান্ত।
তৃষিত হয়ে আছেন তোমার অধর-সুধার জন্যে।
মিনতি আমার,
এখুনি গিয়ে অলঙ্কৃত কর তাঁর অঙ্কদেশ।
কটাক্ষে যাকে করেছ ক্রীতদাস
সে যদি করে তোমার পাদপদ্মের সেবা,
তাতে আবার লজ্জা কিসের?॥ ২২ ॥

সা সসাধ্বস-সানন্দং গোবিন্দে লোললোচনা।
শিঞ্জানমঞ্জুমঞ্জীরং প্রবিবেশ নিবেশনম্॥ ২৩ ॥

সখীর কথা শুনে
আশঙ্কায় আর আনন্দে দুলে ওঠে শ্রীমতীর বুক।
কটাক্ষ-ইঙ্গিতে গোবিন্দের দিকে একবার চেয়ে
সুমধুর নূপুরের ধ্বনি জাগিয়ে
শ্রীমতী প্রবেশ করেন বাসক-গৃহে॥ ২৩ ॥

গীতম্

বরাড়ীরাগরূপকতালাভ্যাং গীয়তে

রাধাবদনবিলোকন বিকসিত বিবিধবিকারবিভঙ্গম্
জলনিধিমিব বিধুমণ্ডলদর্শনতরলিত-তুঙ্গতরঙ্গম্॥
হরিমেকরসং চিরমভিলষিতবিলাসম্
সা দদর্শ গুরুহর্ষ-বশংবদ-বদনমনঙ্গ বিকাশম্॥ ২৪ ॥

চাঁদকে দেখলে,
তরঙ্গ-ভঙ্গে যেমন উদ্বেল হয়ে ওঠে সাগর,
শ্রীমতী দেখলেন,
তাঁকে দেখে তেমনি
আনন্দ-রসে উদ্বেল হয়ে উঠেছে গোবিন্দের মুখ
যে অভিলাষ ছিল অন্তরে অপূর্ণ
এখন তা হবে সার্থক পূর্ণ,
সেই আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলো,
শ্রীমতী-গত-প্রাণ গোবিন্দের আনন॥ ২৪ ॥

হারমমলতর তারমুরসি দধতং পরিলম্ব্য বিদূরম্।
স্ফুটতরফেনকদম্বকরম্বিতমিব যমুনাজল-পূরম্॥ ২৫ ॥

শ্যামল-মৃদুল-কলেবর-মণ্ডলমধিগতগৌরদুকূলম্।
নীলনলিনমিব পীতপরাগপটলভরবলয়িত মূলম্‌॥ ২৬ ॥

যমুনার নীলজলে শুভ্র ফেনার মত
শ্রীহরির নীলবক্ষে শোভা পায় শ্বেত মুক্তাহার॥ ২৫ ॥

স্নিগ্ধ কোমল শ্যাম-অঙ্গে
শোভা পায় পীতবসন,
যেন পীতপরাগে বেষ্টিত নীল-পদ্ম॥ ২৬ ॥

তরলদৃগঞ্চলবলনমনোহরবদনজনিতরতিরাগম্।
স্ফুটকমলোদরখেলিতখঞ্জনযুগমিব শরদিব তড়াগম্॥ ২৭ ॥

বদনকমলপরিশীলনমিলিতমিহিরসমকুণ্ডলশোভম্
স্মিতরুচিরুচিরসমুল্লসিতাধরপল্লবকৃতরতিলোভম্‌॥ ২৮ ॥

রতি-রাগ জেগে ওঠে যে মুখের দর্শনে,
শ্যামের সেই স্নিগ্ধ আননে
ফুটে আছে দুটী নীল নয়ন, চঞ্চল কটাক্ষে ভরা,
যেন শরতের স্নিগ্ধ তড়াগে
ফুল্লকমলবনে খেলা করে চঞ্চল খঞ্জন যুগল॥ ২৭ ॥

শ্যামের মুখকমলে ঝলমল করে যুগলকুণ্ডল
মুখ নয় যেন সূর্য্যমণ্ডল।
ঈষৎ হাসিতে উল্লসিত হয়ে উঠে অধর পল্লব,
দ্বিগুণ করে তোলে রতিলালসা॥ ২৮ ॥

শশিকিরণচ্ছুরিতোদরজলধরসুন্দরসকুসুমকেশম্।
তিমিরোদিত বিধুমণ্ডল নির্ম্মলমলয়জতিলকনিবেশম্॥ ২৯ ॥

বিপুলপুলকভরদন্তুরিতং রতিকেলিকলাভিরধীরম্।
মণিগণ-কিরণসমূহসমুজ্জ্বলভূষণসুভগশরীরম্॥ ৩০ ॥

কুঞ্চিত কেশদামে তাঁর
জড়িয়ে আছে কুসুমের সুরভিভার,
যেন মেঘের বুকে ছড়িয়ে আছে
চাঁদের আলোর সুষমা।
শ্যামল ললাটে তাঁর
শোভা পায় শ্বেত চন্দন-তিলক,
যেন আঁধার আকাশে শুভ্র চন্দ্রকলা॥ ২৯ ॥

প্রেমকেলির আশায় উদ্বেল তাঁর শ্রীঅঙ্গ
স্বর্ণে আর মুক্তায়, মণিতে আর ভূষণে করে ঝলমল,
ক্ষণে ক্ষণে হয়ে উঠে বিপুল পুলকে রোমাঞ্চিত॥ ৩০ ॥

শ্রীজয়দেবভণিতবিভবদ্বিগুণীকৃতভূষণভারম্।
প্রণমত হৃদি বিনিধায় হরিং সুচিরং সুকৃতোদয়সারম্॥ ৩১ ॥

অতিক্রম্যাপাঙ্গং শ্রবণপথপর্য্যন্তগমন-
প্রয়াসেনৈবাক্ষ্ণোস্তরলতরতারং পতিতয়োঃ।
তদানীং রাধায়াঃ প্রিয়তম-সমালোকসময়ে
পপাত স্বেদাম্ভঃপ্রসর ইব হর্ষাশ্রুনিকরঃ॥ ৩২ ॥

শ্রীজয়দেবের এই সঙ্গীতে
উথলে উঠেছে
শ্যামের সেই অপরূপ রূপবিভব।
শ্যামের সে-দেহ,
নিখিলের যত পুণ্য তার চির-গেহ।
ওগো পাঠক, হৃদয়ে ধারণ ক’রে
প্রণাম কর সেই অপরূপ শ্যামমূর্ত্তিকে॥ ৩১ ॥

 

অন্তরের অন্তরতম প্রাণপ্রিয় সেই কৃষ্ণকে দেখে

চঞ্চল হয়ে ওঠে শ্রীমতীর আঁখিতারা।
পর্য্যাপ্তভাবে দেখবার জন্যে
সে-আঁখিতারকা শ্রবণমূল পর্য্যন্ত ছুটে চলে।
তার ফলে দেখা দেয় যে-পরিশ্রান্তি,
আনন্দাশ্রু হয়ে তা পড়ে ঝ’রে॥ ৩২ ॥

ভজন্ত্যাস্তল্পান্তং কৃতকপটকণ্ডূতিপিহিত-
স্মিতং যাতে গেহাদ্বহিরবহিতালীপরিজনে।
প্রিয়াস্যং পশ্যন্ত্যাঃ স্মরশরসমাহূতসুভগ‍ং
সলজ্জা লজ্জাপি ব্যগমদতিদূরং মৃগদৃশঃ॥ ৩৩ ॥

(প্রিয়-মিলনের শুভ-মুহূর্ত্ত সমাগত বুঝে)
সখীরা হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে
কর্ণকণ্ডূয়নের ছলে।
তখন মৃগনয়না
প্রেমকটাক্ষে চেয়ে দেখেন মাধবকে।
শ্রীমতীর সেই ভাব দেখে
লজ্জাও তখন সলজ্জ হয়ে দূরে যায় স’রে॥ ৩৩ ॥

জয়শ্রীবিন্যস্তৈর্মহিত ইব মন্দারকুসুমৈঃ
স্বয়ং সিন্দূরেণ দ্বিপ-রণমুদা মুদ্রিত ইব।
ভুজাপীড়ক্রীড়াহতকুবলয়াপীড়করিণঃ
প্রকীর্ণাসৃগ্বিন্দুর্জয়তি ভুজদণ্ডো মুরজিতঃ॥ ৩৪ ॥

বাহুযুদ্ধে মুরারি যেদিন
নিহত করেন কংসের রণহস্তী কুবলয়াপীড়কে,
তার কুম্ভস্থিত সিন্দূরে আর দেহ-নির্গত রক্তে
রক্তিম হয়ে ওঠে মাধবের ভুজদণ্ড,
যেন জয়লক্ষ্মী নিজে সেই ভুজদণ্ডে
পরিয়ে দিলেন রক্ত-মন্দার-কুসুমের মালা।
মুক্তকণ্ঠে তাই কবি জয়দেব গান গায়,
জয় হোক্ মুরারির সে ভুজদণ্ডের!॥ ৩৪ ॥