চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/দশম সর্গ

চিত্রে জয়দেব
গীতগোবিন্দ

দশম সর্গ
মুগ্ধ মাধব

দশম সর্গ

মুগ্ধ মাধব

 সখীরা শ্রীমতীকে ভর্ৎসনা করছিলেন, কেন তুমি নিষ্ঠুরার মতন অভিমানে ক্ষিপ্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে দিলে ফিরিয়ে? সখীদের কথায় শ্রীমতীর অভিমান আর ক্রোধ ধীরে ধীরে ক্রমশঃ শান্ত হয়ে আসছিল। কুঞ্জ-ভবনে সন্ধ্যার ছায়াও ধীরে ধীরে নেমে আসছিল। শ্রীমতীর মনে কৃষ্ণবিরহের ব্যথা নিবিড়তর হয়ে উঠছিল। এমন সময় কুঞ্জের বাইরে শুক্‌নো পাতার উপর মৃদু চরণের ধ্বনি জেগে উঠল। বাতাস সুরভিত হয়ে উঠল চন্দন গন্ধে। কম্পিত অন্তরে শ্রীমতী চেয়ে দেখেন সামনে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণ। এইভাবে পুনরায় শ্রীকৃষ্ণকে আসতে দেখে শ্রীমতীর অন্তর সংগোপনে আনন্দে কেঁপে উঠল, সলজ্জভাবে তিনি সখীদের দিকে চাইলেন। সখীরা সে চাউনির অর্থ বুঝতে পেরে নীরবে সেখান থেকে সরে পড়লেন। এই অবকাশে মুগ্ধ মাধব নতজানু হয়ে শ্রীমতীকে আহ্বান করে বললেন “দেহি পদপল্লবমুদারম্।”

অত্রান্তরে মসৃণরোষবশামসীম-
নিঃশ্বাসনিঃসহমুখীং সুমুখীমুপেত্য।
সব্রীড়মীক্ষিতসখীবদনাং প্রদোষে
সানন্দগদ্গদপদং হরিরিত্যুবাচ॥ ১ ॥

ক্রমে ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা—ধীরে প্রশমিত হয়ে আসে
বিষণ্ণবদনা রাধার ক্রোধের উগ্রতা।
কৃষ্ণ-অদর্শনে ঘন ঘন বইতে থাকে দীর্ঘশ্বাস।
এমন সময় সহসা শ্রীমতী দেখেন
সামনে দাঁড়িয়ে শ্রীহরি।
লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে শ্রীমতীর মুখ,
চেয়ে থাকেন সখীদের দিকে।
রাধার সেই ভাবান্তর দেখে
আনন্দে গদগদকণ্ঠে বলেন মাধব…॥ ১ ॥

গীতম্

দেশবরাড়ীরাগাষ্টতালাভ্যাং গীয়তে

বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদী
হরতি দরতিমিরমতিঘোরম্।
স্ফুরদধরসীধবে তব বদনচন্দ্রম্।
রোচয়তি লোচন-চকোরম্॥ ২ ॥

প্রিয়ে,
প্রেমভরে একবার শুধু বল একটী কথা,
তোমার শুভ্র-দশনের জ্যোৎস্নাছটায়
দূর হয়ে যাক্ অন্তরের এই আঁধার ঘোর।
তোমার মুখ-চন্দ্রের আকর্ষণে
উচ্ছল হয়ে উঠেছে তোমার অধরের সুধা,—
ওগো প্রিয়ে,
চকোরের মত আমার নয়ন
পিপাসার্ত্ত চেয়ে আছে সেই অধরের দিকে॥ ২ ॥

প্রিয়ে চারুশীলে মুঞ্চ ময়ি মানমনিদানম্।
সপদি মদনানলো দহতি মম মানসম্
দেহি মুখকমলমধুপানম্॥ ৩ ॥

প্রিয়ে চারুশীলে,
দূর কর এই অকারণ মান।
তোমার বিমুখ মানে
বিরহজ্বালায় জ্বলে যায় আমার চিত্ত।
ওগো প্রিয়ে,
তোমার ঐ মুখকমলের মধুদানে
স্নিগ্ধ কর সে-তীব্র-দহনজ্বালা॥ ৩ ॥

সত্যমেবাসি যদি সুদতি ময়ি কোপিনী
দেহি খরনয়নশরঘাতম্।
ঘটয় ভুজবন্ধনং জনয় রদখণ্ডনম্
যেন বা ভবতি সুখজাতম্॥ ৪ ॥

ওগো প্রিয়ে,
যদি সত্যই আমার ওপর হয়ে থাক ক্রুদ্ধ,
তবে ঐ তো রয়েছে তোমার তীব্র নয়নকটাক্ষ,
আমাকে কর বিদ্ধ তাতে;
ঐ ভুজলতার পাশে আমাকে কর বন্দী,
দংশন কর চুম্বনে চুম্বনে,
দাও আমাকে শাস্তি,
যাতে তুমি পাও সুখ॥ ৪ ॥

ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনম্
ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্।
ভবতু ভবতীহ ময়ি সততমনুরোধিনী
তত্র মম হৃদয়মতিযত্নম্॥ ৫ ॥

ওগো প্রিয়ে,
তুমিই আমার ভূষণ,
আমার জীবনের জীবন।
ভব-জলধির তুমিই রত্ন।
হৃদয়ের শুধু একটি কামনা,
তুমি থাক সেখানে চির-প্রীতিতে বাঁধা॥ ৫ ॥

নীলনলিনাভমপি তন্বি তব লোচনম্
ধারয়তি কোকনদরূপম্।
কুসুম-শর-বাণ-ভাবেন যদি রঞ্জয়সি
কৃষ্ণমিদমেতদনুরূপম্॥ ৬ ॥

ওগো তন্বি,
নীলাভ তোমার নয়ন-কমল
রাগে হয়েছে রক্তকমলের মত লাল;
ঐ নয়নের প্রেম-দৃষ্টি
যদি পারে আমার কৃষ্ণদেহকে করতে অনুরঞ্জিত,
তবে জানবো সার্থক হয়েছে তার রূপান্তর॥ ৬ ॥

স্ফুরতু কুচকুম্ভয়োরুপরি মণিমঞ্জরী
রঞ্জয়তু তব হৃদয়দেশম্।
রসতু রসনাপি তব ঘনজঘনমণ্ডলে
ঘোষয়তু মন্মথনিদেশম্॥ ৭ ॥

ওগো প্রিয়ে,
কুচকুম্ভের ওপর দুলছে যে মণি-হার,
রতি-উল্লাসে ঝিকমিক করে উঠুক তার দীপ্তি,
আলোকিত হয়ে উঠুক তোমার বক্ষ;
তোমার সঘন-জঘনে রয়েছে যে মেখলা
মুখরিত হয়ে উঠুক তা রতি-রঙ্গে,
ঘোষণা করুক মন্মথের জয়বার্ত্তা॥ ৭ ॥

স্থলকমলগঞ্জনং মম হৃদয়রঞ্জনম্
জনিত-রতি-রঙ্গ-পরভাগম্।
ভণ মসৃণ-বাণি করবাণি চরণদ্বয়ং
সরস-লসদলক্তকরাগম্॥ ৮ ॥

স্থলকমল-গঞ্জন
আমার হৃদয়-রঞ্জন,
রতিরঙ্গে সুশোভন তোমার ঐ রক্ত-চরণ,
ওগো প্রিয়ে, কর আদেশ
সরস অলক্তকরাগে করি রঞ্জিত॥ ৮ ॥

স্মর-গরল-খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনম্
দেহি পদপল্লবমুদারম্।
জ্বলতি ময়ি দারুণো মদনকদনানলো
হরতু তদুপাহিতবিকারম্॥ ৯ ॥

ইতি চটুল-চাটু-পটু-চারু মুরবৈরিণো
রাধিকামধি বচনজাতম্।
জয়তি পদ্মাবতী-রমণ-জয়দেবকবি-
ভারতী-ভণিতমতিশাতম্॥ ১০ ॥

মদনের দহন জ্বালায়
জ্বলে যায় সর্ব্ব-অঙ্গ……
ওগো প্রিয়ে,
স্মর-গরল-খণ্ডন তোমার ঐ কমল চরণ
হোক্ আমার শিরোভূষণ,
দগ্ধ তনু-মন হোক্‌ স্নিগ্ধ॥ ৯ ॥

এইভাবে মুরারি
চটুল-চাটু-বচনে
শ্রীমতীকে করেন
বন্দনা,

তারই সঙ্গীত রচনা করে
পদ্মাবতী-রমণ কবি জয়দেব॥ ১০ ॥

পরিহর কৃতাতঙ্কে শঙ্কাং ত্বয়া সততং ঘন-
স্তনজঘনয়াক্রান্তে স্বান্তে পরানবকাশিনি।
বিশতি বিতনোরন্যো ধন্যা ন কোঽপি মমান্তরং
প্রণয়িনি পরীরম্ভারম্ভে বিধেহি বিধেয়তাম্॥ ১১ ॥

ওগো ভীরু,
অন্য-নায়িকাসক্ত মনে ক’রে
আমি জানি তুমি ভীত হয়ে উঠেছ,
দূর কর প্রিয়ে সে-ভয়।
তোমার ঘন-জঘন-বিস্তারে
তুমি চিরবন্দী ক’রে রেখেছ আমাকে।
মাধবের অন্তরে একমাত্র তুমিই অন্তরবাসিনী
সেখানে অন্য কারুর স্থান আর কোথায়?
একমাত্র কামদেব ছাড়া,
আমার অন্তরে প্রবেশ করে
এমন কে আছে আর ত্রিভুবনে?
তাই বলি প্রিয়ে,
অনুমতি দাও আলিঙ্গনের॥ ১১ ॥

মুগ্ধে বিধেহি ময়ি নির্দয়দন্তদংশ-
দোর্বল্লিবন্ধ-নিবিড়-স্তনপীড়নানি।
চণ্ডি ত্বমেব মুদমঞ্চ ন পঞ্চবাণ
চণ্ডালকাণ্ড-দলনাদসবঃ প্রয়ান্তু॥ ১২ ॥

অয়ি মুগ্ধে,
শাস্তি যদি দিতে হয়, তুমি নিজে দাও সে-শাস্তি……
বাহু দিয়ে কর বন্ধন আমাকে,
দংশন কর দশন দিয়ে,
পীড়ন কর ঐ নিবিড় স্তনভারে;
দোহাই তোমার, হে চণ্ডি,
দেখো যেন ঐ চণ্ডাল মদনের শাস্তিতে প্রাণ না যায়॥ ১২ ॥

শশিমুখি তব ভাতি ভঙ্গুর-ভ্রূ-
যুবজনমোহ-করাল-কালসর্পী।
তদুদিত-ভয়ভঞ্জনায় যূনাম্‌
ত্বদধর-সীধু-সুধৈব সিদ্ধমন্ত্র॥ ১৩ ॥

চন্দ্রাননে,
তোমার ঐ ভঙ্গুর ভ্রূ
বেঁকে উঠেছে যেন করাল কাল-সাপিনী,
ভয়ে মোহে কেঁপে ওঠে তরুণ মন—
সে-আশঙ্কা দূর করবার সিদ্ধমন্ত্র
কিন্তু সঞ্চয় ক’রে রেখেছ তোমারই অধরসুধায়॥ ১৩ ॥

ব্যথয়তি বৃথা মৌনং তন্বি প্রপঞ্চয় পঞ্চমং
তরুণি মধুরালাপৈস্তাপং বিনোদয় দৃষ্টিভিঃ।
সুমুখি বিমুখীভাবং তাবদ্বিমুঞ্চ ন মুঞ্চমাং
স্বয়মতিশয়-স্নিগ্ধো মুগ্ধে প্রিয়োঽয়মুপস্থিতঃ॥ ১৪ ॥

ওগো তন্বি,
অকারণ মৌনতায়
ব্যথিত চিত্তকে আর করো না বিড়ম্বিত।
মধুর আলাপে আর নয়নের মধু-দৃষ্টিতে
দূর কর সে-ব্যথা।
ত্যাগ কর এই বিমুখভাব,
ত্যাগ করো না তাকে
প্রণয়-মুগ্ধ আপনা থেকে যে এসে দাঁড়িয়েছে
তোমার সামনে॥ ১৪ ॥

বন্ধূকদ্যুতিবান্ধবোঽয়মধরঃ স্নিগ্ধো মধুকচ্ছবি-
গণ্ডে চণ্ডি চকাস্তি নীলনলিনশ্রীমোচনং লোচনম্।
নাসাভ্যেতি তিলপ্রসূন-পদবীং কুন্দাভদন্তি প্রিয়ে
প্রায়স্ত্বন্মুখসেবয়া বিজয়তে বিশ্বং স পুষ্পায়ুধঃ॥ ১৫ ॥

বন্ধূক ফুলের মত রক্তবর্ণ তোমার অধর,
কপোল মধুককুসুমের মত স্নিগ্ধ,
নয়ন তোমার নীলপদ্ম,
তিলফুলের মত নাসা,
দন্ত তোমার কুন্দ ফুলের মত শুভ্র।
তোমার আননেই রয়েছে মদনের পঞ্চ পুষ্পবাণ।
মনে হয়, তোমার ঐ বদনের প্রসাদেই
মদন করেছে বিশ্বজয়॥ ১৫ ॥

দৃশোতব মদালসে বদনমিন্দুসন্দীপনম্
গতির্জনমনোরমা বিজিতরম্ভমূরুদ্বয়ম্।
রতিস্তব কলাবতী রুচিরচিত্রলেখে ভ্রুবা-
বহো বিবুধ-যৌবতং বহসি তন্বি পৃথ্বীগতা॥ ১৬ ॥

দৃষ্টি তোমার মদালসা,
আনন তোমার চন্দ্রসমান,
গতিভঙ্গী তোমার নিখিলের মনোহারী,
রম্ভার গঠনকে লজ্জা দেয় তোমার স্নিগ্ধ ঊরু,
তোমার রতি-ক্রীড়া ললিতকলার চরম নিদর্শন,
তোমার ভ্রূ-তে আঁকা নিপুণ চিত্রলেখা।
ওগো তন্বি,
পৃথিবীর মানবী হয়েও,
স্বর্গ-দেবীদেরও তুমি আশ্রয়॥ ১৬ ॥

প্রীতিং বস্তনুতা‍ং হরিঃ কুবলয়াপীড়েন সার্দ্ধং রণে
রাধাপীনপয়োধরস্মরণকৃৎকুম্ভেন সম্ভেদবান্।
যত্র স্বিদ্যতি মীলতি ক্ষণমথ ক্ষিপ্তে দ্বিপে তৎক্ষণাৎ
কংসস্যালমভূজ্জিতং জিতমিতি ব্যামোহকোলাহলঃ॥ ১৭ ॥

কংসের হস্তী কুবলয়াপীড়ের সঙ্গে যুদ্ধে
তার কুম্ভসম্ভেদ করতে গিয়ে,
নিমেষের মধ্যে শ্রীহরির স্মরণে উদিত হলো
শ্রীমতীর পীনপয়োধর।
তখন সর্ব্বশরীর তাঁর স্বেদসিক্ত হয়ে উঠলো,
আবেশে মুদলেন দুই চোখ।
কংসের অনুচরেরা শ্রীহরিকে পরাজিত মনে করে
জয়ধ্বনি করে উঠলো।
কিন্তু সেই জয়ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে
প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠলেন শ্রীহরি,
নিমেষে হস্তীকে বধ করে দিলেন দূরে ফেলে,—
কংস-অনুচরেরা শোকে কোলাহল করে উঠলো আবার।
সেই কংসারি শ্রীহরি, করুন আপনাদের আনন্দ বর্দ্ধন॥ ১৭ ॥

আজু কে গো মুরলী বাজায়