চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/নবম সর্গ
চিত্রে জয়দেব
গীতগোবিন্দ
নবম সর্গ
মুগ্ধ-মুকুন্দ
নবম সর্গ
মুগ্ধ-মুকুন্দ
শ্রীমতী অভিমান ভরে শ্রীকৃষ্ণকে দিলেন ফিরিয়ে। কিন্তু যাকে ফিরিয়ে দিলেন, তারই চিন্তায় বসে থাকেন একাকিনী, সারাক্ষণ মনে মনে তাকেই করেন ধ্যান। এমন সময় এক সখী এসে বেদনাতুরা শ্রীমতীকে ভর্ৎসনা করে, এ তুমি কি করলে সখি! অভিমানে মাধবকে দিলে রূঢ়ভাবে ফিরিয়ে? ফিরিয়েই যদি দিলে, তবে এখন আবার বসে কাঁদছো কেন? দেখছো না, তোমার অবস্থা দেখে সখীরা সব হাসছে?
তখন সখীরা শ্রীকৃষ্ণকে ফিরিয়া আনবার চেষ্টা করে। শ্রীমতীকে তারা বুঝিয়ে বলে, শ্রীকৃষ্ণকে আমরা ফিরিয়ে আনছি, কিন্তু দেখো, আর যেন অভিমান ভরে তাকে দিয়ো না ফিরিয়ে!
সখীদের মুখে রাধার অনুতাপের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান মাধব। সখীদের অনুসরণ করে তিনি আবার ফিরে চলেন শ্রীমতীর কুঞ্জ ভবনে।
তামথ মন্মথখিন্নাং রতিরসভিন্নাং বিষাদসম্পন্নাম্।
অনুচিন্তিত হরিচরিতাং কলহান্তরিতামুবাচ রহঃ সখী॥ ১ ॥
অভিমানে চলে যান শ্রীহরি।
শূন্য কুঞ্জভবনে ধ্যান করে শ্রীমতী,
ধ্যান করে আপনার মনে
প্রেম-আহতা রতি-সুখ-বঞ্চিতা কলহান্তরিতা।
ধ্যান করে তাকেই,
ফিরিয়ে দিল যাকে।
তাই দেখে এক সখী
শ্রীমতীর কাছে এসে বলে ধীরে,…॥ ১ ॥
রামকিরীরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে
হরিরভিসরতি বহতি মৃদুপবনে।
কিমপরমধিকসুখং সখি ভবনে॥
মাধবে মা কুরু মানিনি মানময়ে॥ ২ ॥
তালফলাদপি গুরুমতিসরসম্
কিমু বিফলীকুরুষে কুচকলসম্॥ ৩ ॥
ওগো মানিনি,
কথা রাখ,
বিমুখ করো না মাধবে মিছা অভিমানে।
ধীরে বইছে পবন,
হরি আসছেন অভিসারে,
এর চেয়ে কি সুখ আছে ভবনে?॥ ২ ॥
তালফলের মত গুরুভার
সরস ঐ কুচকলস,
বিফলে কেন যাবে সখি?॥ ৩ ॥
কতি ন কথিতমিদমনুপদমচিরম্।
মা পরিহর হরিমতিশয়রুচিরম্॥ ৪ ॥
কিমিতি বিষীদসি রোদিষি বিকলা
বিহসতি যুবতিসভা তব সকলা॥ ৫ ॥
কতদিন কতবার তোমাকে বলেছি, সখি,
চিরসুন্দর সেই শ্রীহরি,
তাঁকে করো না পরিত্যাগ॥ ৪ ॥
কেন বৃথা দুঃখে আকুল হয়ে
এমন ক’রে কাঁদছো এখন?
চেয়ে দেখ চারিদিকে
যুবতীরা সব লুকিয়ে হাসছে তোমার দশা দেখে॥ ৫ ॥
সজলনলিনীদলশীলিতশয়নে
হরিমবলোকয় সফলয় নয়নে॥ ৬ ॥
জনয়সি মনসি কিমিতি গুরুখেদম্
শৃণু মম বচনমনীহিতভেদম্॥ ৭ ॥
তার চেয়ে, চল যাই,
যেখানে রয়েছেন শ্রীহরি
সজলশতদলের শয্যায় শুয়ে;
দেখে নয়ন হবে সার্থক॥ ৬ ॥
গুরুবেদনায় কেন সখি,
অন্তরকে করছো ব্যথিত?
মন দিয়ে শোন আমার কথা
সব দুঃখ হয়ে যাবে দূর॥ ৭ ॥
হরিরুপযাতু বদতু বহু মধুরম্।
কিমিতি করোষি হৃদয়মতিবিধুরম্॥ ৮ ॥
শ্রীজয়দেবভণিতমতিললিতম্।
সুখয়তু রসিকজনং হরিচরিতম্॥ ৯ ॥
আমি বলছি শোন সখি,
শ্রীহরি আপনি এসে
মধুর বচনে করবেন তোমার দুঃখ দূর।
কেন অকারণে করছো হৃদয়কে
বেদনায় ভারাতুর?॥ ৮ ॥
শ্রীজয়দেব কবির
এই সুমধুর হরিগুণ-গান,
সুখের প্লাবনে দিক্ ভাসিয়ে
রসিকজনের প্রাণ॥ ৯ ॥
স্নিগ্ধে যৎ পরুষাসি যৎ প্রণমতি স্তব্ধাসি যদ্রাগিণি
দ্বেষস্থাসি যদুন্মুখে বিমুখতাং যাতাসি তস্মিন্ প্রিয়ে।
তদ্যুক্তং বিপরীতকারিণি তব শ্রীখণ্ডচর্চ্চা বিষং
শীতাংশুস্তপনো হিমং হুতবহঃ ক্রীড়ামুদো যাতনাঃ॥ ১০ ॥
পরুষ হয়ে যে-নারী প্রিয়ভাষীকে দেয় ফিরিয়ে,
চরণে প্রণতের দিকে চায় না ফিরে,
অনুরক্তের প্রতি হয় বিরক্ত,
বিমুখ হয় তারই প্রতি উন্মুখ হয়ে যে তাকেই চায়,
বিপরীত-রীতি সে-নারীর কাছে
চন্দনের প্রলেপ হবে বিষ-জ্বালা,
চাঁদের কিরণ এনে দেবে সূর্য্যের তাপ,
রতি-রঙ্গ হবে যাতনার ভার,
তাতে আর আশ্চর্য্য হবার কি আছে?॥ ১০ ॥
সান্দ্রানন্দপুরন্দরাদিদিবিষদ্বৃন্দৈরমন্দাদরা-
দানম্রৈর্মুকুটেন্দ্রনীলমণিভিঃ সন্দর্শিতেন্দবরম্।
স্বচ্ছন্দং মকরন্দসুন্দরগলন্মন্দাকিনীমেদুরং
শ্রীগোবিন্দপদারবিন্দমশুভস্কন্দায় বন্দামহে॥ ১১ ॥
আনন্দে যে-চরণে প্রণাম করে
পুরন্দর-আদি দেবতারা,
প্রণত দেবতার মাথার মুকুটের ইন্দ্রনীলমণি
নীলপদ্মে ভ্রমরের মত পায় শোভা যে-চরণে,
বিগলিত-মকরন্দ-সুন্দর মন্দাকিনীর স্বচ্ছন্দ ধারায়
স্নিগ্ধ শীতল যে-চরণ,
বন্দনা করি গোবিন্দের সেই চরণারবিন্দ,
দূর হোক্ নিখিলের নিরানন্দের ভার॥ ১১ ॥