চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/অষ্টম সর্গ

চিত্রে জয়দেব
গীতগোবিন্দ

অষ্টম সর্গ
বিলক্ষ লক্ষ্মীপতি

অষ্টম সর্গ

বিলক্ষ লক্ষ্মীপতী

 সারা রাত কেটে গেল অপেক্ষায়, প্রিয়তমের অপেক্ষায়। এই কৃষ্ণ আসে, এই কৃষ্ণ আসে, এই চিন্তায় সারারাত্রি জেগে থাকতে হয় শ্রীমতীকে। এই ভাবে রাত ভোর হয়ে গেল। গুরুবেদনায় শ্রীমতীর অন্তর থর থর করে কাঁপতে থাকে। অভিমানে তাঁর চোখ সজল হয়ে ওঠে। এমন সময় প্রভাতে অপরাধীর মতন শ্রীকৃষ্ণ ধীরে এলেন শ্রীমতীর কুঞ্জে, মাথা নত করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। শ্রীকৃষ্ণের দিকে চেয়ে শ্রীমতীর রাগ আর অভিমান শতগুণ বেড়ে উঠলো। দেখেন, অন্য নারীর সঙ্গে কামকেলির স্পষ্ট সব নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণের সারা গায়, বেশভূষায়। আলিঙ্গনে, মর্দ্দনে শুকিয়ে গিয়েছে গলার মালা, ঘসে গিয়েছে চোখের কাজল। তাই শ্রীমতী ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, হে কৃষ্ণ, অবলা বধ করবার জন্যেই তুমি জন্মেছ। আজ দেখলাম সেকথা ধ্রুব সত্য। মিনতি আমার, হে নির্লজ্জ, এখান থেকে চলে যাও। এই ভাবে শ্রীমতী যখন ভর্ৎসনা করতে আরম্ভ করেন তখন লক্ষ্মীপতি শ্রীকৃষ্ণ বিলক্ষ হয়ে অর্থাৎ বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকেন শ্রীমতীর দিকে।

অথ কথমপি যামিনী‍ং বিনীয়
স্মরশরজর্জ্জরিতাপি সা প্রভাতে।
অনুনয়বচনং বদন্তমগ্রে
প্রণতমপি প্রিয়মাহ সাভ্যসূয়ম্॥ ১ ॥

কোনমতে বহু বেদনায়
রাধা জেগে অতিবাহিত করেন রাত্রি।
প্রভাতে দেখেন,
কুঞ্জদ্বারে শ্রীকৃষ্ণ, অপরাধীর মত প্রণত,
মুখে অনুনয়-বাণী।
মদনের শরে জ্বলে ওঠে রাধার চিত্ত,
কিন্তু সহসা চোখে পড়ে,
কৃষ্ণের অঙ্গে অন্য নারীর রতিচিহ্ন……
দুরন্ত ঈর্ষ্যায় বলেন শ্রীমতী,…॥ ১ ॥

গীতম্

ভৈরবীরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে

রজনিজনিতগুরুজাগররাগকষায়িতমলসনিমেষম্
বহতি নয়নমনুরাগমিব স্ফুটমুদিতরসাভিনিবেশম্।
হরি হরি যাহি মাধব যাহি কেশব মা বদ কৈতববাদম্
তামনুসর সরসীরুহলোচন যা তব হরতি বিষাদম্॥ ২ ॥

গত রজনীর গুরু জাগরণে
এখনো ঢুলু ঢুল লাল দু’নয়ন,
স্পষ্ট করছে প্রকাশ অন্য রমণীর প্রতি
তোমার প্রেমের নিষ্ঠা।
হরি! হরি! তুমি যাও!
সরে যাও আমার সম্মুখ হ’তে হে মাধব!
মিছে আর বলো না কপট চাটু কথা।
যে পারবে তোমার বিষাদ দূর করতে,
ওগো পদ্মলোচন,
তারি করো অনুসরণ॥ ২ ॥

কজ্জলমলিনবিলোচনচুম্বনবিরচিতনীলিমরূপম্।
দশনবসনমরুণং তব কৃষ্ণ তনোতি তনোরনুরূপম্॥ ৩ ॥

বপুরনুহরতি তব স্মরসঙ্গরখরনখরক্ষতরেখম্।
মরকতশকলকলিতকলধৌতলিপেরিব রতিজয়লেখম্॥ ৪ ॥

হে কৃষ্ণ,
গত রাতে যে-প্রেয়সীর সঙ্গে করেছ বিহার,
তার কাজলমাখা নয়নে বারবার চুম্বনে
অমন যে অরুণ রাঙা তোমার অধর,
তোমার নীল অঙ্গের মত তা হয়ে গিয়েছে নীলিম॥ ৩ ॥

সারা রজনীর প্রেমযুদ্ধে
শ্যামল তোমার অঙ্গে চিহ্নিত হয়ে উঠেছে
সেই বিজয়িনীর খর-নখ-রেখা,
যেন মরকতফলকে সোণার অক্ষরে হয়েছে লেখা
রতিজয়পত্র॥ ৪ ॥

চরণকমলগলদলক্তকসিক্তমিদং তব হৃদয়মুদারম্।
দর্শয়তীব বহির্মদনদ্রুমনবকিশলয়পরিবারম্॥ ৫ ॥

দশনপদং ভবদধরগতং মম জনয়তি চেতসি খেদম্।
কথয়তি কথমধুনাপি ময়া সহ তব বপুরেতদভেদম্॥ ৬ ॥

উদার তোমার বক্ষে
পড়েছে সেই রমণীর চরণ-কমলের
লাল আল্‌তার দাগ,
(যখন তার চরণ বুকে ধরে সেধেছিলে)
মনে হচ্ছে যেন,
বাইরে ফুটে উঠেছে নব কিশলয়
বিকশিত প্রেমতরুর॥ ৫ ॥

তোমার অধরে হায়, এখনো লেগে রয়েছে
সেই রমণীর প্রেম-দংশন-চিহ্ন,
ক্ষোভে জ্বলে উঠছে আমার দেহ-মন।
এখনো কি বলবে তুমি
অভিন্ন নয় তোমার আর আমার দেহ?॥ ৬ ॥

বহিরিব মলিনতরং তব কৃষ্ণ মনোঽপি ভবিষ্যতিনূনম্।
কথমথ বঞ্চয়সে জনমনুগতমসমশরজ্বরদূনম্॥ ৭ ॥

হে কৃষ্ণ,
কৃষ্ণ তোমার দেহ,
তার চেয়ে কৃষ্ণ তোমার মন

নইলে, প্রেমজ্বরে জর্জ্জরিত
চির-অনুগত যে তোমার,
তাকে এমন করে করতে পার বঞ্চনা?॥ ৭ ॥

ভ্রমতি ভবানবলাকবলায় বনেষু কিমত্র বিচিত্রম্।
প্রথয়তি পূতনিকৈব বধূবধনির্দ্দয়বালচরিত্রম্॥ ৮ ॥

শ্রীজয়দেবভণিতরতিবঞ্চিতখণ্ডিতযুবতিবিলাপম্।
শৃণুত সুধামধুরং বিবুধা বিবুধালয়তোঽপি দুরাপম্‌॥ ৯ ॥

আজ আর ভাবতে লাগে না বিস্ময়,
বনে বনে ঘুরে বেড়াও তুমি
অবলা-বধের আনন্দেই।
বালক কাল থেকেই
তুমি করেছ বধূবধের সাধনা,
পূতনা তার প্রমাণ॥ ৮ ॥


ওগো সুধীজন,
ঐ শোন প্রেমবঞ্চিতা খণ্ডিতা-যুবতীর
আর্ত্ত বিলাপ,
সুধার চেয়ে মধুর, স্বর্গ-সুদুর্লভ
সেই সঙ্গীত,
গান করে আজ কবি জয়দেব॥ ৯ ॥

তবেদং পশ্যন্ত্যাঃ প্রসরদনুরাগং বহিরিব
প্রিয়াপাদালক্তস্ফুরিতমরুণচ্ছায়হৃদয়ম্।
মমাদ্য প্রখ্যাতপ্রণয়ভরভঙ্গেন কিতব
ত্বদালোকঃ শোকাদপি কিমপি লজ্জাং জনয়তি॥ ১০ ॥

হে শঠ,
গত রজনী ছিলে যে প্রিয়ার কাছে,
তোমার বক্ষস্থলে আঁকা তার অলক্তক-রাঙা পা
ঘোষণা করছে তোমার অন্তরের গোপন অনুরাগকেই।
তারি জন্যে যে আজ
ভেঙ্গে পড়লো তোমার আমার চিরন্তন ভালবাসা,
মনে করো না তার জন্যে আমি শোক করছি,
তোমার ব্যবহারে শুধু আমি লজ্জিত হয়ে উঠছি॥ ১০ ॥

অন্তর্মোহনমৌলিঘূর্ণনচলন্মন্দারবিস্রংসন-
স্তব্ধাকর্ষণদৃষ্টিহর্ষণমহামন্ত্র কুরঙ্গীদৃশাম্।
দৃপ্যদ্দানবদূয়মানদিবিষদুর্ব্বারদুঃখাপদাং
ভ্রংশঃ কংসরিপোর্ব্যপোহয়তু বঃ শ্রেয়াংসি বংশীরবঃ॥ ১১ ॥

কংসারি শ্রীকৃষ্ণের যে বংশী-ধ্বনি,
মৃগনয়না গোপবধূদের করে সুরমুগ্ধ,
মুগ্ধা-নারীর ঘূর্ণিত শিরে,
এলিয়ে পড়ে কবরী-পাশ,


কবরী থেকে খসে খসে পড়ে মন্দার কুসুম;
সে বংশী-রব সব কাজের মধ্যে
তাদের করে দেয় স্তব্ধ,
ঘর থেকে আকর্ষণ ক’রে নিয়ে আসে বাইরে,

যে বংশী-রব মহামন্ত্রের মতন
তাদের অন্তর করে পরিচালন,
সেই বংশীরব আবার
দেবতাদের বুকে জাগায় হর্ষ,
সেই বংশীরব তাদের দেয় জানিয়ে
উৎপীড়ক দানবদের ধ্বংস,
কবি জয়দেব করেন প্রার্থনা,
সেই বংশীরবে হোক্ নিখিলের কল্যাণ॥ ১১ ॥