চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/সপ্তম সর্গ
চিত্রে জয়দেব
গীতগোবিন্দ
সপ্তম সর্গ
নাগর নারায়ণ
সপ্তম সর্গ
নাগর নারায়ণ
রাত্রি গভীর হয়ে আসে, মাথার উপরে আকাশে স্ফুটতর হয়ে ওঠে বৃন্দাবনের নিশীথচন্দ্র। শ্রীমতী অসহ বিরহ-ব্যথায় কুঞ্জভবনে বসে থাকেন শ্যামের প্রতীক্ষায়। কিন্তু শ্যাম আসে না। শুকিয়ে ওঠে অঙ্গের মৃগমদচন্দন, শুকিয়ে ওঠে গলার মালতীহার। সখী গিয়েছে শ্যামচন্দ্রকে নিয়ে আসবার জন্যে, সামান্য শব্দ হয়, তিনি উচ্চকিত হয়ে ওঠেন, এই বুঝি শ্যামকে নিয়ে সখী ফিরে এলো। সখী ফিরে এলো কিন্তু একা। অশ্রুজলে শ্রীমতী বুঝলেন তাঁর নারায়ণ আজ নাগররূপে অন্য নারীর সঙ্গে করছেন নিশিযাপন। সখীর কাছে কেঁদে ভেঙ্গে পড়েন শ্রীমতী। তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে, অন্য নারীর সঙ্গে প্রেম-রত মাধবের ছবি, নাগর নারায়ণের ছবি। শ্রীমতীর কাতর বিলাপের মধ্য দিয়ে কবি জয়দেব এই সর্গে মাধবের সেই পরনারী-প্রেম-লীলার ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন।
অত্রান্তরে চ কুলটাকুলবর্ত্নপাতসঞ্জাতপাতক ইব স্ফুটলাঞ্ছনশ্রীঃ।
বৃন্দাবনান্তরমদীপয়দংশুজালৈর্দিক্সুন্দরীবদনচন্দনবিন্দুরিন্দুঃ॥ ১ ॥
প্রসরতি শশধরবিম্বে বিহিতবিলম্বে চ মাধবে বিধুরা।
বিরচিতবিবিধবিলাপং সা পরিতাপং চকারোচ্চৈঃ॥ ২ ॥
বৃন্দাবনের আকাশে ফুটে ওঠে চাঁদ,—
দিকবধূর বদনে যেন চন্দনবিন্দু।
কুলটা নারীর গোপন-অভিসারে
আলোর বিঘ্ন ঘটানোর অপরাধে
বুকে তার কলঙ্ক-চিহ্ন॥ ১ ॥
মালবরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে
কথিতসময়েঽপি হরিরহহ ন যযৌ বনম্।
মম বিফলমিদমমলমপি রূপযৌবনম্।
যামি হে কমিহ শরণং সখীজনবচনবঞ্চিতা॥ ৩ ॥
ক্রমশঃ চাঁদ আকাশে স্ফুটতর হয়ে ওঠে,
কিন্তু আসে না মাধব।
বিষাদে শ্রীমতী করেন বিলাপ
বিবিধ আকুল ভঙ্গিমায়॥ ২ ॥
কথিত সময় কখন চলে গেল,
তবু এলো না হরি।
বিফলে চলে যায় এই অমলিন রূপযৌবন!
হায়! সখীরাও করলো আমাকে বঞ্চনা,
এখন আমি কার শরণ নিই?॥ ৩ ॥
যদনুগমনায় নিশি গহনমপি শীলিতম্।
তেন মম হৃদয়মিদমসমশরকীলিতম্॥ ৪ ॥
মম মরণমেব বরমতি বিতথকেতনা
কিমিহ বিষহামি বিরহানলমচেতনা॥ ৫ ॥
হায়, যার জন্যে এই রাত্রি-নিশীথে
আসতে হলো আমাকে গহন বনে,
সেই আমাকে নিষ্ঠুরের মত
বিদ্ধ করলো মদনের শরে॥ ৪ ॥
এখন আমার মরণই ভাল,
অচেতন এই ব্যর্থ দেহে
বিরহানলে দগ্ধ হওয়ায় কি লাভ?॥ ৫ ॥
মামহহ বিধুরয়তি মধুরমধুযামিনী
কাপি হরিমনুভবতি কৃতসুকৃতকামিনী॥ ৬ ॥
অহহ কলয়ামি বলয়াদিমণিভূষণম্।
হরিবিরহদহনবহনেন বহুদূষণম্॥ ৭ ॥
এই মধুর বাসন্তী নিশা
আমাকে করছে যন্ত্রণায় দগ্ধ,
কিন্তু কোন্ সে পুণ্যবতী নারী
এমন মধুযামিনীতে ভাসছে
হরি-মিলনের সুখের আনন্দে॥ ৬ ॥
প্রিয় আসবে বলে
অঙ্গে ধারণ করলাম মণিবলয়ের ভূষণ,
এখন হরিবিরহে
সেই ভূষণ হলো বেদনার বিষ-কণ্টক॥ ৭ ॥
কুসুমসুকুমারতনুমতনুশরলীলয়া
স্রগপি হৃদি হন্তি মামতিবিষমশীলয়া॥ ৮ ॥
অহমিহ নিবসামি ন গণিতবনবেতসা।
স্মরতি মধুসূদনো মামপি ন চেতসা॥ ৯ ॥
হায়,
আমারই বুকের এই ফুলহার,
কুসুম সুকুমার আমার এই অসহায় দেহ
মদন শরের মতন দিচ্ছে যাতনা॥ ৮ ॥
যার জন্যে,
এই গহন বেতসবনে এলাম
সব ভয় তুচ্ছ করে,
সেই মধুসূদনই তাঁর মন থেকে
আমাকে দিলো নির্ব্বাসন॥ ৯ ॥
হরিচরণশরণ জয়দেবকবিভারতী।
বসতু হৃদি যুবতিরিব কোমলকলাবতী॥ ১০ ॥
তৎ কিং কামপি কামিনীমভিসৃতঃ কিম্বা কলাকেলিভি-
র্বদ্ধো বন্ধুভিরন্ধকারিণি বনাভ্যর্ণে কিমুদ্ভ্রাম্যতি।
কান্তঃ ক্লান্তমনা মনাগপি পথি প্রস্থাতুমেবাক্ষমঃ
সঙ্কেতীকৃত মঞ্জুরবঞ্জুললতা কুঞ্জেঽপি যন্নাগতঃ॥ ১১ ॥
হরিচরণে শরণাগত কবি জয়দেব,
তাঁর এই গান,
কোমল কলাবতী নারীর মত
অন্তর জয় করুক ভক্তজনের॥ ১০ ॥
তবে কি হরি আজ
অন্য নারীর অভিসারে করেছেন যাত্রা?
না, বন্ধুরা খেলাচ্ছলে তাঁকে রেখেছেন আটকে?
কিম্বা অন্ধকার বনপথে হারিয়ে ফেলেছেন পথ?
পথশ্রমে অবসন্নদেহ বসে পড়েছেন কোন্ অজানা তরুতলে?
তিনিই দিয়েছিলেন সঙ্কেত, এই বেতসকুঞ্জে হবে দেখা,
কেন এলেন না তিনি?॥ ১১ ॥
অথাগতাং মাধবমন্তরেণ সখীমিয়ং বীক্ষ্য বিষাদমূকাম্।
বিশঙ্কমানা রমিতং কয়াপি জনার্দ্দনং দৃষ্টবদেতদাহ॥ ১২ ॥
(যখন শ্রীমতী এই রকম চিন্তা করছেন)
সেই সময় মাধবের কাছ থেকে ফিরে এলো সখী,
একাকিনী, বিষাদে নির্ব্বাক মুখ।
তাই না দেখে শ্রীমতী চিন্তায় হয়ে উঠলেন ব্যাকুল,
নিশ্চয়ই মাধব তাহলে গিয়েছেন অন্য নায়িকার অভিসারে।
চোখের সামনে ফুটে ওঠে মাধবের মোহনমূর্ত্তি,
শ্রীমতী বিষাদে বলে ওঠেন…॥ ১২ ॥
বসন্তরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে
স্মরসমরোচিতবিরচিতবেশা
গলিতকুসুমদরবিলুলিতকেশা॥
কাপি মধুরিপুণা বিলসতি যুবতিরধিকগুণা॥ ১৩ ॥
হরিপরিরম্ভণবলিতবিকারা
কুচকলসোপরি তরলিতহারা॥ ১৪ ॥
কেশপাশ পড়েছে শিথিল হয়ে,
শিথিল কবরী থেকে খসে পড়ছে
ফুলদল,
প্রেমরণে সুসজ্জিতা আমার ন্যায়
গুণবতী অন্য কোন নারী
মনে হয় আজ মিলিত হয়েছে মাধবের সঙ্গে॥ ১৩ ॥
আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,
শ্রীহরির আলিঙ্গনের পুলকচাঞ্চল্যে
কুচকলসের ওপর দুলে উঠছে
সে-নারীর বক্ষহার॥ ১৪ ॥
বিচলদলকললিতাননচন্দ্রা
অধরপানরভসকৃততন্দ্রা॥ ১৫ ॥
চঞ্চলকুণ্ডলললিতকপোলা
মুখরিতরসনজঘনগতিলোলা॥ ১৬ ॥
দেখছি,
সে-নারীর মুখচন্দ্রে
উড়ে উড়ে এসে পড়ছে চূর্ণ অলক,
শ্রীহরির চুম্বন-সুখে
ঢুলু ঢুলু মুদে আসছে তার আঁখি॥ ১৫ ॥
ললিত কপোলে তার দুলছে মণিকুণ্ডল,
মুখর হয়ে উঠছে মেখলা
ঘন ঘন জঘনের সঞ্চালনে॥ ১৬ ॥
দয়িতবিলোকিতলজ্জিতহসিতা
বহুবিধকূজিত রতিরসরসিতা॥ ১৭ ॥
বিপুলপুলকপৃথুবেপথুভঙ্গা।
শ্বসিত নিমীলিতবিকসদনঙ্গা॥ ১৮ ॥
বাঞ্ছিতকে বুকে পেয়ে
কখনো বা প্রেমলাজে লজ্জিত হয়ে উঠছে সে,
কখনো বা আনন্দে হাসছে,
রতিরসে বিভোর হয়ে
কখনো বা করছে কত না অস্ফুট ধ্বনি॥ ১৭ ॥
কখনও বা সে-নারী
বিপুল পুলকে উঠছে কেঁপে কেঁপে,
কখনও বা ঘন শ্বাস ফেলে,
কখনো বা দুচোখ মেলে প্রকাশ করছে
রতিরঙ্গ॥ ১৮ ॥
শ্রমজলকণভর সুভগশরীরা।
পরিপতিতোরসি রতিরণধীরা॥ ১৯ ॥
শ্রীজয়দেবভণিত হরিরমিতম্।
কলিকলুষং জনয়তু পরিশমিতম্॥ ২০ ॥
আমি দেখছি,
প্রেমকেলিতে ক্লান্ত সেই
সুভগ নারীর দেহ
শ্রমবারিতে হয়েছে সিক্ত,
রতিরণ-নিপুণা সে-নারী
আবেশে লুটিয়ে পড়ছে
শ্রীকৃষ্ণের বক্ষে॥ ১৯ ॥
শ্রীজয়দেব কবির এই হরিপ্রেমলীলা
দূর করুক সর্ব্বজনের কলি-কলুষ-ভার॥ ২০ ॥
বিরহপাণ্ডুমুরারিমুখাম্বুজ-
দ্যুতিরিয়ং তিরয়ন্নপি বেদনাম্।
বিধুরতীব তনোতি মনোভুবঃ
সুহৃদয়ে হৃদয়ে মদনব্যথাম্॥ ২১ ॥
রাত্রি-অবসানের বার্ত্তা নিয়ে
মদনের বন্ধু চন্দ্র যাচ্ছে অস্ত,
অন্তরে কমে আসছে বেদনার ভার;
কিন্তু,
রাত্রি-শেষের এই পাণ্ডুর চাঁদের মুখ
স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে মাধবের ম্লান মুখপদ্ম,
আবার মদনব্যথায় ব্যথিত হয়ে উঠছে অন্তর॥ ২১ ॥
গুর্জ্জরীরাগৈকতালীতালাভ্যাং গীয়তে
সমুদিতমদনে রমণীবদনে চুম্বনবলিতাধরে।
মৃগমদতিলকং লিখতি সপুলকং মৃগমিব রজনীকরে।
রমতে যমুনাপুলিনবনে বিজয়ী মুরারিরধুনা॥ ২২ ॥
ঘনচয়রুচিরে রচয়তি চিকুরে তরলিততরুণাননে।
কুরুবককুসুমং চপলাসুষমং রতিপতিমৃগকাননে॥ ২৩ ॥
যমুনার তীরে কুঞ্জভবনে
প্রেম-বিহার করে বিজয়ী শ্রীহরি।
প্রেম-জাগানিয়া নায়িকার মুখচাঁদে
চুম্বনে বলিত হয়েছে অধর,
শশিকলঙ্কের মতন
তাতে এঁকে দেন মৃগমদচিহ্ন॥ ২২ ॥
ঘন মেঘভারের মত যে নায়িকার কেশদামে
মদন পেয়েছে তার বিহারের বন,
আনন্দে নিজের হাতে মাধব গেঁথে দেন তাতে
কুরুবকফুলের বিদ্যুৎ॥ ২৩ ॥
ঘটয়তি সুঘনে কুচযুগগগনে মৃগমদরুচিরূষিতে।
মণিসরমমলং তারকপটলং নখপদশশিভূষিতে॥ ২৪ ॥
জিতবিসশকলে মৃদুভুজযুগলে করতলনলিনীদলে।
মরকতবলয়ং মধুকরনিচয়ং বিতরতি হিমশীতলে॥ ২৫ ॥
নায়িকার ঘন কুচগগনে
দেখা যায় তাঁর নখরেখার চাঁদ,
সেখানে দুলিয়ে দেন মণিরত্নের হার,
আকাশ ভরে ওঠে যেন তারায়॥ ২৪ ॥
স্নিগ্ধ করতল তার যেন পদ্মশীতল,
ভুজযুগ তার সুগোল মৃণাল,
সেই পদ্মমৃণালে ভ্রমরের দলের মতন
শোভা পায় মরকতনীলা,
যখন শ্রীহরি পরিয়ে দেন স্বর্ণ-বলয়॥ ২৫ ॥
রতিগৃহজঘনে বিপুলাপঘনে মনসিজকনকাসনে
মণিময়রসনং তোরণহসনং বিকিরতি কৃতবাসনে॥ ২৬ ॥
চরণকিশলয়ে কমলানিলয়ে নখমণিগণপূজিতে।
বহিরপবরণং যাবকভরণং জনয়তি হৃদি যোজিতে॥ ২৭ ॥
শ্রীহরি পরিয়ে দিচ্ছেন স্বর্ণকাঞ্চী
নায়িকার সঘন জঘন দেশে,
সে তো জঘন নয়,
সে যেন রতির ঘরে মদনের কনকাসন।
তোরণে মঙ্গলমালার মত
দোলে সে কনককাঞ্চী॥ ২৬ ॥
নখমণিশোভিত সেই সুন্দরীর চরণপদ্ম
বক্ষে ধারণ করেছেন শ্রীহরি,
বক্ষে ধারণ করে
রঞ্জিত করছেন তাকে অলক্তকে॥ ২৭ ॥
রময়তি সুভূশং কামপি সুদৃশং খলহলধরসোদরে।
কিমফলবসং চিরমিহ বিরসং বদ সখি বিটপোদরে॥ ২৮ ॥
ইহ রসভণনে কৃতহরিগুণনে মধুরিপুপদসেবকে।
কলিযুগচরিতং ন বসতু দুরিতং কবিনৃপজয়দেবকে॥ ২৯ ॥
হায় সখি,
হলধরের সোদর সেই খল শ্রীহরি,
যদি অপর নায়িকার সঙ্গেই আনন্দে করেন বিহার,
তবে আর কেন আমি শুষ্কমুখে
বসে থাকি এই বনভবনে?॥ ২৮ ॥
মধুবিনাশন মুরারির চরণসেবক
কবিরাজ জয়দেবের এই হরিগুণগান,
যে করে শ্রবণ,
দূর হয়ে যায় তার কলিযুগ-পাপভার॥ ২৯ ॥
নায়াতঃ সখি নির্দ্দয়ো যদি শঠস্ত্বং দূতি কিং দূয়সে
স্বচ্ছন্দং বহুবল্লভঃ স রমতে কিং তত্র তে দূষণম্।
পশ্যাদ্য প্রিয়সঙ্গমায় দয়িতস্যাকৃষ্যমাণং গুণৈ-
রুৎকণ্ঠার্ত্তিভরাদিব স্ফুটদিদং চেতঃ স্বয়ং যাস্যতি॥ ৩০ ॥
ওগো সখি, ওগো দূতি,
যদি সে-নিষ্ঠুর আমার সঙ্গে শঠতা ক’রে
নাই এলো কুঞ্জভবনে,
তাতে তুমি কেন হচ্ছো কুণ্ঠিত?
আমি জানি সে বহুবল্লভ,
আনন্দে করে বহু নায়িকার সঙ্গে বিহার,
তাতে তোমার কি দোষ বল?
আর দেরী নেই সখি,
দয়িতের গুণে আকৃষ্ট হয়ে
হৃদয় বিদীর্ণ ক’রে
এখুনি চলবে আমার প্রাণ অভিসারে,
অবিচ্ছেদ প্রিয়-মিলনের আশায়॥ ৩০ ॥
দেশবরাড়ীরাগরূপকতালাভ্যাং গীয়তে
অনিলতরল কুবলয়নয়নেন
তপতি ন সা কিশলয়শয়নেন।
সখি যা রমিতা বনমালিনা॥ ৩১ ॥
বিকসিতসরসিজললিতমুখেন।
স্ফুটতি ন সা মনসিজবিশিখেন॥ ৩২ ॥
ওগো সখি,
পবনে চঞ্চল নীলকমলের মত
যার চঞ্চল-নয়ন,
সে চঞ্চল বনমালীর সঙ্গে যে করেছে রমণ,
পল্লবশয্যায় আর তার লাগে না তাপ॥ ৩১ ॥
বিকশিত পদ্মের মত যার মুখ,
সেই মুখ দিয়ে যাকে সে করেছে চুম্বন,
সে-চুম্বিত মুখ
আর হয় না মদনের বাণে বিদ্ধ॥ ৩২ ॥
অমৃতমধুর মৃদুতরবচনেন
জ্বলতি ন সা মলয়জপবনেন॥ ৩৩ ॥
স্থলজলরুহরুচিকরচরণেন
লুঠতি ন সা হিমকরকিরণেন॥ ৩৪ ॥
যে হয়েছে অভিষিক্ত
তার অমৃত-মধুর মৃদুবচনে,
কি আর জ্বালা দেবে তাকে
মলয়-পবন?॥ ৩৩ ॥
স্থলপদ্মের মত তার
শ্রীকর আর চরণ যে করেছে স্পর্শ,
চাঁদের আলোর স্পর্শে
জাগে না আর তার সন্তাপ॥ ৩৪ ॥
সজলজলদসমুদয়রুচিরেণ।
দলতি ন সা হৃদি বিরহভরেণ॥ ৩৫ ॥
কনকনিকষরুচিশুচিবসনেন।
শ্বসিতি ন সা পরিজনহসনেন॥ ৩৬ ॥
সজল মেঘের মত শ্যামল সে,
যাকে একবার করেছে আলিঙ্গন,
বিরহ আর পারে না নতুন ক’রে
দহন করতে তার হৃদয়॥ ৩৫ ॥
সেই পীতবসনে শ্রীহরি
যার সঙ্গে একবার করেছেন বিহার,
প্রিয়জনের পরিহাসে
আর সে ফেলে না দীর্ঘশ্বাস॥ ৩৬॥
সকলভুবনজনবরতরুণেন।
বহতি ন সা রুজমতিকরুণেন॥ ৩৭ ॥
শ্রীজয়দেবভণিতবচনেন।
প্রবিশতু হরিরপি হৃদয়মনেন॥ ৩৮ ॥
নিখিলভুবনে যত আছে তরুণ,
তিনি হলেন তাদের সকলের চেয়ে তরুণ,
সেই চিরতরুণ যার সঙ্গে করেছে রমণ
কেন আর কাঁদবে সে করুণভাবে?॥ ৩৭ ॥
শ্রীজয়দেব গাইলেন
যে রাধাবিরহসঙ্গীত,
সে-সঙ্গীতের সুরে সুরে
অন্তরে প্রবেশ করুন শ্রীহরি॥ ৩৮ ॥
মনোভবানন্দনচন্দনানিল
প্রসীদ রে দক্ষিণ মুঞ্চ বামতাম্।
ক্ষণং জগৎপ্রাণ বিধায় মাধবং
পুরো মম প্রাণহরো ভবিষ্যসি ॥ ৩৯ ॥
মদনের আনন্দ-সখা ওগো বসন্ত-বায়ু,
বৈরিতা ত্যাগ করে একবার তুমি প্রসন্ন হও!
হে জগৎপ্রাণ,
একবার তুমি এনে দাও মাধবকে সম্মুখে আমার,
তারপর তুমি হরণ ক’রে নিও আমার প্রাণ,
কোন দুঃখ নেই তাতে॥ ৩৯ ॥
রিপুরিব সখীসম্বাসোঽয়ং শিখীব হিমানিলো
বিষমিব সুধারশ্মির্যস্মিন্ দুনোতি মনোগতে।
হৃদয়মদয়ে তস্মিন্নেবং পুনর্বলতে বলাৎ
কুবলয়সদৃশাং বামঃ কামো নিকামনিরঙ্কুশঃ॥ ৪০ ॥
যে কৃষ্ণের জন্যে
প্রিয় সখীদের সংসর্গ শত্রুসংসর্গের মত মনে হয়
স্নিগ্ধ বসন্তবায়ুকে মনে হয় আগুনের শিখা,
হায়!
তবু সেই কৃষ্ণের দিকেই ধেয়ে চলে আমার মন।
বুঝলাম,
নারীর প্রেম বুঝি এমনি দুর্বার॥ ৪০ ॥
বাধাং বিধেহি মলয়ানিল পঞ্চবাণ
প্রাণান্ গৃহাণ ন গৃহং পুনরাশ্রয়িষ্যে।
কিন্তে কৃতান্তভগিনি ক্ষময়া তরঙ্গৈ-
রঙ্গানি সিঞ্চ মম শাম্যতু দেহদাহঃ॥ ৪১ ॥
ওগো বসন্তবায়ু,
যত শক্তি তোমার আছে,
ব্যথিত ক’রে তোল আমাকে।
ওগো পঞ্চবাণ,
বিদ্ধ কর এই প্রাণ,
আর ঘরে ফিরে যাব না আমি।
ওগো যমভগিনি,
তুমিই বা কেন ক্ষমা করবে?
তোমার তরঙ্গরঙ্গে ডুবিয়ে দাও আমাকে,
মরণে স্নিগ্ধ হোক্ দেহের জ্বালা॥ ৪১ ॥
প্রাতর্নীলনিচোলমচ্যুতমুরঃ সম্বীতপীতাংশুকং
রাধায়াশ্চকিতং বিলোক্য হসতি স্বৈরং সখীমণ্ডলে।
ব্রীড়াচঞ্চলমঞ্চলং নয়নয়োরাধায় রাধাননে
স্মেরস্মেরমুখোঽয়মস্তু জগদানন্দায় নন্দাত্মজঃ॥ ৪২ ॥
একদিন প্রভাতে,
সহসা সখীরা দেখে,
শ্রীকৃষ্ণের পরিধানে রাধার নীলাম্বর,
আর রাধার বক্ষ ঘিরে শোভা পাচ্ছে কৃষ্ণের পীতাম্বর,
সখীরা আনন্দে ওঠে হেসে,
তাই শুনে শ্রীহরি কটাক্ষ ইঙ্গিত করেন
রাধিকার লাজনতবদনের দিকে চেয়ে।
নন্দনন্দনের সেই গোপন চাহনি
নিখিলের আনন্দ করুক বর্দ্ধন॥ ৪২ ॥