চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/ষষ্ঠ সর্গ
চিত্রে জয়দেব
গীতগোবিন্দ
ষষ্ঠ সর্গ
ধৃষ্টবৈকুণ্ঠ
ষষ্ঠ সর্গ
ধৃষ্টবৈকুণ্ঠ
সখীর মুখে শ্রীকৃষ্ণের বিরহের নিদারুণ অবস্থা শুনেও শ্রীমতী লতাকুঞ্জ ত্যাগ করে অভিসারে বেরুলেন না। অন্তর চাইছে এখনি ছুটে যেতে কিন্তু দুর্জ্জয় অভিমান শৃঙ্খলের মতন পায়ে থাকে জড়িয়ে। অপরাধী নিজে না এলে বুঝি এ অভিমান ভাঙবে না। সখীরা কি করবে ভেবে ঠিক করতে পারে না। রাধাকৃষ্ণের মিলন ছাড়া তাদের যে নেই আর কোন আনন্দ। তাই সখী আবার ফিরে চলে শ্রীকৃষ্ণের কাছে । শ্রীমতীর নিদারুণ অভিমানের কথা ঢেকে শ্রীকৃষ্ণকে বলে, কৃষ্ণ-বিরহে রাধার কি মর্ম্মান্তিক ব্যথা! যদি তাতে চঞ্চল হয়ে ওঠে শ্রীকৃষ্ণের মন-বৈকুণ্ঠ, অপরাধের ভয় ভুলে গিয়ে যদি শ্রীমতীর মান রাখবার জন্যে শ্রীকৃষ্ণ উপযাচক হয়ে আসেন শ্রীমতীর কুঞ্জে। সেই রসই পরিবেশন করেছেন জয়দেব কবি এই সর্গে।
অথ তাং গন্তুমশক্তাং চিরমনুরক্তাং লতাগৃহে দৃষ্ট্বা
তচ্চরিতং গোবিন্দে মনসিজমন্দে সখী প্রাহ॥ ১ ॥
লতাগৃহে লীনা চির-অনুরাগিণী শ্রীমতী তবু হায়,
প্রিয়-অভিসারে পারলেন না যেতে।
তাই দেখে সখী শ্রীমতীর কাছ থেকে
পুনরায় এলো প্রেম-পীড়িত শ্যামের কাছে॥ ১ ॥
গোণ্ডাকিরীরাগেণ রূপকতালেনচ গীয়তে
পশ্যতি দিশি দিশি রহসি ভবন্তম্।
তদধরমধুরমধুনি পিবন্তম্॥
নাথ হরে সীদতি রাধা বাসগৃহে॥ ২ ॥
শ্রীকৃষ্ণের কাছে এসে সখী বলে,
হে নাথ, হে শ্রীহরি,
লতাগৃহে তোমারি জন্যে বিষাদে কাঁদছে শ্রীমতী।
তার মধুর অধরের সুধা তোমারই জন্য,
সেই তোমাকেই আকুলভাবে চারদিকে দেখছে॥ ২ ॥
ত্বদভিসরণরভসেন বলন্তী
পততি পদানি কিয়ন্তি চলন্তী॥ ৩ ॥
বিহিতবিশদবিসকিশলয়বলয়া
জীবতি পরমিহ তব রতিকলয়া॥ ৪ ॥
দেখলাম,
অন্তরের আকুল আগ্রহে
তিনি অভিসারের জন্যে পা বাড়ালেন,
কিন্তু কয়েক পা যেতে না যেতেই
অবশ হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়লেন॥ ৩ ॥
পদ্মের কিশলয় আর পল্লবের বলয় ধারণ করে
তিনি কোনরকমে বেঁচে আছেন
তোমারি প্রেমরতির আশায়॥ ৪ ॥
মুহুরবলোকিতমণ্ডনলীলা
মধুরিপুরহমিতি ভাবনশীলা॥ ৫ ॥
ত্বরিতমুপৈতি ন কথমভিসারম্।
হরিরিতি বদতি সখীমনুবারম্॥ ৬ ॥
নিজের বেশ পরিবর্ত্তন করে,
শ্রীমতী তোমারি মতন করেছেন বেশভূষা
নিজের দিকে চেয়ে মনে মনে ভাবছেন
তিনিই যেন শ্রীকৃষ্ণ॥ ৫ ॥
কেন শ্যাম আসছেন না অভিসারে,
বারে বারে করছেন সখীদের সেই প্রশ্ন॥ ৬ ॥
শ্লিষ্যতি চুম্বতি জলধরকল্পম্।
হরিরুপগত ইতি তিমিরমনল্পম্॥ ৭ ॥
ভবতি বিলম্বিনি বিগলিতলজ্জা
বিলপতি রোদিতি বাসকসজ্জা॥ ৮ ॥
শ্যামদেহ তুমি এসেছ মনে করে
কখন বা মেঘসদৃশ গাঢ় অন্ধকারকেই করছেন
আলিঙ্গন আর চুম্বন॥ ৭ ॥
আবার কখনও বা,
তোমার আগমন বিলম্ব দেখে
বাসকসজ্জায় উঠছেন বিলাপ করে,
কেঁদে উঠছেন সকল লজ্জা ত্যাগ করে॥ ৮ ॥
শ্রীজয়দেবকবেরিদমুদিতম্
রসিকজনং তনুতামতিমুদিতম্॥ ৯ ॥
বিপুলপুলকপালিঃ স্ফীতশীৎকারমন্ত-
র্জনিতজড়িমকাকুব্যাকুলং ব্যাহরন্তী।
তব কিতব বিধায়ামন্দকন্দর্পচিন্তাং
রসজলধিনিমগ্না ধ্যানলগ্না মৃগাক্ষী॥ ১০ ॥
ওহে শঠ,
তোমারই ভাবনায় ব্যাকুল
তোমারই প্রেমসাগরে নিমগ্ন
সেই মৃগনয়না
তোমারি ধ্যানে আছে জীবনধারণ করে।
কখনো উঠছে রোমাঞ্চিত হয়ে, করছে শীৎকার,
কখনো বা মনোবেদনায় উঠছে ব্যাকুল বিলাপ করে॥ ১০ ॥
অঙ্গেষ্বাভরণং করোতি বহুশঃ পত্রেঽপি সঞ্চারিণি
প্রাপ্তং ত্বাং পরিশঙ্কতে বিতনুতে শয্যাং চিরং ধ্যায়তি।
ইত্যাকল্পবিকল্পতল্পরচনাসঙ্কল্পলীলাশত-
ব্যাসক্তাপি বিনা ত্বয়া বরতনুর্নৈষা নিশাং নেষ্যতি ॥ ১১ ॥
তুমি আসছো মনে করে
ত্বরায় অঙ্গে পরছেন অলংকার,
তুমি আসনি দেখে
আবার তখুনি খুলে ফেলছেন সব।
বাতাসে নড়ে উঠছে গাছের পাতা,
মনে হয় যেন তুমি আসছো,
তাড়াতাড়ি তোমার জন্যে করে শয্যা রচনা।
কখনো বা তোমার ধ্যানে হয়ে থাকে স্তব্ধ।
এইভাবে বেশ পরতে আর বেশ খুলতে,
পথ চেয়ে থাকতে থাকতে আর শয্যা রচনা করতে করতে,
তোমার চিন্তায় আর সংকল্পে
অসহ্য হয়ে উঠেছে তার নিশিযাপন॥ ১১ ॥
কিং বিশ্রাম্যসি কৃষ্ণভোগিভবনে ভাণ্ডীরভূমিরুহি
ভ্রাতর্যাহি ন দৃষ্টিগোচরমিতঃ সানন্দনন্দাস্পদম্।
রাধায়া বচনং তদধ্বগমুখান্নন্দান্তিকে গোপতো
গোবিন্দস্য জয়ন্তি সায়মতিথি-প্রাশস্ত্যগর্ভা গিরঃ॥ ১২ ॥
ওহে পথিক, কেন বিশ্রাম করছো
এই কালসর্প-সমাকুল বটতরুমূলে?
ঐ অদূরে রয়েছে দেখ আনন্দময় নন্দ-আলয়,
ঐখানে যাও!
শ্রীরাধার ঐ বচন নন্দগোপের কাছে
পথিক কৌশলে করে গোপন;
তার জন্যে শ্রীকৃষ্ণ পথিককে করেছিলেন যে প্রশংসা,
তাতে নন্দিত হোক্ তোমার হৃদয়, হে পাঠক!॥ ১২ ॥