চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/পঞ্চম সর্গ

চিত্রে জয়দেব
গীতগোবিন্দ

পঞ্চম সর্গ
সাকাঙ্ক্ষ পুণ্ডরীকাক্ষ

পঞ্চম সর্গ

সাকাঙ্ক্ষ পুণ্ডরীকাক্ষ

 এই সর্গে কবি জয়দেব সঙ্গীর মুখ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা শ্রীমতীকে নিবেদন করছেন। সখীর মুখ থেকে শ্রীকৃষ্ণ যখন শুনলেন, তাঁর বিরহে শ্রীমতী মুমূর্ষু হয়ে উঠেছেন, তখনও কিন্তু তিনি নিজে শ্রীমতীর কাছে ছুটে যেতে পারলেন না। অন্যনারী সহবাসের দরুণ তাঁর মনে যে অপরাধ জমে উঠেছিল, তার ভয়ে মাধব শ্রীমতীর সেই নিদারুণ অবস্থা শুনেও যেতে পারলেন না। তিনি সখীকে অনুরোধ করলেন, তাঁর কথা শ্রীমতীকে জানিয়ে, শ্রীমতীকে যেন সখীরা তাঁর কাছে নিয়ে আসে। তাই সখী ফিরে এসে বিরহকাতরা শ্রীমতীকে শ্রীকৃষ্ণের হয়ে মিনতি করছে, শ্রীকৃষ্ণের দূতীরূপে তাঁর অন্তরের আকাঙ্ক্ষা শ্রীমতীকে নিবেদন করছে এবং পরিশেষে আবেদন করছে, যেন তিনি হরি-অভিসারে এখুনি যাত্রা করেন।

অহমিহ নিবসামি যাহি রাধামনুনয় মদ্বচনেন চানয়েথাঃ।
ইতি মধুরিপুণা সখী নিযুক্তা স্বয়মিদমেত্য পুনর্জগাদ রাধাম্॥ ১ ॥

“ওগো সখি,
আমার মিনতি নিয়ে তুমি যাও শ্রীমতীর কাছে,
নিয়ে এসো তাকে এখানে,
আমি রইলাম এখানে তারই অপেক্ষায়।”
মধুরিপু শ্রীকৃষ্ণের এই মিনতি নিয়ে
সখী ফিরে আসে রাধার কাছে,
বলে…॥ ১ ॥

গীতম্

দেশবরাড়ীরাগরূপকতালাভ্যাং গীয়তে

বহতি মলয়সমীরে মদনমুপনিধায়
স্ফুটতি কুসুমনিকরে বিরহিহৃদয়দলনায়।
সখি হে সীদতি তব বিরহে বনমালী॥ ২ ॥

দহতি শিশিরময়ূখে মরণমনুকরোতি।
পততি মদনবিশিখে বিলপতি বিকলতরোঽতি॥ ৩ ॥

ওগো সখী, দেখে এলাম,
বিরহে তোমার ব্যথিত বনমালী।
সেই বিরহকে দ্বিগুণ ক’রে
বইছে দক্ষিণের মলয়ের আগুন,
ফুটে উঠেছে চারিদিকে সুগন্ধ কুসুম
গন্ধে যার উতলা করে বিরহীর মন॥ ২ ॥

দেখলাম,
চাঁদের আলোয় তিনি মৃতপ্রায় পড়ে আছেন,
মদনের বাণে বিকল হয়ে বিলাপ করছেন॥ ৩ ॥

ধ্বনতি মধুপসমূহে শ্রবণমপিদধাতি।
মনসি বলিতবিরহে নিশি নিশি রুজমুপযাতি॥ ৪ ॥

বসতি বিপিনবিতানে ত্যজতি ললিতধাম।
লুঠতি ধরণিশয়নে বহু বিলপতি তব নাম॥ ৫ ॥

চারদিক থেকে ওঠে অলিগুঞ্জন,
সে-গুঞ্জন নিবারণ করতে
দুহাত দিয়ে শ্রবণ করেন আচ্ছাদন।
প্রতিদিবসের শেষে আসে রজনী,
তুমি-হারা আঁধার রজনী,
প্রতি মুহূর্ত্তে তাই ঘনতর হয়ে ওঠে মনোবেদনা॥ ৪ ॥

সুখের আলয় ত্যাগ করে
তোমার জন্যে আজ তিনি হয়েছেন বনবাসী,
মুখে অহরহ শুধু তোমারই নাম,
ধূলায় লুটায়ে করছেন বিলাপ॥ ৫ ॥

ভণতি কবিজয়দেবে হরি বিরহবিলসিতেন
মনসি রভসবিভবে হরিরুদয়তু সুকৃতেন॥ ৬ ॥

পূর্ব্বং যত্র সমং ত্বয়া রতিপতেরাসাদিতাঃ সিদ্ধয়-
স্তস্মিন্নেব নিকুঞ্জমন্মথমহাতীর্থে পুনর্মাধবঃ।
ধ্যায়ংস্ত্বামনিশং জপন্নপি তবৈবালাপমন্ত্রাক্ষরং
ভূয়স্তৎকুচকুম্ভনির্ভরপরীরম্ভামৃতং বাঞ্ছতি॥ ৭ ॥

কবি জয়দেবের ভণিত এই হরিবিরহকথা
তাঁদেরই জন্যে, প্রেমের ঐশ্বর্য্যে মণ্ডিত যাঁদের পুণ্য অন্তর;
প্রার্থনা করি,
সে-অন্তরে জেগে উঠুন স্বয়ং শ্রীহরি॥ ৬ ॥

একদিন যে কুঞ্জভবনে
তোমার সঙ্গে রতিক্রীড়ায় মাধব হয়েছিলেন পূর্ণমনোরথ,
আজ তুমি-শূন্য সেই প্রেমমহাতীর্থে
তেমনি অপেক্ষায় বসে আছেন মাধব,—
এই আশা নিয়ে,
কবে আবার তোমার কুচকুম্ভ-আলিঙ্গনের অমৃত স্বাদ পাবেন।
অনুক্ষণ মনে মনে তাই তোমাকেই করছেন ধ্যান,
মন্ত্রের মতন করছেন জপ তোমারই প্রিয় নাম,
তোমারই আলাপের মধু-বাণী॥ ৭ ॥

গীতম্

গুর্জ্জরীরাগৈকতালীতালভ্যাম্ গীয়তে

রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্
ন কুরু নিতম্বিনি গমনবিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম্॥ ৮ ॥

ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।
পীনপয়োধরপরিসরমর্দ্দনচঞ্চলকরযুগশালী॥ ৯ ॥

ওগো সখি,
মদন-মনোহর-বেশে তোমার হৃদয়েশ্বর
অপরূপ রতিসুখের আশায় বেরিয়েছেন অভিসারে
ওগো নিতম্বিনি, আর বিলম্ব করো না,
এখুনি অনুসরণ কর তোমার প্রিয়তমের॥ ৮ ॥

তোমার পীনপয়োধরকে মর্দ্দনে পীড়িত করবার জন্যে
চঞ্চল হয়ে উঠেছে বনমালীর করযুগল,
ধীরসমীর যমুনার তীরে
তোমারই জন্যে তাই অপেক্ষা করে রয়েছেন বনমালী॥ ৯ ॥

তোমারই নামে বাজে মোর বাঁশী।

নামসমেতং কৃতসঙ্কেতং বাদয়তে মৃদু বেণুম্‌
বহু মনুতে ননু তে তনুসঙ্গতপবনচলিতমপি রেণুম্॥ ১০ ॥

পততি পতত্রে বিচলতি পত্রে শঙ্কিতভবদুপযানম্।
রচয়তি শয়নং সচকিতনয়নং পশ্যতি তব পন্থানম্॥ ১১ ॥

তোমারই নাম নিয়ে মৃদু মৃদু বাজিয়ে চলেছেন
সঙ্কেত বাঁশী;—
তোমার অঙ্গ স্পর্শ ক’রে যে বায়ু বইছে,
সে-বায়ুতে রয়েছে যে ধূলিকণা,
তোমার অঙ্গস্পর্শিত বলে সে ধূলিকণাকে
গায়ে মেখে ধন্য বোধ করছেন॥ ১০ ॥

পাখী উড়ে এসে বসে গাছের ডালে,
সশব্দে নড়ে ওঠে গাছের পাতা,
সেই শব্দে তিনি সচকিত হয়ে ওঠেন
বুঝি বা তুমি এলে,
তাড়াতাড়ি শয্যা রচনা করতে যান,
আকুলভাবে চেয়ে থাকেন পথের দিকে॥ ১১ ॥

মুখরমধীরং ত্যজ মঞ্জীরং রিপুমিব কেলিষু লোলম্‌
চল সখি কুঞ্জং সতিমিরপুঞ্জং শীলয় নীলনিচোলম্॥ ১২ ॥

উরসি মুরারেরুপহিতহারে ঘন ইব তরলবলাকে
তড়িদিব পীতে রতিবিপরীতে রাজসি সুকৃতবিপাকে॥ ১৩ ॥

সখি,
চরণ থেকে খুলে ফেল মুখর নূপুর,
চঞ্চল শব্দে নূপুর বিঘ্ন ঘটায় মিলন-কেলির।
বক্ষে জড়িয়ে নাও নীল নিচোল,
ত্বরায় চল আঁধার কুঞ্জভবনে
যেখানে রয়েছেন শ্যাম তোমারি অপেক্ষায়॥ ১২ ॥

ঘন নীল মেঘে শুভ্র হংসবলাকার মত
শ্যামের নীলবক্ষে বিরাজ করছে শ্বেত গলহার।
ওগো সখি, বহুজন্মের পুণ্যের ফলে সেই শ্যামবক্ষে
বিপরীত-রতির সময়,
তুমি বিরাজ করবে অচঞ্চল বিদ্যুৎ॥ ১৩ ॥

বিগলিতবসনং পরিহৃতরসনং ঘটয় জঘনমপিধানম্
কিশলয়নয়নে পঙ্কজনয়নে নিধিমিব হর্ষনিধানম্॥ ১৪ ॥

ওগো পদ্ম-আঁখি,
কুঞ্জ-ভবনে উপস্থিত হয়ে
যখন তুমি বসন দেবে ফেলে,
কুসুমশয্যায় শুয়ে যখন আবরণহীন
মুক্ত করবে জঘনদেশ,
আবরণ-মুক্ত রত্ন দেখলে যেমন আনন্দিত হয়ে
ওঠে লোক,
তেমনি আনন্দিত হয়ে উঠবেন শ্রীকৃষ্ণ॥ ১৪ ॥

হরিরভিমানী রজনিরিদানীমিয়মপি যাতি বিরামম্‌
কুরু মম বচনং সত্বররচনং পূরয় মধুরিপুকামম্‌॥ ১৫ ॥

শ্রীজয়দেবে কৃতহরিসেবে ভণতি পরমরমণীয়ম্।
প্রমুদিত হৃদয়ং হরিমতি সদয়ং নমত সুকৃতকমনীয়ম্॥ ১৬ ॥

তুমি জান সখি,
কত অভিমানী শ্রীহরি,
তার ওপর রজনীও হয়ে আসছে শেষ।
তাই বলি, কথা রাখ,
ত্বরায় সেখানে গিয়ে পূর্ণ কর শ্যামের বাসনা॥ ১৫ ॥

শ্যামচরণসেবক জয়দেব কবি
গেয়ে চলে এই মধুর হরিকথা;
হে সুধী, হে সজ্জন,
কবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে—
করুন বন্দনা সেই সুকৃতবাঞ্ছিত করুণাময় শ্রীহরির॥ ১৬ ॥

বিকিরতি মুহুঃ শ্বাসানাশাঃ পুরো মুহুরীক্ষ্যতে।
প্রবিশতি মুহুঃ কুঞ্জং গুঞ্জন্মুহুর্বহু তাম্যতি।
রচয়তি মুহুঃ শয্যাৎ পর্য্যাকুলং মুহুরীক্ষতে
মদনকদনক্লান্তঃ কান্তে প্রিয়স্তব বর্ত্ততে॥ ১৭ ॥

ওগো সখি,
আমি দেখে এলাম,
ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে
শ্যামচন্দ্র বারবার চেয়ে দেখছেন সামনের
পথের দিকে।
তোমাকে দেখতে না পেয়ে
 বিষণ্ণমনে আবার প্রবেশ করছেন কুঞ্জভবনে।
সেখানেও তোমাকে দেখতে না পেয়ে
মৃদু আর্ত্তনাদে আবার আসছেন ফিরে।
বারবার ঘুরে এসে করছেন শয্যা রচনা,
কিন্তু হায়, শয্যা যে শূন্য,
তাই ব্যাকুল হয়ে চেয়ে দেখছেন চারিদিকে॥ ১৭ ॥

তদ্বাম্যেন সমং সমগ্রমধুনা তিগ্মাংশুরস্তং গতো
গোবিন্দস্য মনোরথেন চ সমং প্রাপ্তং তমঃ সান্দ্রতাম্।
কোকানাং করুণস্বনেন সদৃশী দীর্ঘা মদভ্যর্থনা
তন্মুগ্ধে বিফলং বিলম্বনমসৌ রম্যোঽভিসারক্ষণঃ॥ ১৮ ॥

হে সখি,
তোমার সঙ্গে শত্রুতা করবার জন্যে সূর্য্য
গিয়েছে অস্তাচলে,
শ্রীকৃষ্ণের অন্তরের মত গাঢ় হয়ে এসেছে অন্ধকার,
চক্রবাকীর মতন করুণস্বরে দীর্ঘকাল ধরে
আমিও করে চলেছি তোমাকে মিনতি,
তাই বলি ওগো মুগ্ধে,
আর বিলম্ব করে ব্যর্থ করো না এই মধুর অভিসার-
লগ্ন॥ ১৮ ॥

আশ্লেষাদনু চুম্বনাদনু নখোলেখাদনু স্বান্তজ-
প্রোদ্বোধাদনু সংভ্রমাদনু রতামম্ভাদনু প্রীতয়োঃ।
অন্যার্থং গতয়োর্ভ্রমান্মিলিতয়োঃ সম্ভাষণৈর্জানতো-
র্দম্পত্যোরিহ কো ন কো ন তমসি ব্রীড়াবিমিশ্রো রসঃ॥ ১৯ ॥

ওগো সখি, আমি যেন দেখছি,
পরস্পর পরস্পরকে খুঁজতে খুঁজতে তোমরা
হয়েছ মিলিত,
প্রিয়-সম্ভাষণে পরস্পর পরস্পরকে চিনলে অন্ধকারে,
তারপর আলিঙ্গনে হলে বদ্ধ,
তারপর চুম্বন, নখাঘাত, কামকেলি…

রতিক্রীড়ার আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো তোমাদের
দেহ-মন…
আমি চোখের সামনে দেখছি,
সেই অন্ধকারে রসতৃপ্ত তোমাদের মুখের
লজ্জা-মাখানো অপূর্ব্ব আনন্দ-শ্রী॥ ১৯ ॥

সভয়চকিতং বিন্যস্যন্তীং দৃশৌ তিমিরে পথি
প্রতিতরু মুহুঃ স্থিত্বা মন্দং পদানি বিতন্বতীম্।
কথমপি রহঃ প্রাপ্তামঙ্গৈরনঙ্গতরঙ্গিভিঃ
সুমুখি সুভগঃ পশ্যন্ ত্বামুপৈতু কৃতার্থতাম্॥ ২০ ॥

ওগো সুমুখি,
এই সন্ধ্যার অন্ধকারে সভয়চকিত দৃষ্টিপাতে
তুমি অগ্রসর হও প্রিয়-মিলনে,
অন্ধকারে কেউ পাবে না তোমাকে দেখতে;
মাঝে মাঝে তরুতলে ক্ষণিক থেমে বিশ্রাম
করে নিও,
তারপর সেই নির্জন কুঞ্জবনে
শ্রীকৃষ্ণ যখন তোমার প্রেমতরঙ্গায়িত তনুর স্পর্শ
পাবেন
আমি জানি সখি,
কৃতার্থতায় ভরে যাবে শ্যামের অন্তর॥ ২০ ॥

রাধামুগ্ধমুখারবিন্দ মধুপস্ত্রৈলোক্যমৌলিস্থলী-
নেপথ্যোচিত-নীলরত্নমবনী-ভারাবতারান্তকঃ।
স্বচ্ছন্দং ব্রজসুন্দরীজন-মনস্তোষ-প্রদোষশ্চিরং
কংসধ্বংসন-ধূমকেতুরবতু ত্বাং দেবকীনন্দনঃ॥ ২১ ॥

শ্রীরাধার মুখপদ্মের মধু পান করে যে মধুকর,
ত্রিলোকের মুকুটস্বরূপ যে বৃন্দাবন ধাম, তার যে
ভূষণস্বরূপ নীলরত্ন,
ধরার ভার লাঘব করবার জন্যে যিনি কৃতান্তের
স্বরূপ,
প্রিয়-মিলনে মধুর প্রদোষের অন্ধকারের মতন
যিনি গোপীজনদের কামনার ধন,
কংসারি সেই দেবকীনন্দন শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করুন
আপনাদের সকলকে॥ ২১ ॥