চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/চতুর্থ সর্গ
চিত্রে জয়দেব
গীতগোবিন্দ
চতুর্থ সর্গ
স্নিগ্ধ মধুসূদন
চতুর্থ সর্গ
স্নিগ্ধ মধুসূদন
এই সর্গে কবি জয়দেব শ্রীকৃষ্ণের দুশ্চিন্তা দূর করে তাঁকে স্নিগ্ধ করেছেন। তাই এই সর্গের নাম স্নিগ্ধ মধুসূদন। অন্য নারীর সঙ্গে প্রেমলীলায় লজ্জিত শ্রীকৃষ্ণ আকুলভাবে শ্রীমতীকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এবং শ্রীমতীর বিরহে আকুল হয়ে উঠছিলেন। মনে মনে তাঁর শঙ্কা ছিল, না জানি শ্রীমতী তাঁর ওপর কতখানি না কুপিত হয়েছেন। এমন সময় শ্রীমতীর এক সখী এসে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করলো এবং সেই সখীর মুখ থেকে শ্রীকৃষ্ণ শুনলেন, রাগ করা তো দূরে থাক, তাঁর অদর্শন-বিরহ সহ্য না করতে পেরে শ্রীমতী সূর্য্যতাপদগ্ধ কোমল কুসুমের মত শুকিয়ে উঠেছেন এবং তাঁরই দর্শনের জন্যে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছেন। এই সংবাদ শুনে ভয়-ভীত শ্রীকৃষ্ণ স্নিগ্ধ হলেন, আশ্বস্ত হলেন।
যমুনাতীরবানীরনিকুঞ্জে মন্দমাস্থিতম্
প্রাহ প্রেমভরোদ্ভ্রান্তং মাধবং রাধিকাসখী॥ ১ ॥
যমুনার তীরে বেতসের বনে
ম্লানবিষণ্ণ মুখে বসে থাকেন
উদ্ভ্রান্ত মাধব।
এমন সময় ধীরে ধীরে তাঁর কাছে এগিয়ে আসে
রাধিকার এক প্রিয়সখী॥ ১ ॥
গীতম্
কর্ণাটরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে
নিন্দতি চন্দনমিন্দুকিরণমনুবিন্দতি খেদমধীরম্।
ব্যালনিলয়মিলনেন গরলমিব কলয়তি মলয়সমীরম্।
সা বিরহে তব দীনা
মাধবমনসিজবিশিখভয়াদিব ভাবনয়া ত্বয়ি লীনা॥ ২ ॥
হে মাধব,
শ্রীমতী আজ তোমার বিরহে দীনা,
পঞ্চশরের বাণের আঘাতের ভয়ে
তোমার ধ্যানেতে নিয়েছে আশ্রয়।
শীতল যে চন্দন, স্নিগ্ধ যে চাঁদের কিরণ
তাও আজ হয়ে উঠেছে অগ্নিজ্বালাময়।
এমন যে দক্ষিণ পবন,
তাও আজ বিষের মতন করছে দহন,
কারণ চন্দনবন ছুঁয়ে আসতে
চন্দনতরু-কোটরের সর্প-বিষ মিশে যাচ্ছে তার অণুতে অণুতে॥ ২ ॥
অবিরলনিপতিতমদনশরাদিব ভবদবনায় বিশালম্।
স্বহৃদয়মর্ম্মণি বর্ম্ম করোতি সজলনলিনীদলজালম্॥ ৩ ॥
কুসুমবিশিখশরতল্পমনল্পবিলাসকলাকমনীয়ম্।
ব্রতমিব তব পরিরম্ভসুখায় করোতি কুসুমশয়নীয়ম্॥ ৪ ॥
রাধার হৃদয় লক্ষ্য ক’রে
অবিরল বর্ষিত হচ্ছে মদনের নিষ্ঠুর বাণ,
শ্রীমতীর আজ ভাবনা তোমারই জন্য,
কেননা সে-অন্তর জুড়ে রয়েছ তুমিই।
তাই সেই বাণের আঘাত থেকে তোমাকে রক্ষা করবার জন্যেই
সজল শ্যামল পদ্মপাতায় দুই বক্ষ ঢেকে
শ্রীমতী নিজের বক্ষকে করেছে তোমার রক্ষা-বর্ম্ম॥ ৩ ॥
তোমার কামকলায় মধুর যে কুসুমশয্যা
শ্রীমতীর কাছে আজ তা হয়েছে শরশয্যা।
একদিন তুমি আবার সেই শূন্য শয্যায় করবে শয়ন
সেই আশায়,
ব্রত-ধারিণীর মত সে-নারী রচনা ক’রে
চলেছে কুসুমশয্যা॥ ৪ ॥
বহতি চ বলিত-বিলোচন-জলধরমাননকমলমুদারম্।
বিধুমিব বিকটবিধুন্তুদদন্তদলনগলিতামৃতধারম্॥ ৫ ॥
বিলিখতি রহসি কুরঙ্গমদেন ভবন্তমসমশরভূতম্।
প্রণমতি মকরমধো বিনিধায় করে চ শরং নবচূতম্॥ ৬ ॥
শ্রীমতীর নয়নে আজ ঘন মেঘভার,
সেই মেঘ গ’লে অবিরল পড়ছে ধারা বদনকমলে।
যেন রাহু আজ বিকট দন্ত-আঘাতে
চূর্ণ করতে চলেছে চন্দ্রমাকে,
চূর্ণিত চন্দ্র থেকে ঝরে পড়ছে অমৃতের ধারা॥ ৫ ॥
নিভৃতে আজ শ্রীমতী
মৃগমদ দিয়ে রচনা করছে তোমার মূর্ত্তি,
মদনের মূর্ত্তিতে দেখছে তোমাকেই—
মূর্ত্তির অধোদেশে এঁকেছে মকর,
হাতে দিয়েছে রসালমুকুলের শর,
আর ঘন ঘন করছে প্রণাম॥ ৬ ॥
প্রতিপদমিদমপি নিগদতি মাধব তব চরণে পতিতাহম্।
ত্বয়ি বিমুখে ময়ি সপদি সুধানিধিরপি তনুতে তনুদাহম্॥ ৭ ॥
ধ্যানলয়েন পুরঃ পরিকল্প্য ভবন্তমতীবদুরাপম্।
বিলপতি হসতি বিষীদতি রোদিতি চঞ্চতি মুঞ্চতি তাপম্॥ ৮ ॥
প্রণাম করে, আর বলে—
হে মাধব, এই নিলাম তোমার চরণ-শরণ,
তুমি যদি হও বিমুখ,
তাহলে সুধার নিধি স্নিগ্ধ চাঁদও
অগ্নি-দহনে করবে আমাকে দগ্ধ॥ ৭ ॥
চিরদুর্লভ তুমি,
তোমাকে আজ ধ্যানে শ্রীমতী পেয়েছে অতি নিকটে,
আঁকা মূর্ত্তিই হয়ে উঠেছে তার কাছে সত্য,
তাই কখনো বিরহ নিবেদন ক’রে
কাঁদছে সেই মূর্ত্তির কাছে,
কাছে রয়েছ জেনে কখনো বা উঠছে হেসে,
যদি চলে যাও, সেই ভয়ে কখনো বা হয়ে উঠছে বিষণ্ণ,
কখনো বা ফিরে এসেছ মনে ক’রে
কল্প-আলিঙ্গনে করছে হৃদয়ের জ্বালা দূর॥ ৮ ॥
শ্রীজয়দেবভণিতমিদমধিকং যদি মনসা নটনীয়ম্।
হরিবিরহাকুলবল্লবযুবতী-সখীবচনং পঠনীয়ম্॥ ৯ ॥
আবাসো বিপিনায়তে প্রিয়সখীমালাপি জালায়তে
তাপোঽপি শ্বসিতেন দাবদাহনজ্বালাকলাপায়তে।
সাপি তদ্বিরহেণ হন্ত হরিণীরূপায়তে হা কথং
কন্দর্পোঽপি যমায়তে বিরচয়ঞ্ছার্দ্দূলবিক্রীড়িতম্ ॥ ১০ ॥
অন্তরে যদি উপভোগ করতে চাও আনন্দরঙ্গ,
তাহলে ওগো পাঠক,
বারবার ক’রে পড়
হরিবিরহ-আকুল এই ব্রজযুবতীর সখীবচন॥ ৯ ॥
হায় মাধব,
বিরহে তোমার,
শ্রীমতীর কাছে ঘর হয়েছে বন,
প্রিয়সখীদের মনে হচ্ছে বাধার জাল,
কন্দর্প যেন বধোদ্যত ব্যাঘ্র,
নিজেকে মনে হচ্ছে অসহায় বন-হরিণী
দাবানলের মধ্যে ব্যাঘ্রতাড়িতা হয়ে
পড়েছে ব্যাধের জালে॥ ১০ ॥
দেশাগরাগৈকতালীতালাভ্যাং গীয়তে
স্তনবিনিহিতমপি হারমুদারম্
সা মনুতে কৃশতনুরিব ভারম্।
রাধিকা তব বিরহে কেশব॥ ১১ ॥
সরসমসৃণমপি ময়লজপঙ্কম্
পশ্যতি বিষমিব বপুষি সশঙ্কম্॥ ১২ ॥
হে কেশব,
বিরহে তোমার রাধার দেহ হয়েছে দুর্ব্বল ক্ষীণ,
স্তনলগ্ন হার বোধ হচ্ছে পাষাণভার॥ ১১ ॥
হে কেশব,
বিরহে তোমার,
অঙ্গে মাখানো যে চন্দন-পঙ্ক
বিষ ব’লে তাকে লাগছে আতঙ্ক॥ ১২ ॥
শ্বসিতপবনমনুপমপরিণাহম্
মদমদহনমিব বহতি সদাহম্॥ ১৩ ॥
দিশি দিশি কিরতি সজলকণজালম্
নয়ননলিনমিব বিদলিতনালম্॥ ১৪ ॥
হে কেশব,
বিরহে তোমার,
শ্রীমতীর দেহ থেকে বিনির্গত হচ্ছে ঘননিঃশ্বাসভার,
যেন মদনের অগ্নিদাহের বাষ্প॥ ১৩ ॥
হে কেশব,
বিরহে তোমার,
ছিন্ন-নাল সজল কমলের মত আশ্রয়-চ্যুতা
শ্রীমতীর সজল আঁখি আজ
ইতি-উতি চারিদিকে তোমাকেই ফিরছে খুঁজে॥ ১৪ ॥
নয়নবিষয়মপি কিশলয়তল্পম্
গণয়তি বিহিতহুতাশবিকল্পম্॥ ১৫ ॥
ত্যজতি ন পাণিতলেন কপোলম্
বালশশিনমিব সায়মলোলম্॥ ১৬ ॥
হে কেশব,
বিরহে তোমার
কচি কিশলয়ে গাঁথা শয্যা,
মনে হচ্ছে যেন প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড॥ ১৫ ॥
হে কেশব,
বিরহে তোমার শ্রীমতী ব’সে আছে
করতলে রেখে কপোল,
যেন সন্ধ্যার ম্লান আকাশে
শিশু প্রতিপদের চাঁদ॥ ১৬ ॥
হরিরিতি হরিরিতি জপতি সকামম্।
বিরহবিহিতমরণেব নিকামম্॥ ১৭ ॥
শ্রীজয়দেবভণিতমিতি গীতম্
সুখয়তু কেশবপদমুপনীতম্॥ ১৮ ॥
হে কেশব,
বিরহে তোমার শ্রীমতী জানে
সুনিশ্চিত তার মৃত্যু।
তাই জন্মান্তরে যাতে
তোমাকেই পায়,
সেই আশায়,
শ্রীমতী দিবানিশি জপ করে চলেছে, হরি, হরি॥ ১৭ ॥
হরিচরণে যারা সমর্পণ করেছে মন,
জয়দেব কবির এই গান
করুক তাদের সুখের বর্দ্ধন॥ ১৮ ॥
সা রোমাঞ্চতি শীৎকরোতি বিলপত্যুৎকম্পতে তাম্যতি
ধ্যায়ত্যুদ্ভ্রাম্যতি প্রমীলতি পতত্যুদ্যাতি মূর্চ্ছত্যপি।
এতাবত্যতনুজ্বরে বরতনুর্জীবেন্ন কিন্তে রসাৎ
স্বর্ব্বৈদ্যপ্রতিম প্রসীদসি যদি ত্যক্তোঽন্যথা হন্তকঃ॥ ১৯ ॥
স্মরাতুরাং দৈবতবৈদ্যহৃদ্য ত্বদঙ্গসঙ্গামৃতমাত্রসাধ্যাম্।
বিমুক্তবাধাং কুরুষে ন রাধামুপেন্দ্রবজ্রাদপি দারুণোঽসি॥ ২০ ॥
প্রেমজ্বরে আজ জরজর রাধার তনু।
কখনো বা উঠছে কেঁপে, কখনও বা বকছে প্রলাপ,
কখনো বা মূর্চ্ছিত হয়ে যাচ্ছে প’ড়ে।
কোন চিকিৎসাতেই সে-রোগের উপশম ঘটছে না।
স্বর্গ-বৈদ্যের মতন একমাত্র তুমি কেশব,
তুমি পার এই রোগের প্রকৃত ঔষধ দিতে।
অন্য আর যা কিছু ঔষধ, যা কিছু চিকিৎসা
সব হয়ে গিয়েছে ব্যর্থ॥ ১৯ ॥
প্রেমজ্বরে মুমূর্ষু শ্রীমতীর একমাত্র ঔষধ হলো
হে মাধব, তোমার অঙ্গের স্পর্শ-সুধা,
আমি জানি তুমি স্বর্গ-বৈদ্যের চেয়ে চিকিৎসায় নিপুণ,
যদি তুমি উপযুক্ত ঔষধ দানে শ্রীমতীকে
না করো রোগমুক্ত
তাহলে বুঝবো, তুমি ইন্দ্রের বজ্রের চেয়েও কঠিন॥ ২০ ॥
কন্দর্পজ্বরসংজ্বরাতুর-তনোরাশ্চর্য্যমস্যাশ্চিরং
চেতশ্চন্দনচন্দ্রমাঃ কমলিনীচিন্তাসু সন্তাম্যতি।
কিন্তু ক্ষান্তিরসেন শীতলতরং ত্বামেকমেব প্রিয়ং
ধ্যায়ন্তী রহসি স্থিতা কথমপি ক্ষীণা ক্ষণং প্রাণিতি॥ ২১ ॥
ক্ষণমপি বিরহঃ পুরা ন সেহে
নয়ননিমীলন-খিন্নয়া যয়া তে।
শ্বসিতি কথমসৌ রসালশাখাং
চিরবিরহেণ বিলোক্য পুষ্পিতাগ্রাম্॥ ২২ ॥
প্রেমজ্বরে-জরজর-দেহ শ্রীমতীর মন আজ খুঁজছে,
শীতল চন্দন, স্নিগ্ধ চাঁদ আর সজল পদ্ম,—
কিন্তু সে-শীতলতায় দূর হচ্ছে না উত্তাপ।
তাই বিরলে ব’সে করছে তোমার ধ্যান,
গুণছে ক্ষণ কখন আসবে তুমি,
সেই আশাই হলো তার শীতলতার সার
তারই জন্যে এখনো যায়নি তার প্রাণ॥ ২১ ॥
একদা যে রাধা
এক নিমেষের তোমার বিচ্ছেদ পারেনি সইতে,
নয়নের পলকপাতে যে হয়ে উঠতো ক্ষুণ্ণ,
আজ তার চোখের সামনে ফুটে উঠছে
মুকুলে মুকুলে রসালশাখা,
আজ কি করে সে সইবে
এই শেষহীন বিরহজ্বালা?॥ ২২ ॥
বৃষ্টিব্যাকুলগোকুলাবনরসাদুদ্ধৃত্য গোবর্দ্ধনং
বিভ্রদ্বল্লব-বল্লভাভিরাধিকানন্দাচ্চিরং চুম্বিতঃ
দর্পেণৈব তদর্পিতাধরতটী-সিন্দূরমুদ্রাঙ্কিতো
বাহুর্গোপতনোস্তনোতু ভবতাং শ্রেয়াংসি কংসদ্বিষঃ॥ ২৩ ॥
বৃষ্টি-ব্যাকুল গোকুলে
যেদিন এসেছিল প্রলয়ের বন্যা,
সেদিন আকুল গোকুলবাসীদের রক্ষার জন্যে
দর্পভরে যে বাহু দিয়ে
শ্রীকৃষ্ণ ধারণ করেছিলেন গিরি-গোবর্দ্ধন,
কৃতজ্ঞতায় গোপীরা যে বাহু চুম্বন করতে গিয়ে
সীমন্তের সিন্দূরে করেছিল অনুরঞ্জিত,
কংসারি কৃষ্ণের সেই বাহু থেকে বর্ষিত হোক্
আপনাদের কল্যাণ,
নিখিলের কল্যাণ॥ ২৩ ॥