চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/তৃতীয় সর্গ
তৃতীয় সর্গ
মুগ্ধ মধুসূদন
তৃতীয় সর্গ
মুগ্ধ মধুসূদন
গোপনারীদের সঙ্গ ত্যাগ করে মাধব চলেছেন শ্রীমতীর সন্ধানে। তিনি জানেন, অভিমান-ভরে শ্রীমতী নিশ্চয়ই কঠিন ব্যথা পাচ্ছেন। কিন্তু কোথায় তাঁকে খুঁজে পাবেন? জগৎ-সংসার যাঁকে খুঁজে বেড়ায়, সেই শ্রীকৃষ্ণ-মাধব আজ উন্মাদ হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন শ্রীমতীকে। জয়দেব কবি এই সর্গে তাই বর্ণনা করছেন রাধার প্রেম-মুগ্ধ শ্রীকৃষ্ণের আকুলতা। কেমন করে, কাকে জানাবেন তিনি, শত-সহস্র গোপনারী-বেষ্টিত হয়ে থাকলেও তাঁর মন পড়ে আছে সেই শ্রীমতীর কাছে। তাই মুগ্ধ মধুসূদন বিস্মিত হয়ে নিজেই বলছেন, আমার অন্তর যে রয়েছে অভিন্ন, তাকে কেন বাইরে অনুসরণ করে পাচ্ছি ব্যথা?
কংসারিরপি সংসার-বাসনাবদ্ধশৃঙ্খলাম্।
রাধামাধায় হৃদয়ে তত্যাজ ব্রজসুন্দরীঃ॥ ১ ॥
ইতস্ততস্তামনুসৃত্য রাধিকামনঙ্গবাণ-ব্রণখিন্নমানসঃ।
কৃতানুতাপঃ স কলিন্দনন্দিনীতটান্তকুঞ্জে বিষসাদ মাধবঃ॥ ২ ॥
যার জন্যে সংসার-বাসনার শৃঙ্খল
আনন্দে পরেছেন কংসারি,
সেই রাধাকে হৃদয়ে ধ্যান করতে করতে
মাধব সহসা ছেড়ে চল্লেন ব্রজসুন্দরীদের সঙ্গ॥ ১ ॥
প্রেম-বাণে বিদ্ধ মাধব
ইতিউতি চারিদিকে খুঁজে বেড়ান
কোথায় গেলেন শ্রীমতী,
ব্যথিতচিত্তে কোথাও না পেয়ে দর্শন
যমুনার তীরে এক কুঞ্জবনে
বিষণ্ণ মনে বসে ভাবেন॥ ২ ॥
গীতম্
গুর্জ্জরীরাগেণ যতিতালেন চ গীয়তে
মামিয়ং চলিতা বিলোক্য বৃতং বধূনিচয়েন।
সাপরাধতয়া ময়াপি ন বারিতাতিভয়েন।
হরি হরি হতাদরতয়া গতা সা কুপিতেব॥ ৩ ॥
কিং করিষ্যতি কিং বদিষ্যতি সা চিরং বিরহেণ
কিং ধনেন জনেন কিং মম জীবিতেন গৃহেণ॥ ৪ ॥
আমাকে গোপবধূরা ঘিরে আছে
দেখে অভিমানে চলে গেলেন শ্রীমতী,
সেই অপরাধে তখন আমি ভয়ে
বলতে পারিনি কোন কথা।
হরি! হরি! অনাদৃতা মনে করে
তিনি চলে গিয়েছেন রাগ ভরে॥ ৩ ॥
দীর্ঘকাল আমার বিরহে,
জানি না তিনি কি করছেন, কি বলছেন
তাঁর অভাবে আমারই বা কি কাজ
ধন জন গৃহে?॥ 8 ॥
চিন্তয়ামি তদাননং কুটিলভ্রু কোপভরেণ
শোণপামিবোপরি ভ্রমতাকুলং ভ্রমরেণ॥ ৫ ॥
তামহং হৃদি সঙ্গতামনিশং ভৃশং রময়ামি।
কিং বনেঽনুসরামি তামিহ কিংবৃথা বিলপামি॥ ৬ ॥
মনে পড়ে তার
আরক্ত মুখমণ্ডল,
কালো ভ্রূ—রাগে হয়ে আছে চঞ্চল—
যেন রক্তপদ্মের ওপর
ঘুরে বেড়াচ্ছে আকুল ভ্রমর॥ ৫ ॥
হায়, অনুক্ষণ হৃদয়ে আমার
আমি তো অনুভব করছি তার প্রিয় সঙ্গ,
তবে কেন বাইরে বনে বনে
বৃথা অনুসরণে মরছি বিলাপ করে?॥ ৬ ॥
তন্বি খিন্নমসূয়য়া হৃদয়ংতবাকলয়ামি।
তন্ন বেদ্মি কুতো গতাসি ন তেন তেঽনুনয়ামি॥ ৭ ॥
দৃশ্যতে পুরতো গতাগতমেব মে বিদধাসি।
কিং পুরেব সসম্ভ্রমং পরিরম্ভণং ন দদাসি॥ ৮ ॥
হায় তন্বি,
আমি জানি কি নিদারুণ ঈর্ষ্যায়
ব্যথিত হয়েছে তোমার মন,
কিন্তু কোথায় তুমি,
কেমন করে তোমার কাছে চাইবো ক্ষমা?॥ ৭ ॥
হায় সখি,
আমি দেখছি,
তুমি যেন আমার সামনে দিয়ে যাতায়াত করছো,
কিন্তু কেন তবুও তুমি আমাকে আলিঙ্গন দান
করছো না?॥ ৮ ॥
ক্ষম্যতামপরং কদাপি তবেদৃশং ন করোমি
দেহি সুন্দরি দর্শনং মম মন্মথেন দুনোমি ॥ ৯ ॥
বর্ণিতং জয়দেবকেন হরেরিদং প্রবণেন
কেন্দুবিল্বসমুদ্রসম্ভবরোহিণীরমণেন॥ ১০ ॥
ওগো সখি,
ক্ষমা কর আমার অপরাধ,
আর কখনো এ অপরাধ করবো না।
দেখ, তোমার বিরহে কাতর বিবশ আমি,
দর্শন দাও আমাকে॥ ৯ ॥
কেন্দুবিল্ব-সায়র থেকে
চাঁদের মতন উঠেছে যে জয়দেব-কবি,
নম্রনত সুরে আজ সে গান করে
মাধবের এই বিরহ-লীলা॥ ১০ ॥
হৃদি বিসলতাহারো নায়ং ভুজঙ্গমনায়কঃ
কুবলয়দলশ্রেণী কণ্ঠে ন সা গরলদ্যুতিঃ।
মলয়জরজো নেদং ভস্ম প্রিয়ারহিতে ময়ি
প্রহর ন হরভ্রান্ত্যানঙ্গ ক্রুধা কিমুধাবসি॥ ১১ ॥
হে কন্দর্প,
বক্ষে আমার দুলছে মৃণাল-হার, ভুজঙ্গ নয়,
কণ্ঠে দেখছো যে নীল দ্যুতি, সে বিষে নীল নয়,
সে হলো নীলকুবলয়-দলের মালা,
অঙ্গে আমার দেখছো যে ভস্ম,
(স ভস্ম নয়, চন্দন-চূর্ণ।
প্রিয়াবিচ্ছেদের যন্ত্রণায় আমি নিশ্চল হয়ে আছি,
তুমি মহাদেব মনে করে অকারণে আমাকে
আঘাত করছো,
অকারণে ক্রোধে আমার দিকে ধাবিত হচ্ছো॥ ১১ ॥
পাণৌ মা কুরু চূতসায়কমমুং মা চাপমারোপয়
ক্রীড়ানির্জ্জিতবিশ্বমূর্চ্ছিতজনাঘাতেন কিং পৌরুষম্।
তস্যা এব মৃগীদৃশো মনসিজপ্রেঙ্খৎকটাক্ষাশুগ-
শ্রেণীজর্জ্জরিতং মনাগপি মনো নাদ্যাপি সংধুক্ষতে॥ ১২ ॥
হে মদন,
আমি জানি,
বসন্তের এই চূতমুকুল হলো
তোমার বাণ,
আমার অনুরোধ,
আমাকে প্রহার করবার জন্যে
সে-বাণ আর হাতে নিয়ো না।
ক্রীড়াচ্ছলে অনায়াসে তুমি বিশ্বকে করেছ জয়,
আমার মতন মূর্চ্ছিত লোককে আঘাত করে
তোমার কি আর পৌরুষ বাড়বে?
তুমি তো জান, সেই মৃগনয়নার দৃষ্টিবাণে
আগে থাকতেই আমার চিত্ত জর্জ্জরিত হয়ে আছে,
আজও সমানে করে রেখেছে আমাকে
ব্যথাচঞ্চল॥ ১২ ॥
ভ্রূপল্লবং ধনুরপাঙ্গতরঙ্গিতানি
বাণা গুণঃ শ্রবণপালিরিতি স্মরেণ।
তস্যামনঙ্গজয়জঙ্গমদেবতায়া-
মস্ত্রাণি নির্জ্জিতজগন্তি কিমর্পিতানি॥ ১৩ ॥
আজ মনে হয়
শ্রীমতী স্বয়ং যেন কাম-বিজয়িনী দেবী—
ভ্রূপল্লব হলো তাঁর ধনু,
কটাক্ষ হলো তাঁর বাণ,
শ্রবণপ্রান্ত যেন ধনুকের গুণ—
হে তন্বি,
তোমার ভ্রূ-ধনুকে যে কটাক্ষ-বাণ যোজনা করেছ
তাতে আমার যাতনার অন্ত নেই,
তোমার মুক্ত কবরী-ভার যেন খড়্গের মতন
আমাকে নিধন করতে উদ্যত হয়েছে,
তোমার রক্তিম বিম্বাধর দেখে
সারা দেহে জেগে উঠছে মোহ,—
শত্রু-নিপাতের পক্ষে সেই তো যথেষ্ট,
তবে কেন তোমার সুগোল কুচযুগল দিয়ে
আবার প্রাণ-সংহারের খেলা খেলছো?॥ ১৩ ॥
তানি স্পর্শসুখানি তে চ তরলাঃ স্নিগ্ধা দৃশোর্বিভ্রমা-
স্তদ্বক্ত্রাম্বুজসৌরভং স চ সুধাস্যন্দী গিরাংবক্রিমা।
সা বিম্বাধরমাধুরীতি বিষয়সঙ্গেঽপি চেন্মানসং
তস্যাং লগ্নসমাধি হন্ত বিরহব্যাধিঃ কথং বর্দ্ধতে॥ ১৪ ॥
শ্রীমতীর ধ্যানে আমি জানি
আমার অন্তর জুড়ে রয়েছেন তিনি,
সেখানে নিত্য আমি অনুভব করছি তাঁর স্পর্শসুখ,
দেখছি তাঁর চপল আঁখির স্নিগ্ধ কটাক্ষ,
নিয়ত পাচ্ছি সৌরভ তাঁর মুখকমলের,
শুনছি তাঁর সুধামাখা বাণী,
গ্রহণ করছি বিম্বাধরের অমৃত প্রসাদ,
তবু কেন অন্তর হচ্ছে না তৃপ্ত?
বিরহ-বেদনা কেন প্রতিমুহূর্ত্তে যাচ্ছে বেড়ে?॥ ১৪ ॥
তির্য্যক্কণ্ঠবিলোলমৌলিতরলোত্তংসস্য বংশোচ্চরদ্-
গীতিস্থানকৃতাবধানললনালক্ষৈর্ন সংলক্ষিতাঃ।
সম্মুগ্ধং মধুসূদনস্য মধুরে রাধামুখেন্দৌ মৃদুস্পন্দং
কন্দলিতাশ্চিরং দধতু বঃ ক্ষেমং কটাক্ষোর্ময়ঃ॥ ১৫ ॥
শ্রীকৃষ্ণের বাঁকা চাউনীতে
উল্লসিত হয়ে ওঠে রাধার কমল-আনন:
সঙ্গে সঙ্গে ঈষৎ বেঁকে যায় তাঁর গ্রীবাদেশ,
তার ফলে দুলে ওঠে চূড়া আর কুণ্ডল।
গোপীরা কিন্তু তখনো একমনে শুনছিল
শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর সুর,
তাই তাদের চোখে ধরা পড়ে না শ্রীকৃষ্ণের সেই অপাঙ্গদৃষ্টি,
কিন্তু কবি জয়দেবের সৌভাগ্য,
সে দেখেছে প্রেমময়ের সেই প্রেমকটাক্ষ,
তাই সে প্রার্থনা করে,
সে মধুর কটাক্ষে জেগে উঠুক নিখিলের কল্যাণ॥ ১৫ ॥