চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় খণ্ড/দ্বিতীয় সর্গ
চিত্রে জয়দেব
দ্বিতীয় সর্গ
অক্লেশ কেশব
দ্বিতীয় সর্গ
অক্লেশ কেশব
এই সর্গে কবি জয়দেব রাধা-কৃষ্ণের বিচিত্র প্রেম-লীলার অন্তর্নিহিত কথাকে রূপ দিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনের গোপবালাদের নিয়ে প্রেম-লীলা করছেন, দূর থেকে বিরহবিধুরা শ্রীমতী সেই দৃশ্য দেখছেন। আজ তাঁর শ্রীহরি অন্য-নারীর সহবাসে মত্ত। শ্রীমতীর জেগে ওঠে শত স্মৃতি, মধুবনে কিভাবে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে নিয়ে করেছেন প্রেম-লীলা। কিন্তু সমস্ত ঈর্ষ্যার ভেতর থেকে শ্রীমতীর মনে জেগে ওঠে প্রেমের পরম আশ্বাস-বাণী, শত-সহস্র নারীর সঙ্গে বিহার করলেও, শ্রীকৃষ্ণ তাঁরি। শ্রীকৃষ্ণও বৃন্দাবনের গোপরমণীদের মধ্যে দেখেন, সেই শ্রীমতীকেই। তাই এই প্রেমে নেই ঈর্ষ্যা, নেই ক্লেশ। শ্রীমতীর অন্তরে কৃষ্ণ করে চলেছেন অনন্ত রাস-লীলা। তবুও বাইরে যে অভিমান আর ঈর্ষ্যার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই, সে হলো রসের প্রয়োজনে। এই অভিমানের রসে রাধা-কৃষ্ণের নিত্য প্রণয়ই অধিকতর মধুর হয়ে ওঠে।
বিহরতি বনে রাধা সাধারণপ্রণয়ে হরৌ-
বিগলিতনিজোৎকর্ষাদীর্য্যাবশেন গতান্যতঃ।
ক্বচিদপি লতাকুঞ্জেগুঞ্জন্মধুব্রতমণ্ডলী-
মুখরশিখরে লীলা দীনাপ্যুবাচ রহঃ সখীম্॥ ১ ॥
সখীর কথা শুনে
শ্রীমতীর মনে জেগে ওঠে ঈর্ষ্যা।
শ্রীমতী দেখেন,
যে-প্রণয়ে তিনি বাঁধা,
সেই প্রণয়ে হরি বেঁধেছেন অপর গোপনারীদের।
তাহলে কোথায় রইলো তাঁর শ্রেষ্ঠতা?
অভিমানে তাই শ্রীমতী সে-কুঞ্জ ছেড়ে
চলে গেলেন আর এক লতাকুঞ্জে,
সেখানে তরু শিরে শিরে
গুঞ্জন করে ফিরে মধুকরের দল।
নিভৃতে পাশে ডেকে নিয়ে এক সখীকে
দীনহীনার মতন কেঁদে বলেন শ্রীমতী॥ ১ ॥
গীতম্
গুর্জ্জরীরাগযতিতালাভ্যাং গীয়তে
সঞ্চরদধরসুধামধুরধ্বনিমুখরিতমোহনবংশম্।
বলিতদৃগঞ্চলচঞ্চলমৌলিকপোলবিলোলবতংসম্॥
রাসে হরিমিহ বিহিতবিলাসম্।
স্মরতি মনো মম কৃতপরিহাসম্॥ ২ ॥
ওগো সখি,
সুধার অধরে যার
বেজে ওঠে মোহন মুরলী,
গোপনারীর দিকে ঘন ঘন কটাক্ষপাতে
দুলে ওঠে যার মাথার মুকুট
কাণের মণিময় কুণ্ডল,
সেই শ্রীহরি আজ আমাকে করেছে ত্যাগ,
তবু আমার মন
পড়ে আছে সেই রাসমঞ্চে
যেখানে দুলেছি শুধু তিনি আর আমি॥ ২ ॥
চন্দ্রকচারুময়ূরশিখণ্ডকমণ্ডলবলয়িতকেশম্
প্রচুরপুরন্দরধনুরনুরঞ্জিতমেদুরমুদিরসুবেশম্॥ ৩ ॥
গোপকদম্বনিতম্ববতীমুখচুম্বনলম্ভিতলোভম্
বন্ধুজীবমধুরাধর-পল্লবমুল্লসিতস্মিতশোভম্॥ ৪ ॥
সখি গো,
শ্যামের কি রূপ!
মাথায় মণ্ডিত ময়ূরপুচ্ছের মুকুট
আধখানা চাঁদের মতন আঁকা,
মনে হয় শ্যাম যেন
ইন্দ্রধনু-আঁকা বর্ষার মেদুর মেঘ॥ ৩ ॥
বিপুলপুলকভুজপল্লববলয়িতবল্লবযুবতিসহশ্রম্
করচরণোরসি মণিগণভূষণকিরণবিভিন্নতমিস্রম্॥ ৫ ॥
পুলকে বিপুল তাঁর ভুজপল্লবে
আজ বাঁধা পড়েছে সহস্র বল্লব যুবতী,
করেতে কঙ্কণ, চরণে নূপুর,—
মেখলায় মণিহার
আলিঙ্গনের ছন্দে উঠে দুলে,
ঠিকরে পড়ে আলো, রতন-ভূষণের আলো;
সে-আলোয় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়—
কুঞ্জের আঁধার॥ ৫ ॥
জলদপটলবলদিন্দুবিনিন্দকচন্দনতিলকললাটম্
পীনপয়োধরপরিসরমর্দ্দননির্দ্দয়হৃদয়কবাটম্॥ ৬ ॥
মণিময়করমনোহরকুণ্ডলমণ্ডিতগণ্ডমুদারম্
পীতবসনমনুগতমুনিমনুজসুরবরপরিবারম্॥ ৭ ॥
ললাটে যাঁর চন্দন-তিলক
লজ্জা দেয় মেঘে-ঢাকা চন্দ্রকে,
হৃদয় তাঁর মমতা-বিহীন
পীনপয়োধর-পীড়নে॥ ৬ ॥
মকর-মনোহর মণিময় কুণ্ডল
দোলে যাঁর সুন্দর কপোলে,
অপরূপ তাঁর পীতবসনের শোভায়
বাঁধা পড়েছে সুর, নর, মুনি-
কন্যাদেরও হৃদয়॥ ৭ ॥
বিশদকদম্বতলে মিলিতং কলিকলুষভয়ংশময়ন্তম্
মামপি কিমপি তরঙ্গদনঙ্গদৃশা মনসা রময়ন্তম্॥ ৮ ॥
শ্রীজয়দেবভণিতমতিসুন্দর-মোহন-মধুরিপুরূপম্
হরিচরণস্মরণং প্রতি সংপ্রতিপুণ্যবতামনুরূপম্॥ ৯ ॥
গীতম্
মালবরাগৈকতালী তালাভ্যাং গীয়তে
নিভৃতনিকুঞ্জগৃহং গতয়া নিশি রহসি নিলীয় বসন্তম্
চকিতবিলোকিতসকলদিশা রতিরভসরসেন হসন্তম্।
সখি হে কেশিমথনমুদারম্
রময় ময়া সহ মদনমনোরথভাবিতয়া সবিকারম্॥ ১০ ॥
ওগো সখি,
আমার কামনা যার অন্তরে তোলে কামনার ঢেউ,
সেই কেশীমথন আমার প্রিয়,
তার সঙ্গে ত্বরায় আমাকে করো মিলিত,—
আমি যখন রজনীতে নিভৃতে আসি কুঞ্জবনে
প্রিয় আমার রঙ্গছলে থাকে লুকিয়ে,
চকিতনয়নে ইতিউতি যখন চাই চারিদিকে
মধুর হাসিতে প্রিয় দেয় তখন ধরা॥ ১০ ॥
প্রথমসমাগমলজ্জিতয়া পটুচাটুশতৈরনুকূলম্।
মৃদুমধুরস্মিতভাষিতয়া শিথিলীকৃতজঘনদুকূলম্॥ ১১ ॥
কিশলয়শয়ননিবেশিতয়া চিরমুরসি মমৈব শয়ানম্
কৃতপরিরম্ভণ-চুম্বনয়া পরিরভ্য কৃতাধরপানম্॥ ১২ ॥
মনে পড়ে সখি,
প্রথম-মিলন-লজ্জায় যখন থাকি অধোমুখ,
কতশত চাটু বচনে কেমন করে
আমাকে দেয় ভুলিয়ে,
তারপর কখন কথা কইতে কইতে
মৃদু হেসে শিথিল করে দেয় আমার জঘন-বসন॥ ১১ ॥
কিশলয়-শয়নে যখন থাকি শুয়ে,
প্রিয় আমার শয্যা রচনা করে আমারই বক্ষে,
দুই বাহুপাশে বেঁধে যখন করি চুম্বন
চুম্বনে প্রিয় আমার দেয় প্রত্যুত্তর॥ ১২ ॥
অলসনিমীলিতলোচনয়া পুলকাবলিললিতকপোলম্
শ্রমজলসকলকলেবরয়া বরমদনমদাদতিলোলম্॥ ১৩ ॥
কোকিলকলরবকূজিতয়া জিতমনসিজ-তন্ত্রবিচারম্।
শ্লথকুসুমাকুলকুন্তলয়া নখলিখিতঘনস্তনভারম্॥ ১৪ ॥
প্রেমলালসে যখন আঁখি আমার আসে মুদে,
প্রেমপুলকিত হয়ে ওঠে প্রিয়ের গণ্ড,
আমার অঙ্গের শ্রম-জলধারা দেখে
জ্বলে ওঠে দ্বিগুণ মদনানল প্রিয়ের অন্তরে॥ ১৩ ॥
রতিকালে যখন আমি কূজন করে উঠি
প্রেমশাস্ত্র-পণ্ডিত প্রিয় আমার ভুলে যায় তখন
কামকেলির পৌর্ব্বাপর্য্য,
আলুলায়িত কেশপাশ থেকে যখন শিথিল হয়ে
ঝরে পড়ে কুসুম,
অধীর প্রিয় আমার ঘন স্তনভারে মুদ্রিত করে
দেয় নখরেখা॥ ১৪ ॥
চরণরণিতমণিনূপুরয়া পরিপূরিতসুরতবিতানম্।
মুখরবিশৃঙ্খলমেখলয়া সকচগ্রহচুম্বনদানম্॥ ১৫ ॥
রতিসুখসময়-রসালসয়া দরমুকুলিতনয়নসরোজম্
নিঃসহনিপতিততনুলতয়া মধুসূদনমুদিতমনোজম্ ॥ ১৬ ॥
আমার চরণের মণিময় নূপুর
যখন বেজে ওঠে রুণু ঝুনু,
সম্পূর্ণ হয় তখন প্রিয়তমের সুরতবিতান—
বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে যখন মুখর মেখলা
কেশ আকর্ষণ করে প্রিয় আমার করে চুম্বন ॥ ১৫ ॥
রতিসুখ-আবেশে
যখন শিথিল হয়ে আসে তনু,
তখন জেগে ওঠে প্রিয়তমের আঁখিমুকুল—
এলিয়ে যখন পড়ে দেহলতা
নতুন করে তখন জেগে ওঠে প্রেমের দেবতা
আমার মাধবের মনে॥ ১৬ ॥
শ্রীজয়দেবভণিতমিদমতিশয়মধুরিপুনিধুবনশীলম্।
সুখমুৎকণ্ঠিতগোপবধূকথিতং বিতনোতুধুসলীলম্॥ ১৭ ॥
হস্তস্রস্তবিলাসবংশমনৃজু-ভ্রূবল্লিমদ্বল্লবী-
বৃন্দোৎসারি-দৃগন্তবীক্ষিতমতিস্বেদার্দ্রগণ্ডস্থলম্।
মামুদ্বীক্ষ্য বিলক্ষিতস্মিতসুধামুগ্ধাননং কাননে
গোবিন্দং ব্রজসুন্দরীগণবৃতং পশ্যামি হৃষ্যামি চ॥ ১৮ ॥
উৎকণ্ঠিতা গোপবধূর কণ্ঠে
মধু-রিপুর এই বিলাস-আবেশ-গীতি
যা বর্ণনা করলেন জয়দেব কবি,
ভক্তদের হৃদয়ে তা বিস্তার করুক
অনায়াস সুখের সুমধুর লীলা॥ ১৭ ॥
আমি জানি সখি,
যতই কেন গোপবধূরা প্রেমকটাক্ষে
বিদ্ধ করুক মাধবকে,
মাধবের আঁখি আছে আমাতে বাঁধা
আমার দর্শনে
আপনা হতে স্বেদসিক্ত হয়ে ওঠে তাঁর কপোল,—
হাত থেকে খসে পড়ে বিলাস-বংশী,
মুগ্ধ হাসিতে ভরে ওঠে মুখ,
শত-গোপিনী-বেষ্টিত সেই আমারই মাধব,
আমি আনন্দিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছি তারি দিকে॥ ১৮ ॥
দুরালোকঃ স্তোকস্তবক-নবকাশোকলতিকা-
বিকাশঃ কাসারোপবনপবনোঽপি ব্যথয়তি।
অপি ভ্রাম্যদ্ভৃঙ্গীরণিতরমণীয়া ন মুকুল-
প্রসূতিশ্চূতানাং সখি শিখরিণীয়ং সুখয়তি॥ ১৯ ॥
অশোকের লতা আজ
আধ-বিকশিত হয়ে ওঠে তরুণ পাতায়,
ভাল লাগে না সখি—
ভাল লাগে না এই কানন-জাগানো
মন্দমধুর পবন,
রসাল মুকুলে গুঞ্জন করে ফিরে
চিরচঞ্চল ভ্রমরের দল,
ভাল লাগে না আজ সে মধু-গুঞ্জন॥ ১৯ ॥
সাকূতস্মিতমাকুলাকুলগলদ্ধর্ম্মিল্লমুল্লাসিত-
ভ্রূবল্লীকমলীকদর্শিতভুজামুলার্দ্ধদৃষ্টস্তনম্।
গোপীনাং নিভৃতং নিরীক্ষ্য গমিতাকাঙ্ক্ষশ্চিরং চিন্তয়-
ন্নন্তর্মুগ্ধমনোহরং হরতু বঃ ক্লেশং নবঃ কেশবঃ॥ ২০ ॥
যতই কেন গোপীরা
হাসিতে হোক্ উচ্ছল,
যতই কেন প্রেমকটাক্ষে
তারা হোক্ উল্লসিত,
শিথিল কেশপাশ বাঁধবার ছলে ঊর্দ্ধে তুলে বাহু
যতই কেন তারা দেখাক না অর্দ্ধ-প্রকাশিত স্তনমূল,
আমি জানি সখি,
মাধবের অন্তরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছে
এই প্রেমবিধুরা রাধা,
সেই আমার মনোহর নব-কেশব
দূর করুক নিখিলের ক্লেশভার॥ ২০ ॥