চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চার

 অচিরেই তাদের মনোবাঞ্ছা সফল হলো। জগন্নাথদেবের আশীর্ব্বাদে ব্রাহ্মণের স্ত্রী গর্ভবর্তী হলো এবং যথাকালে ব্রাহ্মণের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করলো, পুত্র নয়, এক অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী কন্যা। কন্যার রূপ দেখে ব্রাহ্মণ-দম্পতীর মন আনন্দে ভরে উঠলো। ব্রাহ্মণ কন্যার নাম রাখলো পদ্মাবতী।

 শৈশব থেকেই পদ্মাবতী বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় দিতে লাগলো। কেউ তাকে শিখায় নি, অথচ শিশু সঙ্গীত শুনলেই আপনা থেকে নাচতে আরম্ভ করে। এবং তার নৃত্য-ভঙ্গিমা দেখে গুণীরা পর্য্যন্ত অবাক হয়ে যান। যে-গান, যে-সুর বালিকা একবার মাত্র শোনে, অবিকল সেই সুর তৎক্ষণাৎ বালিকার কণ্ঠ থেকে নির্গত হয়। এতটুকু ভুল হয় না, এতটুকু সুরের হেরফের হয় না। কোথা থেকে বালিকা পেলো এই সুর-জ্ঞান? কোন্ জন্মান্তরের সুশিক্ষা আজও চলেছে বালিকাকে অনুসরণ করে?

 পদ্মাবতীর পিতা উপযুক্ত শিক্ষক রেখে কন্যাকে সঙ্গীত ও নৃত্যবিদ্যা শিক্ষা দেন। শৈশব থেকে পদ্মাবতী ক্রমে কৈশোরে পদার্পণ করে। কিশোরী পদ্মাবতীর তনুদেহে কোথা থেকে আবির্ভূত হয় বিস্ময়কর এক দেহ-বিপর্য্যয়। কাল যে ছিল শিশু, আজ তার দেহ লাবণ্য আর রূপ-রেখায় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিপুণ চিত্রকরের আঁকা ছবির মতন পদ্মাবতীর রূপ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আপনাতে আপনি বিভোর হয়ে পদ্মাবতী যখন নাচতো, তখন মনে হতো স্বর্গ থেকে যেন দেবকন্যা আকাশ-চ্যুত হয়ে মর্ত্ত্যে এসেছে। সেই অপরূপ কন্যার দিকে চেয়ে চেয়ে ব্রাহ্মণ-দম্পতীর অন্তর আনন্দে ভ’রে উঠতো। যেদিন ব্রাহ্মণ নিঃসন্তান ছিল, সেদিন সন্তান-কামনায় জগন্নাথদেবের কাছে যে-শপথ করেছিল, আজ আর সে-শপথের কথা ব্রাহ্মণের মনেই পড়ে না। সেই অনন্যা কন্যাকে ছেড়ে থাকবার কথা ব্রাহ্মণ-দম্পতী কল্পনাও করতে পারে না।  একদিন হঠাৎ ব্রাহ্মণের দ্বারে এক সাধু এসে উপস্থিত হলেন। সাধু ভিক্ষা চাইলেন। পিতার ইঙ্গিতে পদ্মাবতী ভিক্ষাপাত্রে ভিক্ষা নিয়ে এলো। পদ্মাবতীকে দেখে সাধু হেসে উঠলেন। সে-হাসির অর্থ বুঝতে না পেরে ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করলো, হাসলেন যে?

 পদ্মাবতী ভিক্ষা দিয়ে বাড়ীর ভিতর চলে গেলে সাধু জিজ্ঞাসা করলেন, এ মেয়েটি কে?

 ব্রাহ্মণ সগর্ব্বে বলে, আমারই মেয়ে!

 সাধু এবার অট্টহাস্য করে উঠলেন, বল্লেন, তোমার মেয়ে?

 ব্রাহ্মণ বিরক্ত হয়ে বল্লো, হাঁ, আমারই মেয়ে, তাতে আপনার প্রশ্ন করবার কি আছে?

 এবার সাধু গম্ভীর কণ্ঠে বল্লেন, মেয়ের অঙ্গে যে চিহ্ন দেখলাম, তাতে আমার স্থির বিশ্বাস, এ কন্যা দেবতার! দেবতার নৈবেদ্য! দেবতার নৈবেদ্যে মানুষের তো অধিকার নেই!

 সহসা বিদ্যুৎ-ঝিলিকে অতীতের এক বিস্মৃত-প্রায় দিনের স্মৃতি জেগে ওঠে ব্রাহ্মণের বুকে। জগন্নাথদেবের মন্দির-চত্বরে সন্তান-আশায় পড়ে আছে স্বামী-স্ত্রী দুজনে দেবতার চরণ ধরে। মনে পড়ে ভুলে-যাওয়া সেই শপথের কথা, যদি কন্যা হয়, তাহলে তোমার দাসী করে তাকে পাঠিয়ে দেবো তোমার মন্দিরে!

 সাধুর কথায় নিমেষে ব্রাহ্মণের অন্তরে ঘটে যায় বিপুল এক বিপর্য্যয়। পাংশু হয়ে আসে ব্রাহ্মণের মুখ। কম্পিতকণ্ঠে ব্রাহ্মণ বলে, হে সন্ন্যাসী, তোমার দৃষ্টি ভুল দেখে নি। এই কন্যা জন্মাবার আগে, আমি শপথ করেছিলাম, কন্যাকে দেবদাসীরূপে জগন্নাথমন্দিরে সমর্পণ করবো!

 স্মিতহাস্যে সাধু বলেন, সে-শপথ রক্ষা কর আজ! দেবতার যা প্রাপ্য, মানুষের লোভে ঘটিয়ো না তার অন্তরায়!

 বেদনায় আর্ত্তনাদ করে ওঠে ব্রাহ্মণ। বলে, সন্ন্যাসী, তুমি কি বুঝবে অন্ধ পিতৃ-স্নেহের কি জ্বালা? বেশ ছিলাম, ভুলেছিলাম শপথ, কেন তুমি মনে করিয়ে দিতে এলে সাধু?

 তেমনি হেসে সাধু বলেন, আমি না এলেও, শপথের কথা তোমাকে মনে করতেই হতো। দেবতা নিজেই তোমাকে আর কোন উপায়ে স্মরণ করিয়ে দিতেন। ভগবানের নামে উৎসর্গীকৃত যাদের জীবন, তাদের জীবন দিয়ে ভগবান তাঁর নিজের কাজ করিয়ে নেন্। তুমি ভাগ্যবান, এমন কন্যার জনক হয়েছ। আমি স্পষ্ট দেখছি, তোমার এই কন্যা কোন মহৎ দৈবকার্য্য সম্পন্ন করবার জন্যেই জন্মগ্রহণ করেছে। তাকে তোমার স্নেহের পাঁচিল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারবে না ব্রাহ্মণ!

 ব্রাহ্মণ পাথরের মতন নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। সাধু যেমন এসেছিলেন, আবার তেমনি চলে যান।