চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পাঁচ

 ব্রাহ্মণ যতই শপথের কথা ভাবে, ততই বিকল হয়ে ওঠে। দেখতে দেখতে তার আনন্দের স্বর্গলোক কি এক অজানা বিষাদে ম্লান বিবর্ণ হয়ে এলো। অষ্টপ্রহর সেই এক দুশ্চিন্তা ব্রাহ্মণকে ক্ষিপ্তপ্রায় করে তুল্লো।

 পিতার সেই ভাবান্তর দেখে পদ্মাবতী পিতাকে আরো নিবিড় স্নেহে বাঁধতে চেষ্টা করে। পিতা যত মুখভার করে থাকে, পদ্মাবতী ততই হাস্যে, নৃত্যে, সঙ্গীতে, আদরে, আলাপে পিতাকে সারাক্ষণ বেষ্টন করে থাকে। পদ্মাবতী স্নেহে যতই উদ্বেল হয়ে ওঠে, ব্রাহ্মণের অন্তরের বেদনা ততই নিবিড়তর হয়ে উঠতে থাকে। এ কন্যাকে কি করে দেবদাসীর জীবনে নির্ব্বাসিত করা যায়? ব্রাহ্মণ কাতরস্বরে প্রার্থনা করে, হায় জগন্নাথদেব, তুমি কি এতই নির্ম্মম?

 ক্রমশঃ ব্রাহ্মণ নিজের অন্তরে বলসঞ্চয় করে। স্থির করে, শপথের কথা আর সে ভাববে না। আবার পূর্ব্বেকার মতন সহজ স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। পদ্মাবতীও পিতাকে আনন্দিত দেখে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, তার স্নেহে পিতার অন্তরের বিষাদ সে দূর করতে পেরেছে। আবার নৃত্যে সঙ্গীতে মুখর হয়ে ওঠে ব্রাহ্মণের গৃহাঙ্গন।

 কিন্তু দেবতা যাকে চায়, মানুষের সাধ্য কি তাকে ধরে রাখে? দেবতার কাজে যার প্রয়োজন, কোন মাতাপিতার স্নেহ তাকে পারে না আটক করে রাখতে।

 সহসা একদিন পদ্মাবতী শয্যাশায়ী হলো। নাচতে নাচতে তার সর্ব্বাঙ্গ ভারী আর অবশ হয়ে উঠলো। অচৈতন্যের মতন সে পড়ে গেল। ব্রাহ্মণ-দম্পতী তৎক্ষণাৎ বৈদ্যকে ডেকে পাঠালো।

 বৈদ্য এসে পরীক্ষা করে দেখেন, নাড়ী একান্ত চঞ্চল, অস্বাভাবিক দেহের উত্তাপ। পদ্মাবতীর মুখে কোন কথা নেই। জ্বরে বেহুঁস।

 বৈদ্য ওষুধের পর ওষুধ দেন। প্রলেপের পর প্রলেপ। কোন কিছুতেই কোন ফল হয় না। শিয়রে জেগে বসে থাকে মাতা আর পিতা।

 হঠাৎ পদ্মাবতী সেই অর্দ্ধ-অচৈতন্য অবস্থার ভেতর থেকে চীৎকার করে ওঠে, যাই, যাই প্রভু!

 ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণীর দু’চোখ দিয়ে অশ্রু-ধারা গড়িয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণের ধারণা, কন্যার অন্তিম মুহূর্ত্ত সমুপস্থিত। সস্নেহে জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাবি মা?

 পদ্মাবতী বলে, প্রভুর কাছে! জগন্নাথ প্রভুর কাছে! তিনি আমাকে ডাকছেন!

 ব্রাহ্মণ বুঝতে পারে। এতদিন আত্ম-প্রবঞ্চনা করে যে-সত্যকে ঢেকে রেখেছিল, নির্ম্মম আঘাতে আজ দেবতা সে আত্মপ্রতারণার আবরণকে ছিন্ন করে দিতে উদ্যত হয়েছেন। অমোঘ দেবতার বিধান। ব্রাহ্মণ মনে মনে বলে, হে প্রভু, হে জগন্নাথ, তোমারি ইচ্ছা সফল হোক্‌! আমি আর আমার স্নেহে তোমার নৈবেদ্য থেকে তোমাকে করবো না বঞ্চিত!

 বিস্ময়ের ব্যাপার, রাত-প্রভাত না হতেই পদ্মাবতী শয্যা থেকে উঠে বসে, যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলো। বিগত দিনের জ্বরের কোন চিহ্ন পর্য্যন্ত নেই দেহমনে।

 বৃদ্ধ বৈদ্য রোগী দেখতে এসে পরমোল্লাসে ঘোষণা করেন, তাঁর ওষুধ অব্যর্থ, স্বয়ং ধন্বন্তরির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তিনি করতে পারেন!

 ব্রাহ্মণ নীরবে শুধু উপলব্ধি করে, কোন্ মহাবৈদ্যের চিকিৎসায় ঘটলো এই অঘটন।

 ব্রাহ্মণ সাশ্রু-নেত্রে সমস্ত কথা পদ্মাবতীকে জানায়, তার জন্মাবার আগে কিভাবে শপথ করে তাকে জগন্নাথদেবের চরণে সমর্পণ করা হয়েছিল।

 নীরবে পদ্মাবতী সে-কাহিনী শোনে। তার অন্তরে যেন সুদূর কোন্ জন্মান্তর থেকে জেগে উঠতে থাকে বিচিত্র সব আহ্বান। এক নতুন আলোকে সে নিজেকে যেন নতুন করে দেখে।

 বেদনাহত পিতাকে আশ্বস্ত করে বলে, এর জন্যে দুঃখ করছেন কেন বাবা? মেয়ে তো চিরকাল বাপের বাড়ী থাকেনা। দেবতার মন্দিরে আমি দেবদাসী হব, এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কি আছে? দেবতা আমাকে চায়, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য!

 তারপর একদিন শুভলগ্ন দেখে ব্রাহ্মণ-দম্পতী পদ্মাবতীকে সঙ্গে নিয়ে পুরীধামে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে আবার উপস্থিত হলো। যথারীতি কন্যাকে জগন্নাথদেবের পায়ে সমর্পণ করে রেখে এলো।

 পদ্মাবতী জগন্নাথদেবের মন্দিরে দেবদাসী রূপে জগৎ-নাথের পূজারতি করে। প্রতি রাত্রিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে, পুষ্পে মাল্যে বরতনুকে ভূষিত করে, নৃত্যে নৃত্যে নিজেকে দেবতার পায়ে করে সমর্পণ। তার সর্ব্ব-অঙ্গে বেজে ওঠে দেবতার আনন্দ-রতি।

 ব্রাহ্মণ-দম্পতী কন্যাহীন ঘরে ফিরে না গিয়ে প্রত্যহ সেই মন্দিরের চারদিকেই ঘুরে বেড়ায়। প্রতি সন্ধ্যায় সাধারণ দর্শকদের মতনই মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে থেকে দেখে, মন্দিরের ভিতর কন্যা আরতি-নৃত্যে বিশ্বনাথকে বন্দনা করছে।

 কয়েক দিন পরেই ব্রাহ্মণ আবার স্বপ্ন দেখলো। স্বপ্নে জগন্নাথদেব আবির্ভূত হয়ে বললেন, ব্রাহ্মণ, তোমার সত্য-রক্ষায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমার কন্যা সাধারণ মেয়ে নয়। স্বয়ং লক্ষ্মীর অংশে তার জন্ম। এক মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই তার জন্ম হয়েছে। তোমার কন্যার জন্যেই অপেক্ষা করে আছে কেন্দুবিল্ব গ্রামে এক ব্রাহ্মণ-কুমার, জয়দেব গোস্বামী তার নাম। সেই তোমার কন্যার স্বামী। তারই কাছে নিয়ে যাও তোমার কন্যাকে।

 সেই স্বপ্ন থেকে মহানন্দে জেগে ওঠে ব্রাহ্মণ। তৎক্ষণাৎ মন্দিরের প্রধান পাণ্ডার কাছে গিয়ে রাত্রির স্বপ্নের কথা বলে। প্রধান পাণ্ডাও স্বপ্নে অনুরূপ নির্দ্দেশ পেয়েছিলেন। পদ্মাবতীকে সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্মণ কেন্দুবিল্ব গ্রামের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো।